যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে…

যেহীন আহমদ, অনেক অনেক দিনের পরে…

 

যে-জীবন দোয়েলের, ফড়িঙের —
সে-জীবনেও হয়ে যায় দেখা মাঝেমাঝে
এক-দুইটা মানুষের সনে

জীবন আসলে এক আশ্চর্য কুহক
কখনো সমুদ্র কখনো রক্তরঙ্গনে
উদ্ভাসি উঠিতে পারে তসবির তার —
আচমকাই, অন্ধকারে, আলোক অপার

ধরিবারে যেয়ে তারে অপরূপী ধীরে বহে দিন, অপেক্ষার।

*
তিতপুরানা আমলের গানশোনা রাত্রিদিনগুলা পাশরিয়া যাবার আগে
শেষবারের মতো অনুরাগে

যেহীনভাই,
নিতে চাই
নিরঙ্কুশ ফুলের চারা, আপনার নাম

কথাটা, আমার স্বভাব যেমন, জানালাম
যখন আপনি ইহলোকে আর নাই

ডিস্ট্যান্স বেড়েছিল, সংগত কারণে কিংবা কারণ ছাড়াই
বিস্তার এড়ায়া যাই
কিন্তু সংক্ষেপে এইটুকু বলি —

শিশিরে ভেজানো শসার শরীর ঘিরে একপাল খরগোশের কলকাকলি
স্মৃতির ভোরের আলোয় দেখসিলাম

ওইটাই ইয়াদ রেখে
এ-জীবনের বেশিরভাগ স্মৃতিই ইনভ্যারিয়্যাব্লি যায় বেঁকে
একদিন, কোনো পূর্বাভাসহীন, যায়

আপনারে একটা পার্টিকুলার গানের হদিস দিতে না-পারার আক্ষেপটা আমায় আজও ভোগায়।

*
সমুদ্রের সাহচর্যে কেটে গেল পনেরো বছর
অতঃপর
কোনো পর্বতশহর

অথবা অ্যামাজ়ন-সুন্দরবন জঙ্গলে গেলেও হয়

কিন্তু পুকুর চৌবাচ্চা আর নয়
যেহেতু সমুদ্রসমান
গান

শুনিয়ে এখন সমুদ্র অনেক দূরের এক অবলুপ্ত সময়।

*
ফেরানো সম্ভব নয়
হারানো সময়
আর চলে-যাওয়া হাওয়া

যে যায়, তার যাওয়া
আরেক অর্থে থাকা
আচ্ছন্ন বনের পটভূমিকায়, আঁকাবাঁকা

গালিবের গজ়লগুলা তারে ফিরে ফিরে ধরিবারে করে ধাওয়া।

*
অনেক অনেক দিনের পরে
একটা আননোন শহরে

ধরা যাক, আননোন

হয়ে যায় সাক্ষাৎ
হয়ে গেল, অকস্মাৎ
হয় যেমন নভেলে সিনেমায়

নাটকীয় সংঘর্ষ ঘটিয়ে শেষের কবিতা

তেমন, বা আরেকটু, ধরুন
আপনার তো খুবই প্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ;
মানিক বা তারা আপনার তত নন
বরং অমিয়ভূষণ মজুমদার
অনেকটা দাবিদার আপনার অত্যন্ত নরম একটা জায়গার

কমন মনে হলেও কমন নয় টের পাওয়া যায়

আপনার পাঠতালিকায়
দেশিবিদেশি বিস্তীর্ণ বৈচিত্র্যবহ রচয়িতাদের আনাগোনা
ক্ল্যাসিক্যাল মিউজ়িক নিয়া আলোচনা
তাছাড়া আপনার প্লেলিস্টে কে নাই রিসার্চ করলে বের হতে পারে
কে আছে সেই হিসাব করে যে বেজায় বেদরকারে
সেই লোকটা আমি যেন না-হই

কিন্তু, দুপুরবেলার হৈ চৈ
কিংবা রাত্রির তৃণমসৃণ নৈরব্য ও অন্যান্য অনুষঙ্গ
তরল কৌতুকীর তূর্ণ তরঙ্গ

ততক্ষণে একটা ক্যালেন্ডারে প্রেইরিবিস্তীর্ণ উদ্গল হাওরের হাওয়া
ধানবর্ণ ধনেশের ঝুঁটিঝিল্কানো উড়ে যাওয়া…

*
সালিম আলির বইগুলা আপনার প্রযত্নে কেমন কূজনমুখর থাকে
এই কথাটা বার্ডওয়াচার ক্লাবের করিৎকর্মা কাকে যেন বলতে গেসলাম
ভুলে গেসি শ্রীমানের নাম
উনি নিজের গ্রন্থ ছাড়া আর কারো গ্রন্থ মনে করেন না আলাপের দাবি রাখে

অ্যানিওয়ে, এইসব স্ট্রিটসাইড ট্রাবল
কোথায় নাই বলেন, পরকালে এসবের জন্যে যেন গুনতে না-হয় মাশুল।

*
সন্ধ্যা নামতেসে দেখি

দিনভর শুধু বদি আর নেকি —
এর বাইরে একটা থার্ড স্পেইস ভাবতে পারে না যারা
তাদের কাছে একটা আর্টের ইশারা
কাঠবিড়ালির পেয়ারাগাছের মতো, শব্দার্থ ও টীকাটিপ্পনীর ফোকরে
এর কলাপাতা কালারের কচি গ্রিন ভাবটা যায় ঝরে

এই শীতে ক্ষেতের নয়া আলু পুড়িয়ে খেতে খেতে
অ্যানশিয়েন্ট ম্যারিনারের মতো থমথমা জাহাজের মেঝেতে
একটা অ্যালব্যাট্রস খসে পড়বার মুহূর্ত স্মরণ হয়

কী যে মেসমেরাইজিং মুক্তির অভ্যুদয়!

*
চারিদিকে নীরবতা, শান্ত ও সবুজ

রোজ
উইন্টার সিজ়নের এই বিবরণ
ক্লিশে শোনায় বলে যেমন
বদলায়া ভাবলাম এখন

বরিশালের জীবনানন্দের কবিতালাইনের কন্সট্রাকশন

বদলাতে হয়
বিশেষত সন্ধ্যার সময়
জীবনানন্দীয় পরিস্থিতি ইমার্জ করে যখন

চারিদিকে শান্ত সবুজ নীরবতার মতন।

*
গাঁদার হলুদ অপরাহ্ন ক্রমশ সন্ধ্যায় ধাবমান

চৌবাচ্চার ধারে একটা গান
তানবিস্তারে যেতে যেতে থেমে যায় মাঝপথে
মেন্দিগাছের আড়াল পেরোতে পেরোতে
নেউলের গলায় দেখি শিকলের দাগ
বুনো কোনো ফুলের পরাগ

সন্ধ্যা হয় হয়, চারিদিকে মাগ্রিবের আজ়ান।

*
ফানোঁ পড়সি আপনার মুহুর্মুহু প্ররোচনায়
ফ্রেইরি ছিল অবশ্যপাঠ্য, অন্তরঙ্গতার মোক্ষম উপায়;—

আপনার লগে কেউ যখন কথা চালাতে চায়
তার পক্ষে ব্যাপারটা সামলানো সহজ হতো
যদি কিসু পড়া থাকত
বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ
অথবা ফ্রঁৎস ফানোঁ —

মোটে তেমন নয়;
আপনার লগে কথা চালাবার সময়
টের পেত লোকে তার চারপাশে ছেয়ে যাওয়া গান
সুরের সরহদ্দ, অন্দর ও উঠান

সহজ সুস্পষ্ট প্রবেশ ও প্রস্থান

কনফিডেন্ট, ক্যুল অ্যান্ড কাম
ক অক্ষর গোমাংস অথবা হালাল হারাম
সবই ছিল উদার আপনার ভাবনার খোরাক
দুপুরবেলায় রাবারবনে টেখৈপাখির ঝাঁক

উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান
অথবা আকবার, বিলায়েৎ, রবিশঙ্কর
বছরের পর বছর
পরম্পরাধারায় ডিটেক্ট করে যেতে পারতেন কতশত উস্তাদি মিউজ়িশিয়্যান

সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের কল্পনা ও অভিজ্ঞতায়
আগমনের বহু বহু পূর্বেকার কোনো দুপুরবেলায়
আমার মনে পড়ে যায়
হারুকি মুরাকামির লগে মুলাকাত ও মুসাফার প্রথম প্রহর
কাফকা অন দ্য শোর
দুই পাওলোর ইংলিশে ট্র্যান্সল্যাইটেড গদ্যের স্পিরিচুয়্যাল জাল —
কোয়েলো ও ফ্রেইরি — অ্যাইমে সেজ়ায়ার, অ্যামিল্কার কাব্রাল;
ফ্রঁৎস ফানোঁ তো বললামই, বিশেষভাবে রেচেড অফ দ্য আর্থ  ও ব্ল্যাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক
আপনিই চিনাইসেন আমায় স্টাইল ও ট্রেন্ডের মধ্যিকার ফারাক

উজ্জ্বল উইন্ডশিল্ডের সেই দিনগুলা
আমার পক্ষে বেশি হবে হয়তো বলা
তা-ও বলতে কেন বকেয়া রাখব, বলেন?

ডিয়ার যেহীনভাই, আই অউ ইউ ম্যান!

*
সারাদিন অতিকায় কাজকর্ম সমাধার
এর মধ্যেই ইউটিউবে একটা টার্কিশ সান্তুর, সাবকন্টিনেন্টাল সুরবাহার
সন্ধ্যার পরে বেগম আখতার

আর জানালার পাল্লাখোলা হাওয়া
গানের পর গানগুলা গাওয়া

হাওয়াটি ছিল অতিশয় মার্জিত, মন্দ্র, অকৃতদার।

*
মুজ়াররাদ ইয়েমেনির মাজারের রইদ
উড়ে যায় স্ট্রেইট পশ্চিমে

যেতে যেতে একটা আসামপ্যাটার্ন
সম্পন্ন বসতবাড়ির ফ্রন্টভিয়্যু, অল্প উঠান
পুরানা আমলের কিছু স্থবিরতা আর আমজামনিমে
একা বাড়িটির গেটে এক প্রকাণ্ড অর্কিড

গেট পারায়া বারান্দা, তারপর বৈঠকখানা

কালের করাল চক্রে সেই কীটপতঙ্গভরা আলোঅন্ধকার
পুকুর ভরাট করে মেলা হলো অট্টালিকার অতিকায় ডানা

আমার জীবনে এই বাড়িটির অপরিমেয় অবদান ও তাৎপর্য
যদি কিছু সময় থাকে
ব্যতিব্যস্ততার ফাঁকে
এবং থাকে একাগ্র শ্রবণের ধৈর্য —

শোনো, বলি, ডিয়ার ল্যান্ডডেভেলপার!

*
নিসঙ্গতা আপনারে একবারও পীড়িত করে নাই?

জীবনে একবারই জিগাইসিলাম উনারে
একটা কাবাবদোকানের কাউন্টারে
সেই গ্রীষ্মদুপুরে বেভারেইজের বটল আনকর্ক করবার ফাঁকে

একটা ডার্ক ডিস্ট্যান্ট গলায় রিপ্লাই দিসিলেন আমাকে —
না, কখনোই নয়;
নৈসঙ্গ্য উপভোগের, উদযাপনের, সবসময়

জীবনভর কথাটা আমি ইয়াদ রাখতে চাই।

*
নিসঙ্গতা আর সঙ্গ-না-পাওয়া
কানে এক শোনালেও মোটেও তা না

বাই চয়েস কেউ নিসঙ্গ হতে পারে

অ্যালোন হওয়ারে
মেডিটেরানিয়ান লোনলিনেসের এই বিষণ্ণ বৈকালিক সংসারে
বেশ তো গ্লোরিফাই করা হয়

এর তলায় চাপা পড়ে রয়
নিসঙ্গতা আর সঙ্গ-না-পাওয়া আদৌ এক জিনিশ নয়
এই সত্য ও সংশয়

একটা মানুষ সঙ্গ চায়
মানুষের দরোজায় দরোজায়
বেল বাজায়, বিনীত ও অসহায়;
মানুষেরে ফুঁসলায়
বিকালবেলায় বাইরে বেরোবার দায় —
যাওয়া যায় চায়ের বাগিচায়

যাওয়া আরও বহু জায়গায় যায়

নিসঙ্গতা আর সঙ্গকামনায়
কাতর মানুষের ধারে
একবার দুইদণ্ড বসে দেখবার ইচ্ছায়
আমি এই লাইনগুলা টানা টাইপ করি

নমি আমি নিসঙ্গ, সঙ্গলিপ্সু, অচিনা রাগের ধুন ধরি।

*
জীবনটা কাটিয়ে গেলেন অল্প অথচ উপাদেয় আহারে
ব্রেকফাস্টে, লাঞ্চে এবং ডিনারে
প্রাচুর্য নয়, থাকত পরিমিতি

কিন্তু দৈনন্দিন ব্যবহার্য উপাদানের উদ্ধৃতি
ট্রিবিউটকবিতায় জ্ঞাপনের স্কোপ কম
রয়েছে এই জীবনের আরও বহুবিধ জঙ্গম
অর্জিত সফলতা, সাধ ও সংযম

নক্ষত্র, গ্রহফের, নেতি এবং ইতি।

*
মির্জা গালিবের গজ়লগুলা জানত
কোথায় আপনার কতটুকু সম্ভ্রান্ত
কোন কাননের ফুল আর কোন গগনের তারা
আপনারে এমন গহন মগন রাখে আত্মহারা

সাহির লুধিয়ানভি, মির তকি মির
গুলজ়ার
জ়াভিদ আখতার
জ়ালালুদ্দিন রুমি কিংবা মানসুর হাল্লাজের জ়িকির

বোধহয় জানত আরেকজন —
অবিসংবাদিত তিনি, দি অ্যাক্ট অফ গড, শচীন দেববর্মন।

*
ঘর থেকে দূর নয়
পাশেই কবর
দরগালাগোয়া মায়া
চান্নিপসর

যাই তাতে, যেতে হয়
জিয়ারতে যবে
হ্যালো বলি হাত তুলে —
ফের দেখা হবে

ফেরেশ্তাদের ছায়া
গাছের পাতায়
শির্নির খুশবোয়
নাসিকা ঠাঠায়

তারপর মুড়িছিটা
মাছেরে খাওয়াই
জালালিয়া কবুতর
মিনারায় চাই —

টিলাঢালু থরে থরে
এপিটাফে ভরা
আউকাল করে লোকে
শরা না বেশরা

আজব দুনিয়াদারি
হিং টিং ছট
মেটাফোরিক্যালি বলে
মেল্টিং পট

ভূমিকায় কেউ কেউ
কপট ও ছল
সকলেই কমিবেশি
বিবেক বিকল

অমোঘ মরণ তবু
মরণের ঠিক
পাশেই গৃহ ও ঘড়ি
ইহলৌকিক

সকলেই আসে, যায়
হাতছাপ রেখে
সকলেই সকলেরে
আড়চোখে দেখে…

শেষবার দেখে নিই
বিদায়বিধুর
শা-জলাল সাহেবের
মাজারের ঘর।
জাহেদ আহমদ

*ব্যানারে ব্যবহৃত  যেহীন আহমদ প্রতিকৃতিটির স্থিরচিত্রধারক জাহেদ আহমদ


গানপারে যেহীন আহমদ
গানপারে দীপক রায়

Support us with a click. Your click helps our cause. Thank you!

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you