তাহসানের গানছাড়াছাড়ির ঘোষণা ও অন্যান্য || তুহিন কান্তি দাস

তাহসানের গানছাড়াছাড়ির ঘোষণা ও অন্যান্য || তুহিন কান্তি দাস

শেয়ার করুন:

শিল্পী তাহসান বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি গান ছাড়ছেন না৷ যেমনটা ঘাঁটাঘাঁটি করে বুঝলাম একটা নির্দিষ্ট ট্যুরের সেই স্পটে সেটাই লাস্ট কন্সার্ট এমনটাই তিনি বোঝাতে চেয়েছেন। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে গান ছাড়ার ঘোষণা এক ভিন্ন আপোসের বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে৷ সে-অনুযায়ী সবাই প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ যতদূর জানলাম এই শিল্পী বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়াতেও নাই।

সময়টা ভালো না। একটা অদ্ভুত চাপা আতঙ্ক। একটা অচেনা ঘোর ধোঁয়াশা চারপাশে৷ মাজারে হামলা হচ্ছে সমানে৷ মসজিদ মন্দিরে উগ্রবাদীদের বর্বরতা স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। আক্রান্ত হচ্ছে বাউল-ফকির সাধকরা৷ কবর থেকে উঠিয়ে নুরাল পাগলার ওপর পৈশাচিক উপদ্রব। যে-মাজারগুলো এই জনপদে সুরের চর্চায় এবং ধর্মপ্রচারের অন্যতম বাহক। মবের উন্মত্ততা, দিনেদুপুরে ছিনতাই, শৃঙ্খলাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা সব মিলে উচ্ছৃঙ্খল জনপদ।

বাংলার চিরচেনা সাংস্কৃতিক চর্চা কেমন প্রাণহীন-নির্জীব নিস্তব্ধ কবরের মতো মুখ লুকিয়ে আত্মরক্ষার কৌশল নিয়েছে যেন৷ মাটির সংস্কৃতিচর্চাকে যে-কেউ যে-কোনো সময় ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্য ট্যাগ দিয়ে ফ্যাসিবাদের দায় চাপিয়ে আক্রমণের শঙ্কা নিশ্চয়ই অযৌক্তিক না অন্তত এই সময়ে।

এর ভেতরে এক মৌলবাদী গোষ্ঠী যারা বিগত সরকারের আমলে তাদের ছায়াতলে ছিল তারা এখন গানবাজনা নিয়ে যা-তা বলছে৷ গানের শিক্ষক নিয়োগ বাদ দিয়ে ধর্মীয় শিক্ষক দেওয়ার আব্দার জানিয়েছে৷ মানে গানবাজনা চলবে না ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশে এমন আজগুবি প্রস্তাবনা৷ এমন সময় বাংলাদেশের একজন সেলিব্রেটি আর্টিস্ট তাহসানের একটা ফটোকার্ড সামনে আসলো৷ গান ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে এই জনপ্রিয় আর্টিস্ট৷

যদিও তার ঘোষণা অনেকটা হাস্যরসে ভরপুর তথাপি এই সময়ে এমন ঘোষণা মুহূর্তের মাঝে বারুদের মতো ছড়িয়ে গেছে৷ আবার কিছু ভুল তথ্যও ছড়ানো হচ্ছে যাদের শিল্পসংস্কৃতি নিয়া কোনো কাম নাই তারাও কায়দা করে কিছু লাইক শেয়ার কামাইতেসে৷ ঘর পোড়ার মাঝে আলুপোড়া খাওয়া মানুষের তো আর অভাব নাই৷ তবে জেনে নেয়া ভালো, বিদেশের সেই কন্সার্টে কী বলেছিলেন, কেন বলছিলেন তাহসান গান ছেড়ে দেওয়ার কথা৷

গত ৬ সেপ্টেম্বর অ্যাডিলেডে প্রথম কনসার্টের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ‘তাহসান অ্যান্ড দ্য ব্যান্ড’-এর অস্ট্রেলিয়া সফর। এরপর ৭ সেপ্টেম্বর ব্রিসবেন, ১৩ সেপ্টেম্বর সিডনি ও ২০ সেপ্টেম্বর মেলবোর্নে গান পরিবেশন করেন তিনি। ২৭ সেপ্টেম্বর পার্থে হওয়ার কথা এই সফরের শেষ কন্সার্টটি। কিন্তু মেলবোর্নের কন্সার্টে গান শুরু করার আগে ভক্তদের তাক লাগিয়ে দেন তাহসান। তিনি বলেন, ‘অনেক জায়গায় লেখালেখি হচ্ছে যে, এটা আমার লাস্ট কন্সার্ট। আসলে লাস্ট কন্সার্ট নয়, লাস্ট ট্যুর। আস্তে আস্তে মিউজিক ক্যারিয়ারটার হয়তো ইতি টানব।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতেও দেখা যায়, স্টেজে দাঁড়িয়ে ভক্তদের উদ্দেশে তাহসান বলছেন, ‘এটা ন্যাচারাল। সারাজীবন কি এভাবে মঞ্চে দাঁড়িয়ে লাফালাফি করা যায়! মেয়ে বড় হয়ে যাচ্ছে, এখন যদি মঞ্চে দাঁড়িয়ে গাই “দূরে তুমি দাঁড়িয়ে”, দেখতে কেমন লাগে।’

