অঘুমা রাতে একটানা উপন্যাস পড়ে গেলাম একে একে তিনটে এবং আরেকটা আদ্ধেক। গত দুই নিশীথের হিসাব এইটা। আসলে উপন্যাস বলা ঠিক হচ্ছে কি? ঠিক-বেঠিক জানিনে জানিনে, সখি, শুধু কাহিনি জানি। জীবন তো অনিঃশেষ কাহিনিই, জমজমাট, নাচাগানায় ভরপুর। ফলে, বলা ভালো, একধারসে গেলাম পড়ে সেইসব শব্দে-গড়া কাহিনি — জম্পেশ, অবিরত। দুই দিনে আস্ত আস্ত বই — একটি নয় দুইটি নয় সাড়ে-তিনটি — বিলকুল খতম! খেল খতম, পয়সা হজম — এই টাইপের মামলা?
তা, খারাপ লাগসে বলা যাবে না। তাহলে এতটা এগোলাম কী করে? নিশ্চয়ই সুখপাঠ্য ছিল! অবশ্যই। কিন্তু সুখের লাগিয়াই কি এ-ঘর বাঁধিনু, সখি? বিতিকিচ্ছিরি প্রশ্নকণ্টকগুলো গলায় এসে খচখচ করে যে! সেসব অন্যত্র বলিও বাপু, অফ যাও আপাতত। বলি কেবল যে, বেশ জমে গেসিলাম কাহিনিমিষ্ট উপন্যাসাখ্যানে। একযুগান্তরের পুরনো দুইটা শারদীয়া আনন্দবাজার টেনে পড়তেসিলাম এতদিন-অপড়া সুনীল-শীর্ষেন্দু-সুচিত্রাকাহিনি। ইচ্ছে করে নাই বলে এদ্দিন পড়ি নাই। বিগত দুইদিন ধরে খেয়ালের বশে সহসা শুরু করে বেশ পড়ে যেতে পারলাম তরতরিয়ে।
এইসব শারদীয়/ঈদীয় পত্রিকাসাময়িকীর সংখ্যায় ছাপা-হওয়া উপন্যাস নামধেয় কাহিনিগুলো পড়ে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ভুলে যাওয়া যায়। এ এক মস্ত সুবিধের দিক। অত মনে-রাখারাখি জীবনহানিকর। মানতে হবে এটা একটা ম্যাজিক, যে, এ-ধারার লেখকেরা দারুণ ক্ষমতাশালী। কীরূপ ক্ষমতা? টাইম-মেশিনের ন্যায়, সিনেমার সাই-ফাই চিত্রনাট্যে যেমন, একপলকে একটা আজগুবি বিকল্প-বিশ্ব সফর করিয়ে আনা পাব্লিককে। এরপর বাদামের খোসা চাবাতে চাবাতে প্রেক্ষাগৃহফেরত স্বগৃহের অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপানো সুধী দর্শক-চলচ্চিত্রামোদীদের।
মার্জিনে একটা ফোড়ন কেটে রেখে যাই এখানে যে, — বাস্তবতা ভুলিয়ে দেয়া, না বাস্তবতা আরও বেশিভাবে মনে করিয়ে দেয়া — কোনটা আমরা চাই শিল্পসাহিত্যের কাছে? এবং কোনো পথ রয়েছে কি এমন, যেটাকে শ্রেয় গণ্য করা যাবে একবাক্যে? এর উত্তর বহু প্রশাখাপ্রাচুর্যময়, ঢের নধর বইপত্র-লেখাজোখা আছে এ নিয়া। যা-হোক, কথা যদি হয় ফুর্তি নিয়া, মানে পড়ে তুমি ফুর্তি পেলে কি না, বা ফুর্তির জন্য পড়তে গেসিলে কি না, তাহলে একরকম উত্তর। অলরেডি এর অ্যান্সার আমি দিয়া রাখসি জিজ্ঞাসাবাদের আগেই। কিন্তু মননের মধু প্রভৃতি নিয়া ভাবতে গেলে এ-যাত্রা খামোশ রইব আমি। ইত্যাকার ব্যাপার আমার এখতিয়ার-বহির্ভূত, জটিল, ফলে এক্ষণটাকে আমি কুক্ষণ করিবারে নারাজ। অকালে পাঠক হারায়া আমি দেশে দেশে কেঁদে ফিরিবারে নারি। কিন্তু, কোনো দাগটাগ না-দিয়ে বেশ খেলিয়ে-খেলিয়ে পাঠকদের নিয়ে যেতে পারেন সমাপ্তি পর্যন্ত, পূজাবার্ষিকীর উক্ত লেখকগণ ছাড়াও বাজারের বেশিরভাগ লেখক, যদিও পরক্ষণেই উবে যায় মাথা থেকে ভূত কিংবা কাহিনিকিম্ভূত। তবু এইসমস্ত লেখার ভিড়ে দু-একটা নীরব-নির্জন লেখা/লেখকের দেখাও মেলে মাঝে মাঝে।
হ্যাঁ, তা মেলে অবশ্য, হংসমধ্যে বক যথা। বাহুল্য হচ্ছে বলা, তা-ও বলি, নিতান্ত অঙ্গুলিমেয় তারা। আজকের এই বাজারে নির্জনতা জিনিশটাও একটা বেশ বিপণনযোগ্য পণ্য বৈ আর-কিসু তো নয়। যে-নির্জনতা আজ তুমি তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করতেসো, বসে যাও মনিটরে ইয়া-আলি বলে আমার মতন, লিখে নামাতে পারলে কালই তা বাজারে সেলযোগ্য পণ্য। খদ্দের কাটবে কম, থলে পাবা না চটজলদি, তাতে কী, বাজারে তো প্রবেশিলে! বেহুঁশ খুশি। বেজায় আনন্দ।
ফুরায়া যায় কাহিনিদীর্ঘ রজনীদিবস, হট্টগোলে গা ভাসাই নিরস, শরতে এন্ডিয়ানবাংলা আষাঢ়ে উপন্যাস পড়তে পড়তে।
- প্রতুল স্মরণ - February 23, 2025
- বাত্তির রাইত - February 15, 2025
- চিকন চালের চলাচল - February 13, 2025
COMMENTS