মগরাতীরের শিশুদের খুশি ও আনন্দ দেখতে সকালে মোক্তারপাড়া মাঠে এলাম। শুরু হলো ‘দি হলি চাইল্ড কিন্ডারগার্টেন’-এর রজতজয়ন্তী ও পুনর্মিলনী উৎসব। উৎসব সবাইকে টানে। বিশেষ করে শিশুদের উৎসব। প্রতিদিনের ধুলোমলিন মনকে, চাপ মর্মরিত আত্মাকে শিশুরাই ধুয়ে দিতে পারে। শিশুদের হাসিতে ফুল ও ঝর্ণার ধারা। শিশুরাই এই পৃথিবীর বনের পাখি। নিয়ম ও সামাজিকতায় আমরা তাদের খাঁচায় ভরে ফেলি। কেননা একদিন আমাদেরকেও কেউ খাঁচায় ভরে দিয়েছিলেন। এ যেন পিতা ও পুত্রের আঙুলে আঙুল রেখে চিরায়ত নিয়মের পরম্পরা। সেই সূত্রেই নিয়মের অবগাহনে বেঁধে ফেলি শিশুর স্বাভাবিক প্রকৃতি। অথচ, শিশুর পাশে দাঁড়ালে স্পর্শ করে মুঠো মুঠো ছেলেবেলা। মূলত ছেলেবেলার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের প্রত্যেকের জীবন।
দুই
পঁচিশ পেরোনো একটা স্কুলের অনেক ছায়া ও মাধুর্য। শ্রদ্ধেয় কামরুন্নেছা আশরাফ দীনা ১৯৯৪ সালে মোক্তারপাড়ায় কেন বাচ্চাদের একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন — ঠিক বলতে পারব না। এনআই খান ফাউন্ডেশন দ্বারা পরিচালিত স্কুলটির নাম দিয়েছিলেন ‘দি হলি চাইল্ড কিন্ডারগার্টেন’। কিন্ডারগার্টেন ধারায় এটিই নেত্রকোণার প্রথম স্কুল। কেন স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো — এই ব্যাখ্যা আমার কাছে না থাকলেও এই কথা আমি স্পষ্ট জানি তিনি বাচ্চাদের জন্য একটি যথার্থ স্কুল করতে চেয়েছেন। এই শহরের সবাই স্কুলটিকে বড় ম্যাডামের স্কুল হিসেবেই জানে। বাচ্চাদের তিনি ভালোবাসেন। বাচ্চাদের আমরা সবাই ভালোবাসি। কিন্তু শাসন ও দরদ মাখানো মায়ায় স্কুলের বাচ্চাদের তিনি আপন করে নেন। তাই, বাচ্চারা তখন শুধু স্কুলের আর ছাত্র থাকেন না। ছাত্র ও সন্তানের অসীম মায়ায় প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ভেতরে বসবাস করে। এই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। কিন্তু কোনো শিক্ষার্থীই বড় ম্যাডামকে ভুলে যায় না। বড় ম্যাডামও তার শিক্ষার্থীকে ভুলে যান না। তাই একইসঙ্গে তিনি মা ও শিক্ষক। বড় ম্যাডামের স্কুল মূলত একটা পরিবার। ঈদে ও পার্বণে, দুঃখে ও সাফল্যে বড় ম্যাডাম নামক স্নেহের ছায়ায় সবাই ছুটে আসে। উৎসবানুষ্ঠান উদ্বোধন করতে এসে শিক্ষা-উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘আমি শিক্ষাবিদ নই। আমি আজকে উৎসব দেখতে এসেছি। দেখতে এসেছি ঢাকার বাইরের এই স্কুলটিকে। যিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে তিল তিল করে সমৃদ্ধ করেছেন — অধ্যক্ষ কামরুন্নেছা আশরাফ দীনা ম্যাডামকে দেখতে এসেছি। বাচ্চাদের ভালোবেসে পড়ালেখা করাতে হয়। তিনি নেত্রকোণায় তা-ই করছেন। আমি তাই এই মনীষাকে শ্রদ্ধা জানাই’।
তিন
