[গানের শুধু চিত্ত নয়, বিত্তের খবরটাও দরকার রাখা। আজকের দুনিয়ায় বিত্তনিরপেক্ষ কোনোই চিত্তবৃত্তি খুঁজে পাওয়া যাবে না তা হয়তো নয়, যাবে; বেসাতিবিত্তের এই বাজারে আমরা খবর রাখি বা না রাখি যে-কোনো সুরের সংগীতের পাখা উড়ালের সঙ্গে সঙ্গেই সেইটা বাণিজ্যবাতাসের তোড়ে যেয়ে পড়ে এবং খাবি খায় কিংবা বাণিজ্যটা ভালোমতো করে। উপেক্ষা না করে ব্যাপারটা সামলানো দরকার। সুরকার বা গানস্রষ্টা ব্যাবসাটা না করলেও বাজার ঠিকই ব্যবসাটা করে নেয় বা করিয়ে নেয়। বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী কথাটা তো আর এমনি-এমনিই বলা হয় না। কাজেই উদাসীন থাকার সুযোগ নাই। আমরা ‘গানপার’ থেকে দেশবিদেশের গানের ব্যবসাবাতাসের পূর্বাভাস ও সফলতা-ব্যর্থতার সংবাদটা রাখতে চাই। ঠিক এমনই অভিপ্রায় থেকে এই লেখাটা ছাপানো। ১৯৯৭ সনের নভেম্বরে মুক্তিপ্রাপ্ত ম্যুভি (Titanic) টাইটানিকের যে-গানটা বাংলার গ্রামেগঞ্জেও মুখে মুখে ফিরেছে, সেই গানের গল্পটা প্রিসিলা হক লিখেছেন অনবদ্য ঢঙে। এইটা ছাপা হয়েছিল এর আগে ‘আনন্দভুবন’ পত্রিকায় ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে। এত বছর বাদে এইটা আবার প্রকাশকালে নেসেসারি কিছু সম্পাদনা সারতে হয়েছে, সেসব সম্পাদনা বাক্যস্থিত কালিক কিছু নৈকট্য/দূরত্ব নির্দেশ ব্যতিরেকে বেশি কিছু নয় বটে। লেখাটার পূর্বপ্রকাশসূত্র ও উৎস : আনন্দভুবন, বর্ষ ৩ সংখ্যা ১, ১৬ মে ১৯৯৮, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪০৫, ঢাকা। আগের প্রকাশে লেখাটার শিরোনাম ছিল ‘মাই হার্ট উইল গ্য অন’, জনপ্রিয় সেই গানের নামে। এইবার শিরোনাম বদলানো হয়েছে। এই কিসিমের আরও রচনা আমরা ছাপতে চাই, লিখতে চাই, পড়তে চাই, ভাবতে চাই, চেনা-আধাচেনা-অচেনা বাংলা ও দুনিয়ার সমস্ত ভাষার গানের জীবনী ও যন্ত্রণা আমরা গানপারে দেখতে চাই। লিখতে চাই নতুন দিনের গানের ব্যবসাসাফল্য অথবা ব্যর্থতার আখ্যান, আর্কাইভে রাখতে চাই দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ রচনাটাও। — গানপার]
টাইটানিক (Titanic) সাউন্ডট্র্যাক অ্যালবাম প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিলবোর্ড চার্টে একনম্বরে ছিল। আর কয়েক সপ্তাহ শীর্ষে থাকলেই এটি হতো সর্বকালের সর্বাধিক বিক্রীত সাউন্ডট্র্যাক অ্যালবাম। তার মানে বিশাল টাইটানিকের সাফল্যের ঝুলিতে যোগ হতো আরেকটি রেকর্ড।
এ-সাফল্যের মূল কৃতিত্বের দাবিদার জেমস হোনার; যিনি এ-সাউন্ডট্র্যাকের মিউজিক কম্পোজার। ইতোমধ্যেই তিনি তার সাফল্যের চূড়ান্ত স্বীকৃতি পেয়ে গেছেন অস্কারের একটি স্বর্ণমূর্তি জিতে নিয়ে। টাইটানিক ছবির পরিচালক জেমস ক্যামেরন যখন হোনারকে ছবিটির মিউজিক কম্পোজিশনের জন্য বলেন তখন দুটো শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন, — কোনো মার্গীয় সংগীত এবং চটুল পপ যেন না হয়। টাইটানিকের শেষ দৃশ্যে রোজ্ (কেইট উইন্সলেট)-এর অনুভূতিকে বোঝানোর জন্য একটি ল্যভ থিমের প্রয়োজন ছিল। বুদ্ধিমান হোনারকে এরচেয়ে বেশি কিছু বলার প্রয়োজন ছিল না ক্যামেরনের। এমতাবস্থায় হোনার গীতিকার উইল জেনিংসকে বেছে নিলেন গান লেখানোর জন্য। জেনিংস খুব যত্নের সাথে একটার সাথে একটা শব্দ জুড়ে তৈরি করলেন ‘মাই হার্ট উইল গ্য অন’ গানটা।
জেমস হোনারের সাথে আগে থেকেই পরিচয় ছিল সেলিন ডিওনের। দুজনেরই জন্মভূমি ক্যানাডা। হোনারের বিশ্বাস ছিল সেলিন ডিওন খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবে এই ল্যভ থিমটাকে। তাছাড়া গায়িকা হিশেবে সেলিন ডিওন জনপ্রিয় হয়েছিলেন সাউন্ডট্র্যাকের গান গেয়েই। ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’, ‘আপ ক্লোজ অ্যান্ড পার্সোনাল’ সেই জনপ্রিয়তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
সাতানব্বইয়ের মে মাসে চোদ্দ-পনেরোজনের এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গানটির ডেমো রেকর্ড হয়ে যায়। সেদিন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ক্যামেরন, হোনার, সেলিন ডিওন, সেলিনের স্বামী রেনি অ্যাঞ্জেনিল এবং সনি কোম্প্যানির কিছু কর্মকর্তা। রেনি অ্যাঞ্জেনিল সেলিনের আগের গানগুলোর সময়েও যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। এরপরও কেমন-এক টেনশন কাজ করছিল সেলিনের মধ্যে। সে-বছরের গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের তিনদিন আগে নিউইয়র্কের এক হোটেলে বসে তারই স্মৃতিচারণ করছিলেন ডিওন। তিনি বলেন, “ … ‘মাই হার্ট উইল গ্য অন’-এর রেকর্ডের দিন খুব নার্ভাস ছিলাম। সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। পানি না খেয়ে বারবার কফি খাচ্ছিলাম আর ঘামছিলাম। আর গান শুরু করার পর তো আমার দু-হাঁটু ঠকঠক করে কাঁপছিল। তবুও খুব ভালোভাবেই শেষ হয়েছিল রেকর্ডিং।” গান শুনে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিলেন জেমস ক্যামেরন।
এ-পর্যন্ত ক্যামেরন কোনো কাজেই ব্যর্থ হননি। ক্যামেরনের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট তিনি একজন পার্ফেকশনিস্ট। খুব ভালো করেই বোঝেন কখন কি করতে হবে। আর প্রতিভা চিনতে ক্যামেরন কখনো ভুল করেন না। টাইটানিকের সাউন্ডট্র্যাকের জন্য তিনি একজন যোগ্য লোককেই বেছে নিয়েছিলেন।
(Titanic) টাইটানিক সাউন্ডট্র্যাক ‘মাই হার্ট উইল গ্য অন’-এর ধাঁচ কিছুটা আইরিশ গানের মতো। আইরিশ ফিমেইল সিঙ্গার অ্যানাইডা সাধারণত এ-ধরনের অন্যবিটের গান গেয়ে থাকেন। সেলিন ডিওন এতটাই দরদ দিয়ে গেয়েছেন গানটা যে সেটা ছুঁয়ে গেছে অসংখ্য নারী-পুরুষের হৃদয়।
অথচ এমন একটি সাউন্ডট্র্যাকের অ্যালবাম বাজারজাত করতে ক্যামেরনকে কম ভুগতে হয়নি। সবাই ভেবেছিল ক্যামেরনকে দিয়ে ল্যভ স্টোরি হবে না। তাই বিশ্ববিখ্যাত রেকর্ডিং কোম্প্যানি পোলিগ্র্যাম টাইটানিক সাউন্ডট্র্যাকের ব্যাপারে কোনো আগ্রহই দেখায়নি। সেই সুযোগে বাজিমাত করেছে সনি।
সে-বছর ফেব্রুয়ারিতে টাইটানিক সাউন্ডট্র্যাক ‘মাই হার্ট উইল গ্য অন’ রিলিজ হবার সাথে সাথেই বিলবোর্ড সিঙ্গেলস্ চার্টে একনম্বরে চলে আসে। এর কয়েকদিনের মধ্যেই পুরো সাউন্ডট্র্যাক অ্যালবামটি রিলিজ হলে সেটিও বিলবোর্ডে একনম্বর স্থানটি নিয়ে নেয়। অথচ তখন বিলবোর্ড চার্টে টাইটানিক সাউন্ডট্র্যাকের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল শক্তিশালী পার্ল জ্যাম। অ্যালবামটি তখন একই সাথে চোদ্দটি দেশের চার্টের শীর্ষে অবস্থান করছিল। মাত্র ৬ সপ্তাহে অ্যালবামটির ৫ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছিল কেবল অ্যামেরিকাতেই। ফলে ৮ বার প্ল্যাটিনাম রেকর্ড সার্টিফিকেট লাভ করে অ্যালবামটি। কেবল তা-ই নয়, মার্চ মাসে টাইটানিক সাউন্ডট্র্যাকের বিশ্বব্যাপী শিপমেন্ট ছিল ১৫ মিলিয়ন।
ব্যবসায়িক সাফল্যে গর্বিত সনি কোম্প্যানি তখন একটি রিসার্চ শুরু করে টাইটানিক সাউন্ডট্র্যাক অ্যালবামটির ক্রেতাদের উপর। এতে দেখা যায় অ্যালবামটির অধিকাংশ ক্রেতা মহিলা, যাদের বয়স চব্বিশের নিচে এবং চল্লিশের উপরে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনাটি ঘটেছিল সে-বছরের ভ্যালেন্টাইনডেতে। সেদিন খোদ অ্যামেরিকাতে অ্যালবামটি বিক্রি হয়েছে ৮ লক্ষ ৪৭ হাজার ৬ শত ৬০ কপি। কিছুদিনের মধ্যেই টাইটানিক সাউন্ডট্র্যাকের বিক্রি ২০ মিলিয়ন কপি ছাড়িয়ে গেছে।
টাইটানিকের মূল ল্যভ থিম হলো ‘মাই হার্ট উইল গ্য অন’ গান এবং তার বাদ্য। এই পুরো গানটিই জায়গা পায় সেলিন ডিওনের নতুন অ্যালবাম ‘লেটস্ ট্যক অ্যাবাউট ল্যভ’-এ। এ অ্যালবামটিও বিলবোর্ড শীর্ষদশ চার্টে ১৮ সপ্তাহ ধরে একটানা অবস্থান করেছে। এই অ্যালবামেরও মূল ‘মাই হার্ট উইল গ্য অন’ গানটা। এক্ষেত্রে বলা যায়, ‘লেটস্ ট্যক অ্যাবাউট ল্যভ’ যদি সে-সময় রিলিজ না-হতো তবে টাইটানিক সাউন্ডট্র্যাকের বিক্রি আরও অনেকগুণ বেড়ে যেত।
হলিউডের নির্মিত ছবির সাউন্ডট্র্যাক রিলিজ করার প্রচলন শুরু হয় গোড়া থেকেই। প্রথমদিকের সাউন্ডট্র্যাক অ্যালবামগুলোর ব্যবসায়িক সাফল্য উল্লেখযোগ্য। ‘সাউন্ড অফ মিউজিক’, ‘ব্যুচ ক্যাসিডি অন দ্য সানড্যান্স কিড’, ‘স্যাটার্ডে নাইট ফিভার’ ইত্যাদি সাউন্ডট্র্যাক অ্যালবামের কথা খুব সহজেই এসে যায়। এরপর মাঝামাঝি সময়ে চটুল পপের মহা উত্থানে চলচ্চিত্রের সাউন্ডট্র্যাক চার্টে তেমন সফলতা আসেনি কিছুদিন।
আশির দশকের শেষে এসে এই চিত্র আবার বদলাতে শুরু করে। সেই সময়ের সাউন্ডট্র্যাক অ্যালবামগুলোর মধ্যে গ্রিজ, পার্পল রেইন, টপগান, ডার্টি ড্যান্সিং, ফ্যুটল্যুজ প্রভৃতি বিলবোর্ড চার্টে সাফল্য পায়। এরপরেই ‘রবিনহুড দ্য প্রিন্স অফ থিভস’ মহা শোরগোল তোলে। এ-ছবির সেই বিখ্যাত গান ব্রায়ান অ্যাডামসের ‘এভরিথিং আই ডু, আই ডু ফর য়্যু’ পরপর ১১ সপ্তাহ চার্টে শীর্ষে থেকে রেকর্ড করে। এরই ঠিক দুই বছর পরে ‘বডিগার্ড’ ম্যুভির সাউন্ডট্র্যাক ভেঙে দেয় আগের সব রেকর্ড। এই অ্যালবামেই রয়েছে হুইটনি হিউস্টনের সেই বিখ্যাত গান ‘আই উইল অলোয়েজ ল্যভ য়্যু’। ফলে ধারাবাহিকভাবে সাউন্ডট্র্যাক অ্যালবাম সাফল্য অর্জন করতে থাকে। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় ‘লায়ন কিং’, ‘আলাদিন’, ‘ওয়েইটিং টু এক্সেল’, ‘দি প্রিচার্স ওয়াইফ’, ‘এভিটা’, ‘স্পেস জ্যাম’, ‘ম্যান ইন ব্ল্যাক’ ইত্যাদি সিনেমার কথা।
…
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS