সুবিমল সমাচার || আহমদ মিনহাজ

সুবিমল সমাচার || আহমদ মিনহাজ

বুধবার রজনীর সংক্ষিপ্ত আড্ডায় সুবিমল মিশ্রের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যিক তৎপরতার ভালোমন্দ নিয়ে দু-কথা বলিবলি করেও বলা হয়নি। আড্ডার গতিক এর উপযোগী ছিল না। আলাপ দ্রুত প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে গমন করছিল। ফেসবুক জুমলায় সদ্যপ্রয়াত লেখককে শ্রদ্ধা জানানোর ছলে বাংলাদেশের ছোটকাগজকর্মীদের ওপর যারা নিজের ঝাল মিটিয়ে নিলেন তাদের ব্যাপারে কথা যে-কারণে বিশেষ আগায়নি। সুবিমল মিশ্রের সাহিত্যিক তৎপরতার ভালোমন্দ নিয়ে অনেকে এখন কথা বলছেন। লেখক সুবিমল পুরোদস্তুর সক্রিয় থাকার দিনগুলোয় যদি কথাগুলো তারা বলতেন তাহলে ভালো হতো। লেখকের জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে আমরা কথাটথা বিশেষ বলি না। ধরা থেকে বিদায় নিয়েছেন শুনলে কথার ফোয়ারা ছুটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। প্রয়াত কোনো লেখককে কাটাছেঁড়ার নামে গা বাঁচানো অথবা তাকে ন্যাংটো করার ফন্দিফিকির থেকে যত কথা আমরা বলি, তার সবটা, আমার মনে হয় লেখক জীবিত থাকতেই বলে ফেলা উচিত। মারা যাওয়ার পর বলা যাবে না এমন নয়, কিন্তু জীবিত অবস্থায় বলতে পারলে স্বয়ং লেখকের প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ উন্মুক্ত থাকে। সুবিমল মন্দকপালী লোক। দুই বাংলার লেখকসমাজ গত দেড়-দুই দশকের ফেসবুক জুমলায় তাঁকে নিয়ে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়েছেন সেরকম খবর কানে আসেনি। তাঁর সাহিত্যিক তৎপরতাকে কেন্দ্র করে কৌতূহল ও তর্কবিতর্কের পারদ শূন্য দশক অবধি বেশ ঊর্ধ্বমুখী ছিল। সময়ের পটপরিবর্তনে ধারণা করি সেটি স্তিমিত হয়ে আসে।

প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যিক বয়ানে সুবিমল মিশ্রের অবদান ও এর ভালোমন্দ নিয়ে দু-একজন ছাড়া কাউকে সরব হতে দেখিনি। তাঁর রচনায় বেগবান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার দর্শন ও চিন্তনপদ্ধতির ত্রুটি ধরিয়ে দিতে বাংলাদেশে গত দুই দশকে প্রাসঙ্গিক বাকবিস্তার বা ডিসকোর্সে কেউ গমন করেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। এখন তাঁর দেহ রাখার খবর শুনে পুষ্পস্তবক নিবেদনের ‍ধুম আর মিঠে কথায় কড়া জুতার বারি  মেরে কী ফায়দা! প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক লেখালেখির বিপক্ষে সুবিমল মিশ্রের সাহিত্যিক অবস্থানকে সমালোচনার তূণে বিদ্ধ করতে যারা আকুল হলেন তাদের সঙ্গে কোমর বেঁধে বাকযুদ্ধে নামা ইচ্ছে থাকলেও লেখকের পক্ষে সম্ভব নয়। রোগেশোকে ভুগে বেচারা ইতোমধ্যে পাড়ি দিয়েছেন অজানায়! তাঁর দেহ শ্মশানে পুড়ছে। কেন তিনি কাঠ খায় আংরা হাগে-র প্রাণান্ত কসরতে নিজেকে নিঃস্ব করলেন তার উত্তর দিতে এখন আর বেঁচে নেই!

সে যাকগে, সুবিমল নিয়ে আমার সমস্যা সমীহ ও বিরক্তির মিশ্রণে গোড়া থেকে দ্বৈত ছিল। বিচিত্র বইয়ের খনি বইপত্র  ও এর সত্বাধিকারী হান্নানভাইয়ের সুবাদে একসময় তাঁর লেখা সাগ্রহে পড়েছি। সৎ লেখালেখির প্রতি লেখকের কমিটমেন্ট দেখে কুর্নিশ ঠুকেছি মনে-মনে। পাতালপুরির সাহিত্য  থুড়ি আন্ডারগ্রাউন্ড লিটারেচার  বস্তুটি কী জিনিস এই ব্যাপারে ধারণা মোটেও পরিষ্কার ছিল না। এর তল পেতে সুবিমল তখন বেশ কাজে দিয়েছেন। লেখকের মান-গুণ বিচার আর সমাজকে প্রভাবিত করার ঘটনায় তার সক্রিয়তাকে বাজপাখির নয়নে নিরিখ করার দিনগুলোয় নিজের একটি ধাঁচ ও ব্যক্তিত্ব তিনি গড়েপিটে নিয়েছিলেন। বাংলা ভাষার লেখকসমাজকে ক্রিটিসাইজ করার মিশনে নেমে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাঁধিয়ে তোলা লোকটি নয়ের দশকের গোড়া থেকে অন্ত অবধি আমার আগ্রহের কারণ ছিলেন। নিরীক্ষাপ্রবণ লেখায় তাঁর সহজাত স্বাচ্ছন্দ্য ও একরোখামি দেখে সময়-সময় চমকে উঠেছি। এইসব নিরীক্ষার শানে নজুল ঠাহর করতে বসে আবার বিরক্তি জেগেছে মনে। বাজারকাটতি লেখার চাপ সামলাতে ফতুর লেখকদের কাজকারবার নিয়ে তাঁর বিদ্রুপ মাঝেমধ্যে অতিরঞ্জিত বা একরৈখিক মনে হতো, যদিও যুক্তির কোনো খামতি সেখানে ছিল না।

সাহিত্য রচনার বিষয়বস্তু, তার ভাষা ও বয়নশৈলীর প্রথাবন্দি ছাঁচ ভাঙার নেশায় বিচিত্র পথে সুবিমল নিজেকে পরখ করেছিলেন। ফুকো-দেরিদা-রলাঁ বার্থ আর ওদিকে জঁ-লুক গদারের চিন্তনপদ্ধতিকে নিজের নিরীক্ষাপ্রাণ লেখায় নিঃসংকোচে ব্যবহার করেছেন তিনি। পপ আর্ট-র বিচিত্র অনুষঙ্গ যারপরনাই তাঁর লিখনপদ্ধতির মধ্যে গোড়া থেকে সুলভ হতে শুরু করেছিল। লেখার বাক্যবিন্যাস ও বইয়ের অঙ্গসজ্জায় সৃষ্টিশীল নিরীক্ষার বাড়বাড়ন্ত বাংলার লেখক-পাঠক সমাজের হজম হয়নি। সুবিমল নামটি তাদের কাছে ব্যতিক্রম ও অস্বস্তিকর ছিল। লেখাকে গ্রাফিক্যাল আর্ট  হিসেবে উপস্থাপন করা যায়, লম্বা অনুচ্ছেদ জুড়ে বকবক না করে একটা-দুটো বাক্যেও মূল কথাটি খতম করা সম্ভব, বইয়ের পৃষ্ঠা ফাঁকা রেখে পাঠককে নিজের ভাবনা সেখানে যোগ করতে বলা যেতে পারে…ইত্যাদির মধ্যে উত্তর-আধুনিক মনোবিশ্বের প্রাচুর্য ঝিলিক দিলেও বাংলার লেখকসমাজের নোলা সেগুলো সইতে পারেনি। ভাষার মধ্যে ঘনীভূত এক জড়তা টের পেয়ে জীবনভাটিতে পা রাখার দিন থেকে ফরাসি সিনেমাকার জঁ-লুক গদার ভাষা ও নীরবতার মধ্যবর্তী পরিসরকে ক্যামেরায় উঠিয়ে আনছিলেন। গদারভক্ত সুবিমলের একাধিক নিরীক্ষাপ্রবণ রচনা সেদিকপানে স্বয়ং গদারের আগে যাত্রা করেছিল। এই জায়গা থেকে বিচার করলে মনে হবে সুবিমল ভুল সময়ে জন্ম নিয়েছিলেন অথবা সময়ের চেয়ে অগ্রসর ছিল তাঁর নিরীক্ষার পরিধি। অদ্য যারা তাঁর সাহিত্যিক তৎপরতার ভালোমন্দ নিয়ে বাণী ঝাড়ছেন তারা বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ জুড়লে ব্যতিক্রমী এই লেখকের লড়াই ও মেহনতের জায়গাটি বোধ করি কিছুটা স্পষ্ট হতো বাকিদের কাছে।

লেখা থেকে আরম্ভ করে বইয়ের অঙ্গসজ্জা ও সেটি ছাপানোর যজ্ঞ একা হাতে সামলানোয় সুবিমল মিশ্রের একাগ্রতা ঈর্ষণীয় ছিল। বিকল্পধারার সাহিত্যিক তৎপরতার প্রতি পাঠকের আগ্রহ তৈরিতে তাঁর অবদান বিস্মৃত হওয়া সম্ভব নয়। অমিয়ভূষণ ও কমলকুমার নিয়ে লেখকের আলগা ফ্যাসিনেশন  ছিল, যদিও লেখক হিসেবে তাঁরা কী কারণে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার আওতায় পড়েন না সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন সপাটে। বালজাক, মার্কুইস দ্য সাদে, জয়েস আর ওদিকে বিথোভেন, গদার অথবা ঋত্বিক ঘটকের সৃষ্টিশীল তৎপরতায় নিহিত প্রতিষ্ঠানবিরোধী উপাদান সম্পর্কে তাঁর স্বকৃত ব্যাখ্যা ফেলনা ছিল না। এইসব গুণীকে তিনি পাখির চোখ করে নিয়েছিলেন। এর পাশাপাশি তাঁর রচনাশৈলী ও লেখকের জাতমান বিচারে অনুসৃত একরৈখিক তদন্তপদ্ধতি নিয়ে একরাশ প্রশ্ন ও বিপক্ষ মত প্রবল হতে দেখেছি নিজের মধ্যে। মোক্সার জনক রোদ্দুর রায়কে নিয়ে তাৎক্ষণিক  ভাবতে বসে তাঁকে মনে পড়েছিল। দু-চার কথা সেখানে বলার চেষ্টা করেছি।

সুবিমলের অসুস্থতার সংবাদ গত এক বছর ধরে কানে আসছিল। এর মধ্যে গদার দেহ রাখলেন। তাঁকে নিয়ে লেখার তাগিদ টের পাচ্ছিলাম ভিতরে। গদার নিয়ে লিখতে বসে সুবিমলের ব্যাপারে কিছু কথা পাড়তে হয়েছিল। রোদ্দুর রায়কে নিয়ে লেখা তাৎক্ষণিকার কিয়দাংশ জায়গা নিয়েছিল সেখানে। লেখার পরিশিষ্টে স্থান-পাওয়া অংশটুকু এখানে উদ্ধৃত করা আশা করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না :

গদার ও ঋত্বিক ঘটককে তাঁর নিজস্ব ধাঁচে আত্মস্থ করেছিলেন সুবিমল। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা মানে প্রতিষ্ঠানহীনতা নয়;—এই আপ্তবাক্যে অটল লেখক নিজের প্রান্তিক অবস্থান থেকে সত্যজিৎকে প্রথানুগ প্রাতিষ্ঠানিকতার সেবাদাস রূপে চিহ্নিত ও বাতিল করতে মরিয়া ছিলেন। গদার ও ঋত্বিক অন্তপ্রাণ লেখকের রচনাশৈলী যে-দর্শনকে সামনে এনেছিল সেখানে শিল্প ও বাণিজ্যলক্ষ্মীর টানাপড়েনে শিল্পী বা লেখকের পতন প্রকট রূপ পরিগ্রহ করেছিল।  

শিল্প সৃজনের ক্ষুধাকে গলা টিপে ধরে যে-প্রাতিষ্ঠানিকতা তাকে বাণ হানতে অধীর সুবিমল তাঁর রেনিগেড অবস্থানকে যৌক্তিক করতে যেসব লেখক-শিল্পীকে পক্ষ ভাবতেন তাঁদের মধ্যে গদার ও ঋত্বিক ছিলেন অন্যতম। সত্যজিৎ রায়, অপর্ণা সেন এবং এরকম অনেকে আবার প্রতিপক্ষ গণ্য হয়েছেন সেখানে! প্রতিষ্ঠানের প্রচল কাঠামো চূর্ণ করে নতুন কাঠামোয় সত্তাকে স্বকীয়, স্বাধীন রাখতে সক্ষম লেখক-শিল্পীর সুবিমল প্রণীত বিভাজকরেখা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বাদানুবাদ বেশ তুঙ্গ ছিল তখন। অতীত সময়টার দিকে ফিরে তাকালে মনে হবে সুবিমল সৃষ্ট বিভাজন প্রাতিষ্ঠানিকতার একটি ধারাকে খারিজ করে অন্য আরেকটিকে প্রতিষ্ঠা দিতে সকল শক্তি ও উত্তেজনা ক্ষয় করেছিল। বাঙালি নাগরিক সংস্কৃতিতে সক্রিয় প্রাতিষ্ঠানিক দাসত্ব থেকে সৃষ্ট সত্যজিৎ রায়ের প্রতিমা চূর্ণ করতে আকুল লেখক বিকল্প হিসেবে গদার বা ঋত্বিকের প্রতিমা গড়ে নিচ্ছিলেন, যদিও প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নিয়মে একে চূর্ণ করার সুযোগ তাঁর রচনায় সীমিত হয়ে এসেছিল।

প্রতিমাচূর্ণ-মিশনে রবি ঠাকুর বা সত্যজিৎ রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ ও খারিজ করে জেমস জয়েস, কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, গদার কিংবা ঋত্বিককে বিকল্প রূপে তুলে ধরতে সুবিমল খেটেছেন প্রাণপণ। ওদিকে বিকল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ বা খারিজ করার স্পেস নিজের বয়ান থেকে একপ্রকার ছেটে ফেলেছিলেন তিনি। এই গুণীজনরা কি তবে সেরকম বিকল্প ছিলেন তাঁর জীবনে যেটি কখনো প্রশ্নের আওতায় দাঁড়িয়ে নেই? সুবিমল যে এমনটি ভাবেন না সেটা তাঁর লেখায় পরিষ্কার করতে ত্রুটি করেননি। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নিয়মে প্রতিমা ভেঙে নতুন প্রতিমা সৃষ্টি হয় এবং ওটাকে একসময় চূর্ণ করা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়;প্রতিপাদ্যটি তাঁর রচনায় দুর্লভ নয়। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে মনে প্রশ্ন জাগে : রবি ঠাকুর বা সত্যজিতের প্রতিমা চূর্ণ করতে নেমে কী কারণে গোটা রবি ও সত্যজিৎকে তিনি প্রস্রাবের ফেনায় ভাসালেন? কেন তাঁর মনে হলো না বাঙালি মধ্যবিত্ত সৃষ্ট রবি বা সত্যজিতের প্রতিমায় মেদ থাকলেও মেদটুকু ছেঁচে নিলে তারা স্বকীয়তায় ঝিলিক দিতেও পারে!

রবি ঠাকুর ও সত্যজিৎ রায়কে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পাঠ অথবা ব্যাখ্যার সম্ভাবনা সুবিমলকে ভাবিয়ে তোলেনি। বাঙালি নাগরিক মধ্যবিত্তের প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক দাসভাবের কুফল থেকে সৃষ্ট মূর্তিগুলোর মস্তকছেদনকে একমাত্র উপায় ঠাউরে বসেছিলেন তিনি! নকশালরা যেমন বিপ্লবের প্রথম প্রহরে বিদ্যাসাগরের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়ে ভাবছিল বঙ্গে একরৈখিক রেনেসাঁর অন্যতম প্রতীককে এইবেলা চূর্ণ করা গেল! বাঙালি মধ্যবিত্তের হাতে আজোবধি সংস্কৃতির যত মেরুকরণ ঘটেছে সেগুলোকে একপেশে বলে নকশালপন্থীরা প্রায়শ গাল পাড়তেন। বিপুল প্রান্তিক সমাজে প্রাণবন্ত সংস্কৃতির সঙ্গে নাগরিক মধ্যবিত্তের সংযোগ ক্ষীণ হয়ে আসার কারণে তার সংস্কৃতি যাপনের ধারাকে শ্রেণিশত্রুর সহগ বলে তারা বুঝে নিয়েছিলেন। বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রতি নকশালদের বিরাগ মূলত সেখান থেকে তুঙ্গে উঠেছিল। সুবিমল কি এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন? হতেও পারে।

নকশালদের ভাবনায় যুক্তি থাকলেও পন্থা সঠিক ছিল না। একটি শ্রেণি বা সমাজে গড়ে ওঠা প্রতিমাকে প্রতিষ্ঠা দিতে অন্যটিকে তারা চূর্ণ করছিলেন কেবল! সুবিমলের প্রতিমাচূর্ণ-মিশন অনেকটা সেদিকে মোড় নিয়েছিল। ভিতরে আগুনরাঙা ক্রোধের ফুলকি থাকলেও ক্রোধটি তাঁকে প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে নিষ্ক্রমণ নিতে সহায়তা করেনি। একটির পরিবর্তে অন্য প্রতিমায় প্রাণ সঞ্চার ঘটানোর কাজে দম বাজি রেখেছিলেন। রবিসাহিত্যে মোটা দাগে কিংবা সত্যজিতের সিনেমা ও শিশু সাহিত্যে উপকারী কিছু খুঁজে পাননি সুবিমল। তাঁর পাঠবিবেচনায় এগুলোকে বাঙালি পাঠক ও সিনেমা দর্শকের জন্য প্রথানুগ শিল্পের নমুনা দাগিয়ে অবিরত খারিজ করতে অদম্য থেকেছেন। ভালো কথা, কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, ঋত্বিক বা গদার কি ছকের বাইরের ঘটনা? প্রথানুগত্যের লক্ষণ কি তাঁদের মধ্যে তালাশ করলে পাওয়া যাবে না?

সুবিমলের ক্রাইসিস হলো একটি মানদণ্ড খারিজ করতে গিয়ে অন্য মানদণ্ডের পিছনে তিনি হন্যে হয়ে ছুটেছেন। একটিকে কামান দাগতে বসে অন্যটি দিয়ে নিজের গোলাবারুদের বাকশো ভরে তুলেছিলেন। তাঁর রচনাশৈলী যারপরনাই কমলকুমার মজুমদারের আপ্তবাক্যে (*ভাষাকে যে আক্রমণ করে, সেই ভাষাকে বাঁচায়।) নির্ণয় খুঁজে মরছিল। যেসব ভাঙচুরের ভিতর দিয়ে প্রথানুগ ভাষা ও শৈলী থেকে নিষ্ক্রমণের উপায় তিনি খুঁজছিলেন সেখানে আরো অনেকের সঙ্গে জঁ-লুক গদারকে পরম প্রাসঙ্গিক বলে মেনে নিয়েছিলেন। তর্ক-বিতর্ক যাই থাক, সিনেমার ভাষা ও শৈলীকে সাহিত্যের উপজীব্য করে তুলতে গদার তাঁকে পথ দেখিয়েছেন বৈকি! রঙ যখন সতর্কীকরণের চিহ্ন-র মতো রচনাকে বাংলা সাহিত্যে ব্যতিক্রম নিরীক্ষার স্মারক গণ্য করা উচিত।

উদ্ধৃত অংশটি, বুঝতেই পারছেন, সুবিমলের সাহিত্যকৃতির তদন্ত আদৌ নয়। তাঁর সাহিত্য সৃজনের পদ্ধতি যদিও প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যিক তৎপরতার ভিতর দিয়ে স্বকীয় মানদণ্ড গড়ে নিয়েছিল। ওই মানদণ্ডকে বাদ দিয়ে তাঁর পাঠ-মূল্যায়ন সম্ভব নয়, আবার একে রাখতে গেলে সুবিমলের লিখনপ্রক্রিয়ায় সংবেদনশীল যে-ব্যাপারগুলো থাকে সেগুলো আবিষ্কারের আনন্দ ও ফুরসত সীমিত হয়ে আসে। তাঁর নিরীক্ষার জায়গাগুলোয় সেভাবে পা রাখা হয়ে উঠতে চায় না। ওসব ছাপিয়ে একরৈখিক নির্ধারণের পন্থাকে ক্রিটিসাইজ করার ঝোঁক পাঠকের মধ্যে তীব্র হয়। যারপরনাই তাঁর নিরীক্ষাপ্রবণ রচনাশৈলী এক পৃথক আয়তন এবং এটি নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস, কাজটিতে কেউ-না-কেউ নিশ্চয় এগিয়ে আসবেন।

এবার ছোটকাগজ প্রসঙ্গে গমন করি। ই-মেইলে মাত্র দু-চার ছত্র বাক্য খর্চায় বিষয়টির মর্মে আপনি হাত দিয়েছেন। ওই যে বলছেন :

রিভেঞ্জটোন কেন? ঘটনাটা তো অতিখণ্ডিত। দ্রষ্টব্য আর লিরিক ইত্যাদি কিছু কাগজের প্যাটার্ন ও প্যাশন সুবিমলানুবর্তী হলেও বড় অংশটা সুবিমল বা আমাদের দেশে সেলিম মোরশেদ প্রমুখের অনুগামী তো ছিলই না উপরন্তু অন্যগামীই ছিল।

ফেসবুক জুমলায় যারা বাংলাদেশে ছোটকাগজের লেখকদের ওপর নিজের রাগ ঝাড়লেন তাদের ভাবনার গলদ ধরিয়ে দিতে উদ্ধৃত বাক্যগুলো যথেষ্ট মনে হয়। সুবিমলকে শিখণ্ডী খাড়া করে যে-কাণ্ড তারা ঘটিয়েছেন তার ব্যাপারে নীরব থাকা সমীচীন হয়তো! দুই বাংলায় ছোটকাগজে সক্রিয় লেখকদের লেখক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া ও ঐতিহাসিক ভিন্নতাকে অবধানের ঘটনায় এনারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ বলা চলে। ওপার বাংলায় বিকল্পধারার লেখালেখির ক্ষেত্রে ছোটকাগজ স্বয়ং এক প্রাতিষ্ঠানিকতা। লেখকদের বড়ো অংশের যোগান সে দিয়ে এসেছে সেখানে। লেখালেখির মাধ্যম ও প্রকাশরীতিতে পালাবদল ঘটে যাওয়ার কারণে ওপার বাংলার ছোটকাগজ অতীত মান ও বৈভব হারিয়ে কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়লেও তার কাঠামোয় এখনো ধস নামেনি। কলকাতা ও তার বাইরের জেলাগুলোয় লেখকদের গণ্য একটি অংশ মাধ্যমটিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় সক্রিয় রয়েছেন।

বাংলাদেশের ছোটকাগজ এদিক থেকে হতদরিদ্র। দুর্ভাগাও বটে! সূচনা থেকে হোঁচট খেয়ে তবু চলার চেষ্টা করেছে আর এখন প্রায় কোমায় চলে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে তার! ওপার বাংলার মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজে ছোটকাগজের একটি আলাদা সাংস্কৃতিক বলয় চোখে পড়ে। লম্বা সময় ধরে বলয়টি সেখানে গড়ে উঠেছে। বলয় তৈরির যোগ্যতা তাকে সেখানকার নাগরিক সমাজে এখনো প্রাসঙ্গিক থাকতে সাহায্য করছে। ছোটকাগজের নিজেকে প্রাসঙ্গিক বা গ্রহণযোগ্য করে তোলার পথ-পদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে প্রচুর বাদানুবাদ থাকলেও নিট ফলাফল  কিন্তু মন্দ নয়। বিষয়বৈচিত্র্যের সঙ্গে লেখার মান-গুণ-ধার সমীহ জাগ্রত করে মনে। বাংলাদেশের ছোটকাগজ (*বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদ দিলে।) এরকম কোনো পরিসর আজো তৈরি করতে পারেনি। লেখার বৈচিত্র্য, গুণ-মান ও বিপণনের সবটাই এখানে অপটু হাতের কারবার মনে হয়। এখানকার ছোটকাগজের এইসব ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করা যেতে পারে এবং করা উচিত হয়তো। তাই বলে সুবিমল প্রভাবিত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার দাঁড়িপাল্লায় দেশের আপামর ছোটকাগজ ও তার লেখকদের তুলে দিয়ে সিদ্ধান্ত ঠোকা কাণ্ডজ্ঞানহীনের পক্ষেই সম্ভব! ফেসবুকে যারা কাজটি করেছেন তারা কতটা জেনেবুঝে করেছেন সেই ব্যাপারে সন্দেহ তাই থেকেই যাচ্ছে।

সুবিমল-প্রভাব বাংলাদেশের ছোটকাগজ বা সেখানে সক্রিয় লেখকদের জায়গায় দাঁড়িয়ে নজর করলে কখনোই প্রধান স্রোত ছিল না। শক্ত পাটাতনে দেশের ছোটকাগজ সম্পাদক ও লেখকরা দাঁড়াতে পারেননি ঠিকই কিন্তু ওপার বাংলার অন্ধ অনুকরণে নিজেকে তারা নিঃস্বও করেননি। এখানকার ছোটকাগজ তার ভালোমন্দ, সাফল্য ও ব্যর্থতা, শক্তি কিংবা সীমাবদ্ধতার সবটুকু এই দেশের জলমাটিহাওয়া আর সাহিত্যবোধ থেকে শুষে নিয়ে পথ ভাঙার চেষ্টা করেছে। সুবিমল ও তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধী চিন্তাধারার প্রভাব সে-পথযাত্রায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। দ্রষ্টব্য  বা প্রতিশিল্প-র মতো দু-একটি কাগজ বাদে বাকি কারো মধ্যে সুবিমলের চিন্তনপদ্ধতি ও সাহিত্যিক তৎপরতা গভীর ছাপ ফেলতে পারেনি। সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে আপনি সেটি পরিষ্কার করেছেন। আক্কেলমন্দের জন্য এটুকু কাফি মনে করি। তবে যারা বেআক্কেল, তাদের মাথায় পেরেক ঠুকলেও এর মাজেজা ক্লিয়ার করা যাবে না। তাদেরকে বড়োকাগজের মধুর সমীরণে দোল খেতে-খেতে অবিরাম বায়ু ছাড়তে দিন। নিঃসরিত বায়ু থেকে হয়তো বিরাট কোনো সাহিত্য জন্ম নিতে চলেছে এই পোড়ার দেশে!

সুবিমল কেন বা কী কারণে বাঙালি লেখসমাজের এইসব সাহিত্যকর্ম ও তার বিচিত্র ধান্ধার ওপর খাপ্পা ছিলেন তার ব্যাখ্যা বিরতিহীন দিয়ে গেছেন। তাঁর প্রতিগল্প, প্রতিআখ্যান ও প্রতিগদ্যের মলাটে সেগুলো বন্দি হয়ে আছে। এই ব্যাখ্যার শক্তি ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে নির্মেদ ব্যবচ্ছেদ কেউ একদিন নিশ্চয় করবেন। আমার কেবল তাঁর একটি গল্পের কথা এই মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে। বাগানের ঘোড়ানিমের গাছে দেখনচাচা থাকতেন  নাম ছিল গল্পটির। সোনার গান্ধী মূর্তি  বইয়ে গল্পটি পড়েছিলাম মনে হয়! বইয়ের সব-কটি লেখাই অনবদ্য ছিল। যেমন অনবদ্য রঙ যখন সতর্কীকরণের চিহ্ন  নামের নিরীক্ষাপ্রবণ বইটি। গদারকে যদি কেউ বাংলা সাহিত্যে ব্যবহার গিয়ে থাকেন তবে সর্বাগ্রে সুবিমলের নাম নিতে হবে।

সে যাকগে, দেখনচাচার গল্পে ফিরি। বাগানের ঘোড়ানিমের গাছে ঘাঁটি গেড়ে বসা দেখনচাচার কুষ্ঠি-ঠিকুজি গ্রামের কারোই জানা ছিল না। ফুলের গন্ধ আর গুয়ের গন্ধে সে কোনো প্রভেদ দেখতে পেতো না। তার কাছে দুটোকে এক বরাবর মনে হতো। ঘোড়া নিমগাছের ডালে পা ঝুলিয়ে মানবসংসারের সবটাই ফুল ও গুয়ের গন্ধে গুবলেট বলে ছেলেছোকরাদের জ্ঞান দিতো এই দেখনচাচা। গ্রামে একবার কলেরা দেখা দিলে লোকে যখন পালে-পালে হেগেমুতে পটল তুলছে তখন মরণাপন্ন এক যুবতীকে সেবা করে সারিয়ে তোলে সে। যুবতী সেরে উঠলে চাচা তাৎক্ষণিক তার সঙ্গে রতিমিলনের বাসনা জানায়। বিব্রত যুবতীকে বোঝায়, জননী ও জায়ার মধ্যে ভেদাভেদ নেই। যে-স্তন থেকে শিশু দুগ্ধ পান করে ও লায়েক হয়, সেই স্তনকে পরে মাই  ভেবে চুষে। দেখনচাচার ব্যাভিচারে গ্রামের চরিত্রবান সমাজ তো খেপে লাল! চাচাকে পাকড়াও করে বেদম পিটুনি দেয় তারা। মারের চোটে নদীর ধারে অক্কা পায় শেষমেষ। দেখনচাচা আর নেই কিন্তু তার রক্ত যত জায়গায় পড়েছিল পরদিন সেখানে একটি করে ঘোড়ানিমের গাছ গজিয়ে ওঠে। গ্রামের লোকের চোখের সামনে নিমগাছগুলোর কচি পাতা এখন বাতাসে দোলে!

গল্পটি সুবিমলকে চিনে ওঠার মোক্ষম আয়ুধ হতে পারে। তাঁর সাহিত্যিক তৎপরতা আগাগোড়া দেখনচাচার নিয়তি মেনে সক্রিয় থেকেছে জীবনভোর। নামিদামি চরিত্রবান লেখকে ভরপুর সাহিত্যসমাজ, সেখানকার বই ও কাগজের দুনিয়ায় পল্লবিত ফুলের গন্ধ থেকে কতখানি গুয়ের গন্ধ ওঠে সে-কথায় আপাতত না যাই। এইসব চরিত্রবান লেখক আবার সুবিমলের মতো রেনিগেডকে মেরে আধশোয়া করতে ভীষণ পটু। সুবিমলরা তথাপি মরে না। তাদের রক্ত থেকে সকলের অগোচরে ঘোড়ানিমের গাছ আকাশপানে মাথা তুলতেই থাকে। তার কচি পাতা বাতাসে তখন দোল খায়। সুবিমল আর কিছু না পারুন এই সত্যটি বুঝতে পেরেছিলেন,—নিম ভীষণ তেতো হলেও তার প্রয়োজন অনিঃশেষ। দেখনচাচার মতো লোকজন সত্যটি জানে। নিমগাছের মগডালে বসে চরিত্রবান লেখকসমাজের গোমর ফাঁস করতে তারা তাই খাবি খায় না। দেখনচাচার মতো মুখে রক্ত ওঠার ক্ষণে অক্লেশে বলে বসে, আমি কিন্তু সত্যি কথাটাই বলেছি। সুবিমল মিশ্র সেরকম লোক ছিলেন বৈকি। তাঁর প্রয়াণের সঙ্গে বাংলা ছোটকাগজে দেখনচাচার যুগটি অস্তমিত হলো। রঙ্গভরা বাংলার মার্কুইস দ্য সাদে পুড়ে আংরা হলেন শ্মশানে। সত্যটি একদিন কেউ হয়তো সবাইকে ধরিয়ে দেবেন।


আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
সুবিমল মিশ্র স্মরণ : গানপার ট্রিবিউট

COMMENTS

error: