বনগোলাপ || কল্লোল তালুকদার

বনগোলাপ || কল্লোল তালুকদার

প্রায় এক দশক বনগোলাপের খোঁজে বিভিন্ন হাওরে ঘুরে বেড়িয়েছি। এখন মোটামুটি জানি সুনামগঞ্জের কোন কোন হাওরে তাকে পাওয়া যায়। তবে মজার ব্যাপার হলো, এত বছর ধরে চেষ্টা করেও পুষ্পিত অবস্থায় তার দেখা পাইনি। হয় একেবারে প্রাথমিক কলি দেখেছি, অথবা ফুল ফোটে ঝরে গেছে — এমন অবস্থায় তাকে পেয়েছি। বাসায় এনে রোপণ করে ফুল দেখারও চেষ্টা করেছি, কিন্তু তাকে বাঁচাতে পারিনি। আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম, প্রস্ফুটিত অবস্থায় আর বুঝি তাকে দেখা হলো না। কিন্তু এবার গ্রামের বাড়ি থেকে ফেরার পথে রাস্তার পাশে অপ্রত্যাশিতভাবে তার দেখা পেলাম। একটি নয়, বেশ বড় বড় দুটি ঝাড়। তার মধ্যে একটি পূর্ণ কুসুমিত। তাছাড়া গাছভর্তি কলিও আছে। আদি গোলাপের অপরূপ রূপমাধুরী দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল…

‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তেয়াগিলে আসে হাতে…’

বনগোলাপ নিয়ে অনেক আগেই লিখেছি। কিন্তু তখন ফুলের ছবি দিয়েছিলাম নেট থেকে সংগ্রহ করে। কিন্তু আজকের লেখার সঙ্গে যুক্ত ছবিগুলো নিজহাতে তোলা। উল্লেখ্য, ছবিগুলো গোধূলিলগ্নে তোলা। তখন অনেক পাপড়ি ঝরে পড়েছে। সকালবেলার ফুল আরও উজ্জ্বল, আরও তরতাজা হবে নিশ্চয়ই।

“ঘাতক তুমি বাদ সেধো না, এবার
আমি গোলাপ নেবো।”

গ্রিক পুরাণে কথিত আছে, প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী আফ্রোদিতি আবির্ভূত হন সমুদ্রের শ্বেত-শুভ্র ফেনা হতে (Aphrodite; Aphros অর্থ fome বা ফেনা); তখন তার সঙ্গে একটি ফুলও জন্মগ্রহণ করে — সেটি গোলাপ। এজন্য গোলাপ ফুলটি এই দেবীর নামে উৎসর্গীকৃত। আফ্রোদিতির প্রেমিক অ্যাডোনিস (Adonis) একদিন বন্য শুকর কর্তৃক মারাত্মকভাবে জখম হন। তাকে বাঁচানোর জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়ে আসেন দেবী। কিন্তু পথে তাঁর পা গোলাপের কাঁটায় রক্তাক্ত হয়। তবু শেষরক্ষা হয়নি। অ্যাডোনিস মারা যান। আফ্রোদিতির পায়ের রক্ত আর চোখের জলে গোলাপ হয়ে গেল লাল। সেই থেকে লালগোলাপ প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে লাভ করে বিশেষ এক স্থান।

গোলাপের মনোহর রূপমাধুরী যুগ যুগ ধরে মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এই ফুলটি তাই বিভিন্ন পৌরাণিক উপকথায়, শিল্পসাহিত্যে দখল করে আছে এক বিশিষ্ট স্থান। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রথমদিকে গ্রিসের লেসবস-বাসিনী গীতিকবি সাফোর (খ্রিপূ. ৬১০-৫৭০) বাণীবন্দনাতেই গোলাপ পুষ্পকুলের রানিরূপে প্রথম অধিষ্ঠিত হয় (দ্র. আবদুশ শাকুর, আদি গোলাপ ও তার আদি কবি, কালি ও কলম)।

কেবল শিল্পসাহিত্যে নয়, রাজনীতিতেও গোলাপের রয়েছে সরব উপস্থিতি। ইংল্যান্ডে ১৪৫৫-১৪৮৭ খ্রি. পর্যন্ত সংঘটিত হয়েছিল এক যুদ্ধ, যা Wars of the Roses (গোলাপ যুদ্ধ) নামে পরিচিত। ডিউক অব ল্যানকাস্টার (Lancaster) এবং ডিউক অব ইয়র্ক (York) — এই দুই ভাইয়ের মধ্যে সিংহাসন দখলকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই যুদ্ধ। অবশেষে ল্যানকাস্টারের লাল গোলাপকে হারিয়ে ইয়র্কের সাদা গোলাপ জয়ী হয়। বর্তমানে ইরান ও ইংল্যান্ডের জাতীয় প্রতীক গোলাপ।

ফারসি ‘গুলাও’ থেকেই ‘গোলাপ’ শব্দটি সৃষ্ট। হিন্দিতে ও ইউনানিরা বলেন ‘গুলাব’।

গোলাপের জন্মবৃত্তান্ত সঠিকভাবে জানা না গেলেও আধুনিক ধারণা অনুযায়ী ইরাক ও তুরস্ক হলো আদি গোলাপের মাতৃভূমি (Centre of Origin)। পণ্ডিতদের মতে, প্রাচীন গীতিকবি সাফো (Sappho) কিংবা ওমর খৈয়াম যে-গোলাপ দেখে বিমোহিত হয়েছিলেন সেটি বর্তমান সময়ের জটিল সৌন্দর্যের গোলাপ নয়। বরং তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন পাঁচ পাপড়িবিশিষ্ট সহজ-সুন্দর আদিম গোলাপ দেখে।

পাপড়ির সংখ্যা পাঁচের বেশি হলে বুঝতে হবে, এটি বিশুদ্ধ বন্য নয়, বরং সংকর গোলাপ । প্রায় এক হাজার বছর পূর্বে চিনারা সর্বপ্রথম বন্য গোলাপ থেকে সংকরায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবন করেন কৃত্রিম বা ব্রিড গোলাপ। এরপর সূচনা হয় এক পুষ্পবিপ্লবের। সংকর গোলাপ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে সারাপৃথিবীতে। সৃষ্টি হতে থাকে একের-পর-এক মনমাতানো সংকর জাত। অপরদিকে অবহেলার শিকার হয়ে আদিম প্রজাতি হারাতে থাকে তার রাজত্ব। বর্তমানে বন্যজাতের সংখ্যা শ-খানেক, অথচ ব্রিড অর্থাৎ কাল্টিভার গোলাপ আছে তিন হাজারেরও অধিক।

সারাপৃথিবীতে গোলাপের কদর থাকলেও পুরোহিত ব্রাহ্মণরা এই ফুল অর্ঘ্য অর্থাৎ পূজার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে একেবারেই নারাজ। ভিনদেশি ফুল বলেই তারা নাকি এই ফুলে অর্ঘ্য দিতে নিষেধ করেন। তবে অনেকেই মনে করেন, গোলাপ পুরোপুরি ভিনদেশি নয়। গোলাপের কয়েকটি বুনো প্রজাতির আদি নিবাস ভারতবর্ষে। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের মতে, বুনো শতপত্রীই হলো গোলাপ, যার অপভ্রংশ নাম ‘শেউতি’। আবার শতপত্রীর রাশনাম অর্থাৎ জন্মরাশি অনুসারে নাম ‘সুমন’।

ইলিয়াড এবং ওডিসি — দুটি মহাকাব্যেই গোলাপের উল্লেখ রয়েছে, তেমনি প্রাচীন বৈদিক পুরাণেও এই ফুলের উল্লেখ আছে। মহাভারতের বনপর্বে নলবনের মধ্যে তাঁর স্ত্রী দময়ন্তীকে হারিয়ে বিলাপ করে বলেন, — “ইমামসিত কেশান্তাং শতপত্রী নিভাননাম্” … অর্থাৎ, সেই ঘন কালো চুলের মাথা আর ফোটা শতপত্রীর মতো মুখ। এখানে নল তার প্রেয়সীর মুখের তুলনা করছেন শতপত্রীর অর্থাৎ গোলাপের সঙ্গে। এছাড়া ভীষ্ম যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন যুধিষ্ঠিরের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “দ্যাখো, দেবতাদের প্রীতি হয় অমৃত লাভে। সেই অমৃতের বহু প্রকারভেদ। তবে মর্ত্যলোকের অমৃত সর্বাধিক সুগন্ধি কুসুম; আবার সেই সুগন্ধি কুসুমের মধ্যে গন্ধে মন প্রসন্ন করে এবং অপূর্ব রূপ ফোটায়, সেই সুমনই শ্রেষ্ঠ”।(চিরঞ্জীব বনৌষধি, আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য, ৪র্থ খণ্ড, আনন্দ পা. প্রা. লি., পৃ. ১৯৭)।

সুগন্ধির জন্য জগদ্বিখ্যাত এই ফুলের খুশবু নির্ভর করে মাটি, জলবায়ু, জলের গুণাগুণ ইত্যাদির উপর। সাধারণত এটি মরুজ ও পার্বত্য। তবে আদি গোলাপের একটি প্রজাতি বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে এক-সময় প্রচুর পরিমাণে জন্মাত। কিন্তু বর্তমানে কেবল হাওর অঞ্চলে এটি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর, মাটিয়ান হাওর, দেখার হাওর, পাগনার হাওর সহ বেশ কয়েকটি হাওরে এর বিক্ষিপ্ত উপস্থিতি এখনও চোখে পড়ে। হাওরের কান্দা, বিল, জলাভূমির কিনারা প্রভৃতি স্থানে এটি প্রাকৃতিকভাবে জন্মে।

Rosaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত Rosa গণের এ বনগোলাপটির উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Rosa clinophylla, সমনাম Rosa involucrata. ইংরেজি নাম Wild rose of Bengal. হাওরবাসীর কাছে এই জংলি গোলাপ ‘গুঁজার কাঁটা’ নামে পরিচিত। এটি দ্বিবীজপত্রী, কণ্টকযুক্ত, খাড়া, বলিষ্ঠ ঝোপালো, গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। প্রায় ২.৫–৩.০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়। পত্রক ৭–৯ টি, ক্ষুদ্র বৃন্তযুক্ত, আয়তাকার থেকে উপবৃত্তাকার-বল্লমাকার, কিনারা করাতের মতো সূক্ষ্ম খাঁজকাটা, মধ্যশিরা নিম্নভাগে রোমশ, উপপত্র ছোট, ঝালরসদৃশ, সাধারণত পত্র বৃন্তলগ্ন। পুষ্পবিন্যাস খাটো করিম্ব বা একল, কদাচিৎ কাক্ষিক এবং লম্বা। পুষ্প সবৃন্তক, পুষ্পবৃন্ত ছোট, মঞ্জরীপত্রের বাহিরের রেখা বল্লমাকার, ঘনভাবে ক্ষুদ্র কোমল রোমাবৃত। বৃতি নল গোলাকার বা ডিম্বাকার, বহির্ভাগ বাদামি বা ধূসর মখমলসদৃশ, ভিতরে রোমশ। পাপড়ি প্রশস্তভাবে বিডিম্বাকার, শীর্ষ খাঁজযুক্ত, মসৃণ। ফুলে পাঁচটি পাপড়ি এক আবর্তে সজ্জিত। ফুল মনোমুগ্ধকর, মিষ্টি সুবাসযুক্ত, বর্ণ সাদা, কিন্তু পরাগধানী হলুদ। পুংকেশর অসংখ্য। গর্ভদণ্ড মুক্ত, গর্ভমুণ্ড চাকতিসদৃশ রোমশ, বহির্মুখী। ফল গোলাকার, ঘনভাবে সূক্ষ্ম কোমল রোমাবৃত। ফুল ও ফল ধারণকাল ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই। কেবল বীজের সাহায্যে বংশবিস্তার ঘটে।

আবহমানকাল থেকেই গোলাপের বহুবিধ ব্যবহার লক্ষ করার মতো। অনাবিল সৌন্দর্যের কথা ছেড়ে দিলেও এর রয়েছে নানান ভেষজ গুণাগুণ। বৈদ্যবৃন্দ এর গুণ বর্ণনা করে বলেন — এটি রসে তিক্ত, ধারক, বলকারক, হৃদযন্ত্রের হিতকর, মৃদুবিরেচক, পিত্ত-প্রশমক ও মেদোজনক। ঔষধরূপে ব্যবহৃত অংশ ফুল। ফুল মাথার যন্ত্রণায়, চক্ষুরোগে ও অতিরিক্ত ঘর্ম নিঃসরণে হিতকর। এছাড়া অরুচি রোগে, পিত্ত বমনে, কুষ্ঠের প্রথমাবস্থায়, বাতরক্তে এবং অপুষ্টিতে গোলাপের ব্যবহার আছে। গোলাপের নির্যাস থেকে তৈরি হয় সুগন্ধি। গোলাপজল তৈরি কিংবা সুঘ্রাণের জন্য খাদ্যদ্রব্যে এ-ফুলের নির্যাস বহুল ব্যবহৃত। জংলি গোলাপ সাধারণত জোড়কলমে উন্নত গোলাপের ঝাড় তৈরিতে মূলভিত্তি (Stock) হিসেবে ব্যবহৃত।

বর্তমানে গুঁজার কাঁটা সংকটাপন্ন একটি প্রজাতি। সংকটের প্রধান কারণ আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া। তাছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফুল ও ফল ধারণের পূর্বেই গাছের কণ্টকিত শাখা-প্রশাখা ক্ষেতের বেড়া নির্মাণ, জ্বালানি ইত্যাদি নানা কারণে নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়। ফলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় তার জীবনচক্র। বিরল হতে হতে অচিরেই হয়তো এটি চিরতরে প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

কৃষির জন্মলগ্ন থেকেই মানুষ সংকরায়ন ও নির্বাচনের মাধ্যমে বন্যজাত থেকে কাঙ্ক্ষিত চাষযোগ্য জাত সৃষ্টি করেছে। Domestication প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট এ-সমস্ত কাল্টিভার উচ্চ ফলনশীল হলেও মানুষের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া তারা সফলভাবে জীবনচক্র সম্পন্ন করতে পারে না। কিন্তু এদের বন্যজাতগুলো তুলনামূলকভাবে অধিক জীবনীশক্তি ও অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন। অনাদরে-অবহেলায় শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এরা টিকে থাকতে পারে। কাল্টিভার জাতগুলোর জেনেটিক রিসোর্স তাদের জংলিজাতে সংরক্ষিত থাকে। এজন্য বন্যজাতগুলো যদি প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে তার সঙ্গে হারিয়ে যেতে পারে মূল্যবান জিন-সম্পদ। এই ক্ষতি হতে পারে অপূরণীয়। তাই বনগোলাপ অর্থাৎ গুঁজার কাঁটার মতো বিপন্ন প্রজাতিসমূহ সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ নেয়া অতীব জরুরি।


স্থিরচিত্রগুলা লেখকের ক্যামেরায় ক্যাপ্চার্ড। ব্যানারে ব্যবহৃত ওয়াইল্ড রৌজের ছবিটি গ্যুগল-ইমেইজ থেকে নেয়া।

… …

কল্লোল তালুকদার

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you