জীবন তো খুব সুখশান্তির পারাবার নয়, নিরঙ্কুশ নয়নাভিরাম সুপারিবিরিখে-ঘেরা মাইল মাইল শান্তিকল্যাণেরও নয়, খুব ভালো চমৎকার পালোয়ান মানুষেরও কমজোর মুহূর্ত প্রতিদিন প্রহরে প্রহরে যায়, এবং কোনো কারণ ছাড়াই কিংবা ফায়্শা-খামাখা কারণে ঘেরাও করে নিরাশা আমাদেরে। এমনতর সময়ে এককালে নেপোলিয়ন বোনাপার্তের অ্যানেকডোট্যাল গল্পগাছা দিয়া আমাদেরে এনার্জাইজ করা হইত মনে পড়ে, এবং আমাদের হৃত মনোবল ফিরিয়া আসিত বড়দের সস্নেহ কৌশলী কারসাজিতে, সে-তো ছোটবেলায়। এরপর তো জটিল হয়েছে দুনিয়া দিনে দিনে, নেপোলিয়ন দিয়া আর তো কুলিয়ে ওঠা যায় না। বীর নেপোলিয়নের জায়গা নিয়েছে একেকটা লেখা, একেকটা গান, একেকটা সিনেমা বা ছায়ায় স্থির/অস্থির ছবিচিত্র ইত্যাদি। উজ্জীবক একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম।
তো, খুব তো পড়াশোনা নাই আজকাল আমার, কিছু রচনা ভালো লেগে গেলে সেইটাই দিনভর চৌপর জাবর কাটি। কিন্তু, অবশ্যই স্বীকারিয়া যাইতে চাই, কিছু গান ও লেখা বারবার কাজে লেগেছে এনার্জাইজ করতে গদাইলস্কর আমারে। এইখানে তেমনই একটা লেখার গল্প করতে লেগেছি। নিতান্ত হ্রস্বকায় নিবন্ধ একটা। আজকেও আমার এক সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে পড়লাম, পড়তে যেয়ে আবারও আরেকবার উজ্জীবিত হলাম আমি, তিনি নির্ঘাৎ বিরক্ত হইলেন কি না তা আর জিগাই নাই। এইটা বারবার ওয়েবক্ষেত্রে যেয়ে বের করা লাগে, এইখানে একটু উৎকলন করিয়া রাখা যাইতে পারে হয়তো। লোকালয়ে এইটা যারা আগে খেয়াল করে দেখি নাই, তারা একবার একটু ঢুঁ মেরে দেখেও নিলাম।
রচনাটা আমীর খান সাহেবের বার্থ সেন্টেনারিতে লিখেছেন কবীর সুমন। (Ustad Amir Khan) উস্তাদ আমীর খান, বলা কর্তব্য। সচরাচর জন্মশতবার্ষিকীতে যেমন শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হয়ে থাকে, এইটা ঠিক তেমনধারা না, ট্র্যাডিশন্যাল ট্রিবিউট এইটা না, সামথিং-এল্স বলতে যে-জিনিশটা আমি বুঝি, শ্রী সুমনের রচনাটা তা-ই। নিজেকে কোথাও গ্লোরিফাই না-করে, এমনকি উস্তাদজির নাম নিতে যেয়ে অশ্রু ও সর্দি একাকার করা সমুজদার না-হয়ে, খানসাহিবের নামোচ্চার মাত্র কর্ণলতি-চিমটি-কাটা আদব না-দেখিয়ে, এই রচনাটা ফাঁদা। আমাদের সময়ের সত্যিকারের নতুন বাংলা গানের এক মায়েস্ত্রোর হয়ে-ওঠা দিনগুলোর একটা আংশিক রেট্রোস্পেক্ট হয়েছে। এবং, লক্ষণীয়, কোত্থাও উস্তাদজিরে পেন্নাম না-ঠুকেও, ভক্তিগীতি না-গেয়েও, গদগদ গরিলা না-বনেও, নমস্কার না-জানায়েও শ্রদ্ধার্ঘ্য রচা যায়!
এই দেশে হিন্দুস্তানী ধ্রুপদ সংগীত সম্পর্কে একটা আখাম্বা আহা-উহু ছাড়া যাকে বলে ম্যুজিক অ্যাপ্রিসিয়েশন তাহা ল্যান্টার্ন ঝুলাইয়া তালাশিয়াও দরিশন ঘটে না। আমরা ধরে নেব যে আপনার বয়স থোড়া কম বা বেশি তিরিশ-পঁয়তিরিশ, তো অনেক প্রহসনের দর্শক ও অংশগ্রাহক আপনি, হিন্দুস্তানী মার্গীয় সংগীতের সমুজদার এক স্পেসিসের সনে এরই মধ্যে মুলাকাত হয়েছে আপনার প্রায় নিশ্চিত হয়েই বলা যায়। এরা ভাঁড় গোপালের ন্যায় এত প্রতিভা নিয়া জন্মায় নাই ঠিক, তবে এরা গানবাজনার বারোটা বাজানোর সহজাত ক্ষমতার অধিকারী নিশ্চয়। এরাই নিশ্ছিদ্র প্রহরী হিন্দুস্তানী সুরের ও সৌহার্দ্যের।
কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের একটা অ্যানেকডোট্যাল কিচ্ছাকাহনমূলক বই আছে, সেই বইয়ের নাম ‘কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গি’, ভীষণ সুখপাঠ্য ঘটনাবলি পাওয়া যায় বিভিন্ন ঘরানার মস্ত বড় বড় উস্তাদ ও বাঈজিদেরে নিয়া, তাদের যাপন ও জীবনাচরণ নিয়া দারুণ সুন্দর বৈঠকী গদ্যপ্রবাহে লেখা বই একটা। যে-কোনো সংগীতে-অনাগ্রহী পাঠকও এই বই পড়ে হ্যাপি হবে এমন কায়দায় লেখা বই। রিসেন্টলি, গত বছর, ‘মাই নেইম ইজ গওহরজান’ নামে একটা বই বেরিয়েছে, লেখক সঞ্জয় সম্পাত, আনন্দ পাব্লিশার্স থেকে বেরোনো বইটির বাংলান্তরও সুখে সঞ্জীবিত পড়বার মতো। তো, বলবার কথাটা এইখানে এ-ই যে, এইসব বইপত্রে উস্তাদজি কি বিদুষিণী কিভাবে রেওয়াজ করতেন বা হাসিঠাট্টা, কে কত দাম দিয়া কেনা শাল পরিধান করিতেন বা আলোয়ানে কে স্প্রে করতেন পারি-নগরীর পার্ফিয়্যুম, মুজরোপ্রতি কে কত সম্মানী নিতেন, কে ফিটন চড়িতেন বা কে জুড়িগাড়ি হাঁকাতেন ইত্যাদি খোশখব্রিতে ভরা।
কাজের জিনিশ, কুদরতি কিচ্ছাবইও কাজেরই জিনিশ, ডাউট নাই; কিন্তু সমুজদারদের দরকার আলবোলা টানার গালগল্প, আর আমাদের দরকার জীবন্ত অভিজ্ঞতার বয়ান। দরকার আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে নেবার একটা প্রবেশদুয়ার। সুমনজির রচনাটা সেইদিকের একটা ভালো সূত্র। খুব অনুপ্রেরণা ও সাহস পাওয়া যায় পড়ে, — এমন একটা লেখা। আমরা তো সকলেই কোনো-না-কোনোভাবে এই ব্যাপক নাথিংনেস্-অধ্যুষিত সময়কিনারায় দাঁড়িয়ে নিজেদের বিয়িং, — নিজেদের অস্তিত্বটা, — উদযাপন করতে চাই, নিজেদের বিকামিং পরখিতে চাই; কিংবা আমাদের হয়ে-ওঠা বা বিকাশ হোক-না-হোক, — বিকামিং-যে সম্ভব, এইটায় আস্থা হারাতে চাই না। কাজেই কিছু সুর ও সৌহার্দ্য, — হোক তা গানের বা বইয়ের বা সিনেমার বা পেইন্টিঙের, — দরকার আছে জীবনে।
খেয়ালগায়ক উস্তাদ আমীর খান সাহেবের গানা ও বাজনা শুনে ফেরার সকালবেলায় আঠারোর তরুণ সুমনের অবস্থা অনেকটাই যেন আঠারোর তরুণ রবীন্দ্রনাথের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ কবিতার মুহূর্ত। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, বছরের পর বছর ধরে দুর্বিষহ কসরত করে যেয়েও সুমন স্বাধীনভাবে স্বীয় কল্পনাশ্রয়ী তান ও স্বরবিস্তার পারছিলেন না, ব্যর্থ হচ্ছিলেন খেয়ালের মেজাজ নিজের কণ্ঠাভিব্যক্তিতে মেলিয়া-খুলিয়া ফোটাতে। এই ব্যর্থতার বর্ণনা, আর এর থেকে উত্তরণের পথ হাতড়ানো, এই অভিযান ছোট্ট-কলেবর রচনাটাতে উন্মত্ত ঘোড়া বা ষাঁড়ের গতিতে এঁকে দেয়া হয়েছে। এরপর কেমন করে এক প্রভাতের সূর্য-ওঠা সফল হলো, সুমনের বয়ানে সেই গল্প শোনা আমার কাছে অভিজ্ঞতা হিশেবে দুর্ধর্ষ ও স্মরণীয়। শুনি :
“প্রায় তিন ঘণ্টা গাইলেন তিনি। সে-কী সরগম! অমন সরগম-যে কেউ করতে পারে, অমন সরগম-যে সম্ভব, কীভাবে-যে রাস্তা করে নিচ্ছেন তিনি! কত রকমের রাস্তা! পথে পথে একটা দুনিয়া নির্মাণ করে নিচ্ছেন। এ-পথে ও-পথে যাচ্ছেন। পথ দেখিয়ে দিচ্ছেন। পথের পর পথ। কত তার বাঁক! কত গলি, কত বড়রাস্তা, কত পাড়া, কত মাঠ, কত ঘর, কত দালান, কত জানলা, কত দরজা, সেখান দিয়ে কিভাবে রাস্তায় নামছে মানুষ, সময়, ঘটনা — নতুন সকালে বড়রাস্তা ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরলাম এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে। গোটা দুনিয়াটাই পাল্টে গিয়েছে। আমিও পাল্টে গিয়েছি। বাড়ি ফিরে মুখ ধুয়ে দাঁত মেজে তানপুরাটা নিয়ে সুরে বাঁধলাম। (…) আমি ভাটিয়ার রাগটা ধীরে ধীরে গাইতে শুরু করলাম আলাপ করে। খানিকক্ষণের মধ্যেই দেখি আমি সরগম করছি। না। মাস্টারমশাই আমায় তখনও ভাটিয়ার শেখাননি। খাতায় কিছু লেখা ছিল না। মাথা থেকেই সরগম করছি। ধীরে ধীরে। তান করছি ছোট ছোট। জীবনে প্রথম নিজের থেকে তান আর সরগম করতে থাকলাম। না, খুব দ্রুত লয়েও না এবং আকারে খুব বড় বড়ও নয়। ছোট থেকে মাঝারি মাপের সরগম। বিশেষ করে সরগম।
ওস্তাদ আমীর খান আমায় মুক্তি দিলেন।”
মুক্তির এই ম্যুভিটা, — আমার এই সিনেমা পারাদিসো, — রাখছি নিচে। কেউ খুব অনাগ্রহী না হইলে, ব্যস্ত না থাকলে, এই লিঙ্ক (পাঠলিঙ্ক) ধরে যেয়ে একবার ট্রাই করে দেখতে পারেন। বোধহয় রিগ্রেট করতে হবে না।
প্রতিবেদনপ্রণেতা : জাহেদ আহমদ
… …
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS