মনে করেন, একটা সুইসাইড কেইস স্বাধীন আদালতে বিচারের মুখোমুখি হইল। মনে করেন, বিচার চলতেছে। সুইসাইডটা মার্ডার ছিল কি না বা এই সুইসাইডের পিছে কারো প্রভোকেশন ছিল কি না বা কেউ ভিক্টিমরে সুইসাইড করতে বাধ্য করছে কি না। এর বাইরে আদালত কী করতে পারে?
সুইসাইডের ঘটনারে সোসাইটি সাধারণত খুন হিসাবে দেখতে চায় না। এতে সোসাইটি খুব সহজে নিজেরে দায়মুক্ত রাখতে পারে। অনেক স্বাভাবিক ঘটনার ভিতর একটা ‘অস্বাভাবিক ঘটনা’ ট্যাগ দিয়া সোসাইটি দ্রুত এরে ভুইলা যাইতে চায়। ফলে ভিক্টিম যে, মইরা গিয়াও আত্মহত্যার ব্লেইম তারেই নিতে হয়।
যারা মনে করে সুইসাইড টেন্ডেন্সি একটা সাইকোলোজিক্যাল ব্যপার, আমি তাদের লগেও একমত না। এইখানেও এই সাইকোলোজিটা একান্ত ভিক্টিমের। ফলে এইখানেও লাশ হওয়ার পরে দায় ভিক্টিমরেই নিতে হইতেছে।
আমি মনে করি, একজন ব্যক্তির আত্মহত্যার পরিস্থিতি পরিবার, সোসাইটি, রাষ্ট্র সবাই মিইলা তৈরি করে। এবং দায় না নেওয়ার জায়গাটারে এরা সবাই মিইলা ডাকে ‘অস্বাভাবিকতা’, ‘মানসিক ভারসাম্যহীনতা’, ‘চাপ সহ্য করতে না পারা’; বা, ভিক্টমরে যে-কোনোভাবে অপরাধী হিসাবে হাজির করা।
মনে রাইখেন, একটা খুন হইল সোসাইটির সবচেয়ে করুণ এবং অমানবিক ডিজঅর্ডার। এই খুন যেইভাবেই হোক। অতএব ক্ষমতাহীন নাগরিক অথবা ক্ষমতাহীন সমাজ তারে নিয়ন্ত্রণের আইন-আদালত দিয়া কেমনে এই ডিজঅর্ডারের বিচার করে, এইটা হইল ঘটনা। এবং এইভাবে ক্ষমতাহীন নাগরিক নিজের অস্তিত্বের ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত ফয়সালাও করতে পারে৷
যতদূর মনে পড়ে, বসুন্ধরা গ্রুপ আগেও তাদের এক এমপ্লয়ি মার্ডারের কারণে খুব আলোচনায় আসছিল। সোবহানের কোনো-একটা ছেলে ওই খুনের সাথে জড়িত ছিল, এইরকম অভিযোগ উঠছিল তখন। বিচার হয় নাই। অভিযোগ উঠছিল, অনেক টাকার লেনদেনে দফারফা হইছিল ওই খুন। এই ডিজঅর্ডারের ধারাবাহিকতায় গতকাল মুনিয়ার লাশ পাওয়া গেল। অতীত ফের হাজির হইল। আরো করুণভাবে।
টাকার শক্তি আছে, টাকার রাজনীতি আছে, টাকার আইন-আদালতও বোধ হয় আছে। মেহেরবানি কইরা, সোসাইটিরে টাকার এই ঔদ্ধত্য আর উন্নাসিকতার কাছে পরাজিত হইতে দিয়েন না বারবার।
এই ডিজঅর্ডারের ভিতর মিডিয়া তার প্রভুর প্রতি ভক্তি দেখাইতে থাকে। ফলে দেখা যায়, খুনের নথি আত্মহত্যার বেওয়ারিশ ফাইল হইয়া হোঁচট খাইতেছে ভাঙা দরজায়, পানের পিকে রাঙা মলিন দেয়ালে, পাবলিকের উদাসীন অবহেলায়।
মিডিয়ার ভক্তি কুকুরের মতো। নির্লজ্জ এবং প্রশ্নহীন। আপনে নিজেও যখন নিজেরে অমুকের ম্যান, তমুকের লোক দাবি করেন, এও মূলত ওই কুকুরসম ভক্তি।
ক্ষমতার কাছে ক্ষমতাহীনের আত্মসমর্পণও একধরনের ডিজঅর্ডার। দেখা যায়, এই ডিজঅর্ডারের ভিতর অনৈতিক ভিত্তির উপর খাড়া হইয়া থাকা রাষ্ট্র, ক্ষমতাবান এবং ক্ষমতার স্বেচ্ছাসেবকেরা সকাতরে চালাইতেছে নৈতিকতার খবরদারি!
যারা আজ লাশ-মুনিয়ারে দোষ দিতেছেন, তার চরিত্র লইয়া কথা বলতেছেন, তারা মূলত সোসাইটির এই ডিজঅর্ডারে জনবিরোধী ক্ষমতার অনুগত কুকুরের মতো আচরণ করতেছেন। মনে রাইখেন, আপনের দেওয়া অপবাদের জবাব দিতে লাশ-মুনিয়া আর ফিইরা আসতে পারবে না। এক ক্ষমতাহীনরে অপবাদ দিয়া আপনে কোন নীতির প্র্যাক্টিস করতেছেন? আপনের চিন্তা, আপনের বিবেক, আপনের রুহ পইচা গেছে একেবারে। এত এত বিশৃঙ্খলা, এত রোগ আর শোকের ভিতর আপনের এই করুণ পরিণতিও কম যন্ত্রণার না।
দেখেন, এই সোসাইটি ভাইঙ্গা পড়তেছে। এই বিশৃঙ্খলার ভিতর মুনিয়াদের লাশ কেউরে শান্তিতে থাকতে দিবে না।
- স্যামুয়েল বেকেট, নিরর্থকতা, সাইলেন্স আর ভাষার পরাজয়… || হাসান শাহরিয়ার - January 6, 2025
- মুনিয়ার ঝুলন্ত লাশ, ক্ষমতাবান বনাম ক্ষমতাহীন, গণমানসিক বৈকল্য ও অন্যান্য তাধিন তাধিন || হাসান শাহরিয়ার - November 28, 2024
- মিতা নূর, অলিম্পিক ব্যাটারি, সুইসাইড, বিংশের বাংলাদেশ যথারীতি একবিংশে, অনেক অনেক আহাম্মকের কারবার অথবা রোজগার… || হাসান শাহরিয়ার - November 24, 2024
COMMENTS