লোককবি তাজউদ্দিন একজন স্বশিক্ষিত ও স্বভাব কবি। জন্ম ১৯৭১ সালে সিলেটের কোম্পানিগঞ্জের খাগাইল গ্রামে। তাঁর বাবার নাম আবদুল মছব্বির ও মায়ের নাম নূরুন্নেছা বেগম। ছেলেবেলায় দুরন্ত স্বভাবের তাজউদ্দিনকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলেও স্কুলের নিয়ম-কানুন, বাধ্যবাধকতা ও শিক্ষার পদ্ধতি তাঁর ভালো লাগেনি। কয়েকদিন পাঠশালায় গেলেও পরে আর প্রতিষ্ঠানমুখী হননি। তাজউদ্দিন এখনো প্রতিষ্ঠানবিরোধী; তিনি মনে করেন বাংলাদেশের স্কুল ও কলেজ ভালো মানুষ তৈরি করতে পারেনি। আর স্কুল-কলেজে পড়াশোনা না করেও ভালোমানুষ হওয়া সম্ভব। কথোপকথনেও তিনি বলেছেন,—
‘অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা না করতে পারায় আমার কোনো আক্ষেপও নাই। মানুষের মুনষ্যত্ববোধ যদি জাগ্রত না হয়, মূল্যবোধের বিকাশ যদি না হয় তবে এ-পড়ালেখার দরকার কী? আমি তো চোখ খুললেই দেখি কথিত লেখাপড়া করনেওয়ালা লোকই বেশি সমাজের ক্ষতি করছে। আমি এমন পড়ালেখা চাই না। আমি এমন শিক্ষা চাই যে-শিক্ষা মানুষকে প্রকৃত অর্থে মানুষ হিসাবে গড়বে। সেটা স্কুল-কলেজে গিয়ে হোক আর না গিয়ে হোক। কেউ যদি স্কুল কলেজে না-গিয়েও এসব গুণ অর্জন করতে পারি আমি তাঁকেও প্রকৃত মানুষ বলি।’
কৈশোর থেকেই তাজউদ্দিনের গানের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল, তিনি রাতের বেলা বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন গানের আসরে সামিলও হতেন। তখন আশির দশক; অডিও ক্যাসেটে গানশোনার জয় জয়কার; রেডিওতেও পল্লিগান, বাউলগান, মারিফতি গান, ভাটিয়ালি, জারি, সারি ইত্যাদি রোজ বাজত; আর কানের কাছে টেপ-রেডিও নিয়ে তিনি গানে মশগুল থাকতেন। তখন থেকে তাজউদ্দিনের ইচ্ছে গান লিখবেন, গান গাইবেন; কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি সংসারের অভাবে কারণে। বাপের সঙ্গে কৃষিকাজে যোগ দেন একসময়। কিন্তু মনের ভিতরে সারাক্ষণ রাধারমণ, শাহ আবদুল করিম, দুর্বিন শাহ, আমির উদ্দিন প্রমুখ মহাজনের সুর ও বাণী কাজ করত। শরিয়তি, মারিফতি, বাউল ও বৈষ্ণব ভাবনা মাথায় গিজগিজ করত।
মাঝে মাঝে তাজউদ্দিন বুঝতে পারতেন তাঁর মনে নানা ভাব কাজ করে, যা তিনি প্রকাশ করতে চান গানের ভাষায়। তা হতেও থাকে একসময়; লিখতে তো পারেন না, তাই মুখে মুখে গান বেঁধে বন্ধুদের শোনান। বন্ধুরাও তাঁকে উৎসাহ দেন, তারপর মনে হলো এগুলো লিখে রাখা দরকার। এমন ভাবনা থেকে গান রচনা করে প্রথমে মুখস্থ করে নিতেন, পরে সুবিধামতো কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিতেন। লেখার মতো বন্ধুও তেমন আশেপাশে থাকত না তাঁর। কুড়িয়ে পাওয়া কাগজে, এর-ওর খাতায় এভাবে গান লিখে রাখা হয় দীর্ঘদিন; ফলে সংরক্ষণের অভাবে এসব হারিয়েও যায় কালে। এরপর তাজউদ্দিন মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসে চলে যান। দীর্ঘদিন মধ্যপ্রাচ্যে থাকলেও দেশ থেকে ক্যাসেট নিয়ে যেতেন, অন্যরাও নিয়ে যেত; তাই গানের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়নি। গানই মরুভূমির জীবনে একমাত্র সঙ্গী হিসেবে কাজ করত। খেজুরবীথির নিচে তিনি বসে থাকতেন, আর মনে সুখে গান গাইতেন। বাড়ির কথা, দেশের কথা মনে হতো, আর গানে গানে সব ভুলে থাকতে চাইতেন। মনে মনে গান বাঁধতেন সেখানে।
একসময় প্রবাস থেকে ফিরেন তাজউদ্দিন, বিয়েসাদি করেন। একে একে ছয় কন্যাসন্তানের পিতাও হলেন। জীবন সম্পর্কে আরও পরিপক্ক হন তিনি; জগৎ, বিশ্বপ্রকৃতি, স্রষ্টা ও মানুষের সম্পর্ক তাঁকে ক্রমাগত ভাবিয়ে তোলে। যত দিন যায় তত্ত্বজ্ঞানে আকৃষ্ট হতে থাকেন তত বেশি। কথায় কথায় তাঁর জীবনভাবনা এভাবে ফুটে ওঠে,—
