কন্টেম্পোরারি আর্ট মিউজিয়ামের কিউরেটর মশাই নিজের নয়া এক্সিবিশনটার মহরৎ হবে যেইদিন সেইদিনকার সুবেশা নারী-পুরুষ ভদ্রমহোদয়-ভদ্রমহোদয়াদের ভরা মজলিশে একটা তাজ্জবকর মুসিবতে পড়েন। সেই মুসিবতের দৃশ্য ও দৃশ্যান্তরালের কাহিনি নিয়া আবর্তিত হয়েছে ‘দ্য স্কয়ার’ ম্যুভিটা। আর মুসিবত তো একলা আসে না, একটার লেইঞ্জায় আরেকটা মুসিবত ধারাবাহিকাকারে আসতেই থাকে। সেইগুলা মুকাবিলায় কিউরেটর মশাই এবং গোটা মিউজিয়ামের নৈতিক নড়বড়েপনা আর নাকানিচুবানি নিয়াই সিনেমা আগাইতে থাকে।
একটা বাক্য দিয়াই যদি সিনেমাসার ধরতে যাইতে হয় তাইলে সেই বাক্যটা হবে এমন : ‘হিউম্যানিটি অ্যাক্সেস করার লাইগা আমরারে কতটা ইনহিউম্যান হওয়া লাগে?’ এই বাক্যটা আমরা সিনেমাতেই দেখতে পাই যখন স্টকহোমের সেই মিউজিয়ামের এক্সিবিশনটার জনপ্রচারণা চালানো হয় সেই পিআর-ক্যাম্পেইনের ট্যাগলাইন হিশেবে। এবং সিনেমার শুরু থেকেই লাইনটা মাথায় ব্যথার মতন খোঁচাইতে থাকে। এবং সিনেমা চলতে চলতে খোঁচাটা আরও অতিকায় আকার নিতে থাকে।
ক্যারেক্টারটার নাম ক্রিস্টিয়ান জুয়েল নিয়েল্সেন, যিনি কিউরেটর এই প্রদর্শনীর। ‘দ্য স্কয়ার’ সিনেমায় এই প্রশ্নটাই ফিরে ফিরে আসে ক্রিস্টিয়ানের পার্সপেক্টিভ থেকে যে হিউম্যানিটি হাসিল করার জন্য কতটা ইনহিউম্যানিটি ইস্তিমাল করা লাগে আমাদেরে। এই খোঁচাটা কন্সট্যান্টলি আমাদেরেও অস্বস্তিতে রাখে গোটা সিনেমায়। একদম পয়লা সিনে যখন আমরা ক্রিস্টিয়ানরে দেখি তখন উনারে দেখামাত্র মনে হয় উনি খুবই শান্তশিষ্ট, মর্যাদাবান এবং গোছানো স্বভাবের একটা মানুষ। অচিরে একটা ড্রামাটিক ইন্সিডেন্ট ঘটে প্রায় সিনেমারম্ভেই এবং ক্রিস্টিয়ানের কম্ফোর্ট জোনটারে একদম গুঁড়াইতে শুরু করে। বেচারার ম্যানিকিউর-করা লাইফটারে এক্কেরে ঝামা পাত্থর বানায়া দিতে থাকে। এবং মিউজিয়ামের ইনোগ্যারাল অধিবেশনে হাজির মজলিশের পক্ষে তো বটেই, এমনকি সবজান্তা আমাদের পক্ষেও প্রেডিক্ট করা প্রায় ইম্পোসিবল হয়ে ওঠে এর পরের সিনে কি ঘটতে চলেছে। এরপরেও দর্শক হিশেবে আমাদের কাছে বেখাপ্পা হলেও অনেকটা জানে-ধড়ফড়ানির মতো অস্তিত্ব-জানান-দেয়া উপভোগ্য হয়ে ওঠে ক্রিস্টিয়ানের একের পর এক বিপদাপন্ন পরিস্থিতি সিনেমায় দেখতে থাকা ক্রমাগত।
রুবেন অস্টলান্ড পরিচালনা করেছেন সিনেমাটি। ডিরেক্টর হিশেবে উনি সিনেমাটা বানাইতে যেয়ে একটা আনইউজুয়্যাল স্টাইলই নিয়েছেন বলে মনে হয়। এমন অনেক শট আছে যেইগুলায় ক্যামেরা খামাখাই লিঙ্গার করে বলে মনে হয়, এমনকি কোনো ক্যারেক্টারই সিনে নাই কিন্তু ক্যামেরায় ফ্রেইম ধরে রাখা আছে বহুবার বহু জায়গায়। এছাড়া ধরেন যে এর আবহগত শব্দ ও সুর যদি হিসাবকিতাবে যাই দেখব অদ্ভুত অসহনীয় শব্দের সমাহার গোটা সিনেমায় এন্তার। একটা দৃশ্যে দীর্ঘ সময় নিয়ে বাচ্চার কান্না কানের স্বস্তি চিরে ফালাফালা করে দেয়। আওয়াজের লগে এই সিনেমার দৃশ্যের বৈপরীত্য লক্ষ করার মতো। অত্যন্ত পশ অত্যন্ত গোছানো মিউজিয়াম প্রেক্ষাগৃহ, অথচ শব্দাবহ সহনীয় নয় এবং কোথাও কোথাও আসুরিক প্রায়। এমন অনেক ফ্রেইম আছে যেইগুলা সাধারণ বিবেচনায় আরও হ্রস্ব সম্পাদনায় গৃহীত হতো গড়পড়তা ছায়াছবিগুলায়।
আর এইসব কারণেই সিনামাটা নার্ভের উপর প্রেশার ফালায় এর দর্শকদের। ডিরেক্টরের অভিপ্রেতই ছিল হয়তো দর্শকদের নার্ভে হ্যামার মারা। অস্টলান্ড আমরারে এমন একটা ইউনিক জগতের মুখামুখি করেন এই সিনেমায় যে এর সার্ফেইস লেভেলের নিচে বা গভীরে এমনকিছু বক্তব্য আছে কি না তা আমরা মুহুর্মুহু খুঁজে চলি। একটা মনে-রাখবার-মতো সিক্যুয়েন্সের কথা না-হয় একটু বলি এইখানে। টেরি নোট্যারি সিনেমায় দৃশ্যত শক্তিশালী রোলটা করেছেন, রোলটার সিনেমায় নাম পাই ওলেগ এবং এই ওলেগ ক্যারেক্টারটা পার্ফোর্ম্যান্স আর্টিস্ট এক, যাকে এক্সিবিশন-উদ্বোধনী সুধীজনসমাবেশের প্রেক্ষাগৃহে ছেড়ে দেয়া হয় এবং যে প্রায় চারপেয়ে জন্তুর কায়দায় টেবিলে উঠে বিচিত্র মুখব্যাদান আর শরীরী বীভৎসতায় আমাদের মতো মোটাতাজা অ্যারিস্টোক্র্যাটদের জিনা হারাম করে দেয় সিনেমার পুরোভাগে। এই দৃশ্যটা স্টার্ট হয় ভীষণ ঢিলেঢালাভাবে, একদম কমিক রিলিফের কায়দায়, দেখে মনে হয় এক্ষুনি কিছু মজার কাণ্ড ঘটবে, কিন্তু ক্রমে সেই দৃশ্য রূপ নেয় বীভৎসতায়, ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে প্রেক্ষাকামরায়, এবং হাজিরানে-মজলিশের কেউ বুঝে উঠতে পারে না এই ভীতিকর রিয়্যালিটির লগে রিয়্যাক্ট করবে কীভাবে। এমনকি আমরাও থ বনিয়া যাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখবিবর বিস্ফারিত করে। ক্যারেক্টারটায়, ওলেগ নামের ক্যারেক্টারটায়, পার্ট নিয়েছেন যেই অভিনয়শিল্পী, তারে দেখেছি আমরা ‘রাইজ অফ দি প্ল্যানেট অফ দি অ্যাইপ্স’ এবং ‘অ্যাভাটার’ সিনেমায় আগেও। ‘দ্য স্কয়ার’ সিনেমায় প্রায় সমধর্মী ফিজিক্যাল অ্যাপিয়্যারেন্সের রোল করেছেন তিনি। শুরুতে একটা ফানি ইফেক্ট, পরে একটু হরর টাচ, ক্রমশ অসহায় একটা হালতে যেয়ে স্তব্ধ হয়ে ম্যুভিটা আমরা দেখতে থাকি বা শ্বাসরুদ্ধ সংবেদে স্ক্রিন ছেড়ে কেউ কেউ হয়তো উঠেও পড়ি।
ঠিক এই কিসিমেই ডিরেক্টর বারেবারে আমাদের শ্রেণি, বর্ণ, গোত্র আর আত্মন্যায় কিংবা আমাদের হক-নাহক ইত্যাদি বিষয়ক ধারণাগুলারে নিয়ে খেলেন কন্টিনিউ পুরা ছায়াছবি জুড়ে। এক্সিবিশন-কিউরেটর ক্যারেক্টারে ক্লেইস ব্যাং ছাড়াও এলিজাবেথ মস্, ডোমিনিক ওয়েস্ট এবং টেরি নোট্যারি তো বটেই যিনি বীভৎস রসের বিচিত্র স্তরের একটা স্বস্তিহন্তা এক্সপেরিয়েন্স দিতে পেরেছেন তার ক্যারেক্টারচিত্রণে, এরা সবাই মিলে একটা ডার্ক কমেডিই দিয়েছেন আমাদেরে। এবং মনে রাখার মতো ও ভুলতে চাইবার মতো ডার্ক কমেডিই বলতে হয়।
আড়াই ঘণ্টা ব্যাপ্তির ‘দ্য স্কয়ার’ সিনেমায় আপনি কী দেখলেন তা নিয়া ভাবতেই থাকবেন কূলকিনারহারা স্ক্রিন থেকে চোখ পাকাপাকি উঠিয়ে নেবার পরে। এবং কোন পন্থায় যাপিবেন সাধের জীবন, দৈনন্দিনের নীতি ও নৈতিকতা ইত্যাদি নিয়া আপনার সপ্রশ্ন অস্বস্তি তৈরি হতে পারে এইটা দেখার পর থেকে। বেসুরোও মনে হতে পারে কারো কারো কাছে, এবং বলা বাহুল্য সব সিনেমা তো সবাইকে সমান খোরাক বা খানাখাদ্য যোগাবে এমন হলফনামা নাই কোথাও। অবশ্য যদি আপনি মগজের পুষ্টি সিনেমায় পেতে চান তাইলে এই সিনেমাটা তালিকায় রাখতে পারেন। সময় করে দেখতে পারেন ‘দ্য স্কয়ার’, যা আপনাকে একটা আউট-অফ-দ্য-বক্স অভিজ্ঞতা আস্বাদনের সুযোগ এনে দিতে পারে। অ্যাট-লিস্ট ট্রাই ইট ওয়ান্স।
Movie-title: The Square ।। Genre: satirical drama film ।। Written & Directed by Ruben Östlund ।। starring Claes Bang, Elisabeth Moss, Dominic West & Terry Notary ।। Released in 2017
রিভিয়্যুকারী : মিল্টন মৃধা
… …
- কাব্য ও বিজ্ঞান || শ্রীঅশোকবিজয় রাহা বি.এ - January 14, 2025
- মুরারিচাঁদ কলেজ, অশোকবিজয় রাহা এবং একটি অগ্রন্থিত রচনা || মোহাম্মদ বিলাল - January 14, 2025
- জনতার কাব্যরুচির প্রতীক || ইলিয়াস কমল - December 14, 2024
COMMENTS