[যে-তিনটা স্ক্রিপ্ট রেডি আছে বলেছিলেন তিনি ইন্টার্ভিয়্যুতে — এর মধ্যে দুইটার নামধামও বলেছেন স্পষ্টাক্ষরে, একটার নাম ‘জীবনের বালুচরে’ যেইটা নাকি চিংড়িঘেরকারবারিদের নিয়ে এবং অন্যটা ‘চিরন্তন’ যা এক চিত্রীর যাপন ঘিরে আবর্তিত একটি নির্সংলাপ চিত্রনাট্য — এইগুলার খবরান্তর পরে কেউ করেছিলেন? উনি নিজে তো আর বানায়ে যেতে পারেন নাই সিনেমাগুলো, বলা বাহুল্য, প্রযোজক-লগ্নিকারক পান নাই নিশ্চয়, কিংবা খানিক দৌড়ঝাঁপ করে গভর্নমেন্ট-গ্রান্টস্ না-পেয়ে হতোদ্যমও হয়ে থাকতে পারেন আন্দাজ করি। কিন্তু ম্যুভিস্ক্রিপ্টগুলো তো রেডিই ছিল, এই ইন্টার্ভিয়্যু থেকে জানতে পারছি, পরে কেউ খোঁজ নিয়েছিলেন সেগুলোর হালহকিকত? নাকি ইন্টার্ভিয়্যুটাই নোটিস্ করেন নাই কেউ? হতে পারে, শেষটাও, কে কারে খেয়াল করে এই হাম-হ্যায়-বাড়া-কুমড়ার মুল্লুকে? শেখ নিয়ামত আলী (Sheikh Niyamot Ali) ইন্তেকাল করেছেন ২০০৩ খ্রিস্টাব্দে, এই ইন্টার্ভিয়্যু প্রকাশের পাক্কা পাঁচ বছর পরে, সেই পাঁচ তো গেলই এমনকি বিশ বছরেও আমাদের সিনেমার সুস্থতা কামনায় কুম্ভীরাশ্রু-ফেলা রাঘববোয়াল লগ্নিকারীরা আলীর কাহিনিত্রয়ের খোঁজ লইতে পারেন নাই!
নিজে যে-তিনটা কাহিনিচিত্র তৈয়ার করে গেছেন তিনি, এর মধ্যে একটা অবশ্য যুগ্মভাবে বানানো, তিনটাই তো দেখেছি আমরা। পাশরিয়া যাইবার নয় ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ সিনেমায় ডলি আনোয়ারের অভিনয়ে সেই ক্যারেক্টার, ‘দহন’ সিনেমায় হুমায়ুন ফরিদী কিংবা ‘অন্যজীবন’ ম্যুভিতে সেই বিটিভিনাটকে-বহুদেখা আবুল খায়ের নামের শক্তিশালী বৃদ্ধ অভিনেতাটির — যে-চুলায় আগুন ধরতে দেরি হচ্ছিল সেই চুলা রাগে গজগজ করতে করতে বহুদূর নদীতে নিয়া ফালাইবার সেই দৃশ্য! ভুলি নাই আমরা, আবার মনেও রাখি নাই। বলতে ভালোবাসি, প্রিয়তমা আমি তোমারে ভুলি নাই; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমরা ভাব করি এমন যে, কই, তেমনকিছু মনে পড়ছে না তো! দিস্ ইজ্ আস্।
সম্প্রতি ফিল্মফ্রি নিয়ামত আলীর জন্মদিনে একটা ছোট্ট স্মরণশ্রদ্ধার্ঘ অর্গ্যানাইজ্ করেছে দেখে ইয়াদ হলো, গানপারের ভাঁড়ারে ডাঁই-করা প্রাচীন কাগুজে পত্রিকার ভিতরে শেখ নিয়ামত আলীর একটা সাক্ষাৎকার আলাদাভাবে প্যাক করা আছে এইটি রিপ্রিন্ট করার প্ল্যানের আওতায়। তিরিশ এপ্রিল উনার জন্মদিন গেল, প্রয়াত পরিচালকের আত্মজার একটা রচনার মাধ্যমে ফিল্মফ্রি নিয়ামত আলীকে ট্রিবিউট জানিয়েছে দেখে ব্যাপারটা আরও ভালো লাগল; আর আমাদেরও মনে হলো যে দেরি না-করে সেই ইন্টার্ভিয়্যুটা এক্ষুনি কিছু লোকের গোচরে রাখা যাক।
ইন্টার্ভিয়্যুটা ছাপা হয়েছিল ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি ২য় বর্ষ ১৯তম সংখ্যা ‘আনন্দভুবন’ পাক্ষিকে। এইটা পাক্ষিকটার ‘বিকল্প ছবি’ শীর্ষক একটা অনিয়মিত বিভাগে পরিচালকের ছোট্ট-একটা ছবি ইনসেটে দিয়ে মিনি-ইন্টার্ভিয়্যু হিশেবে ছাপা হয়েছিল। সুমন কায়সার নিয়েছিলেন ইন্টার্ভিয়্যুটা। আমরা কায়সারের হালফিল জানি না, জানলে অ্যাপ্রুভ করায়ে নিতে পারতাম রিপ্রিন্টকালে। যে-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এইটা, ‘আনন্দভুবন’, তার সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রয়াত হয়েছেন কয়েক বছর হলো। পত্রিকাটা নানা কারণেই বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের বিনোদনম্যাগাজিন উন্নয়নে আলাদাভাবে উল্লেখ করা যোগ্য, বলা বাহুল্য, সম্পাদক গোলাম ফারুকও।
‘সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে জীবনের বালুচরে’ শিরোনামে শেখ নিয়ামত আলীর ইন্টার্ভিয়্যুটা ছাপা হবার বছরে তিনি ‘জীবনের বালুচরে’ নির্মাণ করতে চলেছেন খবর বেরিয়েছিল। বছর পাঁচের ভিতরেই তিনি জীবনের বালুচর থেকে চলে গেলেন অমরলোকের অন্ধকারে। যেই তিনটা কাহিনিচিত্রনাট্যের কথা আমরা তারই জবানি থেকে পাচ্ছি ইন্টার্ভিয়্যুতে, সেই স্ক্রিপ্টগুলোর হদিস কি কেউ করতে পারব না? — গানপার]
সূর্যদীঘল বাড়ি থেকে জীবনের বালুচরে
সূর্যদীঘল বাড়ি, দহন, অন্যজীবন — মাত্র এই তিনটি ছবিই বানিয়েছেন শেখ নিয়ামত আলী; বলাই বাহুল্য, সংখ্যা নয় ছবির শিল্পমানেই তিনি পরিচিত। আরও মানসম্মত ছবি আমরা তার কাছ থেকে আশা করতে পারি, তিনিও রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে আরও স্বাস্থ্যকর সহযোগিতা আশা করতে পারেন। সব মিলিয়েই এই ছোট সাক্ষাৎকার।
এই মুহূর্তে আপনার হাতে কি কাজ আছে? না থাকলে আগামী পরিকল্পনা কি?
পরিকল্পনা আছে নতুন ছবি তৈরি করার। তিনটা স্ক্রিপ্ট রেডি আছে এখন।
কাহিনি কার?
কাহিনি আমারই। … এ-বিষয়ে আমার একটা বক্তব্য আছে। নামী কাহিনিকারের গল্প হলেই ছবি সবসময় ভালো হবে তা নয়। বিখ্যাত কাহিনিকারদের গল্প নিয়ে তৈরি অসংখ্য ছবি ফ্লপ হয়েছে।
আপনার নতুন কাহিনিগুলোর বিষয়বস্তু ও প্রেক্ষাপট কি?
একটা হলো দক্ষিণাঞ্চলে চিংড়িচাষের ওপর। চিংড়িচাষ কেন্দ্র করে দক্ষিণাঞ্চলের নিরীহ মানুষের ওপর যেসব অত্যাচার-অবিচার চলছে, তারই নানাদিক তুলে ধরার চেষ্টা রয়েছে কাহিনিতে। আমি এজন্য দু-তিন বছর আগে বাগেরহাটে গিয়ে সব দেখেশুনে এসেছি। কাহিনির নাম ‘জীবনের বালুচরে’।
‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ থেকে ‘অন্যজীবন’। মাঝখানে প্রায় সতেরো বছর। সতেরো বছরে মাত্র তিনটি ছবি, কেন?
ফাইন্যান্স পাইনি বলে।
আপনার কাজ কি তাহলে কেবল অনুদানের ওপরই নির্ভর করবে?
আমার আর কি করার আছে? … (হেসে) … আপনারা ফিন্যান্সার বলে দিন …
এতটা সময়েও কোনো বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রযোজক আপনাকে দিয়ে ছবি তৈরিতে আগ্রহ দেখাননি?
না। আমাকে দেখলে ওরা বরং পালায়। কারণ একটা লোক প্রায় কোটি টাকা খরচ করে ছবি বানাবে, কম করে হলেও আজকাল আশি লাখ টাকা লাগে, — সেই টাকাটা উঠে আসুক, এটা তো তারা চাইবেনই। কিন্তু ওদের কনফিডেন্স আসে না কেন আমি এটা বুঝি না। ওরা আমাকে একবার টেস্ট করে দেখতে পারে কমার্শিয়্যাল ছবি আমি কেমন করি।
আসলেই আপনি কমার্শিয়্যাল ছবি করতে আগ্রহী?
হ্যাঁ। এমন ছবি করব যেগুলো একটু কাটছাঁট করে বাইরের ফেস্টিভ্যাল পর্যন্ত পাঠানো যাবে।
এই কম্প্রোমাইজটা কি তবে করবেন অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে?
না, আমি দেখিয়ে দিতে পারি। হয়তো করতে চাই না। কিন্তু দশ বছর পরপর ছবি করব এটা তো নিশ্চয়ই কোনো ফিল্মমেকারের কাম্য নয়।
আপনি তাহলে সিরিয়াসলি ভাবছেন মারপিট-নাচগানের বাণিজ্যিক ছবি বানাবেন?
হ্যাঁ, স্ক্রিপ্ট সেভাবেই করে নেয়া যাবে। সামাজিক দ্বন্দ্বের একটা কাহিনি আছে এখন। আরেকটা এক শিল্পীর জীবন নিয়ে, পেইন্টার। এতে অবশ্য কোনো সংলাপ থাকবে না, অর্থাৎ নির্বাক। নাম হবে ‘চিরন্তন’। একজন শিল্পীর জীবনের চিরন্তন ছবি। এটা একটা শর্ট ফিল্ম। এটার কথা শুনে প্রযোজকরা তো আরও পালায়।
সুস্থ ও জীবননির্ভর ছবি বানালে তা বাণিজ্যিক আনুকূল্য পায় না। আবার ভালো ছবির দর্শক তৈরি করার ব্যাপারেও সংশ্লিষ্টদের একটা দায়বদ্ধতা নিশ্চয়ই আছে — এ চক্র ভাঙবে কিভাবে?
এ চক্র ভাঙতে পারে গভর্নমেন্ট। একটা সুষ্ঠু চলচ্চিত্রনীতিমালা থাকলে কাজটা সহজ হবে। সরকার নিজস্ব ডিস্ট্রিবিউশনব্যবস্থার মাধ্যমে জীবনমুখী ছবি রিলিজ করতে পারে। ভারতের এনএফডিসি যেমন অনুদান দেয়, স্ক্রিপ্ট আহ্বান করে, বিচারের আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতায় না গিয়ে। এখানে তো আমাদের ডিরেক্টর হিশেবে মর্যাদাই দেয় না। শিক্ষিতরা স্থানীয় ছবি দেখা ছেড়েই দিয়েছে।
‘পদ্মানদীর মাঝি’ কিংবা ‘দীপু নাম্বার টু’ দেখতে তো শহরের সিনেমাহ্যলগুলোতে ভালোই ভিড় হয় …
সেটা শিক্ষিত সমাজের কত অংশ? গ্রামে, মফস্বলে এসব ছবি একেবারেই চলে না; যায়ই না অনেক জায়গায়।
এনএফডিসি-র পদ্ধতিটা একটু বলবেন?
এনএফডিসি দেশের বরেণ্য চলচ্চিত্রকারদের ডেকে আনবে; তারপর বলবে, আপনাকে চল্লিশ লাখ — এখন বোধহয় পঁয়তাল্লিশ — টাকা দেয়া হলো, একটা ছবি করে দেন। এক বছর বা ছয় মাসের মতো একটা পিরিয়ড থাকে। তারা ছবি করে দেন। ব্যস, পরিচালকের দায়দায়িত্ব শেষ।
ভালো ছবির পৃষ্ঠপোষকতার জন্য বর্তমানে যে অনুদানের নিয়মটি আছে সেটি সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
এটা সুস্থ ছবির নির্মাতাদের সাহায্য করছে মানতেই হবে। আমি যে-তিনটি ছবি করেছি তার তিনটিই অনুদানের। কিন্তু এ পদ্ধতিকে আরও সুষ্ঠু ও কার্যকর করার অবকাশ আছে।
সাক্ষাৎকারগ্রাহক : সুমন কায়সার
… …
- বাংলায় হিপহপ / ২ || আহমদ মিনহাজ - August 6, 2022
- যেমন বলেন জয় - August 5, 2022
- নিজের সঙ্গে নিজের সময়ের বিষ - August 5, 2022
COMMENTS