শবেবরাত

শবেবরাত

ফজিলৎ নিয়া আলাপ এইটা না, আখিরাতি কি দুনিয়াবি প্রোফিট মার্জিন নিয়া আলাপালোচনার জায়গা আছে দেদার, আমরা এই স্মৃতিনিবন্ধে দেখব গত শতাব্দের মিড-এইটিস্ থেকে নাইন্টিসের মাঝভাগ অব্দি বিকশিত শৈশবের শবেবরাতকালীন কিছু খণ্ডচিত্র। তবে এই চিত্র অধুনা প্রায় নিমিলিত। গরহাজির চোখের সামনে সেই শিশুবান্ধব শবেবরাত। শুধু দোয়াখায়ের ছাড়া বাঙালি মুসলমানের রিলিজিয়াস ইভেন্টগুলোতে ধর্মীয় সক্রিয়তা আজকে তেমন দেখা যায় না। ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে এখন ধর্মকর্ম শুধু বেহেশ্তি বুলন্দ দরোয়াজা পাইবার আশে আচরিত। খুশিবাসির ভিতর দিয়াও ধর্মাচার পালনের একটা কালচার মূলধারায় এই কিছুকাল আগেও ছিল। ঝগড়াফ্যাসাদও ছিল দোয়াল্লিন-যোয়াল্লিন আর মিলাদকালে খাড়াইয়া কিয়াম না বসিয়া কিয়াম ইত্যাদি নিয়া, তা-সবকিছুতেই কিছু কমিক রিলিফ মিলত। মোটামুটি হিউম্যরের একটা জায়গা আমাদের এই ল্যান্ডের রিলিজিয়নগুলোতে ক্যারেক্ট্যারিস্টিক্যালিই ইন-বিল্ট ছিল। বর্তমানে সেসব উধাও। শবেবরাতের রাতভর মুক্তস্বাধীন ঘুরে বেড়াবার কৈশোরক সেই ফ্যামিলি ট্র্যাডিশন এখন অনুশাসনে দমবন্ধ। চোরডাকাতখুনিয়ারাও শবেবরাতে রহমপূর্ণ রয়, কিছুকাল আগে এই বিশ্বাস ভেঙে যায় বিহারিদের ক্যাম্পে জ্যান্ত মানুষ ঘরের ভিতরে পুড়িয়ে মারার মদদপুষ্ট ঘটনায়। ছিল মসজিদগুলো কৈশোরের মুক্তাঞ্চল, যেখানে কচিকাঁচাদের কলকাকলি আর পাকা মুসল্লিদের কপট ধমক চলত সমানে। স্পেস ছিল শ্বাস নেয়ার, এখন নাই আর। চুপচাপ, বরফস্তব্ধ, বদ্ধগম্ভীর। খুশিবাসির জায়গাজমি কমে আসছে ক্রমে, এমনকি ঈদের দিনের অর্থও নাকি খুশিদিন নয়, ঈদ অর্থ খুশি নয়, ইবাদাত, জুম্মাবারের বয়ানে হামেশা আজকাল প্রচারিত। মন্দ বলা যাবে না। তা, ভালো-মন্দ সুফল-কুফল হিসাবনিকাশ এই নিবন্ধে নয়, এইখানে সে-সময়ের ভাগ্যরজনীগুলোর অনাড়ম্বর একটি স্মৃতিবিবরণ রয়েছে, অ্যানালিটিক্যাল কিছু এইখানে পাওয়া যাবে না।

শব্দশৈশব
আমাদের ছেলেবেলায় শবেবরাতের একটা আবশ্যিক অনুষঙ্গ ছিল ধুপবাতি-তারাবাতি শিশুকিশোরদের হাতে হাতে। শবেবরাতের আগের দিন-সাতেক পাড়া-মহল্লার মোড়ে মোড়ে টেবিল পাতিয়ে দোকান বসত ধুপকাঠিপ্যাকেট-ফুলঝরি ইত্যাদি বিক্রির। বড়বেলায় আমি নিত্যবছর শবেবরাতের সিজনে ক্যাঁচরম্যাচর বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য ধুপবাতি-তারাবাতি কিনতে হকার্স মার্কেটে যাই। সেখানকার লিকলিকে বেশুমার সরুগলির ভেতরে, কিলবিলে ক্রেতাদের ভিড়ে, একটানা যাই দেখে দেখে আমার হারানো শৈশবরাজপাট। ঘন ও গিজগিজে সারি সারি দোকানঘর, জুতা-জামা-জর্দা-পানমশলা-খাদ্যশস্যভাণ্ডার-খেলনাপাতি ছাড়াও কত বিচিত্র মনোহারী জিনিশের আড়ৎ, সমস্তই পাইকারি বিকিকিনির বন্দোবস্ত। দোকানঠাসা হরেক পণ্যপসরা। আমি ফি-বছর এই শবেবরাতঋতুতে চষে বেড়াই ধুপবাতি-তারাবাতি-মোমবাতি-আতর-আগর বিক্রি হয় যেই গলিগুলোতে, সেগুলোই শুধু। শবেবরাত তো, প্রতিবেশী পিচ্চিকাচ্চাগুলো খুব পথ চেয়ে থাকে একটা-দুইটা ধুপবাতিপ্যাকেট-তারাবাতি ইত্যাদি বড়দের কাছ থেকে বখরা পাবার জন্য। শবেবরাতের ‘মূল আকর্ষণ’, ছোটবেলায়, ছিল এগুলোই আমাদের কাছে। এইসব শৈশবজাগানি জিনিশপত্তর কিনতে বেশ লাগে। ছেলেবেলা-মনেপড়ানিয়া প্রশ্নে আমার আপোস নাই কোনো।

মনে আছে এখনও, আমাদের ছেলেবেলায় আরও অনেক আনন্দাস্ত্র ছিল শবেবরাতের — মরিচবাত্তি, পটাশ, গোল্লা ইত্যাদি। গত অনেক বছর ধরে মরিচবাত্তি বাজারে দেখি না আর। জিনিশটা ছিল অনেকটা তারাবাতিকাঠির ছোট সংস্করণ, সিলেটি কথ্যবুলিতে আমরা তারাবাতি জিনিশটাকে ফুলঝরি নামে ডাকি। মরিচবাত্তি জিনিশটা কেমন ছিল, বলি। দেশলাইবাকশো, তার ভেতরে দেশলাইকাঠি, কাঠির আগায় বারুদ; দেশলাইপিচে বারুদকাঠি ঘষা মাত্রই জ্বলে উঠত ফর্শা ও স্বপ্নকোমল একধরন আলো, খুব নয়নলোভা আর স্নিগ্ধসুন্দর। তারাবাতি/ফুলঝরির চেয়েও বেশি প্রিয় ছিল এটা, — আমার সমবয়সী শিশুদের কাছে। ইদানীং জিনিশটা দেখি না কোথাও। যেমন দেখি না পটাশ, গোল্লা ইত্যাদি। পটাশ জিনিশটা ছিল মৃদু বিস্ফোরক, আধহাত লম্বা কঞ্চিকাঠির আগায় বারুদ পোরা, বারুদপুঁটলি মোড়ানো থাকত রঙকাগজে। পাথরে বা পাকারাস্তায় উবু হয়ে বসে ডানহাতে পটাশ উঁচিয়ে ধরে ঘা দেয়া মাত্র স্বল্পমাত্রার বিস্ফোরণ হতো, সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ উঠত অনেকটা এ-রকম : পওওঠাশশ্…! গোল্লার অন্য নাম বোম — ডিমসাইজ, রঙকাগজমোড়া বারুদবস্তু; নিক্ষেপকারী নিজের অবস্থানবিন্দুর কিয়দ্দুরে — সচরাচর পিচরাস্তায় — ছুঁড়ে মারবে বস্তুটি, এবং বিস্ফোরিত হবে বেশ সম্ভ্রমজাগানো শব্দে। বোম নামে আরেকটা জিনিশ ছিল, সত্যি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ ও মারাত্মক সেটা। আমার ভয় করত, কোনোদিন ওই বোম আমি ইস্তেমাল করিনি। বিষয়টা ছিল অনেকটা এ-রকম : দেখতে বেশ সত্যিকারের হাইড্রোজেনবম্বের মিনিয়েচার, তবে শরীর কাগজের এবং সরু দু-আঙুল লম্বা। আগায় সুতলির মতো প্যাঁচানো-পাকানো কাগজসলতে মুখ-বের-করা। কাগজের সেই সলতেশীর্ষে আগুন ধরিয়ে দ্রুত নিরাপদ দূরত্বে সরতে হতো ক্রীড়ামোদে শিশুটিকে, এবং বিস্ফোরিত হতো বোম বিকট সমগ্র পাড়া জানান দিয়ে। বিস্ফোরণস্থলে আগুন দেখা যেত, কুচি-কুচি কাগজ উড়ত কিছুক্ষণ বাতাসে, কাছাকাছি জনমনিষ্যির কানে প্রায় তালা লেগে যাবার জোগাড় হতো। এটি সাধারণত বড়রাই, ইশকুলপড়ুয়া পাড়ার কিশোর-তরুণেরা, বেশি ফোটাত; অথবা ইঁচড়ে-পাকা শিশুরা; আমার মতো দুয়েকজন ভীতু সর্বদা তফাতে থাকত। ও হ্যাঁ, আরেকরকম বোমের কথা এখানে এ-স্মৃতিলিখনে গেঁথে রাখি তুলে। বয়স বাড়ছে, ভুলে যাচ্ছি সব আস্তে আস্তে। সেটা হলো, আমরা বলতাম হাতবোমা। হাতে-তৈরি রিনিয়্যুয়েবল এনার্জির বোমা বলা যেতে পারে। সেটা কেমন? সাইকেল/রিকশার চাকার রিং থেকে খুলে-নেয়া একটা স্পোক বাঁকিয়ে ধনুকের আকৃতি দিয়ে স্পোকের বোঁটাসদৃশ অংশে বারুদ পুরে — ম্যাচস্টিকের অগ্রভাগের ওই একটুখানি বারুদগুঁড়ো ছোট্ট বোঁটায় চেঁছে পোরা হতো — স্পোকধনুকের ও-মেরু থেকে এ-মেরুতে টানা-দিয়ে-রাখা বড়শিসুতোর প্রান্তে একটি বড়শিকাঁটার মতো ছোট্ট-তীক্ষ্ম লোহা (আমরা বলি বরইকাঁটা লোহা) বারুদবোঁটায় লাগিয়ে ধনুকটা ডানহাতে ধরে উঁচু কোনো শক্ত পাটাতনে বা পাথরে পেটাতে হয়, এবং সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ! এই ধনুকবোমা/হাতবোমা বারোমাস ব্যবহার করা যেত, বারোমাস বানানো যেত।

আহা! কী দিন ছিল আমাদের! একটুখানি শব্দে মেতে উঠত সমস্তটুকু — আমাদের — আনন্দে, অনাবিল উল্লাসে! একটুখানি আনন্দের খোঁজে কত বোমাবাজিই-না করেছি আমরা, ছোটবেলায়!  এখন? কেমন যেন হয়ে গেছে সব। বাচ্চারাও বুড়োদের মতো গুমড়োমুখো বসে থাকে! এখনকার বাচ্চাদের শৈশবযাপন যারপরনাই ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ। মসজিদে গেলে বাচ্চাদের দুষ্টুমি দেখা যায় না, তারা তাদের মা-বাবাদের শেখানো দোয়াদুরুদ পড়ে দুলে দুলে। পরীক্ষায় বসে, ফেল অথবা পাশ করে, এবং পড়া করে খালি।

যিয়ারৎ
বিশেষ এই দিনটায় একটা আমোদস্ফূর্তি ছিল আমাদের ছেলেবেলায়, ছিল কয়েক বছর আগেও, এখন তা অবসিত হতে হতে নেই একেবারে। বাবা-চাচারা, আমাদের ছেলেবেলায়, বাড়ির বাচ্চাদের নিয়ে বেশ আনন্দ-আমোদ করতেন। ধুপবাতি-তারাবাতি কিনে নিয়ে আসতেন সন্তানসন্ততিদের জন্য। মাগরেবের নামাজের পর, এশার নামাজের আগ পর্যন্ত, উঠোনে ক্যাঁচরম্যাচর শিশুদের হাতে নেচে বেড়াত ফুলঝরি-তারাবাতিগুলো। ঘরে-ঘরে পোড়ানো হতো ধুপবাতি। মিষ্টি কিংবা পাকানো কড়া ঘ্রাণে দেয়ালের ক্যালেন্ডারগুলোও রইত দিওয়ানা। রাতের বাতাস ভরে উঠত ধুপের ঘ্রাণে, নেচে উঠত রজনী শিশুদের হাতে হাতে একের-পর-এক উল্কাবৃষ্টির মতো ফুলঝরিঝিলমিল। অতঃপর, এশার নামাজ সেরে এসে, মুর্গিপোলাও খাওয়া। আরেকটা আবশ্যিক অংশ ছিল গোরস্থানভ্রমণ তথা আত্মীয়পরিজনবর্গের কবর যিয়ারৎ। এই দিনে আপন রক্তজ্ঞাতি ছাড়াও দূরবর্তী মৃত আত্মীয়স্বজনের গোর-যিয়ারৎ উপলক্ষ করে বেশ একটা বেড়ানো হয়ে যেত আত্মীয়বাড়িগুলো। মূলত পুরুষেরাই বেরোতেন এই ভ্রমণে, গোরস্থান থেকে গোরস্থানে, হাতে ধরে বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে। এ-কাজ অবশ্য শবেবরাতের সপ্তাহখানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত। সারারাত মসজিদে-দরগায়-গোরস্থানে-খানকাশরিফে ঘুরে ঘুরে বেড়ানো হতো। যুবকবয়সী বাপচাচারা পাঞ্জাবি-আচকান-টুপি পরে বেরোতেন পরহেজগার বেশে, খেয়েদেয়ে, আতর মেখে, বেশিক্ষণ অবশ্য মসজিদের জিকিরাজগার তাদের বেঁধে রাখতে পারত না, তারা মসজিদসংলগ্ন চা-দোকানে গিয়ে চা-সিগ্রেট ফুঁকতেন আর আড্ডা মারতেন প্রতিবেশী পাড়াতো দোস্তবন্ধুদের সঙ্গে। পাশে তাদের পাঞ্জাবির খুঁট ধরে ছেলেমেয়ে-ভাতিজাভাতিজিগুলো অবাক হা-মুখ তাকিয়ে দেখত বাপচাচার কথা বলার সুন্দর ভঙ্গি ও বড়দের হাসিঠাট্টামশকরা, মুগ্ধ-মশগুল। মনে মনে সেই শিশুরা ভাবত, অত্যাশ্চর্য রজনী তো সত্যি! কী জাদু এই রাত্রির! রাশভারী বাপকেও দেখি এই শবেবরাত এসে হাস্যমুখ করে তোলে!

