রূপকের বাড়ি গিয়েছিলাম অনেকদিন পর, সন্ধের দিকে, ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। ২০০৬ অক্টোবরের আকস্মিক সেই মৃত্যুশীতরাত্রির পর রূপকদের বাড়ি বছরের এ-মাথা ও-মাথা যাওয়া হয়-কি-হয়-না এতটাই নিষ্পলক দ্রুততার সঙ্গে কেটে যেতেছে জীবন প্রায় নিস্তরঙ্গ। অথচ ঊর্মিমুখর, তরঙ্গধৌত, অথচ সফেন সমুদ্র যেন। যদিও একসময়, এই আট বছর আগে একটানা আট বছরের যে-কোনো একদিন, এমন কোনো হপ্তা নাই রূপকের বাড়িতে যাওয়া ভাটা পড়েছে। শীতকালে এক-দুইদিন বাদ দিয়ে হপ্তার প্রায় প্রত্যেকদিন বিকেলবেলা বাইসাইকেলে হনহনিয়ে এক-চক্কর ঘুরান দিয়া আসাটা ছিল রোজকার বৈকালিক রুটিনের মতো। বসে থাকতাম ওদের বাড়ির পশ্চিমমুখো পেছনদিককার খড়-ছড়ানো হোৎকা-বিরাট ধান-কেটে-নেয়া মাঠের লাউ-মূলা-রাইশর্ষে-টোম্যাটোপ্রবাহিত গোল দিগন্তস্পর্শা আকাশ-আচ্ছাদনের তলে। চুপচাপ মোটেও নয় এখনকার মতো, দুনিয়ার কথা আমাদের পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে গোটা ধানশূন্য রবিশস্যের ক্ষেতজাঙ্গাল আন্ধাইর করে তুলত, দুনিয়ায় রাত নামত আমাদেরই কথায় কথায়। সেই-সময় এহেন কোনো বাংলা-ইংরেজি-হিন্দি-উর্দু গানের জন্ম হতো না আমাদের কান ফাঁকি দিয়ে। রূপক এক্ষেত্রে ছিল অতিশয় উদ্যমী ও কার্যকর। অর্থসংস্থান ছাড়াই সে তখন ক্যাসেট সংগ্রহ করে নিত কোনো-এক ভোজবাজি ম্যাজিকে। ক্যাসেটদোকানগুলোর সঙ্গে রূপক খাতির জমিয়ে ফেলতে পারত দ্রুত। ফলে গান শোনার জন্য রূপকের কাছে রেগ্যুলার লিস্টি ধরিয়ে পরে কেবল সংগ্রহণের নিমিত্তে একটু ঘনঘন তাগাদা দিতে হতো। মনে পড়ছিল এই-সমস্ত সাত-সতেরো।
তখনও সন্ধে এসে নামেনি পৃথিবীতে, আলো তখনো রয়েছে শেষ-বিকেলের, শীতের দিন বলে আলো কতকটা যেন ছাইরঙা আলোয়ানের মতো। মনখারাপের মতো মন্থর, মন্দ্র ও মদালস, মমতাছায়াময়। এই এত কথা বলছি একটা নিষ্ঠুর বিশেষণ এড়াবার অভিপ্রায় থেকে, এটা বাস্তবতা আড়াল করার বদ প্রবণতা বলে বসো না আবার যেন হুট করে, এ আসলে বাস্তবতা আরও ঘন চোখে দেখার একটা চেষ্টা। মানে, যেটা বলতে চাইছি, একটা আলো-নিষ্প্রভ সন্ধেবেলাকে অভ্যস্ততা থেকে আমরা বলে বসি মলিন, বলি ফ্যাকাশে সন্ধে, রঙ-মরা অপরাহ্ন। কথ্য অভ্যস্ততার এই এক হ্যাপা, তা তুমি যা-ই বলো, একটা-কিছু মন্তব্য না-করলে যেন চলে না আমাদের। তা ভালোই তো, ভালো না? হ্যাঁ, ভালো। হয়তো হয় কিংবা হতে পারে ফ্যাকাশে সন্ধে, সেটা আলফ্রেড প্রুফ্রকের দেশে, এই বাংলা মুলুকে সন্ধে কভু রঙ-দরিদ্র নয়। কেননা আমরা পদার্থপ্রাচুর্যে নয়, প্রেমে বাঁচি, ইতিহাস কহে যে এদেশের মানুষ ক্ষুধাপেটে তাল-মহুয়ার রসে ভেসে সংনাচ আর কীর্তনে মেতে ওঠে ভরসন্ধেবেলা। আমাদের সন্ধে মানেই মায়া, সাঁঝের মায়া, আজান-মধুর আধ্যাত্মিক বিষাদ আর উতল দূরের উদাস উলুধ্বনি। ছিল। বর্তমানে ক্যাকোফোনি।
জীবনানন্দ পাশ কাটিয়ে সন্ধে বর্ণনা কি সম্ভব আমাদের পক্ষে? তেমন রবীন্দ্রনাথ পাশ কাটিয়ে ভোর তথা প্রভাত বর্ণনা? সাধারণত সম্ভব নয়, জবরদস্তি করে সম্ভব। ঠিক যে-রকম জবরদস্তি আমি করে চলেছি এতক্ষণ ধরে। অথচ এ-ই তো সেই সন্ধে, যার বর্ণনা ‘পাড়াগাঁর গোধূলি-মদির মেয়েটির মতো’ বলেছেন জীবনানন্দ, যথাভাব অব্যর্থ বর্ণনা, আমরা যারা শহরের বাইরে থাকি তাদের কাছে এই বর্ণনা আজও অর্থদৃশ্যবহ। অথবা শরৎচন্দ্রের বর্ণনায় এই সন্ধের আলো অভিধা পায় কনেসুন্দর আলো বলে। এমন হুট করে একটা শাদামাটা বিশেষণ না-বসানোর জন্য শুধু অভিপ্রায় থাকলেই হয়, বাকিটা হাতের নাগালেই।
তুমি কিছু লিখছ মানেই হলো তুমি বাস্তবতাটাকে দেখতে চাইছ আরও ঘন, আরও নিবিড়, আরও সন্নিবদ্ধ নয়নে। সে-তুমি যা-ই লেখো, গল্প বা গান, প্রবন্ধ বা কবিতা, এমনকি চিঠি কিংবা মানবাধিকার বিষয়ক কেজো প্রতিবেদন। লক্ষ করে দেখবে, লোকে বলার সময় বলে ঠিকই যে বাস্তবতা হলো চোখের সামনে যা তা-ই, কিন্তু বর্ণনাকালে — তা লিখিত বা মৌখিক যে-কোনো মাধ্যমে — সেই বয়ানটাই করে যা সে পেয়েছে অন্য-লিখিত বা অন্য-মুখনিসৃত বর্ণনা আকারে হাজির। অর্থাৎ খপ্পর থেকে বেরোতে পারে না অভ্যস্ততার। লেখকদের মধ্যে এই সংকট আমি গভীর অভিনিবেশে খেয়াল করি সবসময়, যখনই কিছু পড়ি কিংবা যাদের সঙ্গে দেখাটেখা হয় কালেভদ্রে খেয়াল করে দেখেছি তাদের কথাবার্তায় রঙের লেপন, স্তরের-পর-স্তর রঙ চাপানো ও চড়ানো। সমস্ত না-হলেও অধিকাংশ অভ্যাসের বর্ণালেখ্য, মুখস্ত রঙের ব্যবহার। কাজেই শাক দিয়া মাছ ঢেকে একটু কৌলিন্য রক্ষার মহাচেষ্টা, মানে ট্যুইস্ট ইত্যাদি, ‘ক্বচিৎ কনককান্তি কমনীয় কায় / গালভরা দাড়ি তার তপস্বীর প্রায়’। সেইটাই। মানে তপসে মাছ। খুলনায় সাতক্ষীরায় যশোরের দিকটায় এখনও লভ্য। মজাদার।
রূপকের বাড়ির গল্প বলতে বসেছিলাম, বলা হয়নি এখনও, বলব পরের কোনো পত্রে। এখন গভীর শীতকাল, ঘরে ঘরে সুপর্ণা শিশির আর কল্পনার মুনিয়াপাখির কুটিরে তিরতিরানি কুয়াশা, কাজেই শীতকালে বেশিক্ষণ গল্প নয়। এক্ষণে গল্প বরঞ্চ অব্যাহত রইল। সেই ভালো সেই ভালো, ওগো, শীতসময়ের মধুকুয়াশার নৈশ নিঝুম আলো।
২
ফিরেছি শীতের সব্জি বাসায় বয়ে নিয়ে, আপিশের সব্জিখামার থেকে, বেলা তখন ঢলে পড়েছে খালনালাবিল পেরিয়ে সমুদ্রপৈথানে। সন্ধে হয়নি তখনো, যদিও, সন্ধিমুহূর্ত বোঝা যাচ্ছিল। মোটরবাইকের এই এক মজা আমি টের পাই যে, দুইপাশের ক্ষেতপালান ধান ধনেপাতা লাউডুগি মিষ্টিকুমড়া কাকরল টোম্যাটো ফুলকপি ফিঙে দোয়েল দৈকলি সব হুড়মুড়িয়ে এসে ঢুকবে তোমার ভেতরে, হুহু ঢুকতে থাকবে চারপাশ-চরাচর। চোখের ভেতরে একটা জিভ রয়েছে আমাদের, প্রত্যেকের সক্কলেরই, বিজ্ঞান-সমর্থিত-নয় সেই জিভ, বয়স যত বাড়তে থাকে, সেই জিভের বায়নাক্কা তত লকলকে লেলিহান হয়ে ওঠে। একটা হাল্কাপাৎলা পাতার তিরতিরানি দেখেও মনে হয়, আহা, কী হেরিলুম! বয়স হবার লক্ষণ সব। মনে হয়, থেকে থেকে কেবলই মনে হয়, এই রঙ এই রূপ এই বিভা এই বৈভব ভোগের ফুরসত যদি না-ই দিলে দয়াল, হরি হে কৃপাসিন্ধু, কেন ভরে দিয়েছ তবে বক্ষহৃদিমাঝারে এই হিংস্র হাহাকার!
থলের ভেতরে দেখো ফুলকপি কী নিঝুম নতশরীরে একরত্তি জীবন হয়ে হেসে গেল পুষ্টিনিষ্ঠ ভরপুর! লালশাকগুচ্ছ বলে গেল শৈশবে-পড়া আদর্শলিপিশ্লোকের গল্প! আর লাইপাতাগুলো, তোমরা যাকে রাইসর্ষে বলে ডাকো, কোমল তেজে কেমন চনমন করছে আর জীবনের স্মৃতিবিছানায় সার্থকতাগান গাইছে! এই তো ভুবন আরেক, অবাক চুপচাপ ভুবন, বয়স হলে মানুষ এমন ভুবন বানিয়ে তোলে। ফেনিয়ে ফেনিয়ে বানায়, বানাতে বানাতে ফেনায়, একটা কথা বলতে যেয়ে একশ কথা বাজায়। এমন মানবজনম আর কি হবে হে, এই ভুলেভালে-ভরা বিভোর জীবন, এই বলে ফোঁপায় কেবল। বয়স হলে মানুষ অযথা কান্নাকাটি করে, এমনি এমনি কাঁদে একা একা, আর অজস্র ভনিতার সঙ্গে যুক্ত হয় একটা খামাখা-খামাখা কান্নাভান। সমস্ত লক্ষণ পরিস্ফুট, অতএব, বয়স হলো আমার, ওদিকে ডিলান এদিকে সুমন বুড়ো হয়ে গেলেন! তো, দুনিয়ার কী যায় আসে তাতে, ফুরোয় যদি ফুরাক!
বয়সের আরেকটা মারাত্মক উপসর্গ হলো, অসহনীয় উপসর্গ, সবকিছু অহেতুক জটিল ও প্যাঁচজর্জর করে তোলে বয়সী মানুষেরা। আজেবাজে কাব্যি লিখে লিখে আত্মীয়স্বজনকে পাকড়াও করে শোনায়, যেন রচেছে গীতাঞ্জলী-পিছে-ফেলা ম্যাগনামোপাস, এবং অবধারিতভাবে বন্ধুকে বিপন্ন করে তোলে। এই যেমন, আমি, এখানে, চিঠি লিখতে বসে এহেন তুলকালাম বাচাল হয়ে উঠেছি যে, এখন দমকল ডাকতে হবে তোমাকে। নেভাতে চাও তো দমকল ডাকো অনতিবিলম্ব। অথচ নিজেই বুঝতে পারছি আমি, থামা দরকার, বুঝতে পারছি কোনো-কোনো বহুগ্রন্থিল গপ্পোবুড়ো তরুণ কবির জনকরতালিসিক্ত কবিতার মতো করুণ হয়ে উঠছে এই চিঠি। কী করব, বয়সের দোষ, অনভ্যাসে বিদ্যানাশ। অথচ এককালে বেশ নায়কোচিত ভরাট কলসির ভুং-ভাং ভাব ধরে বসে থাকতে পারতাম বলে মনে পড়ে। পারতাম, নাকি! হতাশ হই না, কারণ বয়স মানুষকে আশাবাদী রেখে যাবতীয় বাকিসব লুটে নিয়ে যায়, কাল নিশ্চয় ভালো কিছু লিখতে পারব। ভুং ধরে ফেলতে পারব বাইফোকাল পরিহিত বুদ্ধিজীবন্ত, গোটা-সাতেক দিনের শেষে শিশিরশব্দের মতন গোটা-দশেক ধ্বনি উঠিব সহসা হাঁকি, তোমার তখন সামাজিক মর্যাদা নিয়ে হীনম্মন্য গুজরান করতে হবে না দিন, লোকে বলে বেড়াবে ভরা-ঠিলার কামালিয়াত বিষয়ক কিংবদন্তিকথা, তুমি আর-কয়টা দিন সবুর করো, বোবা হতে বেশিদিন বাকি নাই আর, ধৈর্য ধরো, সোনা, হ্যাভ প্যাশেন্স, প্রিয়তমা! — জাহেদ আহমদ ২০১৩
- যেভাবে হয়ে ওঠে ‘এসো আমার শহরে’ || শিবু কুমার শীল - March 6, 2025
- Basudeb Dasgupta’s ‘Randhanshala’ The Cooking Place translated by Sourav Roy - March 4, 2025
- ভিক্টোরিয়া অ্যামেলিনা ও যুদ্ধদিনের ইউক্রেনীয় কবিতা || জয়দেব কর - February 17, 2025
COMMENTS