যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম…  || আহমদ মিনহাজ

যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম… || আহমদ মিনহাজ

মাঝরাত্তিরে কানে হেডফোন ঠেসে স্পটিফাই-এ ঢুকসিলাম আঞ্চলিক গান শোনার আশে। মাইজভাণ্ডারি গানের খনি চাটগাঁয় আঞ্চলিক গানের সম্রাজ্ঞী শেফালী ঘোষের গলাখান, অনেকদিন বাদ, শোনার মতলব ছিল মনে। সমুদ্রমেখলা চাটিগ্রাম, চাটিগাঁ, চাটগাঁ, চট্টল, চট্টলা কিংবা দেশমান্য চট্টগ্রাম, যে-নামে তারে ডাকি-না-কেন, আমার ধারণা, সকলের কমবেশি প্রিয়। নদী, পাহাড় আর উত্তাল সাগরে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দয়াময়ী প্রকৃতি তারে আচ্ছামতো সাজাইছেন। প্রকৃতির উদার কৃপার সঙ্গে গোটা চট্টলা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিতরে থাকা জীবনপ্রণালীর বাহার তাকে আরো খুবসুরত করে তুলসে। মনে-মনে ভাবি, কী নেই চট্টলার! সওদাগরি ঐতিহ্যে সে বাংলার অলংকার। বাংলা ভাষাটা নাকি সিলেটে এসে আহত হইসিল আর নিহত হইসে চট্টগ্রামে এসে;—প্রমথ চৌধুরী রসিকতার ছলে নাকি দুর্মতিবশে উক্তিখান ঠুকসিলেন জানি না, তবে উনার এই ব্রাহ্মণ্যদুষ্ট পরিহাসমাখা বাক্যবাণের তোয়াক্কা না করে সিলেট ও চট্টলার ভাষা তার আপন কক্ষপথ খুঁজে নিতে কসুর করেনি। বাংলা ভাষার উদরের ভিত্রে ঘূর্ণি তুললেও সিলেটি আর চাটগাঁইয়া লোকজন দেশের অপরাপর অঞ্চলগুলার মতোন সদর্পে স্থানিক ভাষাটারে লালন করতেসেন জীবনভোর। দেশবাসীর কাছে নিজ অঞ্চলের গরিমা প্রচারে তাদেরকে সদা অদম্য দেখায়। গরিমায় ধরা থাকে উভয় অঞ্চলের স্থানিকতায় সক্রিয় বিচিত্র সব রংয়ের খেলা, যার প্রভাব দেশের আপামর সাধারণকে অত্র অঞ্চল দুটির ব্যাপারে উৎসুক রাখে। বলা ভালো, উৎসুক হইতে তারা সকলকে প্ররোচিত করেন।

চট্টলাকে একদিক হইতে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী মানা লাগে। মধ্যযুগের সুদীর্ঘ কালপর্বে রাজমহলে জন্ম নেওয়া সাহিত্যের সূতিকাগার রূপে তার ভূমিকা বা আবেদন বিষয়ে নতুন করে ধান ভানার কিছু নাই। দৌলত উজির বাহারাম খান ও আলাওলের কাব্যপ্রতিভায় ভাষার যে-রংবাজিটা মূর্ত দেখি সেইটা মোটা দাগে সমুদ্র আর পাহাড় পরিবেষ্টিত এই জনপদে বিচরণের সুবাদে উনারা ঘটাইসিলেন ওই সময়। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, মুহম্মদ এনামুল হক ও আহমদ শরীফ অবধি বহমান গবেষণা পরম্পরা জাতির কাছে সেই ইতিহাস তুলে ধরতে খামতি রাখে নাই।

বায়েজিদ বোস্তামির মোকামকে ঘিরে মাইজভাণ্ডারি কাওয়ালে শানদার চট্টলার জনজাতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বিস্ময়কর! বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের উত্থানরেখা যদি কেউ সুলুক করতে নামেন সেক্ষেত্রে খুলনার সঙ্গে চট্টলার নাম না নিয়া নিস্তার নাই। ইংরাজ খেদানোর জঙ্গে মাস্টারদা সূর্যসেন, বিনোদ বিহারী চৌধুরী, প্রীতলতা থেকে আরম্ভ করে কত শত নাম এই জনপদে একসময় ভেসে বেড়াইত! সাদা সায়েবের রাজপাট হঠাও আন্দোলনের যত তরঙ্গ ভারতবর্ষে উথলে উঠসে সেখানে কলকাতা-দিল্লি-মুম্বাই বা অমৃতসরের সঙ্গে চট্টলাও কেন্দ্রীভূত ছিল সদা। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ইংরেজ বিতাড়নের যজ্ঞে জাপানের সঙ্গে মিত্রতা ও সমর-পরিকল্পনায় চট্টলার সমুদ্রবন্দর স্বাভাবিক কারণে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। চট্টগ্রাম বন্দরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া ও সেখানে আজাদির প্রথম নিশান পোঁতার ছক আঁকছিলেন নেতাজি।

চট্টলা হচ্ছে সেই রণভূমি যেখানে ইতিহাস ফিরে-ফিরে নিজেকে পরখ করসে। একাত্তরে যেমন কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র শেখ মুজিবের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অনিশ্চয়তায় জাতিকে দেশমুক্তির লড়াইয়ে সংহত থাকার বার্তা দিতে বিলম্ব করে নাই। বিএনপি সৃষ্ট ন্যারেটিভের কারণে কালুরঘাট নিয়া পরে অকথ্য সব ক্যাচাল মহিমাটারে ব্যাপক ক্ষুণ্ন করলেও ফিরে-ফিরে চট্টলাকে স্মরণ করতে জাতি বাধ্য ছিল তখন। বাহান্ন হইতে সত্তর অবধি ক্রমপরিণত দেশমুক্তির আন্দোলনে চালকের আসনে সমাসীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ও অবদানকে বেমালুম লোপাট করার চেষ্টা মোটেও প্রীতিকর ছিল না। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক লড়াইয়ে নামার একখান ঘোষণাকে ভিত্তি ধরে বিএনপি রেজিম যাকে স্বাধীনতার রূপকার বইলা চালানোর চেষ্টায় প্রাণপাত করলেন, বিধির নির্মম পরিহাস বলতে হয়, সেই জিয়াউর রহমানকে চট্টলার সার্কিট হাউজে গুলিতে ঝাঁঝরা হইতে হইসিল! ইতিহাস তার আপন নিয়মে সকল অন্যায়ের শোধ তোলে। কাউকে রেয়াত করে না। আইয়ুব-ইয়াহিয়াকে করেনি। জিয়া-এরশাদ বা খালেদাকেও করে নাই। হাসিনা রেজিম অদ্য যে-ভুলগুলা করতেসেন বইলা মন প্রত্যয় যায়, ওইসব ভুলের মাশুল যারপরনাই উনাদেরকে দিতে হইতে পারে। ইতিহাস হইতে কেউ শিক্ষা নেয় না;—জন্মাবধি ভাঙা রেকর্ডের মতো কানের দুই পাশে ভনভন করতে থাকা বাক্যখানার মাহাত্ম্য প্রকৃত অর্থে যেমন কর্ম তার তেমন ফল বৈ অন্য কিছু নয়। ক্ষমতার মদিরাপানে মদহুঁশ লোকজনের কথাটা সচরাচর স্মরণ থাকে না। পরিণামে সর্বনাশ ঘনায় একদিন। কর্মফলের চক্র তার ষোলকলা পূর্ণ করে বিষে পরিণত হয় আর এভাবে অত্যাচারীর মরণ ডেকে আনে।

সে যাকগে, রুচিশীল বইয়ের প্রকাশনা আর ছোটকাগজের মতো রেনিগেড ঘটনা চট্টলাকে স্মরণে রাখতে বাধ্য করে। ভোজনবিলাসীর কাছে যেমন চাটগাঁইয়া শুটকির কদর আজোবধি অমলিন। যেমন অমলিন তার পার্বত্য অঞ্চল আর সেখানে থিতু আদিবাসী সংস্কৃতির দুর্দান্ত বৈভব। রাজশাহী-রংপুর ও দিনাজপুরের সাঁওতাল পল্লী, মৈমনসিংহ গীতিকার তীর্থভূমি বৃহত্তর ময়মনসিংহ যদি গারোদের কারণে বিশিষ্ট হয়, সিলেট যদি খাসি ও মণিপুরি সংস্কৃতির উদ্ভাসে অনন্যমাত্রিক বইলা গণ্য হয়, চট্টলার ঘন পাহাড়সারির ফোকর গলে উঁকি দেওয়া বৌদ্ধ মঠ এই দেশের স্থানিক সংস্কৃতির বর্ণিল পরিচয়কে অবিরত জানান দিতে থাকে। কর্ণফুলী আর নাফ নদীটাও এভাবে দেশবাসীর কাছে নিজের স্থানমাহাত্ম্য তুলে ধরতে কসুর করে না।

কর্ণফুলীর ঢল যেখানে সাগরের সঙ্গে মোহনা তৈয়ার করে, নোনা জলের সঙ্গে মিঠা জলের মিলনে জল যেখানে দুইটা রূপে একে অন্যকে আলিঙ্গনে আকুল হয়, যুগপৎ নদী দূষণ ও লোপাটের ধাক্কায় বেহাল দেশটার মতো বদসুরত দশায় উপনীত চট্টলা উন্নয়নের শত গুণ্ডামি সয়ে কর্ণফুলীকে সাক্ষী মানে বারবার। শেফালী ঘোষ একদিন গাইসিলেন বটে : ছোড ছোড ঢেউ তুলি ফানি / লুসাই পাহাড়ততুন লামিয়ারে যার গৈ কর্ণফুলী। লুসাই পাহাড় থেকে ছোট-ছোট ঢেউ তুলে নেমে আসা খরস্রোতা নদীটার কাছে দুখিনী চট্টলা ফিরে-ফিরে তার দুর্ভোগের কাহানি শোনায়। ওই নদীটারে সাক্ষী মেনে নালিশ ঠোকে সকাতর : ও রে কর্ণফুলী রে সাক্ষী রাখিলাম তোরে / অভাগিনীর দুঃখর হথা হবি বন্ধু রে। কান্তা নন্দী ও শেফালী ঘোষের মতো শিল্পীর কণ্ঠে সে-দুঃখের কাহানি শুনতে বসে কানে লটকানো বাহারি দুলের ন্যায় নদীটা মনকে মেদুর করে যায়!

বরাক উপত্যকা হইতে নামা সুরমা ও কুশিয়ারার সঙ্গে কর্ণফুলীর সাক্ষাৎ মিতালী নাই। তাদের যা-কিছু মিতালি তার সবটা প্রমত্তা ওই মেঘনার সঙ্গে, তবু কর্ণফুলী নামে নিহিত মায়াটানে নদীটারে সিলেট অঞ্চল জুড়ে বহমান কোনো নদী কিংবা শাখানদী ভাবতে মন চায় মাঝেমধ্যে। টাইগার পাস, ডিসি হিল, ওয়ার সিমেট্রি আর ফয়েজ লেক পরিবেষ্টিত চট্টলা শহর অধুনা কেমন সেইটা আমার পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন। বহুদিন হয় যাই না সেখানে। তবে শুনতে পাই উন্নয়নের ডামাডোলে প্রকৃতির নিজ হাতে সাজানো দ্রষ্টব্যগুলা আগের মতো নাই। বাণিজ্যিক নগরী হওয়ার মাশুল সে গুণতেসে দিবারাতি। মানুষের জীবন-জলবায়ু আর সামগ্রিক সংস্কৃতির জন্য খতরনাক অপরিকল্পিত উন্নয়নের দাম দিতে-দিতে পরিশ্রান্ত নগরটি মরহুম হওয়ার পথে গমন করতেসে শুনতে পাই। উন্নয়নে দোষ ধরার কিছু নাই যদি সেইটা পরিকল্পিত উপায়ে সম্পন্ন হয়। উন্নয়ন নিয়া বরফাট্টাইয়ের রাজনীতিও দোষের না যখন সেইটা জনকল্যাণের সঙ্গে সামগ্রিক কল্যাণের হিসাবকিতাব মাথায় রেখে আগাইতে থাকে। অন্যথায় এর সুফল অন্যদিক হইতে আশীবিষে দংশন করে এক-একটা জনপদ। হাসিনা রেজিম কথাখান ইয়াদ রাখলে হয়তো জাতি উপকৃত হইতেন।

অমিয়ভূষণ মজুমদারের কোনো এক গল্পে বোধহয় পড়সিলাম, দুর্গম জনপদে একটা সড়ক যখন সর্পিল গতিতে আগায় তখন আশীর্বাদ ও অভিশাপ একত্রে ফণা তোলে সেখানে। সড়কের মায়াবি ফাঁদের সঙ্গে তাল দিয়া আস্ত নগরসভ্যতাটা সেখানে গিয়া ঢোকে। তার জেল্লায় লোকের চোখ ধাঁধায়। সম্মোহন ও লোভ গ্রাস করে অন্তর। দিন তখন বদলাইতে শুরু করে। ভাগ্যের চাকা অবশেষে ঘুরছে বইলা সরকার ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা হাঁকডাক আর লম্ফঝম্প করেন বেদম। ভাগ্যের চাকা সত্যি ঘোরে কিন্তু! লোকের জীবন-জীবিকায় নতুন সব চল দেখা দেয়। চেহারায় চেকনাই আসে খানিক। চলনবলন আর বেশভূষা পাল্টায়। বিনোদিত হওয়ার অভ্যাস আগেকার রসদ ছেড়ে নতুন রসদে মজে। সারল্য ও অজ্ঞতার জায়গায় পাকামাথার হিসাবি কায়কারবার মিছিল দিয়া নিজের রাজপাট জাহির করে সেখানে। এইসব ক্যারিকেচারের মধ্যে একটু-একটু করে তলিয়ে যাইতে থাকে একদা প্রায় আদিম আরণ্যিক জীবনটা। সভ্য চোখে ভয়ানক পশ্চাদপদ প্রাগিতিহাসে আর কিছু না থাকুক, প্রাকৃতিক সহবাসে অভ্যস্ত মানুষগুলাকে সড়ক নামের প্রতারণায় নিঃস্ব বা শৃঙ্খলিত হইতে হয় নাই। এখন তারা সেরকম বটে! অমিয়ভূষণ যেমন তাঁর লেখায় দেখাইসেন, সড়ক মাথা তোলার তাৎক্ষণিক অভিঘাতে লোভ ও অতিলোভের বাড়বাড়ন্ত ঘটে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়া স্বকীয়তা জন্ম নেয়। স্বকীয়তার এই বোধ সর্পিল গতিতে ক্রমশ তীব্রতর হইতে থাকে সেখানে। ওই তীব্রতার জের মিটাইতে হিংসা-হানাহানি আর খুঁচাখুঁচির নিরন্তর ঘোরপ্যাঁচে নিষ্কৃতি ও বিরাম খুঁজে মরে মানুষ। চট্টলাসহ দেশের বৈচিত্র্যে রঙিন এক-একটা অঞ্চল, ওই বরিশাল-খুলনা-পটুয়াখালি-বাগেরহাট-পিরোজপুর-ময়নসিংহ-নেত্রকোণা-কিশোরগঞ্জ কিংবা বাহারি রাজধানী ঢাকা এভাবেই সভ্যতার মাশুল গোনার নামে খুন হইতেসে প্রতিদিন। শেফালী ঘোষের কণ্ঠে চাটগাঁর আঞ্চলিক গান শুনতে বসে কথাগুলা মনে উথালপাতাল ঝড় তুলসিল ক্ষণিক।

উন্নয়নের জরুরত মিটানোর বাহানায় দেশজুড়ে বহমান এইসব খুনাখুনির মধ্যে পাল-পাল লোক বিশ্বের দীর্ঘতম সাগরতটে রংঢং করতে ফি বচ্ছর ভিড় করেন জানি। তার মধ্যে ঝাউবনে ছাওয়া সাগরতট নীরব খুন হইতে থাকে। করোনার দিনকাল সম্ভবত একমাত্র যবে সাগরতট তার আদি মেজাজে ফেরত আসছিল প্রায়। অগুন্তি কাঁকড়া, কচ্ছপ আর ডলফিন সাগরের গভীর তল হইতে বাহির হইসিল তখন। এতদিন তারা কোন পাতালে ঘাপটি মেরে ছিল বলা মুশকিল, তবে লকডাউনে জেরবার মানুষের ঘরবন্দি থাকার সুফল সুদে আসলে তারা তখন উপভোগ করসে। মনুষ্যবিহীন সাগরতটে উদ্ভিদ আর প্রাণীকুল সদলবলে আজাদি উদযাপনে বেরিয়ে আসছিল। সুখটা অবধারিত নিয়মে ক্ষণস্থায়ী ছিল। অতিমারির দাপটে সন্ত্রস্ত মানব প্রজাতি যেমন দিনের শেষে এই মহামারি থেকে কিছু শেখে নাই। করোনাঝড় থামতেই তারে যুদ্ধের দিকে ধাবিত হইতে দেখতেসি মোরা। বাইডেন চাচা আর পুতিন মামা মিলেঝুলে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ দেশকে ছারখার করার মিশনে লিপ্ত আছেন অদ্য! করোনা শেষ হইতে না হইতে সাগরও এভাবে তার কুশ্রী স্বরূপে ফেরত যাইতে বাধ্য ছিল। এমতাবস্থায় চট্টলা কিংবা বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তে অকৃত্রিম প্রাকৃতিক কিছু দেখবার আছে বলে বিশ্বাস হয় না। তার চাইতে স্মৃতিতে এক-একটা ঘুমন্ত জনপদকে জাগ্রত করা কাজের। বাস্তব নয় বরং বায়বীয় হইতে থাকা ওইসব স্মৃতিই এখন শেষ পারানির কড়ি। তার মধ্যে কোনো একদিন বাস্তব ছিল এমনসব জনপদের আভাসটা জীবিত। স্মৃতিমধ্যে ঘুমন্ত এইসব বাস্তবতার সঙ্গে তুলনা করলে পৃথিবী জুড়ে ছড়ানো এক-একটি জনপদের অকাল পতন নয়তো ক্রমঅবক্ষয়ের ছবি চোখের সামনে মূর্ত হইতে থাকে। চট্টলা সে-অভিজ্ঞতার অংশ বৈকি।

মগজের আন্ধার সুড়ঙ্গে গুম হইতে থাকা স্মৃতি এমন একখান শহরের ছবি নিয়া হাজির হয় যেখানে একদিন কান্তা নন্দী কর্ণফুলীকে সাক্ষী মেনে মনের খেদ ঝাড়তেন। একদিন যেখানে শেফালী ঘোষ তাঁর শানদার আওয়াজে চাটগাঁকে জীবিত রাখতে ছিলেন কামিয়াব। স্পটিফাইকে সাধুবাদ জানাই। চট্টলাকে ঘিরে সচল স্মারকমালায় কান্তা নন্দীকে ইয়াদ করতে না পারলেও শেফালী ঘোষের নামখানা সে ভোলে নাই। নিজের মহাফেজখানায় তাঁকে বেশ যত্ন করে তুলে রাখসে। গান শোনার প্লাটফর্ম হিসেবে নবীন হইলেও তার কাজকারবার মোটের উপ্রে মন্দ নয়। দৃশ্যবিযুক্ত বাংলা গানের সঞ্চয়নে এই স্ট্রিমিং প্লাটফর্মের ভাণ্ডারকে ইউটিউবের তুলনায় ভরভরন্ত বলার সময় যদিও এখনো আসে নাই। ইউটিউবে ঠিকঠাক তালাশ করতে পারলে যত গানবাজনার খবর মিলে সেদিক হইতে তারে নবিশ মানতে হয়, তথাপি যেগুলা পাওয়া যায় সেগুলা বেশ গোছানো। শব্দমান বা সাউন্ড কোয়ালিটির বিচারে তোফা। আরামদায়ীও বটে! বড়ো কথা দৃশ্যদূষণের বাড়াবাড়ি, ইউটিউবে যেইটা কমন, স্পটিফাই এখনাবধি ওই বিমার থেকে মুক্ত। অডিও নির্ভর হওয়ার কারণে রেডিও আর ক্যাসেটের যুগে শ্রোতাকে সে ফেরত নিয়া যায়। রেডিও কিংবা ক্যাসেটে গান শোনার যুগে শ্রোতা যে-ফিলটা পাইতেন, অর্থাৎ গায়কের আস্ত এ্যালবাম শ্রবণ করা, এ্যালবাম শ্রবণের ক্ষণে তার ভোকালটারে অনুভব করা, এবং কথা-সুর ও বাজনার খুঁটিনাটিতে একীভূত হওয়ার মুহূর্তে মনের খাঁজভাঁজে ছবি ও ভাব পয়দা হইতে থাকার মতো ব্যাপারগুলা স্পটিফাইয়ের কল্যাণে অনেকখানি ফেরত আসতে যাচ্ছে বলা যায়। বিচিত্র কিসিমের গানবাজনার তালাশে ইউটিউবের মহাফেজখানায় আকসার ঘুরাফিরা করলেও গান শোনার নতুন প্লাটফর্মটারে যে-কারণে বেশ আপনা লাগে।

স্পটিফাইকে আপনা লাগার বড়ো কারণ তার শব্দমান বা সাউন্ড কোয়ালিটি। তাৎক্ষণিক উদাহরণ যদি দিতে হয় তো হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নামখানা একবার নেওয়া লাগে। বাংলা ভাটিয়ালি গানে নতুন যুগাবর্ত নিয়া আসা কমরেড হেমাঙ্গের সুরমা নদীর গাঙচিল অ্যালবামের গানগুলা ইউটিউব ও স্পটিফাই দুই প্লাটফর্মেই সুলভ। নির্মলেন্দু চৌধুরী, অমর পাল, আব্দুল আলীম, রথীন্দ্রনাথ রায়, বারী সিদ্দিকী থেকে হালফিল শিল্পীদের আওয়াজে বরণীয় গানগুলা যেমন সুলভ সেখানে। স্মরণীয় সব গানকে পুরানা ফরমেটে পরিবেশনার মেজাজ স্পটিফাই-র কর্তাগণ বাণিজ্যিক ভাবনা হইতে গ্রহণ করসিলেন ধারণা করি। ভাবনাটা বিফলে যায়নি। গানের ভিতর মর্মরিত ইমেজারিকে ফিল করতে সাহায্য করতেসে ব্যাপারটা। যেমন আরকুম শাহের প্রিয় গানগুলার একটা চার চিজে পিঞ্জিরা বানাই মোরে কইলায় বন্ধ গানখানা হেমাঙ্গ তাঁর স্বকীয়তা বজায় রেখে গাইসিলেন এক সময়। সিলেটি শব্দানুষঙ্গের নিখুঁত ব্যাভার আর ওদিকে হেমাঙ্গের কণ্ঠে সহজাত ভাটিয়ালির প্রভাবে শ্রবণসুখকর গানখানা ইউটিউবে শোনার ক্ষণে যে-অনুভূতি প্রগাঢ় হইতে থাকে সেইটা স্পটিফাই-এ গমন করলে দ্বিগুণ গভীর হয়। কারণ বিশেষ কিছু না। আদি রেকর্ড হইতে ধার করার সময় স্পটিফাই ওই গানের শব্দমান ধরে রাখার ব্যাপারে সচেতন ছিলেন।

হেমাঙ্গের দরাজ গলা আর গানখানা গাওয়ার ক্ষণে মোক্ষম সিলেটি বাচনভঙ্গি কানে আরাম বহায়। বাউলা গানের শিল্পীরা প্রচলিত যে-আঙ্গিকে গানটা সচরাচর গাইতে থাকেন তার থেকে সজ্ঞানে নিজেকে আলগ রাখসিলেন হেমাঙ্গ। দূরত্বটা অন্যভাবে গানের ভাববস্তুকে শ্রোতার মর্মে প্রবেশ যাইতে সাহায্য করে। শুনতে বসে মনে হ্য়, আরকুম শাহ বুঝিবা তাঁর জীবদ্দশায় এমন করেই গাইতেন! পল্লীর নিভৃত কুটিরে কোনো গায়ক আরকুমের গানে অবিচ্ছেদ্য নৌকা আর বৈঠাকে এইবেলা খানিক পরোয়া না করে গাইতে বসছেন আর হেমাঙ্গ এখন ওই স্মৃতিটারে সরাসরি চালান করতেসেন নিজদেহে! স্পটিফাই এভাবে ব্যাপারটা ভাবসেন বইলা মনে হয় না তবে আদি রেকর্ড থেকে স্ট্রিমিংয়ে তোলার ক্ষণে শব্দমানের দিকে যত্নশীল থাকায় গানখানা মনে আবেগ জাগায়। শেফালী ঘোষের আওয়াজে চাটগাঁর আঞ্চলিক গান শ্রবণের মুহূর্তে এমনধারা অনুভূতি প্রবল ছিল হৃদে।

স্পটিফাই নিয়া বকরবকর বাদ দিয়া শেফালী ঘোষের কথায় ফিরি। সিলেটসহ সারা দেশের আঞ্চলিক গান, একসময় রেডিওতে যেগুলা খুব বাজত, তার সঙ্গে ক্যাসেট প্লেয়ার আর পরে সিডি অবধি, এই পুরা ফেইজটায় শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের যুগলবন্দি মনে তরতাজা দেখতে পাইতেসি। চাটগাঁর আঞ্চলিক গানের ভাণ্ডারে মণিমুক্তার খামতি নাই। ওইসব মণিমুক্তার সঙ্গে দেশবাসীর সংযোগের বড়ো উৎস ছিলেন এই যুগল। হুরুকালে মোদের বাড়িতে গ্রুন্ডিগ নামে একখান জার্মান রেডিও ছিল। সোজা কথায় জবরদস্ত জিনিস। ওসমান সমাচার নামে নভেলের খসড়ায় একাত্তরের কাহানি বোনা করতে গিয়া গ্রুন্ডিগ বাবাজিকে স্মরণ না করে উপায়ান্তর ছিল না। একখানা ক্যারেক্টার রূপে উনাকে গোনায় নিতে হইসিল তখন।

সে যা-ই হোক, আম্মাকে দেখতাম দুইপর বেলায় ভাতঘুমের আগে গ্রুন্ডিগের কানে মোচড় দিয়া শ্রুতিনাটক আর সিনেমার বিজ্ঞাপন শুনতে। শেফালী ঘোষের নামখানা সেই সুবাদে প্রথম কানে আসছিল। মণিহার ছবিতে ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা-র সুবাদে তাঁর নাম তখন চারদিকে ভেসে বেড়াইতেসে। মণিহার ছবিখানা রঙমহলে আসছিল তখন। আম্মারা সদলবলে দেখতে গিয়াসিলেন। সেকালে আন্ডাবাচ্চা নিয়া মায়েরা পারিবারিক ছায়াছবি দেখতে সিনেমাহলে যাইতেন বৈকি। ছবির আগামাথা মোটমাট দিমাগে ঢুকে নাই। তবে নৌকা প্রজাতির মধ্যে সাম্পানের ভিন্নতা, আলমগীর ও শাবানা অভিনীত উক্ত ছবিখানার কারণে মগজে খানিক মালুম হইতেসিল। আলমগীর নৌকা ওরফে সাম্পানে বসে দাঁড় টানতেসেন আর নৌকায় উপবিষ্ট শাবানার কণ্ঠে শেফালী ঘোষ নিজের খেল দেখাইতেসিলেন! আঞ্চলিক গানের গায়কিতে যে-গুণগুলা আবশ্যক তার সবটা শেফালীর আওয়াজে দাপটের সহিত হাজির ছিল। গীতলতা, আর্তি, মাধুর্য, উচ্চারণের বিশেষত্ব বা দার্ঢ্য, কোনোখানে কমতি ঘটে নাই মোটে। এরকম একখান গান হিট না হয়ে পারে না। সাম্পানওয়ালাও ব্যাপক হিট ছিল। রোহিঙ্গা যুবার ছ্যাকা খাওয়ার ঘটনা উপজীব্য করে বিরচিত মধু হৈ হৈ বিষ হাওয়াইলা, কোন খারণে ভালোবাসার দাম ন দিলা গানখানা যেমন কিছুদিন আগে হাঠেমাঠেঘাটে বেদম বাজতে শুনছি, সাম্পানওয়ালার ক্রেজ গোটা দেশ জুড়ে আরো গভীর ও ছড়ানো ছিল।

চাটগাঁর আঞ্চলিক গানের ভাণ্ডার থেকে বেশ কিছু গান ঢাকাই সিনেমার পরিচালকরা তুলে আনসিলেন। বিশেষ করে চাটগাঁ নামক জনপদে জীবনসংস্কৃতির বৈচিত্র্য নিয়া যিনি মরণের আগে অবধি গান লিখসেন, সুর বাঁধসেন, নিজে এবং অন্যদের দিয়া গাওয়ানোর কামে হেলা করেন নাই, সেই এম. এন. আখতারের লেখা একাধিক গান সিনেমাওয়ালারা তখন লুফে নিসিলেন। সাম্পানওয়ালা যেমন তাঁর লেখা, কইলজার ভিতর গাঁথি রাইক্কুম তোঁয়ারে কিংবা যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম-র মতো কালজয়ী অনেক গান আখতার লিখসিলেন সেই সময়। চাটগাঁর লোকজন আরো ভালো বলতে পারবেন, তবে নেটে যেটুকু তত্ত্বতালাশ করা গেল তাতে এই ব্যাপারে নিশ্চিত বলা যাইতে পারে, আব্দুল গফুর হালীর মতোই এম. এন. আখতার চাটগাঁবাসীর হৃদয়মাঝারে মহারাজের আসনে বিরাজ করেন।

এম. এন আখতার গানের মধ্যে যে-অনুভূতির তরঙ্গটা বহাইতেন তার ইজ্জত শেফালীর আওয়াজে ষোলাআনা জারি থাকসে সদা। যে-কারণে বোধ করি আখতারের লেখা অসংখ্য গানে শেফালীর শরিকানা একদা অবিচ্ছেদ্য ছিল। গানগুলার পরিবেশনায় এখন হয়তো দেখনদারি আর যৌনঅনুষঙ্গ অমোঘ করা মিউজিশিয়ানের কাছে জরুর মনে হবে, অস্তাচলে বিলীন গেল শতকের ছয় হইতে আটের দশকের যুগবিশ্বে ওইটা তীব্র ছিল না। নির্ভেজাল প্রেমের আর্তি, বিষাদ নয়তো বিরহ মেদুর নিবেদন একটা গানকে শ্রোতার কর্ণকুহরে স্থায়িত্ব দানের ক্ষেত্রে কাফি মনে করা হইত। আখতার সেই ভাবে মাথা মুড়ে গানগুলা লিখসিলেন। শেফালীর কণ্ঠ, বলা যাইতে পারে, গানের কথায় সঞ্চারিত আবহের প্রতি সুবিচার ঘটাইতে কার্পণ্য করে নাই। ধারাটা এমনকি সাবিনা ইয়াসমিনেও সমান জীবিত ছিল।

শাবানা-উজ্জ্বল অভিনীত অনুভব ছবিতে যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম গানখানা সত্য সাহার সুরে শেফালীর বদলে সাবিনাই গেয়েছিলেন। কথার রদবদল বিলক্ষণ ছিল সেখানে। এম.এন আখতারের সম্মতি বা হইতে পারে উনাকে দিয়া পরিচালক কামটি সারছিলেন। শাবানার এক্সপ্রেশন ও অভিনয়সক্ষমতার পরিচয়বাহী গানখানা নাগরিক কানে আবেদন বহানোর ভাবনা হইতে সত্য সাহা বোনা করসিলেন মনে হয়। সুর ও গায়কি বিবেচনায় সুকণ্ঠী সাবিনা গানের প্রতি অবিচার করসেন সে-কথা বলার সুযোগ নাই। শেফালীর কণ্ঠে এর মৃদু মেদুর আবেদন যদিও সাবিনায় গরহাজির। আবেদনটা সিনেমার কাহিনি বিবেচনায় বজায় রাখা সম্ভব ও যৌক্তিক ছিল না। সিনেমার প্রয়োজনে তারে তখন নতুন মোড় নিতে হইসিল। বিষাদের বদলে ফাঙ্ক (Funk) টাইপের চাপল্যে ঠেকনা দিয়া সাবিনাকে গাইতে দেখা যায়। দুই শিল্পীর গায়নকৌশলের এই তফাত যারপরনাই কানে ঠং করে বাজে।

সে যা-ই হোক, শেফালী ঘোষের রাজপাট শ্রোতামনে ষাট হইতে আশির দশক অবধি সমানে বহমান ছিল। ওইটা হইসে সেই সময় যখন ফেরদৌসী রহমান, আঞ্জুমান আরা বেগম আর শাহনাজ রহমতুল্লার মতো কিন্নরকণ্ঠীরা বাংলা সিনেমার গানে কণ্ঠ দানে নিবেদিত ছিলেন। শেফালী তাঁর স্বাতন্ত্র্য সমেত গানের জগতে পা রাখেন। চাটগাঁবাসীর মন কাড়েন দ্রুত। অতঃপর নয়ের দশকে তাঁর রাজপাট ম্রিয়মান হইতে আরম্ভ করে। কণ্ঠের ঐশ্বর্য জাদুঘরে ঠাঁই নিতে বসছিল। আন্তর্জালের রমরমা যুগ দেখা না দিলে এতদিনে হয়তো বিস্মৃতির খাতায় নাম উঠত তাঁর! তা-বলে সাম্পানওয়ালাসুন্দর একখান মুখ পাইতাম, ও রে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরেকইলজার ভিতর গাঁথি রাইক্কুম তোঁয়ারে-র মতো গানগুলা মরে নাই। মরণ সম্ভব না। শেফালীর আওয়াজে অমরত্ব পাওয়া ওইসব গান একালে সন্দীপন থেকে আরম্ভ করে বহু শিল্পী নিত্য গাইতেসেন। তবে যেসব শ্রোতা শেফালী ঘোষকে একবার হইলেও শুনসেন, উনাদের স্মৃতিপটে সেই সময়টা ঝিলিক দিয়া যাবে যখন রেডিও বা ক্যাসেট প্লেয়ারে আঞ্চলিক গানের গুণী এই কণ্ঠ ভদ্রলোকদের বৈঠকখানায় দিব্যি অনায়াস ছিলেন।

শেফালী প্রসঙ্গে বাংলা লোকগানের সম্রাজ্ঞী মমতাজের কথা ইয়াদ করা লাগে। শেফালীর বহু পরের ঘটনা হইলেও আশির দশকে গ্রামীণ শ্রোতামহলে মমতাজের দাপট একপ্রকার সুবিদিত ছিল, তবে নাগরিক সমাজ তখন তাঁরে কদর করে নাই। পালাগান আর ক্যাসেটে সরব মমতাজ নাগরিক শ্রোতামহলে প্রবেশ করেন নয়ের দশকের মধ্যভাগে, বুকটা ফাইট্টা যায় টাইপের তুলনামূলক চটুল গান দিয়া, যেইগুলা এক অর্থে মমতাজের গায়কিসত্তার প্রকৃত পরিচয় বহন করে না। শাহ আলম সরকারের লেখা গানে স্বচ্ছন্দ মমতাজের যেসব গান নাগরিক শ্রোতামহলে বিপুলতা পায় সেগুলার মধ্যে আঞ্চলিক গানের বিবর্তন বোধ করি অল্পস্বল্প টের পাওয়া সম্ভব। দেহরাজ্যে হবে যেদিন ভূমিকম্পনআমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল গো মরার কোকিলে আর সিনেমার জন্য গীত খাইরুন লো তোর লম্বা মাথার কেশ-র মতো গানে মমতাজের হাঠেমাঠে বিচরণরত গায়িকসত্তার অবশেষ ধরা দিলেও বুকটা ফাইট্টা যায় বা আরো পরে লোকাল বাস পুরাদস্তুর আর্বান ইয়ুথকে চাঙ্গা করার মানসে গাওয়া। এইটা সেই ইয়ুথ যারা পরে টিকটক প্রজন্মে নিজেকে একীভূত করসে। এহেন প্রজন্মের মধ্যে বাজার কাটতি গানের যে-চাহিদা সেইটা মিটানোর কামে খালিদ হাসান মিলু তনয় প্রীতমকে সফল ভাবা ছাড়া পথ নাই। লোকাল বাস-এ তাঁর Rap-Folk Fusion ও মমতাজকে সেখানে ব্যবহারের ঘটনায় এইটা একপ্রকার স্থির হইতে থাকে, আগামীতে টিকটক প্রজন্মের গানের উপস্থাপন মূলধারার গান হইতে পৃথক গন্তব্য খুঁজে নিবে। প্রীতম, মোজা, তোশিবার গানে এখন যার ছাপ পরিষ্কার। লোকাল বাস-র দেহজ আবেদন অর্থাৎ সেক্সিজমটা প্রীতম তখন সেভাবেই প্রকাশ্যে নিয়া আসছিলেন। এহেন যৌনঅনুষঙ্গে মমতাজের অনুপ্রেবশ গ্রামীণ বা লোকায়ত আবেদনের সঙ্গে বিচ্ছেদবাহী বটে!

সময়ের সঙ্গে নতুন তরঙ্গে ভাসা মমতাজ কিন্তু সেই মমতাজকে চিনতে সাহায্য করেন না যার জবরদস্ত আওয়াজ রাতের আসরে পালাগানে নিজেকে উজাড় করতে অভ্যস্ত ছিল। পালাকার মমতাজ থেকে সাংসদ মমতাজের বিবর্তন নিয়া কথা কওয়ার জায়গা এইটা না, বলার কথা এটুকুন, রুনা লায়লার মতো সকল প্রকার গানে পটিয়সী মমতাজ তথাপি শেফালীর মতো বিশিষ্ট নন ওই জায়গায়, লোকে যাকে একটা এলাকার জীবনবেদ বইলা জানে-মানে। এম. এন. আখতার আর আব্দুল গফুর হালীর মতো গীতরচয়িতা এই জীবনবেদকে চাটগাঁয় বহমান কর্ণফুলী নদী, বায়েজিদ বোস্তামির মোকাম আর মাইজভাণ্ডারী কাওয়ালে ডুবেভেসে পৃথক রূপ দিতে সক্ষম হইসিলেন।

সে যাকগে, এইসব গুরুভার ব্যাপার নিয়া বকরবকর করার মতলব হইতে দুকলম লিখতে বসি নাই। লেখার মূল উদ্দেশ্য, বলা যাইতে পারে, একটা কৌতূহল, যার নিরসন শেফালী ঘোষ শুনতে গিয়া অধমের ঘটে নাই। আরো পষ্ট করে বললে কৌতূহলটা এম. এন. আখতারের বহুল শ্রোতাপ্রিয় যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম গানটি নিয়া। দেশশুদ্ধ লোক জানে গানখানা আখতারের রচনা আর শেফালী ঘোষ ও সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে সমাদৃত হওয়ার দিন হইতে আজোবধি গীত হইতেসে। তো এরকম একখানা আইকনিক সঙ মুখড়াসহ বাদবাকি অংশ নতুন আঙ্গিকে ভাটিয়াল গানের কিংবদন্তি সুনামগঞ্জের ছাওয়াল নির্মলেন্দু চৌধুরী গাইসিলেন, এইটা জানা ছিল না। গায়কিটা সেখানে একেবারেই ভিন্ন। নির্মলেন্দু ভাটিবাংলার শানমান মাথায় নিয়া গাইবার কারণে চাটগাঁর শেফালী বা ঢাকা শহরের সাবিনার গায়নভঙ্গির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব আসমান-জমিনের। কথার উচ্চারণ ও গলার গমক যথাবিহিত নির্মলেন্দুর যেইটা সিগনেচার মার্ক বইলা বিদিত, যেইটা হয়তো তিনি সুনামগঞ্জের হাওর-বাওর হইতে ধার করেন এবং কলকাত্তায় ডেরা পাতার ক্ষণে তার মধ্যে সূক্ষ্ম চোরাটান ও পরিবর্তন মিশাইসেন নিজের মতো করে, যেইটা নিয়া তাঁর সঙ্গে ভাটির আরেক ছাওয়াল হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বাহাস মরণতক জারি ছিল, দুই মহারথীর সাংগীতিক ঝগড়ার বাইরে গিয়া নিশ্চিন্তে বলা যায় নাগরিক শ্রোতার কানে ভাটিয়ালির আবেদনকে জোরদার করতে নির্মলেন্দুর ভিন্ন পথে গমন তাঁর গানের রস উপভোগে বিঘ্ন তৈয়ার করেনি। যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম গানের গায়কিতেও স্বচ্ছন্দ্যটা পুরামাত্রায় হাজির বইলা শ্রোতার টের পাইতে অসুবিধা হয় না।

শেফালী বা সাবিনার বাইরে নির্মলেন্দুর আওয়াজে গানখানা যথাবিহিত শ্রবণসুখকর ও অন্য ভাব মনে পয়দা করে যায়। গায়নভঙ্গির মুন্সীয়ানা নিয়া যারপরনাই কথা তোলার সুযোগ নাই। কৌতূহল অথবা খটকা যেইটা মনে জাগে সেইটা গানের কথায়। এম. এন. আখতারের গানে মর্মরিত কথার সঙ্গে নির্মলেন্দুর গাওয়া গানটির কথায় ফারাক ব্যাপক। মুখড়াটা আখতার এভাবে বাঁধসেন সেথায় :

যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম
যদি নতুন একখান মুখ পাইতাম
মইশখালীর পানের খিলি তারে
বানাই খাবাইতাম।
এক দিন্থর লাই ডাকি তারে
হাউশের পিরীত শিখাইতাম।
আমি হাউশের পিরীত শিখাইতাম।

সিনেমায় ব্যবহৃত গানটির শুরুর চরণ অবশ্য ভিন্ন। মইশখালির জায়গায় সেখানে সদরঘাটের উল্লেখ পাইতেসি। গানের বাকি কথাগুলান, আগেই বলসি, আখতারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে হইতে পারে, সত্য সাহা রদবদল নিয়া আসছিলেন। চাটগাঁর আঞ্চলিক টোনালিটি যারপরনাই সিনেমার গানখানায় জীবিত থাকে নাই। সিনেমায় গান যেহেতু সিচুয়েশন বুঝে ব্যবহৃত হয় বা ওইভাবে কথার চরণ সাজাইতে হয়, ধারণা করি, আখতার সেই ভাব মাথায় নিয়া গানের কথায় শুদ্ধ বা হালফিল প্রমিত শব্দচয়ন করসিলেন। কথার দুলকি চালে রদবদল ঘটায় শেফালী ও সাবিনার গায়কিতে ফারাক অবধারিত ছিল। সত্য সাহা হয়তো এইটা ভাবসিলেন, এই গান শেফালীকে দিয়া গাওয়ানো দুরস্ত হইলেও ছবিতে শাবানা যেভাবে উজ্জ্বলকে এ্যাপ্রোচ করতেসে, উপরন্তু শুদ্ধ বাংলায় দুজনের আলাপ-সালাপ, উজ্জ্বলকে পটানোর জন্য শাবানার ফিচলামি ইত্যাদি শেফালী যে-টোনে গানটা গাইসেন, তার সঙ্গে বেমামান। আবার তাঁরে দিয়া নতুন করে গাওয়ানোর মধ্যে রিস্ক থাইকা যায়। যদি কোনো কারণে শেফালী এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করেন তাইলে সব মাটি। তো এই জায়গায় সবিনা সই।

প্রকৃত ঘটনা আসলে কী ছিল সেইটা এখন আর জানার উপায় নাই। সত্য সাহা, এম. এন আখতার, শেফালী সকলেই একে-একে দেহ রাখসেন। সাবিনাকে জিগ্যেস করা যাইতে পারে। আমাদের এখানে যদিও গান তৈয়ার ও তার ভিন্নমাত্রিক বিবর্তন নিয়া তদন্তে নামার কালচার আজোবধি গড়ে উঠে নাই। মৌসুমী ভৌমিক বাদে কাউকে এইসব ব্যাপার নিয়া বড়ো আকারে উৎসুক হইতে দেখসি বইলা মনে পড়ে না। প্রকৃত কারণ যারপরনাই জানার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যেমন ক্ষীণ, ইন্টারনেটের সুবাদে পাওয়া নির্মলেন্দুর গানখানা গাওয়ার ইতিহাসটাও। ভাটিবাংলার ছাওয়াল নির্মলেন্দু ভিন্ন তরিকায় গেয়েই ক্ষান্ত হন নাই, গানের কথা মুখড়া হইতে শেষতক ওই ভিন্নতা মেনে বিরচিত। মুখড়ায় নির্মলেন্দু গাইতেসেনে :

সুন্দর একখান মুখ পাইতাম
যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম
আদর কইরা সাজাইয়া পানের খিলি
তারে খাওয়াইতাম।

পানের সঙ্গে স্থানমাহাত্ম্য, যেমন মইশখালী ওরফে মহেশখালী কিংবা সদরঘাট কিংবা পরে ভিন্নজন গাইতে গিয়ে অন্য নামও যুক্ত করসেন সময় বিশেষ, তার পুরোটাই লোপাটা সেখানে। আদ্যিকাল হইতে মহেশখালী মিষ্টি স্বাদের পানের জন্য মশহুর! মোর সেজ ভাইকে এই পান রীতিমতোন বিলাসিতা করে চিবাইতে দেখসি দীর্ঘদিন। ব্যবসার সুবাদে চাটগাঁয় তার যাতায়াত ছিল একসময়। তখন ওই পানের প্রেমে পড়েন ভাইজান। লোক মারফত কিছুদিন বাদ পানের চালান আসত। তার সঙ্গে ভাবিরে দেখতাম সুপারি মিহি করে কাটতেসেন। মোলায়েম কচিসবুজ পানে সুপারি-জর্দা ঠেসে যে খিল্লিটা বনত, তার স্বাদ, হলফ করে বলতে পারি, বরিশালের বাংলা পান বা মোদের খাসি পান থেকে আলগ কিসিমের। মহেশখালীর পানকে সাঁচি পানের কুটুম ভাবা যাইতে পারে। সাঁচির ন্যায় ওইটাও মোলায়েম। খাসির মতো কড়া কিংবা বাংলার মতো পানসা ঝাঁঝের না। মুখে দিয়া চিবানোর সময় মনে হয় মাখনের মতো গলে যাইতেসে। সদরঘাটের পান, ধারণা করি, বুড়িগঙ্গা নদীতীরের ঘাটলা জুড়ে পানের বিচিত্র বাহার ও পানরসিক লোকের জুমলার কারণে তার যে-খ্যাতি সেখান থেকে সিনেমায় স্থান পায়। নির্মলেন্দুর গানের মুখড়ায় তার সবটাই অনুপস্থিত। গায়ক যে মুখখানারে সেখানে তালাশ করে বা যে-মুখের আশে নিজের অনুভূতি ডেলিভারি দেয় তার সবটাই আখতারের গানে বইতে থাকা আঞ্চলিকতার অনুষঙ্গ হইতে পৃথক।

নির্মলেন্দু যে-কথার প্রবাহে ভাটিয়ালির খেল খেলেন সেইটা কথার ধাঁচে আঞ্চলিক হইলেও অনেকবেশি নাগরিক অনুষঙ্গে ভরভরন্ত। ভাটিয়ালির উপ্রে গায়কের সহজাত দক্ষতার কারণে শ্রোতা যেইটা চট করে ধরতে পারে না। আখতার ও শেফালীর বেলায় ঘটনা বিপরীত। গানের চলন এমনকি সিনেমায় শুদ্ধ বাংলার অনুপ্রেবশ সত্ত্বেও মোটের উপ্রে শেফালীর কণ্ঠে গীত অদিভাবের সঙ্গে নীরব সংযোগ রেখে আগাইতে থাকে। একই ধাঁচের গানের ভিন্ন পরিবেশন ও রচনাভঙ্গির কারণে কোনটা আগে পরে রচিত ও সুরারোপিত হইসিল সেইটা নিয়া মনে ধন্দ তৈয়ার হয়। নির্মলেন্দুর কণ্ঠে গাওয়া গানখানার রচয়িতা, যদি তথ্য ভুল না হয়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও উৎপল চৌধুরী। দুজনে মিলে গানখানা বাঁধসিলেন ওই সময়। যদিও গৌরীপ্রসন্নের গানের সংকলনে এর হদিশ পাই নাই! যদি গানখানা উনারা দুজনে লিখে থাকেন সেক্ষেত্রে আখতারের গানখানা শ্রবণের প্রভাব থেকে লিখসিলেন নাকি আখতার ওই গান শোনার প্রভাবে নতুন করে লিখসেন সেইটা পরিষ্কার না। জোর সম্ভাবনা যদি বলি তাইলে আখতারের গান হইতে মূলভাব গৌরীপ্রসন্ন ও উৎপল চয়ন করসিলেন মনে হয়। একটা গানের প্রভাবে আরেকটা বিরচণের এই ধারা নতুন কিছু নয়। নাজায়েজ বলা যাবে না তারে। তবে প্রভাব বা প্রেরণার ফেরে যে-বিবর্তন ঘটে সেইটা তাৎপর্য রাখে এবং ওই জায়গা থেকে আলোচনা ও বাহাসে ক্ষতির কারণ নাই। এইটা বরং গানগুলার টেক্সচুয়্যাল ইনভেস্টিগশনটারে ঋদ্ধ করে।

অন্যদিকে এভাবেও ভাবা যাইতে পারে বোধহয়, আঞ্চলিক গান যে-আবহ হইতে উঠে আসে সেখানে এইসব সত্ব, মালিকানা, রচয়িতা হয়তো দিনের শেষে বিশেষ মূল্য রাখে না। প্রসঙ্গটি যেহেতু উঠসে এইবেলা, অদ্য নতুন করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা আইলারে নয়া দামান গানখানার কথা পাড়তেই হয়। নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের কানে প্রবল জনপ্রিয় গায়ক মোজা ও তোশিবার হাত ধরে সিলেট অঞ্চলে যুগ-যুগ ধরে গীত বিয়ার গীতের পুনর্জীবন সুখকর ঘটনা সন্দেহ নাই। নবীন গায়ক হিসেবে মোজাকে বেশ প্রতিভাবান মানতে হয়। ওদিকে টিকটককন্যা তোশিবাও সিলেটি লোকগান ক্যামনে গাইতে হয় সেইটা রপ্ত গিয়াসেন মনে হয়। যারপরনাই নয়া দামান-এ গানের স্বকীয়তা খুন না করে Rap-র সংযোজন এর রস উপভোগে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটায় না।

এখন নয়া দামান-র স্বত্ব নিয়া ক্যাঁচাল তরুণ দুই শিল্পীকে বেশ বিপাকে ফেলসে বলা যায়। সিলেটি বিয়ার গীতে আইকনিক গানখানা পরিবেশনার সময় এর লোকায়ত যোগসূত্র তালাশের ভাবনা তাদের কারো মনে টোকা দিয়া যায় নাই। গানটা পণ্ডিত রামকানাই দাশের জননী দিব্যময়ী দাশের রচনা হইলেও হইতে পারে। রামকানাই এক সময় আইলোরে নোয়া জামাই উচ্চারণে গানটা গাইসিলেন। সিলেট বেতারে যদিও ইয়ারুন্নেছার কণ্ঠে শ্রোতারা গানটা সেই সময় অহরহ বাজতে শুনেছে এবং সেই সুবাদে বিয়ার পানদান সাজানোর সময় মা-খালাদের নিজ কর্ণে গানটা বহুবার গাইতেও শুনছি। এখন এই গানের রচয়িতা দিব্যময়ী না অন্য কেউ ইত্যাদির গুরুত্ব নাগরিক ভদ্রজনের নিকট প্রবল হইলেও গানটার প্রকৃত স্বত্ব মূলত গ্রামীণ কৌমসমাজের বিবাহকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক উপাচারে নিহিত। কপিরাইট-র ভজকটে পড়ে আসলি ব্যাপারটা খোয়া যাইতেসে মনে হয়।

গ্রামীণ কৌমসমাজে বেড়ে ওঠার কারণে দিব্যময়ী হয়ত তাঁর নিজস্ব আঞ্চলিক অনুষঙ্গ মিশিয়ে গানখানা নতুন করে বাঁধসিলেন। আরো গভীরে তালাশ করলে দেখা যাবে গানটা সিলেটের গাঁওগেরামে বহু কাল ধরে বিচিত্র আঙ্গিকে গীত হয়ে আসছে। গীতখানা কার রচনা সেইটা নিয়া কোন্দলে যাওয়ার ঠেকা কৌমজনতার মাথায় আসে নাই। সংস্কৃতি পয়দা হওয়ার ক্ষেত্রে গ্রামীণ সমাজ কপিলেফ্ট (Copyleft) বা স্বত্ব ত্যাগের শর্তে সহজাত হওয়ার কারণে অঞ্চল ও গায়কি ভেদে গানের কথা-সুর-উচ্চারণ ইত্যাদির যৎসামান্য পরিবর্তনে গেল-গেল রব তোলার ঘটনা সচরাচর প্রবল হইতে দেখা যায় না। নয়া দামান গানের আদি স্বত্বাধিকারী বইলা কাউরে যদি চিনাইতে হয় সেক্ষেত্রে সিলেট আঞ্চলের গ্রামীণ কৌমজনতার নাম সর্বাগ্রে আসবে। সমবায়ী প্রক্রিয়ায় কোনো এক যুগসন্ধিক্ষণে গানটা তারা সৃজন করেন ও বিয়ার অনুষ্ঠানে গীত হইতে থাকে। সুতরাং ওইসব অনামা গীতরচয়িতা ও গায়কের এই গানটার ওপর স্বত্ব অবধারিত নিয়মে মৌলিক। তারাই এর আদি বা প্রকৃত স্রষ্টা। নতুন শব্দ, উচ্চারণ, যন্ত্রানুষঙ্গ জুড়ে গানখানা যারা বিভিন্ন সময়ে শ্রোতামহলে পরিবেশ করসেন, স্বত্বের প্রশ্নে উনাদের নাম তারপর নেওয়া যাইতে পারে।

মোজা ও তোশিবা এইখানে ভুলটা করসেন। গ্রামীণ কৌমসমাজে নয়া দামান গীত হওয়ার ক্ষণে কথা-সুর-উচ্চারণ ও যন্ত্রানুষঙ্গ কীভাবে স্বয়ংক্রিয় নিয়মে পাল্টাইতে থাকে ও একসময় বিবর্তনের ভিতর দিয়া স্থিরতা লাভ করে ইত্যাদি বয়স কম হওয়ার কারণে তারা দিমাগে নিতে পারেন নাই। লোকায়ত মাধ্যমের কপিলেফ্ট চরিত্র আকলে নিলে গানটাকে নির্দিষ্ট ব্যক্তির মালিকানায় জিম্মা করা সম্ভব না। এমনকি বাউল মহাজনদের গানকে কেবল উনাদের একক সম্পত্তি ভাবার উপায় সেখানে কার্যত অবশিষ্ট থাকে না। স্বত্ব দাবি করতে গেলে উল্টা আপদ ও বিড়ম্বনা বাড়ে। স্মরণ রাখা বেশক, বাউল পদকর্তাদের গীতে ব্যবহৃত কথা-সুর-উচ্চারণের এদিক-সেদিক বিপত্তির কারণ হয় না যতক্ষণ গ্রামীণ কৌমসমাজে বিচরণে অভ্যস্ত গায়ক পদগুলা গাইতে থাকেন। এক অঞ্চল হইতে অন্য অঞ্চলে পরিভ্রমণের কারণে এমতো রদবদল স্বাভাবিক ঘটনা। প্রক্রিয়াটা কৌমসমাজে সচল কপিলেফ্ট চরিত্রের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে ঘটে বইলা গ্রামীণ শ্রোতা এইসব নিয়া হয়রান হওয়ার ঠেকা থোড়াই বোধ করে। যত পেরেশানি তার সবটাই শহরাগত ভদ্দরনোকদের, যেহেতু তারা গবেষক-সংগ্রাহক-আলোচক হ্যানত্যান ইত্যাদি।

লালন সাঁইজি হইতে বাউল করিম অবধি মহাজনরা গানের কথা ও সুরের বিচ্যুতিতে গেল-গেল রব তুলেছেন বলে অধমের জানা নাই। সাধনতরিকার অংশ রূপে ভাবদিওয়ানা হয়ে এইসব পদ তাঁরা গাইতে অভ্যস্ত। গানের দেহ হইতে নির্গত ভাবরস শ্রোতা ও গায়কের দিলে ঠিকঠাক প্রবেশ যাইবার ঘটনায় আগল না দিলে নিজ গানের কামিলিয়াত তাঁদেরকে সুখী রাখে। মহাজনরা ভালো করে জানেন তাঁদের পদ খালি শিষ্যরা গাইবে এমন নয়, চাষা হইতে মাঝি সকলে প্রাণের টানে গানের উপ্রে নিজের অধিকার আরোপ করে সেখানে, গানের দেহে সংগোপন মারেফতকে নিজ মনের ভাও অনুসারে দেহে চালান করে তারা। সোজা কথায় জাঁক দেরিদা ও রঁলা বার্থ মহাশয় কখন ধরায় আগমন করতেসেন তার অপেক্ষা না করেই যুগযুগান্তর ধরে বাংলাদেশ তথা দুনিয়া জুড়ে বিস্তৃত লোকায়ত সংস্কৃতি মুক্তক্রীড়ায় অভ্যস্ত। চরিত্রের দিক হইতে লোকায়ত সংস্কৃতি চিরকাল কপিলেফ্টপন্থী।

জীবদ্দশায় বাউল করিমের গান বিচিত্র উপায়ে গীত হইতে শুনছি। গায়নপ্রণালীর বৈচিত্র্য নিয়া উনাকে সবিশেষ বিব্রত হইতে দেখি নাই। তবে হ্যাঁ, গানের দেহে সক্রিয় ভাবরসকে পাত্তা না দিয়া যেমন খুশী সাজার কসরত যারা করতেন তাদেরকে সতর্ক বা সংযমী হইতে হয়তো বলসেন কখনো। কথা কিংবা সুরের রদবদল ভাবরসে গুরুতর মানহানির কারণ না ঘটানো অবধি কপিলেফ্ট-এ সহজাত উকিল মুন্সি, জালালউদ্দিন খান, দুর্বিন শাহ বা বাউল করিমকে এসব নিয়া হট্টগোল মাচাইতে দেখা যায়নি। শহুরে সংগ্রাহকরা এই জায়গায় বিপজ্জনক প্রাণীতে মোড় নিতে থাকেন। বাউল পদকর্তার গানের কথা-ভাব-সুর হইতে স্বরলিপিকরণ নিয়া উনাদের অতি উৎসাহ বিড়ম্বনা তীব্র করায় শ্রোতামনে। গ্রামেগঞ্জে সহজ অভ্যাসে গীত গানের কথা, সুর ও উচ্চারণের তরিকায় কমবেশি যে-রূপান্তর সেগুলাকে গোনায় নিতে তারা প্রায়শ বিমুখ বোধ করেন। করিম গানখানা ক্যামনে গাইতেন সেই তত্ত্ব-তালাশে উনাদের দিনরজনি কাবার হয়। গান বাঁধার সময় তিনি কী শব্দ জুড়েছিলেন সেগুলাকে আতশকাচ দিয়া নিরিখ করায় ক্ষতি নাই কিন্তু তাকে একমাত্র গণ্য করে তুলকালাম শুচিবায় স্বয়ং করিমকে নাগরিক জেলখানায় কয়েদ করে। গবেষকরা কথাটা বোধহয় ইয়াদ রাখা প্রয়োজন বইলা মানেন না!

গানের শিকড় সন্ধানে শহুরে পণ্ডিত ও সংগ্রাহকদের এমতো প্রবণতাকে দোষারোপ করে ফায়দা অল্পই মিলবে। সংগীতের সর্বজনগ্রাহ্য সংস্করণ প্রণয়নের ওইটা হইসে বিজ্ঞানসম্মত ধারা। উক্ত ধারায় যদি স্থির থাকতে হয় সেক্ষেত্রে লালন সাঁইজি, সৈয়দ শাহনূর, আরকুম শাহ, শেখ ভানু কিংবা শাহ আবদুল করিমের গান গাইতে থাকার রীতিনিয়মে যেসব বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা তার সবগুলাকে পাশাপাশি স্থান দেওয়া ও বিবেচনা করা উচিত, যদি সেটা গ্রামীণ কৌমসমাজে গীত হয়ে থাকে। অন্যথায় গ্রামীণ কৌমসমাজ যে-অধিকারবলে বাউল পদকর্তাদের গীতমালাকে আপনার বইলা ভাবে ও এর উপ্রে দাবি খাটায়, সেইটা খোয়া যায়। আসলি কথাখান সরল, আঞ্চলিক গানটারে যখন কপিলেফ্ট বইলা ভাবতেসি তখন গানের নতুন পরিবেশনায় আপত্তি ঠোকা মুশকিল। যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম হয়তো উক্ত অধিকারবোধের জায়গা হইতে এম. এন আখতার ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার পৃথক ভাবে মাথা মুড়ে লিখসিলেন একসময়। কে আগে অথবা পরে লিখসেন কিংবা কার দ্বারা কে প্রভাবিত হইসেন ইত্যাদি বড়ো ব্যাপার না সেখানে। তবে হ্যাঁ, একটা গানের উৎপত্তি ও বিবর্তনের সুলুক করা গানের ইতিহাস ও শিল্পমানের বিচিত্র আবর্তন উপলব্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক।

যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম গানটারে হয়তো এই ফেরে নির্মলেন্দু চৌধুরী ভাটিয়াল টানে জুড়ে শ্রোতার নিকট হাজির করসিলেন। উনার পরিবেশনা শ্রবণ সুখকর নিশ্চয়। অন্যদিকে শেফালী ঘোষের কণ্ঠ হইতে নির্গত গানখানায় ব্যঞ্জনা অধিক গভীর বইলা শ্রোতা মনে-মনে হয়তো প্রত্যয় যায়। শেফালী শ্রোতাকে বার্তাটা দিতে কসুর করেন না,—একাল অথবা আসন্ন কোনো কালে গানখানা নতুন আঙ্গিকে পরিবেশনায় সমস্যা নাই তবে পরিবেশনার ক্ষণে ইয়াদ রাখা জরুরি, চাটগাঁর স্থানিক অনুষঙ্গে তার বিকাশ-প্রকাশ ঘটসিল। ওইটা হইসে তার প্রকৃত স্থান। ওইখানে সে সর্বাধিক সার্বভৌম ছিল। স্বনির্ভরও বলা যাইতে পারে। চাটগাঁ হইতেসে তার আদি সাকিন আর বাদবাকি যা-কিছু তার সবটাই বাহিরানা। স্বত্ব থাকুক বা না থাকুক, আঞ্চলিক গানের নতুন আঙ্গিকে পরিবেশনায় তার স্থানিকতাটারে সসম্মানে বিবেচনা করার মধ্যে সওয়াবের ভাগ অধিক আর সেটাই উত্তম সুবিচার।

লেখালগ্নি লিঙ্কগুলি 

আহমদ মিনহাজ রচনারাশি

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you