শিন্নি
চাল-ভাঙানো গুঁড়ি দিয়ে কিংবা আটা বা ময়দা দিয়ে বানানো হতো রুটি, চালের গুঁড়ির রুটিই অবশ্য বেশিরভাগ লোকে প্রেফার করত, সঙ্গে থাকত ঝোলমাংশ। শবেবরাতের এটা একটা কমন ফ্যুড-আইটেম ছিল। সন্ধের দিকে খাওয়া হতো। কয়েক বছর ধরে এটা আমাদের বাসাতেও হয় না আর। অবশ্য কোথাও কোথাও, শুনেছি পুরান ঢাকায়, আটারুটি  আর হালুয়া হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী শবেবরাতের খানা। আমাদের এখানে হালুয়া হয় শবেবরাতের সিজনে, তবে বাসায় খাওয়ার জন্য নয় সেভাবে, মসজিদে বিতরণের জন্য শিন্নি হিশেবে। শিন্নির কথায় মনে পড়ছে এখন, কত বিচিত্র রকমের শিন্নি/শির্নি ছিল তখন! পনেরো দিন জুড়ে মসজিদে-মসজিদে শিন্নি বিলানোর মোচ্ছব লেগে থাকত। আখনি, খিচুড়ি, ক্ষির, জিলিপি, হালুয়া-বনরুটি ইত্যাদি ছিল সবচেয়ে বেশি চালু। এর মধ্যে গোমাংশমিশ্রিত আখনি আর মটর-দেয়া খিচুড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি হতো বেশি। হালুয়া-বনরুটি অত জনপ্রিয় ছিল না তখন, এখন যেমন একচ্ছত্র শবেবরাতের শিন্নি এইটা। বা জিলিপির খুব কদর দেখি আজকাল এই বাবতে। দোকান থেকে কেনো, আর মসজিদে পাঠায়ে দাও, ঝুটঝামেলা নাই।

তখনকার দিনে লোকজন মহানন্দে ঝামেলা করে বেড়াত। শিন্নি হতো বাড়িতে বাড়িতে বাবুর্চি ডাকিয়ে এনে। শিন্নির রন্ধনঘ্রাণে ম-ম করত মহল্লা-পাড়া। হালুয়া শিন্নিকে আমরা বলি তুষাশিন্নি। ক্ষির খাওয়া হতো কলাপাতায় ঢেলে। ডেকচিভরতি ক্ষিরশিন্নি নিয়া যাওয়ার পাশাপাশি গাদাগুচ্ছের কলাপাতা কেটে নিয়ে যেতে হতো মসজিদে। একলাইনে সারিবদ্ধ লোক বসিয়ে কলাপাতে ঢেলে দেয়া হতো গরম ক্ষির, এর উত্তেজনাই ছিল আলাদা। আমি অবশ্য নিজে কখনো লাইনে বসে বা জটলায় দাঁড়িয়ে শিন্নি নিতে পারিনি। আমার কেবল ভয় হতো আমাকে তো দেখতেই পাবে না এই ভিড়ে এবং শূন্যহস্ত শিন্নিহীন ভিড় থেকে বেরিয়ে আসার বেদনার্দ্র অপমান আমি সইতে পারব না — খালি এ-ই মনে হতো। দূর থেকে দাঁড়িয়ে কেবল উদাস নয়নে দেখতাম শিন্নি নিচ্ছে কেমন দাপুটে ভঙ্গিতে আমার বন্ধুরা, আমারই পিচ্চিশরীর বন্ধুরা আস্ত ভিড় ও বড়দের সবাইকে একমুহূর্তে নাচিয়ে ছাড়ত, আমি দেখতাম। গুঁতো সহ্য করবার মতো শক্তিশালী ছিলাম না কখনোই। কিন্তু বঞ্চিত হতাম না তেমন, কারণ ওই বয়সেই আমি ছিলাম চাকরিমনস্ক, ছিলাম আমার বন্ধুদের শিন্নিকিপার। ওদের একেকজনের ডাবল-ট্রিপল কখনো কখনো ততোধিক শিন্নিহিস্যা আমার কাছে গচ্ছিত রেখে ওরা যেত পুনরায় বেনিফিট-অফ-ডাউট নিতে, এবং অন্য অনেককিছুর ন্যায় তারা এক্ষেত্রেও সফল হতো অবধারিত। সবশেষে যার যার ভাগ নিয়ে গেহে ফেরা, তার আগে অবশ্য সর্বসম্মতিক্রমে একটা ভাগা আমার জন্যও বরাদ্দ হতো। বড় হয়ে চাকরি করতে গিয়েও দেখি আমার এই একটাই স্কিল ও এফিশিয়েন্সি ছাড়া আর কোনো নলেজ-এলেম নাই। হরিলুটের মালসামান পাহারা দাও, মাসশেষে ফ্যামিলিতে ফেরো একভাগা শিন্নি নিয়া, আর-কি চাই।

ফুলঝরিপ্রেয়ার্স
শিশুত্রয়ীর হাতে নেচে নেচে হেসে ওঠে একথোকা সানন্দা আলোফুল্কি। নিখিলের আকর্ণবিস্তৃত উচ্ছ্বাস যেন ঝরে ঝরে পড়ে চারিধারে। যেন শতেক ফুলের পাপড়ি আর পরাগরেণু মহল্লা ভাসায়ে দেয় আলোর সুবাসে। যেন বসন্তথৈথৈ স্নিগ্ধ গুঞ্জরিয়া যায় আলোপ্রকাশিতা আনন্দধৈবৎ। হুল্লোড় নয়, স্নিগ্ধ খুশিনিঃশ্বাস আর বিস্ময়ঝিলিক শিশুত্রয়ীর মুখে-চোখে এবং গোটা আলতো অবয়বে। এই দীপাবলিঝিলিমিলি নিশীথসন্ধ্যায় শিশুত্রয়ী নিসর্গের মতো খলবলিয়া যায়। শিশুত্রয়ীর জন্য, দুনিয়ার থোকা থোকা আলোপাখি শিশুদের জন্য, প্রতিটি সন্ধ্যাই যেন শবেবরাত হয়; এই দোয়া আর্দ্র হাওয়ার শাখায়-পাতায় আমলকি আর অড়বরইয়ের কচমা ডালে দোল খায় মিহি মিহি। শিশুখুশিতে একটি বিপন্ন বদ্বীপ সম্পন্ন হয়ে ওঠার ভরসা জাগে ফের জাগিয়া-থাকা শিশুর পিতার অন্তরে অন্তরে। ভেতর-বাহির একাত্ম হয় এই স্নিগ্ধস্পন্দ শবেবরাতের ঘরোয়া তেলাওয়াতের সুরে।

এতদঞ্চলে এর নাম ফুলঝরি, ফুলের মতন ঝরি ঝরি মৃত্তিকায় তৃণশয্যায় সিমেন্টইয়ার্ডে পড়ে বলেই অমন নাম তার, বিদেশে/ভিনজেলায় এরে তারাবাতি নামেও ডাকতে শোনা যায়। সেইটাও মন্দ সম্বোধন নয় নিশ্চয়। তারার মতনই থরথরিয়ে ঝরে, যেন তারাখসা, যেন নক্ষত্রনৌটঙ্কি। কিংবা হাউই বলা যায় তারে, মিনিয়েচার ফর্মের হাউই, বেশি খুশিয়া আর আলোকোচ্ছ্বলতা তার মিনিয়েচার সুরতের কারণেই। মিনি ফায়ারওয়ার্ক বলতে পারি। শিশুহাতে ফুলঝরি যেন ‘পলকে পলকে ঝলসি উঠিছে ঝলকে ঝলকে’, হে ঠাকুর, এ কী সৃষ্টিনাশা কাণ্ড, শবেবরাতের দিনেও মুমিনের মনে তোমার লাইনঘাটের হেন দৌরাত্ম্য অতিশয় রাহাজানিরই শামিল, ক্ষেমা দেও মোরে, এরপরও শবেবরাতের সন্ধ্যায় ‘শান্ত হাসির করুণ আলোকে’ এক অতিকায় আয়ুপক্ষী নিঃশেষে ব্যয়িত হবার বেদনায় ‘ভাতিছে নয়নপাতে’, এই ফুরিয়ে যাওয়া, পার্থিব ফুর্তির পাশেই বয়ে চলে অপার্থিব বিষাদের চিরকেলে এক নদী … নিস্তার নাই এর হাত থেকে, এমনকি শিশুস্ফূর্ত শবেবরাতের মহিমান্বিত রজনীতেও! স্যুয়িটেস্ট গানগুলো আমাদেরে চিরকাল স্যাডেস্ট থট উপহার দেয় ‘বীণাবাদিনীর শতদলদলে’ বেষ্টিত রয়েও!

গোস্তাকি নিও না আমার, ধর্মাবতার, আমি চিরদিন শবেবরাতে শিশুত্রয়ীর হাতে ফুলঝরি দিয়া যাব তুলে। সেই ম্যাজাইদের গল্পে জ্ঞানী দরবেশগণ নক্ষত্রালোকিত খড়ের গাদায় শিশুটিকে যেসব উপঢৌকন দিয়েছিলেন, যদি ম্যাজাইদের ন্যায় দিব্যজ্ঞানী আর ঐশী বিত্তশালী হতাম তবে শিশুদেরে সেই-সমস্ত ও অন্যান্য অজস্র উপঢৌকনই দিতাম আজি এই বরাত বিলিবরাদ্দবণ্টনের রাতে। জেল্লা নাই বিত্তের, পরিধানে নাই গিলে-করা আলখাল্লা বা আচকান-কিস্তিটুপি, দীন মের্জাই-পরা মাসমাইনেতে বাঁধা চাকুরিজীব এক, ফলে আমার ফুলঝরিতেই শিশুবরণ, ফেরেশ্তা স্বাগতকরণ। কবুল করো, পরমপ্রিয়, ফুলঝরিতে এই শিশুস্ফুরণ মঞ্জুর করো মনমাঝি আমার!

আর যদি নিতান্ত রুষ্ঠ হও ফুলঝরি বিতরণের বিনিময়ে ফেরেশ্তাহাসি জিনিবার হেন কূটকৌশলে, হে ত্রিকালসিন্ধু দয়াল, ক্ষম এ পামরে! এরপরও ফুলঝরি বিতরণের সাধ আমার মরবেনাকো জেনো! ফুলঝরিবিহসিত ত্রয়ী শিশুমুখ দেখার ভিতরে যদি ধর্মনাশের আশঙ্কা থাকে, হে নাথ, হেঁতালের লাঠি দিয়া আমারে পেটায়ো। তবু, প্রভু, ত্রয়ী শিশুর নসিবে এনায়েৎ কোরো ফুলঝরিবিকাশের ভবিষ্যৎ! শঙ্খদোয়া আজি ভেজিনু আমিও তব দুয়ারে, “এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম / আজ বসন্তের শূন্য হাত — / ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও / আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক। / … জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে / ধূসর শূন্যের আজান গান; / পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল / আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক। / … না কি এ শরীরের পাপের বীজাণুতে / কোনোই ত্রাণ নেই ভবিষ্যের? / আমারই বর্বর জয়ের উল্লাসে / মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে?” … হে মাবুদ, বর্বর এই জয়োল্লাস আমার থামাও, স্বপ্নে থাকতে দাও সন্ততিদিগেরে আমার, ফুলঝরিতে আলোসুরভিত থাকে যেন আমার সন্তান, আমার বাচ্চারা আনন্দে থাক, স্নিগ্ধ ফুলঝরিকিরণে কাটুক তাদের শৈশব ও সমস্ত জিন্দেগি, মৌলা আমার, মাবুদ, তুমি নিশ্চয় আলোর উদ্গাতা, আলো অপছন্দ করার কথা না তোমার অন্তত ওহাবাইটদের ন্যায়!

লেখা : জাহেদ আহমদ

… …

জাহেদ আহমদ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you