গানপারে হুমায়ূন স্মরণে সাজানো লেখাগুলোর (হুমায়ূন স্মরণ ও মূল্যায়ন সংকলন, গানপার ২০২২) কিয়দংশ যথারীতি পূর্বপঠিত, তবে সূচির মাধ্যমে একত্রে পাওয়ায় রিকল-র কাজটা সহজ হয়েছে। লেখাগুলোয় ফের নজর বোলাতে গিয়ে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পাঠকসমাজে হুমায়ূনের অমিত প্রভাবশালী ঘটনায় পরিণত হওয়ার ইতনেতি ভাবনা মনে তরঙ্গ তুলছিল। মধ্যবিত্ত সমাজের যে-বৃত্তে তিনি একচ্ছত্র এর বাইরে ছোট-বড়ো বৃত্ত দেশে বিরাজ করে। সেগুলোর মধ্যে তাঁর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের প্রভাব কতটা কী ইত্যাদি ভাবনা মনে উঁকি দিচ্ছিল। সূচনাদিনের লড়াইয়ে হুমায়ূনের জিতে যাওয়া ও উত্থান স্মরণীয় ঘটনা হলেও দেশের মধ্যবিত্ত পাঠকসমাজের জন্য উত্থানটা আশাজাগানিয়া প্রেরণার সঙ্গে ভয়ানক অভিশাপ হয়ে উঠেছে মনে হয়। প্রেরণার তুলনায় অভিশাপের দিকটা অতিকায় রূপ নিতে যাচ্ছে বলে শঙ্কা করি। বাংলা ভাষার সাহিত্যে হুমায়ূন সত্যিই অসামান্য ঘটনা অথবা সামান্যের দলে তিনি এক অসামান্য লেখক? — প্রশ্নটিকে সততার সঙ্গে বাজিয়ে দেখা প্রয়োজন।
আমরা মধ্যবিত্ত যৌক্তিক কারণে সীমাবদ্ধ জলে সাঁতার কেটে অভ্যস্ত, হুমায়ূন কি সেই সীমাবদ্ধতা পার হয়ে বৃহৎ কোনো কাণ্ড সত্যি ঘটিয়েছেন? সীমাবদ্ধতাকে নিজের সহজাত জীবনবোধ ও মন্ত্রমুগ্ধ ভাষাশৈলী দিয়ে ধারণ করছেন দেখে কি আমরা তাঁকে বৃহৎ ঠাউরে নিচ্ছি? তাঁর প্রখর রসবোধ ও ভাবালুতা কি বাঙালি মধ্যবিত্তের সংসার থেকে পাওয়া? আলগা কিছু কি আরোপ করেছিলেন সেখানে? যার জন্য মধ্যবিত্ত সকাতর প্রতীক্ষায় ছিল এতদিন? হুমায়ূন কি সেক্ষেত্রে আমাদেরকে তাঁর শিকারে পরিণত করেছেন নাকি তিনি স্বয়ং বাঙালি মধ্যবিত্তের সস্তা ভাবলুতার জায়গাগুলো পুরা করতে বসে নিজের প্রতিভা ও মেধার অপচয় ঘটিয়েছেন? আমরা কি তাঁকে হত্যা করেছি অথবা তিনি আমাদেরকে? হুমায়ূন এভাবে বোধ করি বিপজ্জনক প্রপঞ্চেই পরিণত হতে চলেছেন; — তাঁর নিজের জন্য এবং বিপরীতে আমাদের জন্যও বটে!
বাংলাদেশে তাঁর অবিশ্বাস্য পাঠকপ্রিয়তা ওপার বাংলায় গিয়ে হোঁচট খায়! আনন্দবাজার-র পূজো সংখ্যায় টানা আট বছর লিখেও সেখানকার পাঠকমহলে তাঁর ক্রেজ গড়ে ওঠেনি। ওদিকে দেশে ততদিনে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এমন লেখক বলতে গেলে নাই হতে চলেছিল। হুমায়ূনজোয়ারে ওপার বাংলার সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু আর দেশের অগ্রজ লেখকরা সেই যে বাজার হারিয়েছিলেন, তারপর সেটা আর তাঁরা কখনো ফেরত পাননি। দুই বাংলার নাগরিক মধ্যবিত্ত পাঠকসমাজে হুমায়ূন-প্রভাবের এই রকমফের আবার নতুন ভাবনার জন্ম দিয়ে যায়। মেইলে এসব নিয়ে বিস্তারিত হওয়া কঠিন। বড়ো কথা হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যকে বাজারে নিয়ে এলেন, যেটা তাঁর পূর্বসূরী ও সমকালীন লেখকরা করে দেখাতে পারেননি। এমন এক আবহ দেশে জন্ম নিলো যার কল্যাণে বিচিত্র আঙ্গিকে ভাবনা করা ও লেখার চলটা ক্রমশ উবে যেতে শুরু করে! বলা ভালো, হুমায়ূনের সঙ্গে পারা যাচ্ছে না দেখে অন্যরা দম হারিয়ে বেতো ঘোড়ায় পরিণত হতে থাকেন এবং রেশটা আজো কাটেনি। বাংলা কথাসাহিত্যের ভাষা, বিষয়, শৈলী, নিরীক্ষাকে হুমায়ূন তাঁর নিজের মাপে বোতলবন্দি করলেন বলা চলে। বাকি লেখকরা ক্রমশ কমজোর হয়ে পড়ার দোষে এবং ঈর্ষা থেকেও হতে পারে…, প্রথমে তাঁর ব্যাপারে কমবেশি নিস্পৃহতা ও তাচ্ছিল্য দেখালেও পরে অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তায় সিক্ত হুমায়ূনের স্তাবকতায় নিজেকে নিঃস্ব করেছেন দেখতে পাই।
উত্থানের দিনকালে বিরচিত রম্যরচনায় বাঙালি শিক্ষিত পাঠকসমাজের রুশ সাহিত্য নিয়ে মাতামাতিকে হুমায়ূন রসঘন উপহাসে বিদ্ধ করতেন মনে পড়ে। শওকত আলী বা হাসান আজিজুল হকের ধাঁচে যারা লিখতেন তাঁদেরকে মাস্টারি টাইপ শক্ত লেখা ইত্যাদি বলে খোঁচা দিতেন মাঝেমধ্যে। এক নতুন লেখকের আগমন ও পাঠকপ্রিয়তার ঘটনাকে উনারা নীরবতা নয়তো নাকউঁচু মনোভাবে উপেক্ষা করছেন দেখে হুমায়ূন সম্ভবত ক্ষুব্ধই বোধ করতেন তখন। যারপরনাই খোঁচা দিতেন মাঝেসাঝে। সত্যমিথ্যা জানা নেই তবে সেই সময় এই কথাখান চাউর ছিল, — আহমদ ছফাকে নিজের বই উৎসর্গ করতে যেয়ে বেশ বিড়ম্বনা সইতে হয়েছিল তাঁকে। বই হাতে পেয়ে ছফা রাতেই পাঠ শেষ করেন ও পরদিন সকালে রাতের ঘুম নষ্ট করার জন্য হুমায়ূনকে একদফা ঝাড়তে তাঁর বাসায় ধাওয়া করেন। যদিও হুমায়ূনকে পেট্রোনাইজ করার ঘটনায় আহমদ শরীফ ও ছফার অবদান সর্বজনবিদিত।
এহেন ঘটনা আবার আমাদের বুদ্ধিজীবীদের পাঠপদ্ধতিকে প্রশ্নের বিষয় করে তোলে। আহমদ শরীফের জীবনবীক্ষণ বা চিন্তাভাবনার জগৎ যে-ধাঁচে বোনা ছিল সেখানে নন্দিত নরক-র ভাবালুতায় বোনা দারিদ্র্যে তাঁর বিমুগ্ধ বোধ করার কথা নয়। তিনি তবু মুগ্ধই বোধ করেছিলেন সেই সময়। বইয়ের ভূমিকা লিখে দিতে তাই কৃপণতা করেননি। শরীফের এই ভাবালুমুগ্ধ ভূমিকাখানার কথা স্মরণ করলে মনে প্রশ্ন ও বিস্ময়ের ঢেউ বহে।
ওদিকে হুমায়ূনের শক্তি ও সীমাবদ্ধতার জায়গাটিকে বাঙালি মধ্যবিত্ত মনোজগতের নিরিখে ছফার পক্ষে ভাবতে পারার কাজটি সহজ হলেও বই উৎসর্গের ঘটনায় (…ওটা যদি সত্যি হয়ে থাকে…) তাঁর প্রতিক্রিয়া বিস্ময়কর মানতে হয়! হুমায়ূনের কাছে তিনি কি অন্য কিছু আশা করছিলেন? ভাবালুতার বাইরে গিয়ে রচিত কিছু, যা হয়তো তাঁর লেখার ধাঁচের সঙ্গে একদম বেমানান? হুমায়ূনের শক্তির জায়গাটা তো ছোট-ছোট বাক্যে বোনা ভাষার মায়াজালে তৈরি ভুবনের মধ্যে সার্থক নিষ্পত্তি লাভ করেছে সবসময়। আপাত অবাস্তব কিন্তু মধ্যবিত্তমনে সদা সচল বাস্তব সব চরিত্র সেথা নড়েচড়ে বেড়ায়। পাঠককে তারা তাৎক্ষণিক গ্রাস করে। তার বিচারবোধকে অসার ভাবতে বাধ্য করে তারা।
হুমায়ূন এমন এক ভাষাপৃথিবী ও রসবোধের মালিক ছিলেন যাকে অনায়াস পড়তেই হয় এবং পাঠের পরে স্মরণ না রাখলে ক্ষতিবৃদ্ধি ঘটে না। বাস্তবের তিক্ত সত্যের ভারে পাঠককে জর্জরিত করার জন্য তিনি লেখেননি। তিক্ত সত্যকে পাঠক সেখানে চমকাতে দেখে কিন্তু ওটা তার ওপর বোঝা হয়ে চেপে বসার সুযোগ পায় না। মায়াবী ও জাদুকরি কুহকে বোনা ভাষার টানে সকল তিক্ততা মধুর বিষাদে অপার্থিব ফানুসে মোড় নেয় শেষতক। হুমায়ূনসাহিত্যের পাঠ-ব্যবচ্ছেদ প্রচলিত মহান সাহিত্যের মাপে মিল করে পড়াটা তাই বেশ কঠিন। এখানে ছফার প্রতিক্রিয়া বাঙালি বিশ্বসাহিত্যপড়ুয়া পাঠককুলের উন্নাসিক ভাবালুতাকে বোধ করি নগ্ন করে যায়! হুমায়ুন আজাদ এখানে ছফার অনুগামী। এক সাক্ষাৎকারে উক্তি করেছিলেন বটে, ‘জীবনকে তিনি হুমায়ূন আহমেদ টেলিভিশনের বিশ ইঞ্চি মাপে কেটে নিয়েছেন।’
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যর একটা অঘোষিত মানদণ্ড হুমায়ূনের আবির্ভাব ও উত্থানের মধ্য দিয়ে পাঠকমনে শক্ত জায়গা করে নিয়েছে। অন্য কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে তারা হুমায়ূনকে খুঁজে ফিরেন এবং না পেয়ে নাকচ করতে দ্বিধা করেন না। এটা কি তবে পাঠকের প্রাগ্রসর পাঠশক্তির পরিচয় বহন করে অথবা পশ্চাদগামিতার? সমস্যাটির জন্য হুমায়ূনকে দায়ী করা যায় কি, নাকি তাঁর পাঠকসমাজ স্বয়ং এর জন্য দায়ী? হুমায়ূনকে পাঠ করতে যেযে তাদের পাঠরুচি কি চিরতরে নষ্ট হয়ে গিয়েছে? তাদের পক্ষে তিনি ছাড়া আর কাউকে পাঠ করাটা যারপরনাই সম্ভব হচ্ছে না? আগামীর পাঠক কি তবে ওই অভ্যাসে শান দিতেই থাকবে? অথবা সময়ের অমোঘ টানে নতুন কোনো হুমায়ূন দেখা দেবেন, যার জেল্লায় তারা পুরোনোকে ভুলবেন?
এইসব প্রশ্ন তোলার মতো পরিসর দেশে নেই। তাঁকে নিয়ে সৎ, সাহসী আলোচনার জায়গাটি সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। যা-ই হোক, হুমায়ূনের কীর্তিকে সবিস্তার বিশ্লেষণ ও অবধানের প্রয়োজন রয়েছে। তাৎক্ষণিক পরিসরে কাজটা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে ওদিকপানে ধাবিত হলে মেইলটা আর শেষ হতে চাইবে না। পরের কোনো মেইলে আরো বিস্তারিত হওয়ার আশা রেখে সংক্ষেপে অন্য কথা পাড়ি এইবার।
তাৎক্ষণিকামালা
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
হুমায়ূন স্মরণ ও মূল্যায়ন সংকলন, গানপার ২০২২
- শিরোনাম রাষ্ট্রসংস্কার - September 6, 2024
- হাসিনাপতন : পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক সংযোজন || মোস্তাফিজুর রহমান জাভেদ - September 4, 2024
- শিক্ষকের পদ || পূজা শর্মা - August 27, 2024
COMMENTS