সাক্ষাৎকারে হেলাল হাফিজ || সরোজ মোস্তফা

সাক্ষাৎকারে হেলাল হাফিজ || সরোজ মোস্তফা

উনসত্তুরের অনিবার্য উত্তাপে জাগ্রত ভাষার সহজ ও সহজাত পঙক্তিমালা নিয়ে বাংলা কবিতায় হাজির হয়েছেন কবি হেলাল হাফিজ। প্রেম-দ্রোহের শিল্পস্নাত ভাষায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অগ্নি ও মুমূর্ষু রূপকে কাব্যে রূপায়িত করেছেন তিনি। কালকে যিনি ধারণ করেন, তিনিই প্রকৃত কবি। ‘যে জ্বলে আগুন জ্বলে’ — প্রেম ও দ্রোহের বর্ণমালা।

১৯৪৮ সালের ৭ অক্টোবর নেত্রকোণায় জন্ম নেয়া কবির আজ ৭৫তম জন্মদিন। কবির জন্মদিন উপলক্ষে ‘হিমু পাঠক আড্ডা’-র উদ্যোগে নেত্রকোণা দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক অসাধারণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। মূলত সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী, হিমু পাঠক আড্ডার সত্ত্বাধিকারী আলপনা বেগমের উদ্যোগে আয়োজিত কবির জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নেত্রকোণার সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে কবির প্রতি শ্রদ্ধা ও অর্ঘ্য নিবেদন করেন।

এরও আগে নবমীর রাতে কবি হেলাল হাফিজের সাথে ফোনে দীর্ঘক্ষণ কথা হয়। আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন তানভীর হায়াত খানকে বলেছিলাম হাসপাতালে কবির কেবিনে গিয়ে ফোন ধরিয়ে দেয়ার জন্য। কবি হেলাল হাফিজও তানভীরকে খুবই পছন্দ করেন। তানভীরের উপস্থিতিতে প্রেমমুগ্ধ হয়ে কবিও অত্যন্ত আন্তরিকতায় কথা বলতে শুরু করলেন।

সাক্ষাৎকারটি এই ফোনালাপের পরিমার্জিত রূপ।


“যে-বেদনা মানুষকে নান্দনিক করে সে-বেদনা আমি পেয়েছি… ”
সাক্ষাৎকারে হেলাল হাফিজ || সাক্ষাৎকার গ্রহণ ও গ্রন্থন : সরোজ মোস্তফা


কেমুন আছেন প্রিয় কবি?
পিজি হাসপাতালের ৬০৩ রুমে আছি। বেলা তো অনেক হলো। চোখ ভালো না, কিডনি ভালো না। তবু বলি ভালো আছি। হাসপাতালের সাদা বিছানায় ভালোই আছি। তোমাদের সাথে আবারও দেখা হবে।

আগামী শুক্রবার (৭ অক্টোবর) নেত্রকোণার দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে হিমু পাঠক আড্ডাউদ্যোগে আপনার ৭৫তম জন্মদিন উদযাপন করা হবে।
জীবনকে আমরা খুব ভালোবাসি। জন্মদিনের আয়োজন করে মানুষ সেই জীবনেই অভিনন্দিত করে। শুনে খুব ভালো লাগল দত্ত উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এই আয়োজন হচ্ছে। আমি এই স্কুলের ছাত্র। আমি নেত্রকোণা কলেজেরও ছাত্র। আমি হিমু পাঠক আড্ডাকে ধন্যবাদ জানাই।

নেত্রকোণার প্রতি কোনো বিশেষ অভিমান কি আপনার আছে? নেত্রকোণায় আপনি আসেন না কেন? সর্বশেষ নেত্রকোণা সাহিত্য সমাজের অনুষ্ঠানে খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার  গ্রহণ করতে এসেছিলেন। পরে আর আসেননি।
অনেকদিন আসা হয় না। এই না আসায় বিশেষ কোনো অভিমানও নেই। নেত্রকোণাকে আমি খুব ভালোবাসি। কী সুন্দর মগড়া নদী! অভিমান হয়তো আছে। জন্মভূমি তো মা। মায়ের সাথে সন্তানের অভিমান তো থাকতেই পারে। খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার  গ্রহণের পর আর নেত্রকোণা যাইনি এ-কথা সত্যি। কিন্তু চোখ বন্ধ করে আমি বোন নেত্রকোণাকেই দেখতে পাই। আমি নেত্রকোণাকে বোন বলে সম্বোধন করেছি। নেত্রকোণাকে অন্তরের কোথায় রেখেছি বুঝতে পেরেছ। আমার লেখা পুরো কবিতাটা পড়বে, তাহলে নেত্রকোণাকে ঠিক ঠিক চিনতে পারবে।

(কবি তাঁর নেত্রকোণা  কবিতাটি পড়ে নিতে বললেন) …

নেত্রকোণা
কতদিন তোমাকে দেখি না
তুমি ভালো আছো? সুখে আছো? বোন নেত্রকোণা!

আমাকে কি চিনতে পেরেছো?
আমি ছিলাম তোমার এক আদরের নাগরিক নিকট-আত্মীয়
আমাদের বড়ো বেশি মাখামাখি ছিল,
তারপর কী থেকে কী হলো
আভাইগা কপাল শুধু বিচ্ছেদের বিষে নীল হলো।

দোহাই লক্ষ্মী মেয়ে কোনোদিন জিজ্ঞেস করো না
আমি কেন এমন হলাম জানতে চেয়ো না
কী এমন অভিমানে আমাদের এত ব্যবধান,
কতটা কষ্ট নিয়ে আমি ছিমছাম সন্ন্যাসী হলাম!

কিছু কথা অকথিত থেকে যায়
বেদনার সব কথা মানুষ বলে না,
রমণীকাতর সবিতা সেনের সূতি শাড়িও জানে না
সোনালি অনল
আর কত জল দিদির ভেতর।

কেউ কি তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে প্রাঙ্গণে?
কারো কি তোলপাড় ওঠে ট্রেনের হুইসেল শুনে মনে?
তোমার মাটির রসে পরিপুষ্ট বৃক্ষ ফুল
মগড়ার ক্ষীণ কলরোল
অমল কোমল এক মানুষের প্রতীক্ষায় থাক বা না থাক,
তুমি আছো আমার মজ্জায় আর মগজের কোষে অনুক্ষণ,
যে-রকম ক্যামোফ্লাজ করে খুব ওতোপ্রোতভাবে থাকে
জীবনের পাশাপাশি অদ্ভুত মরণ।
২৫.১১.৮১

 আপনার পিতা খোরশেদ আলী তালুকদার সাহেব সুসাহিত্যিক ছিলেন। আপনার লেখালেখির ক্ষেত্রে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিল?
আমার পিতা খোরশেদ আলী তালুকদার খুবই বিখ্যাত মানুষ ছিলেন। তিনি মাথায় পাগড়ি বেঁধে চলাফেরা করতেন। এইজন্য লোকজন তাঁকে পাগড়িওয়ালা স্যার সম্বোধন করতেন। পিতার ব্যক্তিত্ব আমাকে অবশ্যই আকর্ষণ করেছে। আমি ছিলাম খেলাধুলার মানুষ। সব ধরনের খেলাধুলাই আমি করেছি। একসময় সব ধরনের খেলাধুলা রেখে লেখালেখিতে ফিরেছি। আব্বাকে মানুষ খুব শ্রদ্ধা করে, মান্য করে, এই বিষয়টি আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিল। শুধু শিক্ষক নয় লেখক হিসেবেও তিনি সমাজে শ্রদ্ধেয় ছিলেন। আব্বার এই ব্যক্তিত্ব আমাকে অবশ্যই প্রভাবিত করেছে।

 আপনার এই নেত্রকোণা  কবিতায় সবিতা সেন নামে বিশেষ এক নারী চরিত্রের নাম পাওয়া যায়। তিনি কে? আপনার কাব্য ও কবিত্বে কীভাবে আছেন তিনি?
তাঁর কথা আমি কবিতায় লিখেছি। নতুন করে আর বলার কি আছে। কোনো-একজন মানুষ এককভাবে কারো কাব্য ও কবিত্বকে প্রভাবিত করতে পারে বলে আমি মনে করি না। তিনি আমার কাব্যের নায়িকা। তিনি আমার মিস্ট্রেস। আমি প্রথম প্রেমে পড়ি সবিতা মিস্ট্রেসের। আমার থেকে বারো-তেরো বছরের বড় ছিলেন। তাঁকে দেখলেই আমার মায়ের মতো মনে হতো। তিনি অসম্ভব আদর-যত্ন করতেন। কখনো মনে হতো আমি তাঁর ভাই। কখনো মনে হতো আমি তাঁর ছেলে। কখনো মনে হতো আমি তাঁর প্লেটোনিক প্রেমিক। একটা স্নিগ্ধ-মিষ্টি আবেগের সম্পর্ক ছিল। সবিতাদি খুব সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন। তিনি সবই বুঝতেন। তিনি মাতাহারা এই উদ্দাম বোহেমিয়ান মানুষটিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন। আমার অনেক প্রেমের কবিতার তিনিই তো নায়িকা। তাঁকে কল্পনায় রেখে অনেক কবিতাই আমি লিখেছি।

এই যে সমাজ-মানুষ-বন্ধুত্ব — কোনোকিছুতেই আটকে থাকেননি আপনি। আবার কোথাও চলেও যাননি। স্থির সন্তের মতো এই জীবনটা প্রেসক্লাবে-হোটেলে কাটিয়ে দিলেন।
কারো দেয়া কষ্টকে আমি মনে রাখিনি। জীবন খুব ছোট। ছোট জীবনের কষ্টও ছোট। মানুষের কষ্টকে আমি কবিতায় রূপ দিয়েছি। যে-বেদনা মানুষকে নান্দনিক করে সে-বেদনা আমি পেয়েছি। আমাকে প্রেরণা দেয় বিরহ, আমাকে প্রেরণা দেয় বিচ্ছেদ। আমি শুধু কবিতা লিখতে চেয়েছি। অনেক চাওয়া নিয়ে আমি কখনোই থাকিনি। যত না-পাওয়া, যত তাচ্ছিল্য সবকিছু দিয়ে আমি কবিতা লিখতে চেয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসে। কবি হেলাল হাফিজকে ভালোবাসে।

যদিও ‘কবিতা একাত্তর’ নামে আরও একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তবুও আমার বিবেচনায় ‘যে জলে আগুন জ্বলে’-ই আপনার একমাত্র মৌলিক কাব্যগ্রন্থ। এই একটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আপনি কি তৃপ্ত?
একজন কবির জন্য একটা কাব্যগ্রন্থও অনেক। কাব্যগ্রন্থকে হতে হয় মৌলিক। কবির নিজের একটা জগৎ হাজির থাকবে সেখানে। কবিতার কাছে থাকতে থাকতে আমি কবিতার কাছেই ফিরেছি। সবাই টাকা জমায়, আমি মানুষ জমাতে চেয়েছি।

 ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ? ভবিষ্যতের পাঠক কি এর কবিতাগুলো পড়বে?
আমার কবিতা ভবিষ্যতের পাঠক পড়বে কি পড়বে কি পড়বে না — এই বিষয়ে আমি বলতে পারব না। আমি সময়কে লিখতে পেরেছি। সময়ের মানুষের লড়াইটাকে লিখতে চেয়েছি। আমি বলেছি, ‘নিউটন বোমা বোঝো / মানুষ বোঝো না।’ উত্তাল সময়ের উত্তাপ আমি লিখেছি। মানুষের ভালো লাগলে মানুষ পড়বে। দেশকে, মানুষের চোখের স্বপ্নকে তো মানুষ অস্বীকার করে না। সম্ভব না। তাই মানুষের ভালো লাগলে মানুষ পড়বে আমার কবিতা। খুব কষ্ট হচ্ছে। আর কথা বলতে পারব না। আবার কথা হবে। ঢাকায় এসো।


সরোজ মোস্তফা রচনারাশি
গানপারে অন্যান্য সাক্ষাৎকার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you