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘শিশুরা হচ্ছে বীজ। বীজের যত্ন করতে হয়। না হলে বীজের অঙ্কুর হয় না’। কামরুন্নেছা আশরাফ দীনা মূলত বীজের যত্ন করে প্রজন্ম তৈরি করছেন। পঁচিশ বছর হলো একটা স্কুলের। কিন্তু স্কুলের একটা ছাত্রও তাকে ছেড়ে যায়নি। শিক্ষক ও মাতৃত্বের নাড়ির খোঁজে আজ তাই মোক্তারপাড়ার মাঠ কানায় কানায় পরিপূর্ণ। পাঁচ বছরের শিশু থেকে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বয়সী শিক্ষার্থীরা একটা শামিয়ানার নিচে দাঁড়িয়েছে। রজতজয়ন্তী ও পুনর্মিলনী উৎসব উদযাপন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী
মো. মোক্তাদীর মোর্শেদ বলেন, ‘সারাদেশ থেকেই আমাদের বন্ধুরা আসছে। আজ আমাদের জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ দিন।আমাদের উৎসবের স্লোগান হচ্ছে ‘চলো ফিরি শৈশবে, মেতে উঠি উৎসবে, পঁচিশের আলোয় রাঙা, প্রাণের প্রাঙ্গণে’। আমরা কিছুই হারাইনি। বড় ম্যাডাম আমাদের শক্তি। আমাদের স্কুল আমাদের পরিবার’।
এটিএম আব্দুর রাজ্জাক এই শহরের প্রাণের স্বজন। মুক্তবুদ্ধির সকল কাজে তিনি সবার পাশে থাকেন। মিলনের চৌষট্টি পাপড়ি দেখতে, আয়োজকদের সহায়তা করতে তরুণদের সাথে মুগ্ধ মনে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। রাজ্জাক ভাইয়ের মতো লোকেরা শরীরে ও বয়সে প্রাচীন থাকলেও মনটা শিশুদের মতো সরলই থাকে। ছোট এই শহরে দরদী মানুষটি শুধু স্নেহ ও শান্তির ফুল ফোটান।
চার
ঢাকের আওয়াজে শুরু হলো সকাল। ডিসেম্বরেও বৃষ্টি হলো। মনে হচ্ছে প্রকৃতি বদলে যাচ্ছে। আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, পুরো জানুয়ারি মাস জুড়ে চলবে শৈত্যপ্রবাহ। চলুক। প্রকৃতিকে কে বদলাতে পারে? চলমানতাই প্রকৃতির ধর্ম। পৃথিবীতে সবকিছুই মুছে যাবে, শুধু শিশুরাই গানে গানে থেকে যাবে।
বাচ্চারা মূলত স্বপ্নের মিউজিক। নিজের জীবনকেও কখনো কখনো ভারী মনে হয়। তাই, বাচ্চাদের মিউজিকের পাশে বসতে হয়। সেই মিউজিকের সুর বুকে মাখতেই মোক্তারপাড়ার মাঠে এসেছি। মাঠটাকে মনে হচ্ছে আকাশী পদ্মের বিল। এই পদ্মবিলে বড়রাও আছেন। আছেন সাইফুল্লাহ এমরান, দারাভাইয়ের মতো সজীব মানুষ।
মানুষের ভিড়ে আকাশের রঙের মতো অনেক আড়ালে চুপ হয়ে থাকেন কবি শিমুল মিল্কীর মতো মানুষ। এরা সকল কাজের পেছনে থেকে মঞ্চটাকে প্রস্তুত রাখেন। সবাই চলে যাওয়ার পর মঞ্চটাকে গুছিয়ে রেখে উনারা বাড়িতে ফেরেন। কোনো কথা নেই। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও নিশ্চুপ নক্ষত্র তারা। এরা আছেন বলেই, বাচ্চারা এই পৃথিবীর আলোতে বসবাস করেন।
শ্রদ্ধা জানাই কামরুন্নেছা আশরাফ দীনা ম্যাডামকে। ভলোবাসা দিলে ভালোবাসা আসে। ম্যাডামের বাড়িতে আজ পরিপূর্ণ সন্তানের ভালোবাসা। এরা কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষক, কেউ ব্যাংকার, বিচারক কিংবা ব্যবসায়ী। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিচয় এরা সবাই বড় ম্যাডামের ছাত্র। বড় ম্যাডামের সন্তান। এরা সবাই বড় বড় মহৎ মানুষ। মোক্তারপাড়ার মাঠে মহৎ মানুষের রজতজয়ন্তী ও পুনর্মিলনী উৎসব।
… …
- ভরা চান্নির উপত্যকায় কাব্য ও কথকতা || সরোজ মোস্তফা - October 30, 2024
- নূরুল হকের দুটো অপ্রকাশিত কবিতা || সংগ্রহ ও ভূমিকা : সরোজ মোস্তফা - July 28, 2021
- মুক্তস্বরের মানুষ || সরোজ মোস্তফা - April 20, 2021
COMMENTS