‘জীবন হলো ভালো-মন্দ পরিমাপের উপলব্ধি। যাঁরা ভালো মন্দ বিচার করে পথ দেখাতে পারে তারাই সার্থক হয়। সার্থকতা তো এমনি এমনি আসে না। একেকটি জীবনের পূর্ণ অধ্যায় সমাপন হলেই বোঝা যায় জীবনের সাফল্য অথবা ব্যর্থতা। জীবনের বৈশিষ্ট্য এমনি যে, সে যে কোনো পথে মানুষকে নিয়ে যেতে পারে-হোক সেটা ভালো না হয় মন্দ। অবশ্য মানুষ নিজের জীবনকে নিজেই চাইলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গড়ে নিতে পারে। আবার মানুষের জীবনের পূর্ণতার সবটুকু মানুষের হাতেও নয়। কখনো কখনো মানুষকে কর্মের জন্য, ফল লাভের জন্য থামতে হয়। মাবুদের কাছে যেমন চাইতে হয়, একই সঙ্গে পরিশ্রমই জীবনকে বদলে দিতে পারে।’
এরকম নানা উপলব্ধি তাঁর গানের কথায়ও রূপায়িত হতে থাকে। ছোটোবেলা থেকে তাজউদ্দিন অন্যায় দেখতে পারতেন না, মানুষে মানুষে প্রভেদও তাঁকে কষ্ট দিত। সামাজিক অনাচার, দুর্নীতি, ভন্ডামি, অনিয়ম তাঁকে ক্ষত-বিক্ষত করত; বিশেষ করে ধর্মাবতার ও গণ্যমান্য মানুষের ভন্ডামী ও দুর্নীতি দেখলে। একসময় প্রেম ও আধ্যাত্মিক ভাবের সঙ্গে এসবও তাঁর গানের বিষয় হয়ে ওঠে। প্রতিবাদী ভাষায় তিনি গান রচনা করতে থাকেন। এসকল গানে তাঁর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে সচেতন করে তোলা। আবার প্রেমভাব ও আধ্যাত্মিক গান লিখে মানুষকে নরোম ও স্রষ্টার প্রতি আশিক বানানোই তাঁর অভিপ্রায় হিসেবে কাজ করে। মেয়েরা বড়ো হতে থাকলে তাজউদ্দিন গান রচনা করে মেয়েদের দিয়ে খাতায় লেখাতেন, এভাবে তাঁর গান জমতে থাকে। পরে আবার অনেক খাতাও হারিয়ে যায়। এ নিয়ে তাঁর খেদ মনে—
‘এভাবে আমার অনেক গান নষ্ট হয়ে গেছে। ছেঁড়া কাগজে অনেক গান লিখিয়েছি, অনেক কাগজ হারিয়ে গিয়েছে নানাভাবে। তাই আমার রচিত বিভিন্ন সময়ের অনেক গানও এভাবে হারিয়ে গিয়েছে। এভাবে নষ্ট হওয়া গানের সংখ্যা অনেক। আমার গানগুলো লিপিবদ্ধ নাই। কেউ যদি লিপিবদ্ধ করে রাখত, আর আমি দেখে যেতে পারতাম, তাহলে আমার ভালো লাগত। আনন্দ পাইতাম। মনে হতো জীবনে কিছুই পারিনি, অন্তত একটা কাজ করলাম কয়েকটা গান রচনা করে।’
বয়সের তাজউদ্দিন এখন পৌঢ়ত্বে পৌঁছেছেন। সমাজে এখন অনেকে তাঁকে মান্য করে তার স্পষ্টবাদিতা ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য। এখনও কৃষিকাজ করেন, কৃষিফার্ম করেন। কাজের ফাঁকে স্থানীয় বাজারে মানুষের সঙ্গে সময় কাটান, গল্প করেন, চা খান। মাঝে মাঝে গ্রাম-গ্রামান্তরে সালিশে যান। ন্যায়ের পক্ষে কথা বলেন। অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকেন। সময় পেলে, মনে ভাবনা এলে মুখে মুখে গান বাঁধেন; আর বাড়ি ফিরে মেয়েদের লিখে রাখতে বলেন। এভাবে তাঁর গান জমতে থাকে, খাতায় খাতায়; খোলা পৃষ্ঠায়।
২
তাজউদ্দিনের অনেক গান নষ্ট হয়ে গেছে; অনেক আবার হারিয়েও গেছে। তবে যেসব গান সংগ্রহে আছে তা থেকে তাঁর গানের ভাব, ভাষা, বক্তব্য-বিষয় সম্পর্কে একটা ধারণা করা যায়। দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন ভাবের গান তিনি লিখেছেন, এসবের মধ্যে সৃষ্টিতত্ত্ব, আল্লাহ ও নবীর মহিমা, পির-মুর্শিদ মহিমা, গুরুর বন্দনা, পিতা-মাতার বন্দনা, দেহতত্ত্ব, ফকিরি, শরিয়তি, মারিফতি, বাউল-বৈষ্ণবতত্ত্ব, প্রেম ও বিচ্ছেদ, আধ্যাত্মভাব, ভক্তিবাদ এবং সমাজসচেতনতামূলক গান প্রধান। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এসব গান সাহিত্যগুণ সম্পন্ন; ভাষাব্যবহারে দক্ষতা, উপমা-রূপক ব্যবহারে মুনশিয়ানা সত্যি অবাক করার মতো। তত্ত্বমূলক গানগুলো পাঠ করলে নিতান্ত বিস্মিত হতে হয়। জীবনবোধের গভীরতা, চিন্তার প্রখরতা ও বিদগ্ধগুণে তাজউদ্দিনের গানগুলো বাংলা লোকগানের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
প্রথমেই তাজউদ্দিনের সৃষ্টিতত্ত্ব ও আল্লা-স্মরণমূলক গানগুলোর কথা বলা যাক। জগতের সৃষ্টির ব্যাপারে ইসলামে যে-তত্ত্ব আছে তাজউদ্দিনের গানেও তা দেখা যায়। আল্লাহকে তিনি জগতের স্রষ্টা ও সর্বশক্তিমান বলে মানেন এবং আল্লাহর সান্নধ্যলাভই তাঁর জীবনের একমাত্র চাওয়া বলে তিনি দাবি করেন। তাজউদ্দিনের মতে, আল্লাহ নিজ রূপে আদম সৃষ্টি করেছেন; তাই আদম-সন্তান আল্লাহর মায়াময় সৃষ্টি। আল্লাহ মানুষকে ভালোবেসে মানুষের কাছে কেতাব দান করেছেন, মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন আল্লাহর পবিত্র গুণাবলি। আল্লাহর যে নিরান্নব্বইটি নাম রয়েছে তাতে একেক নামে একেক রূপ ও গুণে বিশ্বব্রহ্মান্ডকে মহিমান্বিত করেছেন তিনি। তাজউদ্দিনের নিজের কথায়,—
‘মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক তিনি স্রষ্টা আর মানুষ তাঁর সৃষ্টি। আসলে পরম সত্তার দিকে তাঁর সৃষ্টির আত্মসমপর্ণই মানুষের চূড়ান্ত পরিণতি। […] আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখা, মিথ্যাকথা পরিহার করা, বিপদে ধৈর্য ধারণ করা, অন্যের হক নষ্ট না করলেই আল্লাহকে পাওয়া যায়। সহজ-সরল পথই আল্লাহর দিদার লাভের সর্বোত্তম পথ বলে মনে করি। মানুষ যদি সহজ-সরল পথে চলে, দায়িমি সালাত আদায় করে তাতেই আল্লাহর দিদার পাওয়া সম্ভব। ‘দায়িমি সালাত’ বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি সর্বক্ষণ আল্লাহর সঙ্গে ক্বলবের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারার কঠিন ক্ষমতা যে লাভ করে, সে-ই আল্লাহর দিদার লাভ করতে পারে অনায়াসে।’
আল্লাহকে স্মরণ করে আল্লাহর মহিমা কীর্তন করে তাঁর একটি গানের অংশ এমন—
দীন দুঃখিনী বন্ধু আমার নামটি তোমার কুদরত উল্লাহ্
তুমি আমার জীবন-মরণ আমি চাই তোমার চরণধূলা।।
বানাইয়া এই বিশ্বভুবন পাঠাইয়া দিলায় সৃষ্টিগণ
সবাই তোমায় করে স্মরণ বিশ্বাস করি আমানতুবিল্লাহ।।
যে যাহা দুঃখ বলে যখন তুমি তা শুনিয়া তখন
দূর করিয়া দুঃখীর বেদন সুখ দিয়া করো উজালা।।
তুমি সব জীবের জীবন নিজ গুণে করতেছ পালন
বিপদে বন্ধুয়া সুজন বিপদ বারণ করনেওয়ালা।।
কথোপকথন থেকে তাঁর ভাবনা সম্বন্ধে আরও জানা গেছে যে প্রেম থেকেই জগৎ সৃষ্টি, মানবসৃষ্টি। আর আল্লাহকে ভালোবাসাই প্রকৃত প্রেম। সুতরাং মানুষের মধ্যে যদি আল্লার প্রকৃত প্রেম সৃষ্টি হয়; যে সদা জাগ্রত থাকে সে-মানুষ কোনোদিন খারাপ হতে পারে না, খারাপ কাজে লিপ্ত থাকতে পারে না। দ্বিধাহীন চিত্তে তাই তাজউদ্দিন ঘোষণা দেন, ‘জগতে আল্লাহ-প্রেমই শ্রেষ্ঠ প্রেম বলে মনে করি।’
হজরত মুহম্মদ (স.)-কে আল্লাহর প্রেরিত শ্রেষ্ঠ নবি ও রাসুল বিবেচনা করে তাঁকে জগতের সর্বশ্রষ্ঠ মহাপুরুষ হিসেবে মান্য করে গুণকীর্তন করেছেন গানে গানে—
নিজ নূরে করিয়া পয়দা দোস্ত বলে ডাকলেন খোদা
নামের সাথে নামটি বান্ধা দোস্ত বলে প্রমাণ দিলা।।
যে নবী আল্লার পিয়ারা সেই নবীর উম্মত আমরা
শাফায়াত নবী করবেন সারা কঠিন কাল হাশরের বেলা।।
সৃষ্টির সেরা নবীশ্রেষ্ঠ স্রষ্টা নবীর উপরে তুষ্ট
বলে তাজউদ্দিন নিকৃষ্ট আমায় দিও নবী চরণধূলা।।
ওলি-আউলিয়ার মধ্যে হজরত শাহজালাল ইয়ামনিকে তিনি উৎকৃষ্ট মানব বলে আখ্যা দেন। সিলেটে ইসলাম প্রচার ছাড়াও নানা অলৌকিক গুণাবলি ও মানবিকতা তাঁকে শাহজালালের প্রতি অনুরাগী করে তোলে, তাঁর প্রতি ইশক আনে—
জালালি পরশ পাইয়া সিলেট হইলো স্বাধীন
শুনিয়া তাওহিদের বাণী দেশ ছাড়ল শত্রু বেদিন
পুত্রহারা বুরহান উদ্দিন ঝরে দুই চোখের পানি।।
সিলেটবাসীর মুখে হাসি ফোটাইলেন আসিয়া
ইসলাম প্রচার করলেন সিলেট শাহজালাল আউলিয়া…
আল্লাহ-রাসুল বাদে পির-ওলি বন্দনা, মাতৃ ও পিতৃবন্দনা তাজউদ্দিনের গানে দেখা যায়। মুর্শিদ ও গুরুর বন্দনাও গানের বিষয় হয়েছে নানাভাবে। আল্লা-রসুলের পর মাকে তিনি সবার উপরে ঠাঁই দিয়েছেন। কারণ তাঁর মতে মায়ের মতো দরদি আর ধরায় কেউ নাই। মা শুধু গর্ভে ধারণ করেন না, পৃথিবীতে স্নেহে-যত্নে সন্তানকে লালন পালন করেন। তিনি মনে করেন মায়ের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন,—
মাগো তুমি গুণের গুণী আমি তোমার চিরঋণী
ঘোর নিদানে রাখিও গো মা তোমার চরণতলে
তোমার পাইলে আর ভয় নাই পাগল তাজউদ্দিনে বলে।।
তাজউদ্দিন কোরান ও হাদিসের বয়ান অনুযায়ী মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বলে মনে করেন। নিজের কথায়—
‘আল্লাহ মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব বলেছেন। আমিও বলি মানুষ শ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়ে নিজেকেও সৌভাগ্যবান মনে করি। প্রত্যেক মানুষের উচিৎ নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করা। মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব হওয়া সত্তে¡ও যুগে যুগে মানুষ সম্পর্কে অনেক অভিযোগ আসে। আমি বলি দরিদ্র আর স্বভাবজাত কারণে অনেক মানুষ নষ্ট-ভ্রষ্ট হলেও তা সাময়িক। একদিন মানুষ পরিশুদ্ধ হবে, মানবিক গুণাবলি জাগ্রত হবে, মানবিকতায় ঋদ্ধ হবে। জগতে অসংখ্য ধর্ম থাকা সত্ত্বেও ‘মানুষ’ পরিচয়ে মানুষ মহিমান্বিত হবে। জগতকে আলোকিত করবে এবং যুগে যুগে মানুষ তা-ই করছে।’
কিন্তু তিনি নিজের জীবনাভিজ্ঞতায় দেখেছেন মানুষের চেয়ে অধম প্রাণী আর দ্বিতীয়টি নেই। হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা প্রভৃতিতে মানুষ পশুকেও অতিক্রম করেছে। অথচ চাইলেই মানুষ ‘মানুষ’ হতে পারে। তাঁর কথায়—
মানুষ হতে চাইলে রে মন টাকা-পয়সা লাগে না
মানুষকুলে জন্ম নিয়া মানুষ কেন হইলে না।।
এমন মানুষ হওয়ার সাধনার কথা লালন ও আবদুল করিমও বলেছেন। তাজউদ্দিন মানুষের কুলে জন্ম নেওয়াকে একটা বড়ো সুযোগ বলে মনে করেন। তাঁর চিন্তার সঙ্গে লালনের চিন্তার অদ্ভুত মিল দেখতে পাই। লালন বলেছেন, ‘এমন মানবজনম আর পাবে না’। তাজউদ্দিনও তা-ই মনে করেন। তাই মানুষকে মানুষের সাধন ভজন করতে হবে। কিন্তু সাধনার দিশা এমনি আসে না। তাজউদ্দিন এখানে পির-ফকিরের পথের কথাও বলেন। সাধনায় মুর্শিদ দরকার, কারণ কেউ তো পথ দেখাতে হবে,—
মন রে তুমি আর করিও না দেরি যাও চলিয়া তাড়াতাড়ি
যাইয়া মুর্শিদেরি বাড়ি মুর্শিদেরি চরণ ভজো না।
সময় থাকতে করো সাধন ধরিয়া মুর্শিদেরি চরণ
অসময়ে করিলে রোদন কোনো কাজে লাগবে না।।
বাংলার ফকিরেরাও ওই একই কথা বলেছেন। সাধনায় ফকিরি তত্ত্বের নির্দেশও তাঁর গানে দেখতে পাওয়া যায়—
মন রে চাও যদি শান্তির বিধান আগে ঠিক করো ইমান
দূর হবে ইবলিশ শয়তান পাশে তোমার থাকবে না।
ইমান ঠিক করো যদি শয়তান আর হইবে না বাদী
তেলে ভাজো ছয়নদী হইবে তুই খাঁটি সোনা।।
পির-ফকির ও বৈষ্ণব-বাউলদের মধ্যে যে সর্বমানুষে ভক্তি ও ভালোবাসা তাও তাঁর গানে দেখা যায়—
মন রে মানুষ বলতে সব একসমান কেউ হিন্দু আর কেউ মুসলমান
কেউ কয় আল্লাহ কেউ ভগবান স্বরূপ করে সাধনা।
এই নাম যে করছে সাধন ধন্য তার মানব-জীবন
পাগল তাজউদ্দিন কয় নাই তার মরণ অমরপুরে তার ঠিকানা।।

প্রেমভাবের কিছু আধ্যাত্মিক গান অসাধারণ রূপক-উপমায় প্রতীকী ভাষা লাভ করেছে। মানুষের শত্রু রয়েছে তার আপনার মাঝে, এই শত্রুদের জয় করে নিতে না পারলে সাধক হওয়া যাবে না; প্রিয়মিলন সম্ভব হবে না। সংশয়ে-সংকটে সর্বদা সজাগ থেকে তবে প্রেমের সাধনা করতে হবে। এমন ভাব একটি গানে এভোবে প্রতিফলিত হয়েছে,—
বন্ধের নামে সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যাও
ভবসাগর পাড়ি দিয়া কিনারায় ভিড়াও।।
মাঝি-মাল্লা অরাজি হইলে ডুবাইব নাও
মাল্লা বাধ্য করো আগে ধরিয়া মাল্লার পাও।।
আড়ি কোনায় সাজ করেছে আকাশ পানে চাও
এ তাজউদ্দিন কয় ও মাঝি ভাই ঢেউ কাটিয়া বাও।।
জীবন সম্পর্কে তাজউদ্দিনের অভিজ্ঞান হচ্ছে জীবন ক্ষণস্থায়ী, চিরকাল মায়ার মানুষ পাশে থাকে না। দাদা-দাদি, নানা-নানি, পিতা-মাতা সব চলে যায় একে একে। একদিন নিজেও ডাক পড়ে। তাহলেও পরিজনের স্মৃতি জীবনের পরম সম্পদ। একই মায়ের পেটে জন্ম নেওয়া সত্তে¡ও জীবনের পথে সবাই একা। এটাই জীবনের রীতি হিসেবে দেখেছেন,—
ভাইবোন আমরা এক ঝাড়ের বাঁশ কেউ কারো নয় সাথি
যার তার পথে চলে যাব নিভিলে ঘরের বাতি
এই কি রে দুনিয়ার নীতি বলে পাগল তাজউদ্দিন।।
তাজউদ্দিনের গুরুতত্ত্বের গানগুলোর ভাবও অতি উন্নতমানের। গুরু হচ্ছে আশিকের মুক্তির উসিলা। তিনি মনে করেন আগে গুরু ঠিক করে নিতে হবে। গুরু ছাড়া মুক্তি নাই। গুরুই ওস্তাদ, গুরুই মাতা-পিতা। গুরুকে তিনি বলেছেন ‘দেহঘরের ডিক’ অর্থাৎ ঘরের খুঁটি। গুরুকে পেতে হলে তাই নিষ্ঠ হতে হয়, ছোটো হতে হয়। না হলে গুরু লাভ করা যায় না। আর গুরু না পেলে উপায়ও থাকে না। গুরুকে যারা মানে না তাজউদ্দিন তাদের ‘মুনাফিক’ বলে অভিহিত করেছেন। এই গুরুই তাঁর মুর্শিদ, তরনেওয়ালা—
সময় থাকতে করো সাধন ধরিয়া মুর্শিদের চরণ
অসময়ে আর পাইবে না কোনো দিক।
যে মানে মুর্শিদের বাণী সে হয় ভবে মহাজ্ঞানী
পঞ্চরসে সে হয় রসিক।।
লক্ষ্য ঠিক রেখে তাই গুরুর মন্ত্র শিখে নিতে হবে। অবশ্য গুরুবাক্য আত্মস্থ করতে হলে আশিক হতে হয়। তবে বর্তমান যুগে আদর্শ গুরুকে পাওয়া দুষ্কর বলেও মনে করেন তাজউদ্দিন। তাঁর কথায়—
‘আত্মশুদ্ধি লাভের জন্য প্রকৃত পির-মর্শিদকে আমি মান্য করি। তবে ছদ্মবেশী ভণ্ডামিকে অপছন্দ করি। বর্তমান সময়ে আল্লাহ-ভীতু খাঁটি পির-মুর্শিদের অভাব আছে বলে আমার অনুভব। যাঁরা প্রকৃত অর্থে পির-মুর্শিদ বা আধ্যাত্মিক সাধক তাঁরা প্রচারে বিশ্বাসী না। বেশিরভাগ সময় তাঁরা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যান। পরলোভী, ভণ্ডদের সংখ্যা এখন ব্যাপক বেড়ে গেছে। এটাও চিনে নেওয়া কঠিন কে আসল আর কে ভণ্ড।’
বৈষ্ণব পদাবলির রাধাভাবের প্রভাব তাজউদ্দিনের অনেক গানে দেখা যায়। এসব গানের প্রধান বিষয় প্রেম ও বিরহ। এখানেও নারী কথক, নারী প্রতারণার শিকার। নারীর দুঃখ, একাকিত্ব, যন্ত্রণা মানবিক আধারে রূপায়িত হয়েছে গানগুলোতে—
ঘরে-বাইরে হইলাম দোষী পিরিতি করিয়া
কলঙ্কিনী হইলাম আমি জগৎজুড়িয়া।।
যৌবনফুলের মালা গাঁথি নিরলে বসিয়া
যৌবনফুল ফুটিয়া ঝরে যৌবন যায় শুকাইয়া।।
প্রেম-আগুন ধরল কলিজায় নিভাব কী দিয়া
জল দিলে নিভে না আগুন জ্বলে গইয়া গইয়া।।
অন্য গানে—
প্রেম আগুন লাগিয়া সোনার অঙ্গ হইলো কালা
আর কোনদিন আসিবে আমার শ্যাম চিকনকালা
সয় না প্রাণে যৌবন-জ্বালা মরি প্রেমের বিষে।।
জীবন অনিত্য, জীবন নশ্বর। জীবনের এই অনিত্যতা তাজউদ্দিনকে সবসময় ভাবায়। এক্ষেত্রে হাসন রাজার সঙ্গে তাঁর বড়ো মিল। হাসন রাজা যেমন ব্যাকুল ছিলেন মিছে দুনিয়াদারির অনিত্যতায়, তাজউদ্দিনও তেমন। হাসন রাজা জীবন-সংসারকে ‘মায়াপুরি’ বলেছিলেন; বলেছিলেন, ‘মানুষ ভবের মায়ায় বন্দি’। তাজউদ্দিনও তা-ই বলেন। জগতের যে-কারণে আগমন মৌলার পথের অনুসন্ধান, তা না করে মানুষ বিভ্রান্ত হয়, তাজউদ্দিনও নিজেকে বিভ্রান্ত মনে করেন—
ভবের হাটে আইলায় ছুটে করিতে বেপার
লাভে-মূলে হারাইয়া সাল্লা পাইয়া ছয় চোরার।।
জীবনে আপনজন কেউ নয়, নিজের কর্মফলই আসল সঙ্গী। তাই ভ্রমের পথ ছেড়ে মৌলার পথের দিশা চান তিনি : ‘তাজউদ্দিন কয় সব ছাড়িয়া পথ ধরো আল্লাহর’।
মানুষের শারীরিক সক্ষমতা, ক্ষমতা, বল, সৌন্দর্য সবকিছুই অস্থায়ী। এসবই একদিন মানুষ হারায়, অথচ মানুষের কত দম্ভ, মানুষ অন্যকে কত অত্যাচার করে। তাজউদ্দিন মনে করেন মানুষের অজ্ঞানতাই এজন্য দায়ী। জ্ঞানী মানুষ গৌরব যেমন করতে পারে না, ক্ষমতাও দেখাতে পারে না। কারণ জগতে ক্ষমতাবান ওই একজনই, তিনি মহান আল্লাহ—
থাকবে না তোর এই গায়ের বল একদিন সব যাবে চলে
বাহাদুরি আর মাতব্বরি করতেছ গায়ের বলে।।
সিকন্দর এক বাদশা ছিল হাওয়া বান্দিয়া খাজনা লইল
সেও খালি হাতে গেল রইল না ভূ-মণ্ডলে।।
তাই তাজউদ্দিনের কথা দম্ভ ভুলে সামান্য মানুষ হও, কারণ মানুষ সামান্যই। মানুষের পথ সোজার। সোজা পথে চললেই মুক্তি মেলে।
নিজের সম্পর্কে তাজউদ্দিনের ধারণা তাঁর পথ সরল-সোজা। সোনাকে সোনা আর পিতলকে পিতল বলতে অভ্যস্ত। অথচ এটাই জীবনে সমস্যা। যারা সোনাকে পিতল ও পিতলকে সোনা বানায় তাদের কাছে তিনি ‘বেআক্কল’ সাজেন, যদিও তাজউদ্দিন ভাবেন উলটোটা—
স্বার্থকুরগণ বলে আমায় তাজউদ্দিন পাগল
সোনারে আমি সোনা বলি সোনারে কই না পিতল।।
স্বার্থ নিয়া করে দ্বন্দ্ব বোঝে না ভালো আর মন্দ
চউক থাকিতে হইয়া অন্ধ সোনারে কয় ফেমিকল।।
স্বার্থর লোভে হারাইয়া দিশা সোনার দামে খরিদ করল শিশা
সে হইল আসল বেদিশা আস্তা একটা বিয়াক্কল।।
হিংসাকুর মানুষেরা তাজউদ্দিনকে হিংসা করলেও তিনি কিন্তু রাগ-গোস্বা করেন না। কারণ তিনি জানেন এরা লোভী ও স্বার্থপর। স্বার্থের কারণে এসব মানুষ যেকোনো অমঙ্গল ঘটাতে পারে, মানুষের ক্ষতি করে।
সমাজসচেতনামূল গানে দেখা যায়, সামাজিক বাস্তবতায় তরুণ-সমাজের অবক্ষয় তাজউদ্দিনকে সব সময় ব্যথাতুর করে তোলে। অ্যান্ড্রয়েড কালচারে গ্রাম-বাংলায় যে অধঃপতন ও দায়-দায়িত্বহীন প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে, যারা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায় তাদের প্রতি প্রসন্ন তিনি নন। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে অন্ধভাবে গ্রহণ করে এরা যে চরম অধঃপাতে তলিয়ে যাচ্ছে তা তাঁর সংবেদনশীল মনে নাড়া দেয়—
কাজকর্ম লাগে না ভালো বেচিয়া মায়ের কানের দুল
সাদাকালো রং লাগাইয়া ডিজাইন করে মাথার চুল
কান্দিয়া মা হইল আকুল খুঁজে পায় না অলংকার।।
বর্তমান ছেলেরা চলে মেয়েদের রূপ ধরিয়া
ব্রেসলেট হাতে মেন্দি লাগায় গলাতে চেইন পরিয়া
প্রেমিকারে সঙ্গে নিয়া টাউনে ঘোরে বেশমার।।
এই অবক্ষয় এতটা যে বাপ ও ছেলের আচার-আচরণে পার্থক্য নেই আর। তাঁর মনে হয় বর্তমান সমাজে ছোটো আর বড়োর মধ্যে ভেদাভেদ নেই; এখানে যারা নিকৃষ্ট তারাই সাধু সেজে বসে আছে, আর উৎকৃষ্টরা চুপ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এতটাই যে সমাজের সর্বক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়েছে। ফলে এই সমাজের উদ্দেশ্যে তিনি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেন এভাবে—
শ্রোতা বলতে নাই আর দেশে বর্তমানে সব নেতা
আগের মতো আর স্বাদ লাগে না খাইলে রউ মাছের মাথা।
বালিগড়ার দাম অযথা অতি স্বাদ লাগে খাইতে মুরি।।
ছোটোবড়ো নাই ভেদ-বিধান বর্তমানে সমাজে
সরিষায় লেগেছে ভূত যায় না তাবিজ-কবজে।
বাপ থাকি পুয়া বেশি বোঝে ভালো নয় গাছের গুড়ি।।
তাজউদ্দিন দীর্ঘ মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসজীবন কাটান সংসারে সুখ আনতে। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রাম ও নিগৃহীত জীবন দেখেছেন। দেখেছেন অনেককে দেশের টাকা পাঠানোর জন্য দিনরাতে পরিশ্রম করতে, কেউবা দেশের কথা ভুলে ফুলবাবুর মতো ঘুরে বেড়াতে। অনুভব করেছেন প্রবাসী যুবকদের দেশে রেখে আসা নববধূদের অন্তর্জ্বালা। দিনশেষে দেখেছেন বিদেশের প্রবাসজীবন গোলামি ছাড়া কিছু নয়, এতে জীবন অসারই হয় শেষে। নিজের প্রবাসজীবন নিয়ে তাঁর কথা হচ্ছে—
আমি দেখলাম ঘুরে দেশ আর বিদেশ পুরলো না আমার মনের উদ্দেশ
দুঃখ কইলে হবে না শেষ পাইছি মনে যে ব্যথা।
ভাবিয়া তাজউদ্দিনে কয় হারাইয়া অমূল্য সময়
হইল না এক আনার সঞ্চয় সকলি গেল ব্যর্থা।।
আল্লাহকে খুশি না করে যারা বাইরে ইমানদার সাজে তাদের প্রতি রুষ্ট তাজউদ্দিন। তাঁর মতে এরা ভন্ড, নামাজ-রোজ-ঈদ এদের কাছে লোকদেখানো। প্রকৃত ইমান ও ইসলাম এদের মধ্যে নাই বলে তাদের প্রতি বিদ্রুপাত্মক বাণী রচনা করেন তিনি। অথচ এমন মানুষ সারা সমাজ ছেয়ে আছে। আত্মম্ভরী ও লোকদেখানো ভন্ডদের বিষয়টি ফুটে উঠেছে এভাবে—
আমার মতো মুসল্লি আর নাই থাকলে দেখাও চাই
মাঝে-মধ্যে নমাজ পড়ি আমি মনে মনে ভাবি তাই।।
সমাজে সব সময় একদল ধর্মব্যবসায়ী বসবাস করে। এদের দ্বারা ধর্মের যেমন, মানুষেরও ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। তাজউদ্দিন সবসময়ে এসব ধর্মব্যবসায়ীর প্রতি সোচ্চার ছিলেন। ধর্মব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে ধর্মকথায় মনগড়া জিনিস আরোপ করে থাকে, এটাকে তিনি খারাপ চোখে দেখেন। কথোপকথনে সুস্পষ্টভাবে বলেছেন—
‘ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করি। কোরানেও তাদের ব্যাপারে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। আমি গানে গানে বলি, ‘মোল্লা, মুন্সি, মুরব্বিগণ, সোজা পথে চলে কয়জন / কথা কয় মানিকের মতন / মহাজনের আইন মানে না।—এটি ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতি আমার দর্শন। তবে প্রকৃত আলেম, মৌলভি ও ধার্মিকদের আমি মনে-প্রাণে শ্রদ্ধা করি। আমি নিজেও একজন প্রকৃত আল্লাহ-বিশ্বাসী ও ধার্মিক। গান খারাপ—কথাটি আমি মানি না। আল্লাহর নাম ধরে গানে টান দিলে আল্লাহকে পাওয়া যায়, আল্লাহর সঙ্গে প্রেম সৃষ্টি হয় বলে আমি মনে করি। উদাস মনে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের নামে গানে টান দিলে রাতের অন্ধকারে কলিজা ভেদ করে আল্লাহ-প্রেম জাগ্রত হয়, পাষাণ পাথর মন গলে চোখের জলে ভেসে যায় মানবহৃদয়।’

তাজউদ্দিনের বিভিন্ন গানে ভন্ড ধর্ম-ব্যবসায়ীদের চরিত্র-চিত্রণের বিষয়টি দেখা যায়। তিনি সত্যিকার ধর্মের উপাসক, আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিবেক ও মানবতার সঙ্গে চলার পক্ষে। অন্য ধর্মের প্রতি রয়েছে তাঁর সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধা। তাজউদ্দিন মানুষকে ভালোবাসেন, অন্য ধর্মের মানুষকে সম্মানও করেন। তিনি মনে করেন ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। তিনি চান ধর্মে-ধর্মে, মানুষে-মানুষে সহাবস্থান। বাংলার সাধকেরা যা সবসময়ে চেয়ে আসছেন—
‘তবে ধর্ম নিয়ে, ধর্মের পরিচয়ে সমাজ-রাষ্ট্রে অশান্তি বন্ধ হোক—আমি এটা চাই। আমি মনে করি কোনো ধর্মই অশান্তি ও অন্যায়ের কথা বলে না। আমরা মানুষরাই ধর্মের নামে দুনিয়ায় অশান্তি ও পাপাচার করি। প্রতিটি ধর্মের পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ থাকুক, আমি কোনো ধর্মের বিরোধী নই।’
সিলেটের গ্রামাঞ্চলে এখনো সালিশপ্রথা প্রচলিত আছে। এই সালিশকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একধরনের অবৈধ বাণিজ্য। ঘুষের লেনদেন হয় প্রচুর, ঘুষের বিনিময়ে অনেক মুরব্বি রায় দেন, তারা ন্যায়কে অন্যায় এবং অন্যায়কে ন্যায় করে তোলেন। অনেক তথাকথিত মুরব্বি নিজেও অন্যায় কাজে যুক্ত রয়েছেন। নিজে একজন মুরব্বি হয়ে সালিশে যুক্ত হয়ে মর্মে মর্মে তা অনুভব করেছেন তাজউদ্দিন। তিনি দেখেছেন অন্য কোনো কাজে নিযুক্ত না হয়েও মুরব্বি পেশায় নিয়োজিত হয়ে অনেকে সচ্ছল জীবন যাপন করছেন। এটা যেমন সমাজে অন্যায় প্রতিষ্ঠা করছে, তেমনি অনেক নিরপরাধ ব্যক্তি ও পরিবারের জীবনে অভিশাপ বয়ে আনছে। কথোপকথনে এ-সম্পর্কে বলেছেন—
‘সমাজ অন্যায়ে ছেয়ে গেছে, ন্যায় চাপা পড়ছে। সালিশি বিচারে গেলে অন্যায়ের জয় দেখি, ন্যায় পরাজিত হতে দেখি—এটাকেই আমি আমার জীবনের ব্যর্থতা বলে মনে করি। এমতাবস্থায় আমি যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করি তখন আমাকে লোকে পাগল আখ্যা দেয়। টাকার বিনিময়ে সমাজে যখন ন্যায়-অন্যায়ে রূপান্তর হয়, তখন আমি ব্যর্থ হয়ে সমাজকে বর্জন করি, আম-মানুষ আমাকে ভালোবাসে, মুরব্বিরা আমাকে দেখতে পারে না। কারণ, তাদের অন্যায়ে আমি সায় দিই না। বিবেক-বিবর্জিত সমাজকে দেখা—এটাকেই জীবনের র্ব্যথতা বলে মনে করি।’
তাজউদ্দিন তাই এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন গানে গানে—
কথায় কথায় ফ্যাস লাগাইয়া তারিখ দেও স্বার্থ না পাইয়া
ছয়মাস যায় বিচার গাইয়া বিচার তো আর শেষ অয় না।।
যে দেয় আগে বিচারের যকাত তার বিচার করো হে জাগাত
নইলে দেও প্রাণে আঘাত করিয়া অনেক বাহানা।।
সামাজিক অবক্ষয়, সমাজের ভাঙন, মূল্যাবোধের আকাল তাজউদ্দিনকে সদাই ব্যাকুল রাখে। একটা সময় তিনি দেখেছেন মানুষে মানুষে কী মধুর সম্পর্ক। ছোটো ও বড়োর মধ্যে সদ্ভাব, সামাজিক নিয়মের নানা সুফলতা। গ্রামের মানুষ একসময় কত সরল ছিল, ছিল সর্বত্র ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এখন সবাই কেমন নিজে নিজে চলতে চায়, সমাজিক অনাচারে কেউ গা করে না—
হিংসা একে অন্যের প্রতি ভাইয়ে ভাইয়ে আদাঅতি
ছোটো-বড়ো নাই খাইড়-খান্তি, কিয়ামতেরি আলামত।
কেউর প্রতি কেউর নাই ভাব-ভক্তি থাকবে না আর পাঞ্চায়িতি
শয়তানে করায় বেমুরতি উঠে গেছে ভাব-মুরত।।
তাজউদ্দিন মনে করেন ধর্মবোধ ও ইমান-আকিদার অভাবে সেসব হচ্ছে। মানুষের মধ্যে শয়তান বিরাজ করছে; তাই মুক্তির একটাই পথ, অন্তর থেকে শয়তানকে পরিহার করতে হবে।
তাজউদ্দিন একজন রাজনীতিসচেতন মানুষও। ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, চব্বিশের আন্দোলন নিয়ে নিজস্ব ভাবনাও তাঁর গানে দেখি। ভাষা-আন্দোলনকে তিনি বাঙালির জাগরণের ভিত বলে মনে করেন। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো ঘটনা। একাত্তরের স্বাধীনতাকে বাঙালিজীবনের গৌরবমুকুট ও জাতীয় বড়ো অর্জন মনে করেন। মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি জাতীয় নেতা মানেন। চব্বিশের আন্দোলনকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন; তবে যারা ‘নতুন স্বাধীনতার’ কথা তুলছেন তাদের সমালোচনা করেন তিনি। তাজউদ্দিন মনে করেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধই বাংলাদেশের স্বাধীনতার একমাত্র স্মারক। সরকার পতনের পর বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে যে অপমান করা হলো তাতেও তিনি ব্যথিত হন—
বঙ্গবন্ধুর কী অন্যায় করলায় অমান্যতা
সয় না প্রাণে এই অপমান কলিজায় দিয়াছ ব্যথা।।
স্বাধীন দেশের কও আবার করছ স্বাধীন
আগে আছলায় কোন দেশের অধীন
নতুন দেশের নাম রাখবায় কোনদিন জানাইও একবারতা।
বাংলাদেশের বাঙালি যারা সবাই কয় এক কথা
১৯৭১ সালে পাইছি আমরা স্বাধীনতা।।
তাজউদ্দিন মনে করেন বাংলাদেশের রাজনীতির বড়ো সমস্যা হচ্ছে হিংসা ও বিদ্বেষ। এর দল আরেক দলকে দেখতে পারে না। নেতৃত্বের সমস্যাও আসল সমস্যা। কারণ নেতারা সঠিক নয়; দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষই এখানে বড়ো নেতা হয়ে যায়—
সরকারে করে সরকারের ক্ষতি আর হবে না দেশের উন্নতি
মিটায় একে অন্যের স্মৃতি জানে সব জনতা।
চোর-ডাকাইত বর্তমান সমাজের বড়ো নেতা।।
এভাবে তাজউদ্দিনের গানে সমাজ-নিরীক্ষণ ও সমাজ-মনস্কতার গভীর পরিচয় পাওয়া যায় এবং সমাজের উন্নতিকল্পে নানা অসঙ্গতিকে তিনি গানে তুলে ধরেন।
সবশেষে এটুকু বলার যে, তাজউদ্দিনের গানে সিলেট অঞ্চলের লোকগানের ভাবসম্পদের প্রতিফলন দেখা যায়; একই সঙ্গে দেখা যায় বাংলার বাউল-ফকির-বৈষ্ণবের কণ্ঠের ধ্বনিও। তাজউদ্দিন বাউল-ফকির নন, তিনি একজন গৃহী মানুষ। গৃহের আঙিনায় তিনি জাগতিক ও মরমি ভাব পোষণ করে নিজের জীবনসাধনা করে যাচ্ছেন। ‘আমি কাজ করে খাই, আল্লাহর আদেশ মানি—এটাই আমার সাফল্য’—এমন কথা যিনি বলেন তিনি সামান্য মানুষ নন, অসামান্য চিত্তের অধিকারী বলতে হবে। বাংলার সোঁদা মাটি, জল-হাওয়া ও প্রকৃতির মিশেলে লোকভাবনায় যে মরমি ভাবের উদয় হয় তার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ দেখা গেছে তাজউদ্দিনের গানে। একদিকে জালালুদ্দিন রুমি, অপর দিকে হাসন-লালন-দুর্বিন শাহ-করিমের ভাবজগতের স্পন্দন তাঁর গানের বাণীতে পরিস্ফূট। এসব বাণীর মর্মে যেমন আছে আত্মপ্রেম ও আত্ম-অনুসন্ধান, তেমনি আছে খোদাপ্রেম; আছে ভক্তিবাদ-ফকির, বাউল-বৈষ্ণবের সাধন ও ভজন। সবচেয়ে বড়ো বিষয় মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও ভক্তি। এই গানগুলো দীর্ঘদিন ভাবুক-হৃদয়কে প্রেরণা দেবে; প্রেমে উদ্দীপিত করবে—তাজউদ্দিনকে বাঁচিয়ে রাখবে।
জফির সেতু রচনারাশি
- লোককবি তাজউদ্দিন ও তাঁর গান || জফির সেতু - November 25, 2025
- শাহজালাল শাহপরান গ্রামবাঙলায় গাজির গান || তুহিন কান্তি দাস - November 22, 2025
- আমাদের গ্রামের নাম আমাদের নদীর || কাজল দাস - November 19, 2025

COMMENTS