একজন শিল্পী কখন গান গাইবেন আর কখন অবসরের ঘোষণা দেবেন সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়৷ একটা সময়ের পর গলার সেই ধার থাকে না। ফলে ধার থাকতেই অনেকে অবসরের ঘোষণা দেন আবার কেউ কেউ ছাড়তে বাধ্য হন শ্রোতারা আগ্রহ হারানোর কারণে৷ তবে তাহসান সম্ভবত মজা করেই কথাটা বলেছেন সেই কন্সার্টে৷ তার একটা লজিক্যাল গ্রাউন্ডও আছে৷ এর আগেও অভিনয় ছাড়ার সময় এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি। সেই মজার ছলে তিনি যা বলসেন তা এই সময়ে দিচ্ছে ভিন্ন বার্তা৷ যখন গান করাটাই একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে সমাজে আবির্ভূত হয়েছে৷ সেই চ্যালেঞ্জের সময় এভাবে অবসরের ঘোষণা যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে তাতে মানুষ হতাশ হয়েছে৷ আশাহত হয়েছে অনেকেই যাঁরা এই শিল্পীর গান শুনেনও না কিন্তু এই সময়ে শিল্পের দায় থেকেই করছেন সমালোচনা৷

অনেকটা কাপুরুষের মতো শিল্পসংস্কৃতি ছেড়ে পালানোর শামিল বলে যে-যার মতো প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন৷ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না, তাহসানের সমালোচনার জন্য তার সমমর্যাদার শিল্পীই হইতে হবে৷ কিংবা সে কী মানের শিল্পী সেটা একান্ত তার ব্যক্তিগত বিষয়৷ জনপ্রিয়তার মানদণ্ড দিয়া শিল্প মাপা কিংবা না মাপা উভয় ক্ষেত্রেই যুক্তি পাল্টাযুক্তি আছে৷ তবে এই সমালোচনার যোগ্য মানুষ তিনি সেটা বলতে দ্বিধা নেই৷ আমার ধারণা দেশ-জাতির সঙ্কটে শিল্পীদের নির্জীব হয়ে যাওয়ার দীর্ঘ লালিত ক্ষোভ থেকেই মানুষ এই সমালোচনা করছে৷ এর দায় যে সেলিব্রেটি শিল্পী হিসাবে তাহসানের ওপর বর্তায় না তাও অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই৷ যত বড় আর্টিস্টই হোক শ্রোতা তাঁর কাছে দেবতা সমতূল্য। শিল্পী তাহসান গান ছাড়তেই পারেন, তবে এই সময়ে হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে নিজের মেয়ের কথা বলায় সবাই উগরে দিচ্ছেন নিজের ভেতরের সমস্ত রাগ-ক্ষোভ৷ তবে তাঁর মূল বক্তব্যটা একটু আলাদা বলেই মনে হয়েছে। যেমনটা মানুষ ধরে নিয়েছে তার থেকে একটু ভিন্ন ছিল৷

যদিও বর্তমান সময়ে প্রতিষ্ঠিত বা সফল মানুষ মাত্রই ভণ্ড এমন এক আধুনিক ন্যারেটিভ প্রচলিত রয়েছে সমাজে৷ কেউ কেউ এই ন্যারেটিভেও ভাসছেন৷ ফলে প্রতিষ্ঠিত মানেই ধান্দাবাজ এই ন্যারেটিভ ভয়ঙ্কর কেননা শিল্পীর স্ট্রাগলকে উড়িয়ে দেওয়া হয় এইভাবে৷

আমি নিজেও আহত হয়ে একটা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। তবে সম্ভবত তাহসান চলমান ট্যুরেই আরেকটা কন্সার্ট করছেন। এখন পর্যন্ত শিল্পীর পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয় নাই তবে কণ্ঠজনিত জটিলতাকেই তিনি মিন করেছেন৷ মেয়ের কথাটা হয়তো বলার জন্যই বলসেন যা দেখা যাচ্ছে ভিডিওক্লিপে৷ কিন্তু একজন প্রকৃত আর্টিস্টের সময় এবং বাস্তবতার কথাও মাথায় রাখতে হয়৷ মাথায় রাখতে হয়, এই কথা বলার পর কী প্রতিক্রিয়া দেবে শ্রোতা কিংবা সাধারণ পাবলিক৷ এই বিবেচনায় একটা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়াও জরুরি। কেননা ভুল মেসেজ দ্বারা সবাই প্রভাবিত হচ্ছে এই বিবৃতির অনুপস্থিতিতে।

তুহিন কান্তি দাস ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫


গানপারে তুহিন কান্তি দাস
গানপারে তাহসান খান

গানপার
শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you