যে কথা আগে বলতে হবে || সরোজ মোস্তফা

যে কথা আগে বলতে হবে || সরোজ মোস্তফা

কবিতার নির্ধারিত নিয়তি এ-ই যে একটা সময় পরে অধিকাংশ কবিতারই প্রাণপ্রবাহ অচল হয়ে পড়ে কিংবা কবিতাগুলোকে অহেতুক মনে হয়। সময়ের ধুলা জমতে জমতে অধিকাংশ কবিতাই প্রাক্তন হয়ে যায়। কবিতার আঙ্গিক ও ইতিহাসচর্চায় সেসব কবিতারও পরম্পরা থাকে। পূর্বপুরুষের চর্চিত স্বর বহনের অঙ্গীকার রাখেন নতুন দিনের কবি। কাজেই কবিতা নামের লিখিত আত্মাটি প্রাক্তন হয়েও হারিয়ে যায় না। একটা সার্কেলের প্রবাহে ফিরে ফিরে আসেন পাঠক ও কবি। অনুভবের ভেতরে তাকিয়ে কবি ও পাঠক উভয়ই কবিতার পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকেন।

তবে কিছু কিছু কবিতা থাকে যা জন্মমুহূর্তের উজ্জ¦লতায় সময়, পাঠক ও শিল্পীর জীবনাভিজ্ঞতাকে ঝাঁকুনি দিতে থাকে। সেসব কবিতায় সময় কিংবা ব্যক্তি-মননের আভাসের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দেয় শাশ্বত কালের অভিজ্ঞান। কবির পঙক্তিতে পর্যাপ্তই থাকে সময়ের স্রোত। সময়ের স্রোত ধারণ করে কবির বলা গল্পটা ভাব ও অর্থের নিত্য নিত্য প্রসারণ ঘটায়। অনুভূতির প্রসারণে এই কবিতাগুলোই হয়ে ওঠে ক্লাসিক। আমার কাছে মনে হয় কবি নূরুল হক সেই ক্লাসিকধর্মিতার ভেতর দিয়ে গেছেন।

একজন কবি কখনো পরিকল্পনার দ্বারা কবিতা রচনা করেন না। তবে কবিতা বুননের নিজস্বতায় থাকে তাঁর অতিক্রমণের চেতনাভাস। নূরুল হকের কবিতায় থাকে সময় পরিক্রমণ আর জীবনযাপনের নিঃশ্বাস। কবির কিছু কিছু কবিতা আমাকে নিত্য-শিহরিত জীবনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। আমি পরিমাপহীন এক অনুভূতির ভেতরে ঢুকি। খুব পরিচিত শব্দের ভেতরে ঢুকে দেখি পোনা মাছের ঝাঁকের মতো অগণিত দৃশ্য আর অভিজ্ঞতা। নূরুল হক তাই আমার প্রিয় কবি। বড় কবি।

আমার কাছে কবি মাপার স্কেল নেই। নূরুল হক পড়তে ভালো লাগে। বারবার পড়ি। ক্লান্তি লাগে না। বারবার পড়াতে বরং দৃশ্যের জন্ম হয়। কবিতার চতুষ্কোণে এক-রকমের ঘোর তৈরি হয়। সেই ঘোরে কবিতার ভেতরজগতে ঢুকি। দৃশ্যের ভেতরে দৃশ্য দেখি। অনুভব করি শান্তির টাটকা শিহরণ। বারবার পাঠের পরও যে-কবিতায় তেজ থাকে তাকেই আমি বলি প্রকৃত কবিতা। সেই কবিতাকে বলি ক্লাসিক; অমৃতের পুত্র।

আমার কাছে নূরুল হক এজন্যই গুরুত্বপূর্ণ কবি। কোথাও এই কবির কবিতা পেলে আগ্রহ নিয়ে পড়ি। কবির সারলিক বর্ণনার বিপুলতায় অভিনিবেশ করি। কবে থেকে নূরুল হককে চিনি তার কালপর্ব মনে নেই। মনে আছে, ২০০৭ সালে বেরিয়েছে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়েছে রক্তদানায়’। এই গ্রন্থপাঠে আমি দেখে ফেলেছি মানুষ। ছোট ছোট পঙক্তির ভেতর দিয়ে দেখেছি দেশ ও বাস্তবতা। সময় ও কালো মুহূর্তের কারণকথা। তারপর বেরিয়েছে ‘একটি গাছের পদপ্রান্তে’ (২০১০)। এই কাব্যগ্রন্থে  অপরাহ্নবেলার সম্মোহন। নিজের সংসারের হালচাল বলতে গিয়ে কবি বলেন :

চলে এসেছে মেহমান,
দুটি পাখি
এবং একটি পিঁপড়ে।
আমার সংসারের হালচাল, পৃ. ১০

জগতের সামনে দাঁড়িয়ে জগৎ নিয়ে বলতে থাকেন কবি :

সামনে পড়ে গেছি
তার,
দেখলাম
আশ্চর্য জগৎ।
মৃত্যুর কাকলিভরা
রাত নিয়ে
বিস্তারী সূর্য এক
হাত ধরে আছে
শত
তারকা শহর।
জগৎ, পৃ. ২৫

নিত্য জুম্মাবার ও প্রকৃতির চিরায়ত রূপ দেখাতে গিয়ে কবি বলেছেন :

দুপুরবেলার রোদ
কোথাও ঢালভূমি খুঁজছে
জুম্মার নামাজের পর।
গাছগাছালির নিচে
এক এক খণ্ড ছায়া
যেন এক-একটি দোয়া।
কলেমায়ে জুম্মাবার, পৃ. ১৩

একজন কবি সারাক্ষণ নিজেকেই লিখে যেতে থাকেন। মাহমুদ দারবিশ বলেন, “কবিতার বাইরে আমার জীবনের অর্থ নেই।” কবিতা আসলে আত্মজীবনের বর্ণমালা। কবির জীবন-নিঙড়ানো কথাগুলোতেই পাঠক নিজেকে খুঁজে পান। সাদা পৃষ্ঠার কালো হরফগুলোতে ঝকঝক করে মানবজীবন। আগে, পিছে, উপরে, নিচে জীবনে ফিলিংসের কি শেষ আছে? তাকানোর পর জেগে ওঠে একেকটি অর্গান। আবেগে, লড়াইয়ে, মুগ্ধতায় শিল্পীরা যাপিত জীবনকেই রাঙিয়ে যান। তাকানোর মুহূর্ততায় কবি নূরুল হক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞানে বলেন :

জীবন এক অপূর্ব দৃশ্য,
যা দেখে মানুষ
বাড়ি ফেরার কথা
ভুলে যায়।
পাদটীকা, পৃ. ৪০

‘মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প ও অন্যান্য কবিতা’ (২০১২) গ্রন্থে একটি জাতির অস্তিত্বের ইতিহাসকেই বয়ান করা হয়েছে। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ কোনো পুরনো শব্দগাথা নয়। কিন্তু আমাদের জাতীয় ইতিহাসটাকে কারা যেন স্পর্শ করে ফেলেছে। নিজেদের অনুভবকে জায়েজ করে নিতে চাইছে। তবে সইতে সইতে, মানতে মানতে এই আমাদের নিজেদের অহমের ইতিহাসটাকে ম্লান করে দিতে চাইলে কবিকেই লিখতে হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের  অসমাপ্ত গল্প’-র মতো দীর্ঘ কবিতা। চিন্তায় ও মননে যে-পচন ধরেছে সে-পচনকে সরিয়ে দেয় এই কবিতা। প্রথানুগততার ভেতর দিয়েই কবি একটা গল্প শোনান, সে-গল্পে বৃষ্টি নামে। সে-গল্পে শহর ও শহরতলির আখ্যান উঠে আসে। একজন সিদ্ধার্থের ভেতর দিয়ে আমরা সমগ্র মুক্তিযোদ্ধাদের দেখি। কেমন পুতুলনাচের দৃশ্য বয়ানের মতো করে গল্পটা বলেছেন কবি।  বলার সে-শান্ত ভঙ্গিটায় সূর্য ও পাখিও চুপ করে থাকে :

সেদিনও গেছে,
যেদিন একদিকে মৃত্যু
অন্যদিকে ভয়
মাঝখানে জীবন
শুধু কাঁপছে
থরথর করে।
সেদিনের নাম ছিল একাত্তর।
মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত গল্প, পৃ. ৯

এই কাব্যগ্রন্থের শেষ সিন্দুকে ‘একঝুড়ি নদী’ শিরোনামে কিছু ছোট ছোট কবিতা আছে। এগুলোকে কবিতা না বলে একেকটা সচল জীবন কিংবা একেকটা ফুসফুস বলাই ভালো। কবিতার নান্দনিক রূপ-যে কত বৈচিত্র্যময় হতে পারে তারই নমুনা  ‘একঝুড়ি নদী’। কবিতাগুলোতে শুধু দৃশ্য, শুধু ক্যানভাস, গল্পের ক্রন্দিত পুতুল। বাড়তি শব্দ-মাংসহীন কবিতাগুলোতে শুধু অনুভূতি :

১.
ভোরবেলাটা আমার শাকভাত
প্রতিদিন পাই
গরিবের ঘরে।
শাকভাত, পৃ. ৯২

২.
পায়ের নিচে লুটোচ্ছে যে ধুলো
সেই ধুলোই কি
আমি?
কি, পৃ. ৯৩

৩.
যদি
সঙ্গে বসে বিড়ি খাও
খুশি হব।
বন্ধুত্ব, পৃ. ৯০

৪.
এ জীবন
কাঁখে করে নিয়ে যেতে
এসেছিলে ঘাটে
এখন কলস ভেঙে যায়।
এসেছিলে, পৃ. ৯০

৫.
দুঃখ
মানুষের ঘরে
শুয়ে থাকে বিছানায়
সন্তানের মতো।
দুঃখ, পৃ. ৮৮

৬.
সময় পুড়িয়ে
ভস্ম নিয়ে খেলা করি
মাঝে মাঝে।
লোকজন একেই কবিতা বলে জানে।
কবিতা, পৃ. ৮৭

৭.
যুদ্ধক্ষেত্রের মৃত সৈনিকের মতো
পড়ে আছে
একটি ডাল।
উবুড় হয়ে।
মনে হচ্ছে ফুসফুস এখনো নড়ছে।
একটি ডাল, পৃ. ৮৬

৮.
আশ্চর্য রহস্যময় এক ফুল
এই পৃথিবী।
কোথা থেকে হাসিগুলি
পাপড়ি হয়ে ফোটে
আর কোথায় মিলায়
কূল পাওয়া দায়।
ফুল, পৃ. ৮২

৯.
আকাশে উড়ছে দুটি পাখি।
ঘেঁষাঘেঁষি।
যেন দুই ভাই।
দুই ভাই, পৃ. ৮১

১০.
মনে হয়, বসে পড়ি
মাটির নিচে কোথাও।
শক্তি নেই উঠে দাঁড়াই।
মাটির উপরে এত হাওয়া লাগে
ভয় পাই।
বার্ধক্য, পৃ. ৮১

সত্যি একঝুড়ি নদী। নদীর প্রবাহ যেন আর থামে না।

নূরুল হকের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয় কবি চিরপরিচিত এই জগতেই আছেন। মনে হয় নিত্যতায় যাপিত অনুভবগুলোকেই লিখে যাচ্ছেন কবি। কবিতাগুলো যেন নৈশ আওয়াজের মতো, শ্রাবণের প্রগাঢ় ধারার মতো, কিংবা শীতঋতুর অম্লান হাসির মতো। সামান্য উপমা আর ছোট্ট ছোট্ট গল্পের ভেতরে ঝকমক করছে একেকটি কবিতা।

একজন কবি হয়তো নিজেকে বারবার জিজ্ঞেস করেন কীভাবে লিখব পরের কবিতা? নিজেকে হয়তো বারবার জিজ্ঞেস করেন,  আমার কবিতাও কি পুরনো হয়ে যাচ্ছে অন্যদের মতো? আমি বিশ্বাস করি এই জিজ্ঞাসা কবিকে সতেজ রাখে। কেননা একটি নতুন লেখা মানেই তা আবার পুরনো হয়ে যাওয়া। তাই ক্লান্ত না হয়ে কবিকে নতুনতর শব্দভাবনা আর বুননের প্রকৌশলে হাঁটতেই হয়। এই সূক্ষ্ম  নান্দনিকতায় কবি নূরুল হককে পরিবর্তনের সুনন্দা নদীতে স্নান করতে হয়েছে। সময়ের তরঙ্গে ডুবিয়ে ডুবিয়ে কবিকে লিখতে হয়েছে ‘শাহবাগ থেকে মালোপাড়া’। আমি কোনো পণ্ডিতি ব্যাখ্যায় না নেমে এবটি কবিতা উদ্ধৃত করতে চাই। বলতে চাই এই কবিতাটির ভেতর বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ৪৩ বছর আছে। কেন শাহবাগের গণজাগরণ? — এই প্রশ্নের উত্তর আছে। কোনো প্রশ্নের উত্তর লেখা কবির কাজ নয়। কবির কাজ কবিতা চয়ন, যে-কবিতার অতলতায় মিশে থাকে সত্য ও ইতিহাস :

একদিন একটা পাখি এসে বলল,
‘বাংলাদেশ, তুমি যদি কোনো নদীর নাম হয়ে
থাকো,
তাহলে তোমার জল আমি পান করব না ।
কারণ গরল এবং অমৃত একই স্রোতে মিশেল হয়ে
এই নদীতে বইছে।’
বলল, পৃ. ৮১

কবিতাগুলোতে কবি সত্যের ডাক দিয়েছেন। একটা জেগে-ওঠা কিংবা নিষ্পেষিত উপত্যকার আখ্যান ‘শাহবাগ থেকে মালোপাড়া’।

কবি নূরুল হক এমন সহজ আর বিপুল ব্যঞ্জনাময় করে কবিতা বলেন। নিরন্তর প্রবাহিত বাংলা কবিতার মুক্তস্রোতে এসেছেন কত কত মহৎ কবি আর এসেছে কত কত কবিতার যুগ। সেইসব মহৎ কবি আর কবিতার যুগকে আমরা অবশ্যই অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু কোনো প্রকৃত কবিই পুরাতন কাব্যভাষা আর কবিতার যুগকে ধরে রাখতে চান না। ভাব ও ভাষার রূপান্তরের মধ্য দিয়েই এসে যায় নতুন কবিতার যুগ। মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-জসীমউদ্দীন-বিনয়-শামসুর রাহমান-আল মাহমুদের পর বাংলাদেশের স্বাধিকারচেতনার কিছু উত্তাল কাব্য ও কবিতা বাদ দিলে বাংলা কবিতা কার্যত নির্জন, ফাঁকা। ভাষা ও ভাবনার প্রায়োগিক অনুশীলনে কেটেছে এই সময়ের কবি ও কবিতা। বিশেষণের পর বিশেষণের লম্বা বহর আর আমি-তুমির ঢিলেঢালা অন্তহীন আবেগ কিংবা ভাবালুতায় ভরপুর উল্লম্ফনধর্মী নিছক পঙক্তিমালার ঘোলা ডোবায় সাঁতার কেটেছে এই সময়ের কবি ও কবিতা। শিল্পের স্বাভাবিক ছন্দে এই সময়ে উঠে আসেনি কোনো মৌলিক কবিকণ্ঠ। যে সুর ও শব্দ পাঠককে বিমুগ্ধ করে, কবিতাকে করে চিরঞ্জীব, সে সুর ও স্বর রপ্ত করতে কবিকেও হতে হয় মগ্ন অনুভবী। ভাষার নিজস্বতা আর অনুভবের মগ্নতা নিয়েই একজন কবি মৌলিক হয়ে ওঠেন। বাংলা কবিতায় নূরুল হকের এই সহজ ব্যঞ্জনাময় কাব্যভাষা দীর্ঘ সময়ের অন্ধকার ভেদ করা এক মোহনীয় আলোকচ্ছটা। নতুন কবিতার ইঙ্গিত।

রক্তকণা কবির পঙক্তিতে পঙক্তিতে ঝলকিত। নূরুল হক কোলাহলহীন অল্প কিছু কথায় আভাসে ইঙ্গিতে ঢেউয়ে ঢেউয়ে কবিতা বলেন। অধিকাংশ কবিতাই স্বগতোক্তির চালে কবি একনিঃশ্বাসে বলেন। তন্বী দেহের এই কবিতাগুলোর গাঁথুনি খুব সহজ কিন্তু ভেতরটা অনেক বিশাল, কারুকার্যময়, সহজ রহস্যময়, ভাবনাময় সুদূরতা।

কবির কবিতায় মেকাপ নেই। কোনো সাজঘর থেকে বেরিয়ে আসার চকচকানিপূর্ণ বেতাল শব্দের দলা নেই। শব্দ ও ভাবনার জগৎ নিয়ে কবি সোজাসুজি পাঠকের সামনে বেরিয়ে আসেন। এর জন্য কোনো বাহানা লাগে না। তাই কবিতাগুলোতে অলঙ্কার নেই। শ্রবণভোলানো ছন্দবৈচিত্র্য কম। পাহলোয়ান পণ্ডিতেরা তাই ঠোঁট ওল্টাতে পারেন। আলঙ্কারিকরা তর্জনি হাঁকিয়ে শাসাতে পারেন খুব। কিন্তু কবিতা তো কবিতাই; একটা নীরব বৃক্ষের মতো সদা স্পন্দনময়। এটা ঠিক যে শব্দ, ছন্দ, অলঙ্কারের গাঁথুনিতেই গড়ে ওঠে এই শিল্প। কিন্তু এই গাঁথুনি পর্যন্তই। প্রকৃত কবিতা শব্দাতীত, ছন্দ-অলঙ্কারের গাঁথুনিসীমার অনেক বাইরে অন্যকিছু। কবিতার যাবতীয় আকার-আকৃতি, তত্ত্ব, উপদেশ অতিক্রম করে যাওয়াই নতুন কবির কাজ। চেতনার রৌদ্রালোক থেকে জাত এইসব নক্ষত্রোজ্জ্বল পঙক্তিমালা বাংলা কবিতার পাঠকের কান ও ইন্দ্রিয়কে নতুন উপলদ্ধির সম্মুখে দাঁড় করায়। দার্শনিক আভায় জীবনবোধের অতল গভীর থেকে উচ্চারিত সহজ কথনভঙ্গির এই কাব্যভাষা বাংলা কবিতাকে দেয় বাঁক বদলের ইঙ্গিত আর নতুন পথের সন্ধান।

ব্যক্তি-অভিজ্ঞানের অপূর্ব রঙ্গন কবির কবিতা। কিন্তু আত্মগত, মনোগত বিষয়কে প্রাধান্য দিলেও কবি নিশ্চয়ই বাস্তবতাবিবর্জিত নন। ব্যক্তি-অভিজ্ঞানের ভেতরেই আছে সমাজমানসের প্রতিচ্ছবি, আছে সামাজিক অগ্নিস্রোত। সমকালীন স্তব্ধতার ভেতর থেকে সহজ স্ফূর্তিতে এই কাব্যভাষায় উঠে এসেছে অসংখ্য সত্যের বিকিরণ।

আমাদের কাব্যের অসামান্য মূল্যায়ক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মেজাজে বললে বলতে হয়, নূরুল হকের কবিতার প্রাণশক্তির প্রবল তোড় থেকে চোখ ফেরানো কঠিন। কাব্যের নক্ষত্রোজ্জ্বল পঙক্তিমালায় এত এত লাবণ্য আছে, কথার অতীত এত সুদূরতা আছে, কবিতার তন্বী দেহে আঙুরগুচ্ছের মতো থোকায় থোকায় এত রহস্য জড়িয়ে আছে যে বাংলা কবিতার পাঠককে হিমশিম খেতে হয়। পাঠক বোঝার চেয়ে কবিতার দিকে তাকিয়ে থাকেন, লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে থাকেন, নতুন স্বাদের কবিতায় আপ্লুত থাকেন।

যা কবিতা তা কি পুরনো হয়? অকবিতা পুরনো হয়। দিনে দিনে হীরকদ্যুতির মতো বাড়ে প্রকৃত কবিতার মনোলোভা আহ্বান। প্রকৃত কবিতা যুগ-যুগান্তকারী অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে যায়। বাংলা কবিতায় নূরুল হকের কবিতা সেই এগিয়ে যাওয়ার সুর। শব্দধ্যানী রসস্রোতী এই কবি আপন স্বাতন্ত্র্য নিয়েই মহীয়ান। বাংলা কবিতার পাঠক ছোট ছোট পঙক্তিমালার মধ্য দিয়েই এই কবির জাত চিনে নেবেন। পাঠক নিজের গরজেই এই কবিকে আবিষ্কার করবে। কেননা কবিতার যে-ভুবনে তিনি নোঙর করেছেন সেই ভুবনে পূর্বপুরুষের পরম্পরা আছে। আছে নিজস্ব রঙের স্বাতন্ত্র্যিকতা। শব্দে, অনুভবে, চিত্রময়তায় বাংলা কবিতাকে তিনি স্বাভাবিক সামগ্রিকতায় বেঁধেছেন।


কবিতাসমগ্র / নূরুল হক
চৈতন্য  থেকে প্রকাশিত তিনশতাধিক পৃষ্ঠা সম্বলিত বইটির মূল্য ৫৫০ টাকা
২০২০ ফেব্রুয়ারিতে বেরোনো বইটির প্রচ্ছদশিল্পী নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you