আপনি যদি মিনিট-পনেরো ম্যুভিটার সঙ্গে থেকে কোনো অনিবার্য কারণে কিংবা কারণ-ব্যতিরেকে স্ক্রিন্ ছেড়ে উঠে পড়েন, যদি বিশেষ দ্রষ্টব্য হিশেবে এর ডিরেক্টরের নামটা আপনার চোখে না-পড়ে কিংবা পড়লেও পরিচালকের সঙ্গে এর আগে দেখাসাক্ষাৎ হয় নাই বিধায় এমনটা গাত্রোত্থান ম্যুভিস্ক্রিন্ ছেড়ে, বলা বাহুল্য যে এই সিনেমার প্রতি জাস্টিস্ তো করেনই নাই উপরন্তু বঞ্চিত করেছেন নিজেকে। এমনিতে এই মিনিট-পনেরো শুরুর দিকটায় একে স্রেফ সফটকোর পার্ভার্শন্ মনে হতে পারে কারো কারো কাছে, কেউ কেউ মনে করতে পারেন এইটা ফালতু ফ্যুট-ফেটিশ বৈ কিছু তো নয়, য়্যু কমপ্লিটলি মিসিন্টারপ্রেট দ্য হোল্ থিং। ঘটনাটা আদতেই ডিফ্রেন্ট। গোটা ছায়াছবিটা (The Man Who Loved Women) দেখে সেরে আপনার ভুল তো ভাঙবেই, কিংবা ওই মিনিট-পনেরো পরেকার কিয়দ্দুর অগ্রসর হলেই আপনি এর প্রতি স্থিরচক্ষু ও উৎকর্ণ হয়ে উঠবেন। সন্দেহ নাই, অন্তত আমার তো সন্দেহ নাইই, নিঃসন্দেহ হবেন আপনিও আরেকবার এই ব্যাপারে যে একটা ভালো ম্যুভি আপনাকে কোত্থেকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে।
এই সিনেমার নায়ক মধ্যবয়স্ক, চল্লিশোর্ধ্ব, অবিবাহিত। চোখে পড়ার মতোই বিষাদমগ্ন, কোন-এক বোধ দ্বারা তাড়িত, অনুক্ষণ নিজের মুদ্রাদোষে ভাবনালগ্ন। কোনো নারীর সঙ্গে একাট্টা গাঁটছড়া বাঁধতে সে বিশ্বাসী নয়। আবার এমনও নয় যে সে ভীত, বিশেষ কোনো কারণে, নারীর সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপনে। এমনও নয় যে তথাকথিত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রোটোটিপিক্যাল্ চরিত্রের প্রতিভূ সে। একেবারেই আত্মনিমজ্জিত স্বভাবের অনুবর্তী রেখে ক্যারেক্টারটাকে খেলিয়েছেন ত্রুফো। ম্যুভি দেখে ওঠার অনেক অনেক দিন পরে এর স্রষ্টা ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর পূর্ণাঙ্গ জীবনবৃত্তান্ত যখন জানবেন আপনি, তখন এই সিনেমার পাঠ অন্য আলোয় অবলোকন করতে পারবেন, এবং বুঝতে পারবেন এই নির্মাতার গোটা-পঁচিশেক ম্যুভির মধ্যে অটোবায়োগ্র্যাফিক্ রেফ্রেন্সেস্ কীভাবে একীভূত হয়েছে আগাগোড়া। কাজেই ফিজিক্যালি না-হলেও মনের দিক থেকে ক্যারেক্টারটা সাধারণদৃষ্ট সংসারের ভাতমাংশগ্রস্ত জবরজং জবুথবু লোক নয়। এই ধরনের ক্যারেক্টার পেলে আপনি অ্যান্যালিসিস্ করার আয়াসে না-যেয়ে নর্ম্যালি বিশেষণ বসায়ে পগারপার হতে চান, বিশেষণটা সাধারণত ডিস্টার্বড বা মনোবিকলনগ্রস্ত ইত্যাদি হয়ে থাকে। ব্যাপারটা অত সোজা না মনে হয়। মানুষবিচার বা ক্যারেক্টারবিচার নানাভাবেই হতে পারে, নানাবিধ তরিকা আছে বিচারবিবেচনার, এর মধ্যে বিশেষণ ঠুকে মামলা খালাস করার ন্যায় রিডিক্যুলাস্ কারবার দ্বিতীয়টি হয় না। ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর জীবন ও সিনেমা যারা জানেন, তারা তো কথাটা মানবেনই। ভিশ্যুয়্যাল্ জর্নাল্ বলতে যে-একটা ধাঁচ, সেই ধাঁচে থেকে এই সিনেমা আপনাকে ঘুরিয়ে আনবে বহু ধাঁধার গোলকধাম। অটোবায়োগ্র্যাফিক্ মেমোয়ার বুঝি সিনেমাটা? হ্যাঁ, তা-ই, এবং তা ছাড়িয়ে যাওয়া কাজ। যদিও পরিচালক বলেন নাই যে এইটা তার আত্মজীবনী, ক্রিটিকবৃন্দ বলেছেন, আমরাও ত্রুফোর জীবনতথ্য জেনে ব্যাপারটা আমলে নিয়েছি, কিন্তু ত্রুফোর ম্যুভিগুলোতে টেক্নিক্ ও টেক্সচারের দিক থেকে বেশকিছু মোটিফ ঘুরেফিরে আসতে দেখে এইটা আর বুঝতে বাকি থাকে না যে আত্মজৈবনিকতা তার অভিপ্রেত কৌশল একটা।
বার্টান্ড মোরান্ নামের এক ক্যারেক্টার ঘিরেই সিনেমাখ্যান আবর্তিত। মোরানেরই জবানে ন্যারেটিভ গড়ে উঠেছে এবং আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত গড়িয়েছে। একেবারে শুরুতে এবং শেষে জ্যেনেভিয়্যেভ নামের এক নারীর স্বর আমরা শুনতে পাই, যিনি সিনেমাটায় শুরুতেই-মৃত মোরানের সঙ্গে আমাদিগেরে ইন্ট্রোডিউস্ করিয়ে দিচ্ছেন, জ্যেনেভিয়্যেভ আসলে মোরানের প্রকাশিতব্য উপন্যাসের/আত্মজীবনীর প্রকাশক এবং বলা বাহুল্য অবধারিত অন্যতম প্রণয়িনীও। বস্তুত উপন্যাসটার বাক্যগুলোই পড়ে যাই আমরা বুঁদ হয়ে গোটা ছায়াছবি জুড়ে এবং দেখে যাই জীবনের প্রথম উপন্যাস লিখতে যেয়ে একজন লেখকের দিবারাত্র লড়াই। টাইপরাইটারের মাধ্যমে প্রণীত জীবনও তো জৈবিক প্রক্রিয়ায় প্রসূত জীবনের সমতুল্য জীবন্ত, কথাটা আপনি স্বীকার করবেন সিনেমাটার সঙ্গে যেতে যেতে। এমনিতে একদম ভূতগ্রস্ত লোকের ন্যায় মোরানকে নিজের উপন্যাস/আত্মজৈবনিকী লিখে যেতে দেখা যায় সিনেমা জুড়ে এবং অভিযাত্রীর মতো আমরাও মোরানের লিখনাভিযানে শরিক হয়ে যাই নিমেষে।
এমন মোটেও নয় যে মোরান্ বিকারগ্রস্ত, বরং মোরানের মতো মনোলগ্ন মগ্নচৈতন্য ভাবুক ও বিবেচক কমই দেখা যায় সংসারে। এমনও নয় যে সে ক্যাসানোভা বা ডন্ জোয়ান্। এইটা ছায়াছবির শেষের দিকে একটা জায়গায় একজনের মুখ দিয়া বলানোও হয়েছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে। সে আসলে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে জীবনটাকে দেখে ফেরে। এইটা দারুণ সুন্দর ও বিশ্বস্তভাবে এই সিনেমায় এসেছে, এই বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারটা। ক্যারেক্টারের লেখকবৃত্তি নিয়োজন গোটা ব্যাপারটাকে অধিকতর বিশ্বাস্য করে তুলতে কাজ দিয়েছে। এবং সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ব্যাপার যেইটা আমার কাছে, এই সিনেমার আখ্যানভাগ কমিক্ ও মজা-মৌজে পর্যবসিত হবার সমূহ আশঙ্কা সত্ত্বেও হয়েছে ঠিক উল্টো, অদ্ভুত বিষাদে ছেয়ে ফেলে আপনাকে, এবং ব্যাপারটা কাহিনির শুরু থেকেই বিস্তার করতে থাকে তার ছায়া। ভাবালুতাহীন বিষাদছায়া।
বার্টান্ড মোরান্ নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হয় তাদের পা দেখে। পায়ের ছন্দ ও বিভঙ্গ ঘিরে এই সিনেমায় যেন দর্শনানুশীলন করে গেছেন ত্রুফো ম্যুভির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কত কত উদ্ধৃতিযোগ্য পঙক্তি সিনেমায় ছড়ানো! কতকিছুর সঙ্গে পায়ের তুলনা টানা হয়েছে, এবং অসাধারণ তুলনাগুলো। কম্পাসের সঙ্গে তুলনা টেনে যেমন বলা হয়েছে, নারীদের পা হচ্ছে সেই কম্পাস্ যেটি পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখে ঘূর্ণনরত এবং নারীদের পদযুগলই পৃথিবীকে ছন্দে বেঁধে রাখে এবং অর্কেস্ট্রা ও ব্যালেন্স রক্ষা করে। সে নারীদের হাঁটার সময় রাস্তাঘাটে, রেস্তোরাঁয়, উদ্যানে ও ময়দানে তাদের পায়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখে। পা দেখেই সে ভেবে নেয় সেই নারীদের মানসিক পরিস্থিতি। প্রায়শ মিলে যায় তার আন্দাজ, কখনো কখনো মেলেও না অবশ্য। পদযুগল দেখেই সে প্রমীলাদের প্রতি নিমগ্ন হয়। হাঁটা দেখে সে হন্যে খুঁজে ফেরে সেই বিশেষ হন্টনভঙ্গিমার নারীটিকে, পেয়েও যায় এবং যৌথ সম্মতিতে তারা পালঙ্ক পর্যন্ত এগিয়ে যায়। একটুও আপত্তিকর বা অশ্লীল নয় এর প্রকাশভঙ্গি, ইশারা বা অভিব্যক্তি কিচ্ছুটি নয় বেফায়দা বাঁদরামিভরা, বিস্ময়ের সীমা ছাড়িয়ে যায় এই ব্যাপারটা আবিষ্কার করে।
ক্যারেক্টারটা কাহিনির/সিনেমার শুরু থেকেই নিজের জীবন নিয়ে, অ্যাকচুয়্যালি তার জীবনের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারীসংসর্গ নিয়ে, একখানি কিতাব/বই লিখে চলে পুরো ম্যুভি জুড়ে। এই সিনেমার ভিতরে বই লিখনের ব্যাপারটা আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য ও সসম্ভ্রম করে তুলেছে সিনেমাটাকে। শেষমেশ লোকটা তো মারাই যায়, মৃত্যুদৃশ্য দিয়েই সিনেমা শুরু এবং শেষেও তা-ই, আমরা কাহিনিটাকে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখতে থাকি আগুপিছু। মোরানের বইটা ছাপা হয় অবশেষে মৃত্যুর পর। উপন্যাস হিশেবে বইটা ছাপা হলেও আমরা তো ততক্ষণে জেনে গেছি যে এইটা তার আত্মজীবনের উল্লেখযোগ্যাংশ। প্রকাশকগৃহ থেকে একাধিকবার বইটার ম্যানাস্ক্রিপ্ট প্রত্যাখ্যাত হয়, এবং সেই-সমস্ত প্রত্যাখ্যানঘটনাগুলোও সবিস্তারে দেখে ফেলে আমরা আমাদের জীবনের কমিক্ ও মেকি দিকগুলো নিয়া ভাবিতও হই না এমন নয়। অ্যাট লাস্ট নামজাদা পাব্লিশার-কাম্-প্রেমিকা মাদাম্ জ্যেভেনিয়্যেভের আত্মোপলব্ধির বদৌলতে বইটা বাজারের কাচঘরে শোভা পেতে থাকে। দুর্দান্ত সিনেমাভিযান। যথাপূর্ব, ত্রুফোর অন্যান্য অধিকাংশ সিনেমার মতো, সংলাপভিত্তিক। তবু যেন, সংলাপভিত্তিক হয়েও, রুদ্ধশ্বাস থ্রিলার আদ্যোপান্ত।
‘দ্য ম্যান্ হু ল্যভড উওমেন্’ (The Man Who Loved Women) ম্যুভিটা তার ফ্রেঞ্চ নামের ইংরেজি ভাষান্তরে হবার কথা ‘দ্য স্কার্টচেজার’, কিন্তু তা হয়নি নানা কারণে, সেই কারণগুলোও কৌতূহলোদ্দীপক আলোচনার যোগ্য, যদিও বর্তমান নিবন্ধে ব্যাপারটা না-ঘাঁটাই আর। আমরা এ-ও অচিরে জেনেছি যে এই ফিল্মের বিষাদগ্রস্ত সুরের আচ্ছন্নতার কারণে এর ইংরেজি সাবটাইট্যল্ রিলিজের সময় ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো নাম পাল্টে রাখতে চেয়েছিলেন ‘দ্য ম্যান্ হু ওয়্যজ্ অ্যাফ্রেইড অফ উওমেন্’; ইন্ট্রেস্টিং না ব্যাপারটা?
ছায়াছবিটার শ্রেষ্ঠাংশে চার্লস্ ডেন্যার অভিনয় করেছেন অবিস্মরণীয়। অনেক নারী অভিনয়শিল্পীর মধ্যে কেন্দ্রীয় সময় জুড়ে থেকেছেন ব্রেজিত ফ্যসি। পাক্কা দুইঘণ্টা ব্যাপ্তিকালের ম্যুভিটি রিলিজ্ হয়েছে ১৯৭৭ সনে। ফ্রেঞ্চ ল্যাঙ্গুয়েজে এর সংলাপগুলো প্যজ্ দিয়ে দিয়ে সাবটাইট্যল্ দেখে দেখে এগোতে একটুও ক্লান্তিকর মনে হয় না আপনার কাছে, এ এমনই এক বিস্ময়সিনেমা। ফ্রাঁসোয়ার বেশিরভাগ সিনেমার মতো এইটারও স্ক্রিপ্ট ত্রুফো সহ মোট তিনজন রাইটারের রচনা। বাকিদ্বয়ের নামধাম, কলাকুশলী অন্য সকলেরও, উইকিতেই পেয়ে যাওয়া যায়; বেশি কিছুই কিন্তু ঢুন্ডতে হয় না আজকাল। ত্রুফোম্যুভি নিয়া হাজারেবিজারে স্কলার্লি বিদ্যাবোধিনী ক্লিকদূরেই বিরাজিছে নেটের প্রকাশ্য সুগম সড়কে।
Film Title: The Man Who Loved Women ।। Released Year: 2077 ।। Genre: Comedy/drama ।। Duration: 120 min ।। IMDb Score: 7.5/10 ।। Director: François Truffaut ।। Stars: Charles Denner, Brigitte Fossey ।। Music Score: Maurice Jaubert ।। Net profit approximately $ 7.2 million
লেখা : জাহেদ আহমদ
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS