ছিলেন দুঁদে এক ডিপ্লোম্যাট। কুরুক্ষেত্র সংঘটনকালে এবং এর আগে-পরে অ্যাভেইল করা যায় তার ক্যারিশম্যাটিক ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য নিদর্শনগুলো। পোলিটিক্স বুঝতেন ভালো। কৌরব-পাণ্ডব উভয়কূলেই তিনি ফিলোসোফারের ভূমিকায় অ্যাক্ট করেছেন। রয়েছে এর বাইরে এন্তার বিচিত্র ভূমিকা তার। ড্রাইভ করতেন দারুণ। ড্রিঙ্ক করতেন কি না আপাতত অবান্তর কোয়েশ্চন। কুরুক্ষেত্রের ব্যাটলফিল্ডে অর্জুনের রথচালকের কাজটা দায়িত্ব নিয়েই করেছেন তিনি। বিশেষ একটা স্টাইলে ড্যান্সম্যুভসমেত চলাফেরা করতেন। কস্টিউমসেন্স ছিল অসাধারণ। রমণীমোহন মুচকি স্মাইলের জন্য জগদ্বিখ্যাত। অত্যন্ত সপ্রতিভ। তবে টেলিভিশনের টকশোগুলো যথাসম্ভব এড়ায়ে চলতেন সবসময়। জেনানাদের সামনে যেন উৎসমুখবিস্ফারিত কথার ফোয়ারা। নারীদের একচেটিয়া আদর-সোহাগ লভেছেন জিন্দেগিভর। পুরুষদেরও। সম ছিলেন, নাকি উভ, সন্দেহ রইলেও ষোলোশত মতান্তরে ষোলোসহস্রাধিক বান্ধবী ছিল তার শোনা যায়। ডন জিয়োভ্যানির চেয়েও ক্ষমতাধর ছিলেন সিডিউসিং স্কিলের দিক থেকে। এসবের পেছনে পাপারাৎসিদের কারসাজিও থাকতে পারে বলে তথ্যসূত্রসচেতন মহলের অনেকেই মনে করেন।
তবে যে-ব্যাপারে সন্দেহ নাই তা এ-ই যে তিনি বাঁশি বাজাইতেন। উদান নাই মাদান নাই দিবারাত্র টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স সুরের ঘোরে মত্ত রইতেন। গোচারণপ্রান্তরে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াইতেন। দুইফরবেলায় গাঙপারে যেয়ে একটা-কোনো গাছের ডাল বেছে নিয়ে উঠে পড়তেন এবং গভীর মনোযোগে নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে অধ্যয়ন করতেন। ফিগ্যারেটিভ স্টাডি নিয়াই দিনরাইত ব্যস্ত রইতেন। মোটামুটি কৃতি শিক্ষার্থীই ছিলেন বলা যায়। লাম্-সাম্ ক্যাল্কুলেশনেও গোপিনীর/কুঞ্জবালাদের কোয়ান্টিটি থেকে উনার অর্জন-অ্যাচিভমেন্ট সম্পর্কে একটা আইডিয়া পাওয়া যায়। কামেল আদমি ছিলেন। গোসলকালে ফিমেইল ড্রেসেস্ এবং এক্সেস্যরিস্ হাতাইতে যেয়ে বহুবার হাতেনাতে ধৃত হয়েছেন। বখে যেতে যেতে নারীদেরই নিত্য প্রযতনে ফের ভালো হয়ে উঠেছেন। লভেছেন লর্ডের খ্যাতি।
তিনি কৃষ্ণ। বসুদেব এবং দেবকীর অষ্টম সন্তান। নন্দ নামেই ছিলেন মশহুর ছেলেবেলায়। ডাকনাম আছে আরও কয়েকটা। মায়ের ন্যাওটা ডানপিটে ননীচোর। চুরির অভ্যাসটা যায় নাই জিন্দেগির ইয়া লাম্বা সফরেও। চুরি করেছেন বহু কুমারী ও ভার্যার মন। চুরি করে চলেছেন আজও। শৈশব-কৈশোর কেটেছে বৃন্দাবনে। এরপর গোকুলে, দ্বারকায়; এখন তো উনার শানশওকাত অনেক, ব্যাপক, দুনিয়ার বহু দেশে রয়েছে উনার বিলাসবহুল প্যালেস্। যুদ্ধজঙ্গের নৈতিকতা নিয়া আলাপচক্রে উনার পাঠক্রম স্কিপ্ করার উপায় নাই। কিন্তু সবচেয়ে বেশি স্মৃত হন তিনি বিপন্ন প্রণয়িনী ও প্রণয়ার্থীদিগের কাছে, সম্ভবত, পেটরোগা প্রেমিকের বালামুসিবতে তিনি স্মৃত হয়ে চলেছেন যুগে যুগে বৈদ্যুতিক পাখার মতো পুনঃপুনঃ ঘূর্ণনে।
এই ভদ্রলোকের জন্মদিন আজকে। হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার কৃষ্ণ! হ্যাপি বার্থডে টু য়্যু! গোপবালাদের গুঞ্জরনে আজি বৃন্দাবন মধুমুখরিত। ননী, মাখন, ছানা, আমৃত্তি, জিলিপি, ফির্নি, বাতাসা, পায়েস ইত্যাদি জিভরোচক খাবারে উপচে-ওঠা ডাইনিং স্পেস্। চন্দনে আর আতর-গোলাপে মৌ-মৌ কুঞ্জও প্রস্তুত। জন্মাষ্টমী বলে কথা। বাকিটা ঠাকুরের মর্জি।
কৃষ্ণের জন্মদিনে দেওয়ানা মাস্তানা হয়ে জিকির বা নামগান জপ করবার লোকের তো অভাব নাই। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে … বা, বাংলায় এমনও বলা যায়, হিরো কৃষ্ণ হিরো কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হিরো হিরো। উনি হিরো অবশ্যই, আগা থেকে গোড়া, আজোব্দি, কিন্তু উনার মধ্যে যে একেবারেই ভিলেইনি নাই তা বলা সাধ্যাতীত। অস্বাভাবিক নয় যে মানুষের স্খলনগুলোই অবতারদের মধ্যে থাকে। কেবল নামকীর্তনকালে দেবতা-অবতারদিগের ভ্রান্তিবিচ্যুতিগুলিও উঁচা নজরে দেখা হয়। ব্যাপক গ্লোরিফাই করা হয় দেবদ্বিজের ভিলেইনি-বদমাইশি। নিশ্চয় সেসব নিয়া ভাবনাভাবনির লোকের আকাল অন্তত একবিংশে নাই, ছিল না আগেও, জন্মদিনে সেসব নিয়া গান গাইলে প্রেমিক-প্রেমিকাদের বুরা লাগবে নিশ্চয়।
কৃষ্ণপ্রভাবের চিহ্ন তো বাংলার সাহিত্যে রয়েছেই। মিউজিকে রয়েছে। পেইন্টিঙে। এবং কোথায় নয়? ড্যান্সে একটা আশ্চর্য প্রভাব লক্ষ করব, মুদ্রায়, বিশেষত পুরুষ ড্যান্সারদের বিলোলিত শরীরী বিভঙ্গি ও নর্তনমুদ্রায়। ইন্ট্রেস্টিং যে এই বিলোল বিভঙ্গিটা আমরা দেখি না-পুরুষ না-নারী মানুষদের মাঝে। এবং অত্যন্ত স্ট্রং একটা ডায়মেনশন নিয়া হাজির হয় এইটা সাম্প্রতিক সেলেবদের মধ্যে একজনের উদাহরণ যখন ভাবি। ঋতুপর্ণ ঘোষ। এইগুলা ভাবায়। ডিকশ্যনারিতে দেখব কন্দর্পকান্তি, কৃষ্ণকান্তি, ক্যালানে কাত্তিক ইত্যাদি শব্দগুলো ভুক্তিগুলো। তবে বাংলায় নাচের লোকগুলার মধ্যে, মেইল ড্যান্সারদের মধ্যে, এই জিনিশটা এতই দৃষ্টিকটু ও ফেইক যে ইরিটেইট করে আমাদেরে। যেইটা ভাবা যায় তা এ-ই যে, এমন ধরনে জেশ্চারবহুল বডিম্যুভমেন্টের কৃষ্ণাবয়বের ভাবনাটা গ্রো করল কবে থেকে এবং কেমন করে এবং কেন? খুবই হিম্মতওয়ালা ব্যাপার বাইর করা যাবে এই চ্যানেলে ভেবে গেলে। অ্যানিওয়ে। অ্যাভেইলেবল পুরুষ বা নারী নয়, কৃষ্ণ যে একটা ডিফ্রেন্ট এন্টিটি প্রচলিত নারী-পুরুষ পরিচয়বাজারে, এইটা বোঝা যায় এখন পর্যন্ত কৃষ্ণের সমস্ত হাজিরায়। শিল্পে এবং দৈনন্দিনে। পিটার ব্রুক্সের দি মাহাভারাতায় কিংবা ইসকন বা রামকৃষ্ণ মঠের পাণ্ডা-সেবাইতদের চলাফেরায় হাবেভাবে।
বলা হয়ে থাকে কৃষ্ণের পরিচায়ক প্রধান অস্ত্র ‘সুদর্শন চক্র’। তবে, এইটাও অগ্রাহ্য করবার মতো নয় যে, কেষ্টঠাকুর তথা লর্ড কৃষ্ণের মুখ্য উয়েপ্যন্ বাঁশি। কথিত যুদ্ধাস্ত্র ‘সুদর্শন চক্র’ গরহাজির আজ, যেমন ডাইনোসোরাস্, বাঁশি কিন্তু বিরাজিছে। এবং আশার, অথবা আশঙ্কার, কথা হচ্ছে এ-ই যে বাঁশি বাড়ছে। এই আশঙ্কাটা বাঁশিভীত কন্যাবৎসল পিতামাতাদের, প্রেমের সুরে লেলিহান উনাদিগের উন্মাদ পূর্বজন্ম স্মরণে; আশঙ্কা আমাদের নয়, আশঙ্কা আমাদের নাই, বাঁশিসুরে খেলা করে একটা আবিলতাহীন জগজ্জোড়া আশা।
লেখা / জাহেদ আহমদ
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS