বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলে আমার জন্ম। সেখানেই শৈশব ও তরুণবেলা কেটেছে। অতিদরিদ্র এলাকা হওয়ায় আমার জন্ম-এলাকায় দুর্গাপূজার খুব একটা প্রচলন ছিল না। আশপাশের আট-দশ গ্রামে এক-দুটি পূজা হতো কি না সন্দেহ! আর যেসব গ্রামে পূজা হতো, তা-ও ছিল ধনাঢ্য কোনও পরিবারের একক উদ্যোগ। সর্বজনীন পূজা আয়োজনের রেওয়াজ এখনকার মতো তখন ছিল না। সময়টা আশির দশকের শেষ সময়। হাওরাঞ্চলের যেসব বাড়িতে তখন দুর্গাপূজা হতো, সেখানে রমরমা কিংবা চোখ-ধাঁধানো কোনও আয়োজন থাকত না। পুষ্পস্তবক অর্পণ, প্রসাদ বিতরণ আর রাতের বেলা ভক্তিমূলক কীর্তনগান কিংবা বড়োজোর যাত্রাগানের আসর — পূজা বলতে আমরা সেই বয়েসে তা-ই বুঝতাম।
গণহারে না-হলেও পূজাতে নতুন কাপড় কেনার চল হাওরাঞ্চলের মুষ্টিমেয় কিছু বাড়িতে ছিল। বাবা-মা চাকুরিজীবী, এমনকি তুলনামূলকভাবে আমাদের সহায়-সম্পত্তিও মোটামুটি ভালোই ছিল। সংগত কারণে পূজা উপলক্ষে আমাদের পরিবারে নতুন কাপড় কেনার চল ছিল। সেই নতুন জামাকাপড় গায়ে জড়িয়ে কখনও বাবা-মায়ের সঙ্গে, আবার কখনও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পূজা দেখতে যেতাম। যতটুকু স্মৃতিতে রয়েছে, মনে পড়ে, আমাদের আশপাশের কয়েক গ্রামের মধ্যে কেবল ঘুঙ্গিয়ারগাঁও গ্রামের সরকারবাড়িতে এবং সুখলাইন গ্রামের ডাক্তারবাড়িতে — এ দুটি জায়গায় পূজা হতো। সেখানে রাতের বেলা কীর্তন গান অথবা যাত্রাগান হতো, আবার কোনও কোনও বছর এসবের কোনও আয়োজনই থাকত না।
আমাদের ছোটবেলায় দুর্গাপূজা শুরুর আগে দেবী দুর্গাকে স্বাগত জানিয়ে কোনও গানের ধারা পরিবেশিত হওয়ার প্রচলন চোখে পড়েনি। তবে একসময়, তা-ও কমপক্ষে শতাধিক বছর আগে, হাওরাঞ্চলে, বিশেষত সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রামে ‘আগমনি গান’-এর প্রচলন ছিল। জ্ঞাত-অজ্ঞাত অনেক গীতিকারের রচিত কয়েকশ’ গান হাওরাঞ্চলের কীর্তনীয়া কিংবা রসজ্ঞ ব্যক্তিরা তখন দুর্গাপূজা উপলক্ষে মণ্ডপের সামনে আয়োজিত বৈঠকিগানের আসর কিংবা কীর্তনগানের আসরে এসব আগমনি গান ব্যাপকভাবে পরিবেশন করতেন। আর এখন কিছু কিছু এলাকা ছাড়া সময়ের পরিক্রমায় সেই আগমনি গানের ধারা অনেকটাই তলানিতে ঠেকেছে।
দুই
বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের সাত জেলার মধ্যে সিলেট ছাড়া অপর ছয় জেলা সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহে আগমনি গানের প্রচলন ছিল। তবে সিলেটে নানা সময়ে টুকটাক যে আগমনি গান পরিবেশিত হয়নি, তা-ও কিন্তু নয়। আশির দশকের পর যখন গ্রামীণ মানুষের বিনোদনের নানা নতুন নতুন মাধ্যমের পরিসর বাড়তে লাগল, মূলত তখন থেকেই অন্যান্য আরও লোকসংগীতের ধারার মতো আগমনি গানের ধারাটিও সংকুচিত হতে শুরু করে। পূজামণ্ডপগুলোতে নিজস্ব ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির বদলে স্থান করে নেয় হাল-আমলের বাংলা সিনেমার গান, কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাউলগান কিংবা যাত্রাগানও। এভাবে ধীরে ধীরে বিনোদনমাধ্যমের পরিবর্তনও ঘটে। এখন, শহর তো বটেই, এমনকি গ্রামাঞ্চলের পূজামণ্ডপগুলোতে পর্যন্ত উচ্চস্বরে মাইক বাজিয়ে হিন্দি কিংবা বাংলা রকগান অথবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে লোকসংগীত ঘরানার কিছু সস্তা জনপ্রিয় গান দেদারসে বাজাতে শোনা যায়। ফলে, আগমনি গানের চর্চা আর বিকাশ অনেকটাই মুখ থুবড়ে পড়ে। দিনের পর দিন এমন চলতে থাকায় একসময় আগমনি গানের শৌখিন শিল্পীরাও মুখ ফিরিয়ে নেন। আর এভাবেই বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে এখন অনেকটা ‘যান্ত্রিক’-নির্ভরতার মাধ্যমেই পূজামণ্ডপে গান বাজিয়ে ‘দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছেন’।
তিন
বাংলাদেশে কমবেশি সব অঞ্চলেই আগমনি গানের প্রচলন ছিল। যদিও, হাওরাঞ্চলে এ ধারার বিকাশ ও বিস্তার ছিল ঈর্ষণীয় পর্যায়ের। তবে গত কিছুদিন আগে এ ধারার গানের খোঁজ করতে গিয়ে আমাকে অনেকটা হতাশই হতে হয়েছে। হাওরাঞ্চলের বর্তমান সময়ের পরিচিত ও জনপ্রিয় যেসব শিল্পীর সঙ্গে আলাপ করেছি, তারাই একবাক্যে জানিয়েছেন, আগমনি গানের কোনও ধারা সেভাবে এই অঞ্চলে প্রচলিত ছিল না। কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষেরা এমন ধরনের গান অদৌ গাইতেন কি না, তা নিয়েও তারা খুব একটা অবহিত নন বলেও জানালেন। তবে প্রাচীন কয়েকজন শিল্পী ও সংগীতরসজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া যায় এক নতুন তথ্য। তাদের অনেকেরই ভাষ্য, মোটামুটি সিলেট শহর ছাড়া হাওরাঞ্চলের সবক’টি এলাকাতেই কমবেশি আগমনি গানের প্রচলন ছিল। আর শহর সিলেটে আগমনি গানের উত্থান সেভাবে কখনও না-ঘটলেও দুর্গাদেবী-বন্দনাকেন্দ্রিক বিভিন্ন গান এবং কীর্তন পরিবেশনার ধারা অতীতেও ছিল, এখনও রয়েছে।
আগমনি গান নিয়ে আমার লেখা প্রস্তুতের সূত্র ধরে কিছুদিন আগে আলাপ হয় আমার শ্বশুর ক্ষিতীশ চন্দ্র দেবনাথের সঙ্গে। তাঁর বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার সিকন্দরপুর গ্রামে। এর আগে তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে হাওরাঞ্চলে প্রচলিত নানা ধারার লোকগানের একটা বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। তিনি নিজে একসময় বিভিন্ন আসরে কীর্তনগান গাইতেন। এখন বয়স বাড়ার কারণে কিংবা সময়াভাবে অথবা গানের ধারাগুলো বিলুপ্ত হয়ে আসার কারণেই হয়তো সেভাবে আর কোনও আসরে গাইতে যান না। সেই তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, হাওরাঞ্চলে প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই দুর্গাপূজা শুরু হলে আগমনি গান গাওয়া শুরু হয়ে যেত। শৌখিন শিল্পীরা পূজামণ্ডপের সামনের উঠোনে কিংবা স্থাপিত প্যান্ডেলে বসে একযোগে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহকারে গান পরিবেশন করতেন। গ্রামের ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন সেসব গানের মুগ্ধ শ্রোতা।
ক্ষিতীশ চন্দ্র দেবনাথ তাঁর স্মৃতির ঝাঁপি খোলেন। বলেন, “চল্লিশ বছর আগে একবার একজনের একটি গানের খাতার সন্ধান পাই। তিনি এক রাতের জন্য আমাকে তাঁর খাতাটি পড়তে দিয়েছিলেন। সারারাত সে-খাতাটির বেশকিছু গান আমি অন্য একটি খাতায় কপি করে নিই। এর মধ্যে বেশ কিছু আগমনি গানও রয়েছে। সেসব গান আমি একাধিক আসরে গেয়েছি।” তিনি তখন জানান, আগমনি গানের রচয়িতাদের মধ্যে শ্যামসুন্দর এবং বিষ্ণুপ্রিয়ার গানই হাওরাঞ্চলে বেশি পরিবেশিত হয়। এসব রচনা অন্তত দেড় শতাধিক বছর আগের বলে তাঁর ধারণা। তবে এই গীতিকারদের জন্মস্থান কিংবা পরিচিতি তাঁর জানা নেই। পরম্পরাসূত্রে কেবল এসব গান এক শিল্পীর খাতা থেকে আরেক শিল্পীর খাতাতে লিপিবদ্ধ হচ্ছে বলে তাঁর মন্তব্য।
আগমনি গান নিয়ে ক্ষিতীশ চন্দ্র দেবনাথের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁর পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি সংগ্রহ করে নিই। দেখি, অনেক কীর্তনগানের পাশাপাশি গোটা বিশেক আগামনি গানও সেখানে রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি গান নিম্নরূপ —
১
তারা গো মাগো আমার এই আকিঞ্চন
কৈলাশ ছেড়ে হেথায় এসে করো আগমন॥
দোহাই লাগে ভোলানাথের গো
মাগো যদি করো অন্য মন॥
পুষ্প-চন্দন হাতে নিয়া গো
মাগো দিব তোমার শ্রীচরণ॥
বিল্বপত্র হাতে নিয়া দিব মায়ের শ্রীচরণ
দীন শ্যামসুন্দর কয় অন্তিমকালে গো
মাগো, পাই যেন যুগল চরণ॥
২
একবার দাঁড়াও গো মা হৃদকমলাসনে
ভুবনমোহন রূপটি গো মা হেরিব দুই নয়নে॥
তুমি অন্নপূর্ণা মা, তুমি শ্মশানের শ্যামা
কৈলাশের উমা তুমি, বৈকুণ্ঠের মা
মাগো আধ রাধা আধ কৃষ্ণ সাজিলেন বৃন্দাবনে॥
তুমি পুরুষ কি নারী, তত্ত্ব হয় বোঝা ভারী
তুমি না বুঝালে তত্ত্ব বুঝতে না পারি
মাগো মা বলিয়া ডাকলে তোরে গো
মাগো কোলে নেও সন্তান বলে॥
৩
আজি আনন্দের আর নাই সীমা
গিরিপুরে আসলো রে উমা॥
কেহ বাজায় খোল-করতাল
কেহ বাজায় দামামা
কেহ বলে কালী কালী
কেহ বলে শ্যামা মা॥
৪
আমি ডাকি গো মা তারিণী
পার করো গো বিপদনাশিনী॥
আমি ঘোর বিপদে পড়ে ডাকি
দাও গো চরণ দু-খানি॥
তুমি ভক্ত বাঞ্ছা
পূরণ করো দেখা দিয়া আপনি॥
আমি বিনয় করে তোমায় ডাকি
সাধন-ভজন না জানি॥
৫
মাগো সাধন-ভজন জানি না
কাঙাল জেনে করো করুণা॥
মাগো দয়াময়ী নামটি তোমার গো
মাগো জগতে আছে জানা॥
মাগো শ্রীচরণ তারিণী দিয়া গো
মাগো পুরাও মনের বাসনা॥
দীন শ্যামসুন্দর কয় অন্তিম কালে গো
মাগো তোমায় যেন ভুলি না॥
৬
মাকে পূজিব শতদলে
এসো গো মা হৃদয় কমলে॥
মাগো লক্ষে লক্ষে দিব জবা
তারিণী মায়ের চরণে॥
মাগো মায়ের পদে না দিই জবা
জনম গেল বিফলে॥
৭
পড়েছি মা অকূলে
কাঙাল জেনে নেও কোলে তুলে॥
ভবসাগরে পড়ে ডাকি গো
মাগো ডাকি মা মা মা বলে॥
মাগো মনে বড়ো আশা আছে
পূজিব শতদলে॥
দীন শ্যামসুন্দর কয় অন্তিমকালে গো
মাগো স্থান দিও চরণতলে॥
৮
আমার মায়ার বন্ধন কেটে দেখা মহামায়া
ভজব মনানন্দে প্রেমানন্দে গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া॥
ভজব তিল-তুলসী-জলে, নদীয়া যুগলে
জাহ্নবীর কূলে যাইয়া॥
অধিক মায়ায় হয়ে মত্ত, ভুলেছি মা গৌরতত্ত্ব
নাম-মাহাত্ম্য শুনতে চিত্ত যায় রহিয়া॥
জানে সাধুভক্তগণে, শ্রীগুরু বৃন্দাবনে
কৃষ্ণ পাইল গোপিকারা॥
আমার নাইকো সাধনভক্তি, কিসে পাব মুক্তি
সেই মুক্তি দে মা ভবতারা, গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া বলে
নদীয়া যুগলে ভাসল আমার নয়নতারা॥
৯
হইল উমা মায়ের আগমন
কি আনন্দ গিরিরাজ ভুবন॥
মায়ের মাথে শোভে মুকুট বাহার
মায়ের গলে শোভে মণিমুক্তা হার॥
মাগো ভুবনমোহন রূপটি
মায়ের সিংহপৃষ্ঠে আরোহন॥
আগমনি গানের বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে আমার সম্পাদিত গানের ছোটোকাগজ ‘দইয়ল’-এ সঞ্জীব দেবলস্কর এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, “কৈলাশ থেকে হিমালয়ে বাপের বাড়িতে মাত্র তিনদিনের জন্য উমার আগমন এবং দশমী দিনে ফিরে যাওয়া — এই সময়সীমায় মা-বাবার মনের কত বিচিত্র অনুভূতি, গিরিপুরে নরনারীর বিচ্ছেদবেদনার কাতরতা, ঘরের মেয়েকে ফিরে পাওয়ার উচ্ছ্বাস, শ্বশুরবাড়িতে হিমালয়দুহিতার দুঃখ-সন্তাপ, ভোলানাথ স্বামীর প্রতি তাঁর অনুরাগ, শ্বশুর-জামাই, শাশুড়ি-জামাই, বাবা-কন্যা, মাতা-কন্যা সম্পর্কের টানাপড়েন, নানা ঘটনার মোড়কে, নানা ছলনায়, প্রতীকী আভাসে, ইশারায়-ইঙ্গিতে, ব্যঞ্জনায় এসব অভিব্যক্তির প্রকাশ — আগমনি গানের এই হলো মূল কথা।” সঞ্জীব দেবলস্করের লেখার সূত্র ধরে আগমনি গানের যে বিষয়বস্তুর সন্ধান আমরা পাই, তা কিন্তু আবার আমার শ্বশুরের সংগৃহীত উপর্যুক্ত ৯টি গান থেকে যথাযথ রশদ পাওয়া যায় না। এ প্রসঙ্গে আমার শ্বশুরের বক্তব্য ছিল, আগমনি গানের বিষয়বস্তু নানা ধরনের ছিল। সব পর্যায়ের গান তাঁর সংগ্রহে নেই। তবে গানের আসরের সব শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণের সময় কিন্তু সকল পর্যায়ের গানই পরিবেশিত হতো। এক্ষেত্রে একেক শিল্পী একেক ধরনের গান পরিবেশন করতেন।
ক্ষিতীশ চন্দ্র দেবনাথ আরও বলেন, “এখন আগমনি গানের ধারাটা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। একসময় এমন ধারার ব্যাপক প্রচলন থাকলেও এখন আর খুব-একটা এই রীতির প্রচলন নেই। গ্রামীণ পুরনো মানুষেরা যারা এখনও জীবিত রয়েছেন, তারা নানা পূজামণ্ডপে এক-আধটু এই আগমনি গান গাওয়ার চেষ্টা করে থাকেন। যদিও ক্রমশ এমন গান পরিবেশনের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে আসছে।” প্রায় একই কথা জানালেন সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী প্রবীণ লোকসংগীতশিল্পী সুষমা দাশ। তিরানব্বই বছর বয়সি সুষমা বলেন, “একটা সময় হাওরাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে দুর্গাপূজামণ্ডপের সামনে গানের আসর বসত। আমরা ছোটবেলায় এমন আসর অনেক দেখেছি। সেখানে কীর্তনীয়ারা আগমনি গান গাইতেন, আমরাও টুকটাক এসব গান গেয়েছি। তবে এখন আর শিল্পী কিংবা কীর্তনীয়াদের সেভাবে আগমনি গান গাইতে দেখা যায় না। বলা যায়, এ ধারাটা এখন বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে।” সুষমা দাশ ক্ষিতীশ চন্দ্র নাথের এমন আশঙ্কার বিষয়টি বাংলাপিডিয়ায় আগমনি গান নিয়ে মুদ্রিত ভুক্তিতেও পাওয়া যায়। এটি লিখেছেন দুলাল ভৌমিক। সেখানে বলা হয়েছে —
আগমনী-বিজয়া শিব-পার্বতী (উমা/দুর্গা)-র কাহিনী অবলম্বনে রচিত এক প্রকার জনপ্রিয় বাংলা গান। এর সঙ্গে শারদীয় দুর্গাপূজার একটা সম্পর্ক আছে। ধনাঢ্য পিতা গিরিরাজ হিমালয়ের কন্যা পার্বতীর বিবাহ হয় দরিদ্র শিবঠাকুরের সঙ্গে। বিবাহের পর কন্যা স্বামীর ঘরে চলে গেলে সেখানে মেয়ের দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের কথা চিন্তা করে মা মেনকার মাতৃহৃদয় আকুল হয়ে ওঠে। শারদীয় কোনো এক রাতে মা-মেয়ে উভয় উভয়কে স্বপ্নে দেখেন। মেনকা স্বামীকে অনুরোধ করেন উমাকে নিজগৃহে নিয়ে আসার জন্য। পিতা-মাতার অনুরোধে উমা মাত্র তিনদিনের জন্য পিতৃগৃহে আগমন করেন। তাঁর এ আগমনকে কেন্দ্র করে রচিত গানই আগমনী গান। পিতৃগৃহে তিনদিন অবস্থানের পর উমা যখন পুনরায় পতিগৃহে ফিরে যান, তখন যে বিষাদের সুর বেজে ওঠে তাকে কেন্দ্র করে রচিত গানগুলিই বিজয়া গান নামে পরিচিত। এ দু প্রকার গানকে একত্রে বলা হয় আগমনী-বিজয়া গান। এ গানের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কবি রামপ্রসাদ সেন (আনু. ১৭২০-১৭৮১)। পরে আরো যাঁরা এ গান রচনায় খ্যাতি অর্জন করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য (আনু. ১৭৭২-১৮২১), রামবসু (১৭৮৬-১৮২৮) ও দাশরথি রায় (১৮০৬-১৮৫৭)।
আগমনী-বিজয়া গানের অনুপ্রেরণা এসেছে বৈষ্ণব গীতিকবিতা থেকে। উভয়েরই মূল রস মধুর, তবে আগমনী-বিজয়া গানে করুণ রসেরও অভিব্যক্তি ঘটে। তাছাড়া বৈষ্ণব কবিতায় থাকে ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রাধান্য, আর আগমনী-বিজয়া গানে থাকে সার্বজনীনতার সুর। মঙ্গলকাব্যের রুদ্রচণ্ডী এ গানে একাধারে কন্যা ও মাতৃরূপে আত্মপ্রকাশ করেন। গানগুলিতে বাৎসল্য ও করুণরসের অপূর্ব সমাবেশ দেখা যায়। এ গানের বিষয়বস্তু বাঙালি হিন্দুর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের গার্হস্থ্য জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং বাস্তবতার এক নিখুঁত চিত্র পাওয়া যায় এসব গানে। বাঙালি পরিবারের কন্যা ও জামাতাগৃহের বিরোধের কথাও এতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
আগমনী-বিজয়া গানের মধ্য দিয়ে শাক্তপদাবলির সংসারমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বাঙালি হিন্দু মেয়েদের যখন বাল্যবিবাহ হতো তখন মা মেনকার মতো বাঙালি মায়েরাও স্বামীগৃহে মেয়ের সুখ-দুঃখের কথা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন হতেন। তাঁরাও আকুলভাবে মেয়েকে কাছে পেতে চাইতেন, আর মেয়েরাও উমার মতো পিতৃগৃহে আসার জন্য সারাবছর অপেক্ষায় থাকত এবং সে-সুযোগটি ঘটত সাধারণত শারদীয় দুর্গাপূজার সময়। এ সময় মেয়েকে কাছে পেয়ে মা স্বস্তি বোধ করতেন, আনন্দিত হতেন, আবার বিদায়ের সময় মেনকার মতোই দুঃখে কাতর হতেন। সমাজের এ প্রেক্ষাপটে আগমনী-বিজয়া গান বাঙালি জীবনে এক অস্থায়ী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
কিন্তু বাংলা গানের এ ধারা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, কারণ জগজ্জননীরূপে চণ্ডীর যে ব্যাপকতা, তাকে তাঁর কন্যারূপ স্বল্পপরিসরে বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। মাতাকে কন্যারূপে কল্পনা করে ভক্তদের মধ্যে ভক্তিসাধনার পরিবর্তে স্নেহবাৎসল্যের এক প্রবল তরঙ্গ দেখা দিয়েছিল, কিন্তু সে-তরঙ্গ আবার অল্পতেই স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, সম্ভবত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে। তাই এ গানের ধারা আর বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি। তবে বাঙালি হিন্দুরা এখনও শারদীয় দুর্গাপূজার সময় উমা-শিবকে নিজেদের মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে অভেদ জ্ঞান করে আনন্দ-বেদনা অনুভব করে।
চার
আশির দশকে অর্থাৎ আমাদের ছোটোবেলায় আগমনি গানের প্রচলন আমাদের চোখে পড়েনি। তবে দুর্গাপূজাকে ঘিরে দুর্গার বন্দনাকেন্দ্রিক ভক্তিমূলক গান পরিবেশিত হতে আমরা দেখেছি। যদিও বোধ করি, সেসব গানের মধ্যে এক-দুটি আগমনি পর্যায়ের গানও থাকত। পরে, আরও পরে, যখন চলতি শতাব্দের ঠিক পূর্বমুহূর্তে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য সিলেটে বসতি গাঁড়ি, তখন দুর্গাপূজা চলাকালে কিছু গান শিল্পীদের দ্বারা পরিবেশিত হতে দেখি। এসব গানও কিন্তু আগমনি গান নয়। এসব গানের বিষয়বস্তুও ছিল দুর্গার বন্দনা। ‘আগমনি গান’ বলে পৃথক কোনও গানের ধারা শহর সিলেটে সেভাবে চোখে পড়েনি। তবে আমাদের দেখার আগে, শহর সিলেটে আগমনি গানের ধারার কোনও প্রচলন ছিল কি না, তা জানতে চাই লোকসংগীতশিল্পী দুলাল ভৌমিকের কাছে। শহর সিলেটে জন্মগ্রহণকারী দুলাল সত্তরের দশকে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী হয়েছেন। দুলাল বলেন, “শহরে সেভাবে শিল্পীদের আগমনি গান গাইতে আমরা দেখিনি। আমি নিজেও এমন ধারার কোনও গান গাইনি। তবে আমাদের জন্মের আগে কিংবা আমি দেশ ছাড়ার পর এমন গানের ধারার প্রচলন শহরে ছিল/আছে কি না, তা আমার জানা নেই।”
দুলাল ভৌমিকের কথার সূত্র ধরে সিলেটের প্রবীণ সংগীতশিল্পী হিমাংশু বিশ্বাসের দ্বারস্থ হই। তিনি শহর সিলেটে জন্মাষ্টমী, মহালয়া ও দুর্গাপূজা উপলক্ষে আয়োজিত গানের আসরে গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। তাঁর কাছে আগমনি গানের বিষয়ে জানতে চাই। তেয়াত্তর বছর বয়সি হিমাংশু বলেন, “১৯৭২ সালের দিকে বিদিত লাল দাসের নেতৃত্বে সিলেটকেন্দ্রিক একটি লোকগানের দল গঠিত হয়। সত্তরের দশক থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ওই দলের মাধ্যমে সিলেট নগরের মির্জাজাঙ্গাল এলাকার নিম্বার্ক আশ্রমে আমরা দুর্গাপূজার সময় গান গাইতাম। এ সময় বেশকিছু আগমনি গানও আমরা গাইতাম। তবে হাওরাঞ্চলে আগমনি গানের ব্যাপক প্রচলন থাকলেও শহর সিলেটে এ ধারার গানের প্রচলন ছিল না বললেই চলে।” প্রায় একই তথ্য জানান পঞ্চান্ন বছর বয়সী সংগীতশিল্পী বিজন রায়। তিনি বলেন, “সেভাবে আগমনি গান আমরাও কখনও গাইনি। তবে দুর্গাপূজা চলাকালে বিভিন্ন মণ্ডপে ভক্তিমূলক বিভিন্ন গান আমরা পরিবেশন করে থাকি। এসব গানের ফাঁকে বিশেষ করে দুটি আগমনি গান আমরা প্রায় প্রত্যেক শিল্পীই কমবেশি গেয়ে থাকি। এ দুটি গান হচ্ছে : বাজল তোমার আলোর বেণু ও আজ শরতের আলোর বাঁশি বাজল।”
আগমনি গান প্রসঙ্গে সিলেটের প্রবীণ তিনজন শিল্পীর অভিজ্ঞতার বিপরীতে আরেকটি চিত্রও অবশ্য পাওয়া যায়। সেটি হলো এই প্রজন্মের শিল্পী অনতিতরুণী তন্বী দেবের উত্থাপিত একটি সূত্র। তন্বী জানালেন, সিলেটের প্রয়াত নাট্যকার বিদ্যুৎ কর (১৯৫১-২০১১) সম্ভবত ২০০৬ সালের দিকে একটি আগমনি গান রচনা করেছিলেন। এ-গানটির সুর দিয়েছিলেন সজল দত্ত। যেটি বর্তমানে অনেকেই দুর্গাপূজার সময় গানের আসরে গেয়ে থাকেন। তন্বীও নিয়মিত এ-গানটি পরিবেশন করেন বলে জানালেন। সিলেটের নানা ধরনের লোকগান তাঁর জানা থাকলেও আগমনি পর্যায়ের গান এর বাইরে তাঁর আর জানা নেই। তন্বী সরবরাহ করা বিদ্যুৎ কর রচিত গানটি এ-রকম —
জাগো দুর্গা জাগো চণ্ডী
মহামায়া ভুবনমোহিনী
জাগো দুঃখ-ত্রাসেরও নাশে
দুর্গা দুর্গতিনাশিনী॥
জাগো দয়াময়ী জাগো মহামায়া
জগতের কল্যাণে দানো কৃপাছায়া
জাগো নারায়ণী ভুবন মোহিনী
জাগো মাগো জগজ্জননী॥
জাগো মহাদেবী, জাগো দশভূজা
কায়োমনে প্রতিক্ষণে করি যেন পূজা
জাগো ত্রিনয়নী ভবের ভবাণী
জাগো মহিষাসুরমর্দিনী॥
পাঁচ
বাংলাপিডিয়ায় আগমনি গানের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে যেমনটা উল্লেখ করা হয়েছে, “[…] বাংলা গানের এ ধারা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, কারণ জগজ্জননীরূপে চণ্ডীর যে ব্যাপকতা, তাকে তাঁর কন্যারূপ স্বল্পপরিসরে বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। মাতাকে কন্যারূপে কল্পনা করে ভক্তদের মধ্যে ভক্তিসাধনার পরিবর্তে স্নেহবাৎসল্যের এক প্রবল তরঙ্গ দেখা দিয়েছিল, কিন্তু সে-তরঙ্গ আবার অল্পতেই স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, সম্ভবত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে। তাই এ গানের ধারা আর বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি।” — অনেকটাই তাই। একে তো ‘সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন’, অন্যদিকে ‘মাতাকে কন্যারূপে কল্পনা’করা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একটু কঠিনই হয়ে উঠেছিল বটে। তাই এই দুই কারণের মাঝখানে পিষ্ট হয়ে লোকসংগীতের একটি সমৃদ্ধ ধারা হওয়া সত্ত্বেও আগমনি গানের ধারাটি মোটামুটি বিলুপ্তির কাতারেই চলে গিয়েছে। তন্বী দেবদের মতো হাল-আমলের মুষ্টিমেয় কয়েকজন শিল্পীর কণ্ঠে মাঝেমধ্যে এমন গান এক-দুটি গীত হলেও সেটি যে কেবল পরম্পরা রক্ষার এক ক্ষীণ প্রচেষ্টা, সেটা নিশ্চয়ই স্বীকার করতে কারও দ্বিধা থাকার কথা নয়। ভবিষ্যতে এ ধারার গান শিল্পীদের মাধ্যমে খুব যে বিস্তৃতি ঘটবে, সে-আশা করারও কোনও কারণ সম্ভবত নেই। তবে লোকসংগীতের সমৃদ্ধ এ ধারার যেসব গান এখনও বয়স্কদের মুখে গীত হয়ে আসছে, সেসব সংরক্ষণ করতে না-পারলে বোধহয় একসময় আগমনি গানের বর্ণিল ঐতিহ্যের বিষয়টিই ভাবী প্রজন্মের কাছে অচেনা ও ধূসর হয়ে থাকবে। এর বাইরে অন্তত ঐতিহ্যিক বিবেচনায় হলেও এসব গান সংগৃহীত ও সংরক্ষিত হওয়া প্রয়োজন।
… …
- রবীন্দ্রনাথের দুটি গান : ব্যক্তিগত পাঠ || সুমনকুমার দাশ - May 8, 2020
- লোককবি গিয়াস : কয়েকটি স্মৃতিটুকরো || সুমনকুমার দাশ - January 23, 2020
- কোকা পণ্ডিত ও তাঁর ‘বৃহৎ ইন্দ্রজাল’ || সুমনকুমার দাশ - January 8, 2020
COMMENTS