মাথায় উস্কুখুস্কু চুল। কানে হিয়ারিং অ্যাইড (শ্রবণ-সহায়ক যন্ত্র)। কাঁধে ঝুলছে একটি থলে। সিলেট নগরের গলি দিয়ে খানিকটা কুঁজো হয়ে হাঁটতে প্রায়ই দেখা যেত অরবিন্দ দাস গুপ্তকে। তাঁকে যখনই দেখতাম, আমার দৃষ্টি নিক্ষেপ হতো তাঁর ঘাড়ে ঝোলানো ওই থলেটির দিকে। এর ভেতরে থাকা গুপ্তধন দেখার বড় কৌতূহল ছিল।
তিনি প্রায়ই আমার কর্মস্থল দৈনিক সিলেটের ডাক কার্যালয়ে আসতেন। সংবাদকক্ষে এসেই সোজা আহমাদ সেলিম ভাইয়ের ডেস্কে গিয়ে উনার সাথে অত্যন্ত নরম স্বরে জরুরি কথা বলে নীরবে চলে যেতেন। আমি তাঁর আসা-যাওয়া এবং খানিকক্ষণ বসে থাকার দৃশ্য অবলোকন করতাম। আসলে সেটাও নয়, আমার নজর পড়ত তাঁর কাঁধে-ঝুলানো থলের দিকে! মাঝেমধ্যে তিনি এসে আহমাদ সেলিম ভাইকে না-পেয়ে যাকে কাছে পেতেন তাঁর কাছে আহমাদ সেলিম কখন আসবেন জিজ্ঞেস করে অভ্যর্থনাকক্ষে গিয়ে বসে থাকতেন।
এ-রকম একদিন আহমাদ সেলিম ভাই অফিসে নেই। তিনি আসছেন, আমি গিয়ে তাঁকে বললাম — সেলিমভাই কিছু সময়ের মধ্যেই আসবেন। আপনি বসেন। — চা পান করার কথা বললাম। তাঁর কানে হিয়ারিং অ্যাইড জেনেই আমি কথাগুলো একটু উঁচু স্বরে বলছিলাম। তিনি একটি মিহি হাসি দিয়ে, মিহি কণ্ঠে বললেন, — ধন্যবাদ, চা খাবো না, উনি আসলে বলবেন, আমি অভ্যর্থনাকক্ষে আছি।
আমি উঁচু স্বরে কথা বলার জন্য মনে মনে লজ্জা পেলাম এবং হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে চলে আসলাম। কিন্তু, ইতোমধ্যে আমি জেনে গিয়েছিলাম, শিল্পের জ্ঞানভারে কুঁজো নগরের গলিতে একাই চলতে থাকা মানুষটির ঝোলার ভিতর কল্পনা আর সৌন্দর্যের আঁকিবুঁকি গুপ্তধনে ভরা। রঙতুলির জীবনযাপন আর চর্চায় তিনি ঢেলে, নিঙড়ে দিয়েছেন তাঁর জীবনের সর্বস্ব। সিলেটে যারা এই লাইনে ভালো কাজ করছেন, তাদের একটা বড় অংশ অরবিন্দ দাস গুপ্তের এই ঝোলার ক্যারিশমা।
অরবিন্দ দাস গুপ্ত সিলেটের অলিগলিতে ঝোলা কাঁধে, পায়ে হেঁটে শিল্প বিলি করা এক গালিভার। কাঁধে ঝোলা ভরা স্বপ্ন, সুন্দর, কল্পনা নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে থাকা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। তাঁর জীবনকে বলা যেতে পারে একটা মোমবাতির মতো; — অন্ধকারে যে জ্বলে জ্বলে ক্ষয়েছে আর চারপাশটা আলোকিত করেছে।
পরপারে ভালো থাকুন অরবিন্দ দাস গুপ্ত!
সাঈদ নোমান । লেখক ও সাংবাদিক
- ১০ কবিতা || হোসনে আরা কামালী - June 26, 2025
- ঘুম ও না-ঘুমের গদ্যলেখা || ফজলুররহমান বাবুল - June 12, 2025
- অবসাদ ও অন্যান্য || জওয়াহের হোসেন - June 11, 2025
COMMENTS