কবি কিহোতে || ফজলুররহমান বাবুল

কবি কিহোতে || ফজলুররহমান বাবুল

বারবার বলতে চাই, কবিতা জীবনের উৎসারণ — কথাটি বহুল ব্যবহারে ক্লিশে হতে পারে, তবে এর মর্মার্থ চিরকালের। যাপিত জীবনের নানান অভিজ্ঞতা নতুন করে দেখার উদ্দীপনা থেকে কবিতা। কবিতার পঙক্তিমালায় নানান গুণ থাকে বলে লোকে আজও কবিতা পড়ে, উপলব্ধি বা উপভোগ করে। কবিতা কমবেশি আত্মজৈবনিক হওয়া সত্ত্বেও পাঠক সেখানে নিজের জীবনের আভাস দেখতে পায়। অনেক সময় কবির বলা কথার সঙ্গে পাঠকের অনুভূতি মিলে যায়, কখনও-বা মিলে না, তবে এই বেমিল পাঠককে নতুন অনুভবে সিক্ত হতে প্ররোচিত করে এবং জীবনে সেটার মূল্য কম নয়।

অন্যের অনুভবকে নিজের অনুভবের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করার দুঃসাহস কবিকে সমাজের কাছে আদরের করে রাখে; যে-কারণে কবিতা আত্মজৈবনিক চরিত্র ধারণ করলেও লোকসমাজে কবি ও কবিতার কদর এখনও উঠে যায়নি।

জীবনকে দেখার অভিজ্ঞতা কবিদের একরকম হয় না; সেখানে অনেক প্রভেদ থাকে; উপলব্ধি, কল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে বিরোধ ঘটে; কিন্তু দিনশেষে সব প্রভেদ জীবনস্রোতের অংশরূপে কবিতায় জায়গা করে নেয়। কবি সন্ন্যাসী নয়। কবির একটি সামাজিক জীবন রয়েছে, সেখানে তাকে সংসারের চাকায় কলুর বলদ হয়ে ঘুরতে হয়। এই শৃঙ্খল তাকে যে অনুভূতির সামনে দাঁড় করায় সেটা প্রকাশ করতে গিয়ে কবি ভাষার ব্যাকরণসিদ্ধ সীমানাটি অতিক্রম করে। এই অতিক্রমণের নাম হতে পারে কল্পনা। কবি নিজের যাপিত সময়ের সমান্তরালে এমন এক জীবনের স্বপ্ন দেখে যেখানে সে একা ও সার্বভৌম।

জীবনকে মোকাবিলার প্রশ্নে কবিতা হচ্ছে কবির আপসহীন স্বেচ্ছাচারিতা। এই স্বেচ্ছাচারিতা যাদের আগ্রহী করে তারা কবিতার পাঠক হয়ে ওঠে। প্রশ্ন অবশ্য থাকে, প্রশ্ন থেকে যায় — এটা কি জীবন থেকে কবির নিষ্ক্রমণ নয়? জীবনের ভালো ও মন্দকে ভাষার মোড়কে অচিন ও রঙিন করা নয়? নিয়মবদ্ধ জীবনে বিপর্যয় ঘটানোর জন্যই কি তবে কবিতা?

এইসব প্রশ্নের উত্তর আসলে এক-কথায় হয় না। কবিও কূটতর্কে নিজেকে সচরাচর বন্দি করতে চায় না। এর পরিবর্তে নতুন একটি কবিতা লিখে প্রশ্নের সদুত্তর দিতে চেষ্টা করে। কবি হচ্ছে ডন কিহোতে। নিজের জীবনের রকমারি হাস্যকর অসঙ্গতির সঙ্গে লড়বে বলে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়। নিজের স্কন্ধে যে জীবনের বোঝা সে টানে তাকে মাঝেমধ্যে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়। এ-রকম মনে হয়, কেউ ঘাড়ে ধরে কবিকে সেটা টেনে নিতে বাধ্য করছে। জীবন এমন এক প্রতিপক্ষ যার সঙ্গে বাস্তবে লড়াই করা খুব কঠিন। তবে কল্পনায় ততটা নয়। সুতরাং কবির ঘাড়ে ডন কিহোতের ভূত সবার আগে চেপে বসে। ওর মতো ঘোড়ায় চড়ে কবিও কাল্পনিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করে। আসলে নিজের সঙ্গে নিজেই লড়ে!

মানুষ ক্রমাগত যুদ্ধ করে তার নিজের বানানো ছায়ার সঙ্গে। না ঈশ্বর না শয়তান, কেউ তাকে এর সঙ্গে যুক্ত করেনি। সে নিজের কর্মদোষে ঈশ্বর ও শয়তান হয়ে উঠতে থাকে। যে-জীবনকে সে যাপন করে সেটা তার নিজ হাতে গড়া এবং সেটাই আবার তার কাছে ছায়াবাজির খেল। কবি নিজের ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে। লড়াইয়ে কবির সম্বল কল্পনা বা ভাষার ছায়াবাজি। কবির জন্য কল্পনা হচ্ছে সেই উঁচু পাহাড় যেখানে সে জন্মের পর থেকে ওঠার চেষ্টা করছে এবং ভবিষ্যতেও এই চেষ্টা জারি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। যতদিন মানুষ নিজেকে ছায়াবাজির নায়ক করতে থাকবে ততদিন কবিতার ছায়াবাজিও চলবে। তাই, আমরা বলি — কবিতার দিন শেষ হচ্ছে না।

ছায়ামানবের জীবনে কবিতার ছায়াবাজির উপযোগিতা রয়েছে কারণ এটা জীবনের সীমানা অতিক্রম করে নতুন কিছু বলার চেষ্টা করে। জীবন তার বৈচিত্র্য সত্ত্বেও মোটের উপর একঘেয়ে ছন্দে বাঁধা। কবিতা সেখানে নতুনত্ব আনার জন্য উদ্বিগ্ন হয়। এই উদ্বেগ ছাড়া জীবনের মরা গাঙে জোয়ার আসে না। সেই জোয়ার আনার লক্ষ্যে কবি কবিতার রথ ছোটায়। এক প্রবল আত্মবিশ্বাস ও ঘোর তাকে চালিত করে। সে জানে বাস্তবের মানুষ হিশেবে তার জীবন কতভাবে সীমাবদ্ধ! কিন্তু কবিতার জগতে পা রাখার পর নিজেকে অন্য মানুষ মনে হয়। কবিতা হচ্ছে কবির স্বীকারোক্তি। এই স্বীকারোক্তি মনকে নাড়া দিয়ে যায় বলে লোকে এখনও কবিতা পড়ে।


গানপারে ফজলুররহমান বাবুল

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you