নগরমুসাফিরির নবতরঙ্গ

নগরমুসাফিরির নবতরঙ্গ

শেয়ার করুন:

কবিতায় বাংলাদেশের নব্বইয়ের যেটুকু অর্জন, লক্ষণ ও চারিত্র্য, জওয়াহের হোসেন সেখানে একটু হলেও যুগিয়েছেন খড় ও কুটো। গত শতকের অন্তিম দশকে লেখালেখিফিল্ডে আবির্ভূত কবিদল সবাই মিলে এমন একটা বাকবিভূতি ক্রিয়েইট করেছিলেন, এমন একটা কাব্যভাষা, যার দাবিদার একক কোনো কবি নন বরং অনেকের সম্মিলিত ধ্বনিপুঞ্জে সেটি সৃজিত হয়েছিল।

অতি বিজ্ঞাপিত পণ্যদুনিয়ায় এখনও অন্যভাষ তালাশ করেন যারা তাদের কবিতায়, হাউকাউ না-করে যেখানে একলা মানুষের নৈসর্গিক নন্দন ফুটিয়ে যান যারা তাদের বর্ণমল্লিকায়, জওয়াহের হোসেন তাদের মধ্যে একজন। গোটা নাইন্টিস জুড়ে অ্যালিয়েনেইটেড সমাজের স্বরসংশ্রয় শিল্পের ফ্রেমে ক্যাপচার করবার দায় বাংলাদেশের কবিরা কাঁধে নিয়েছিলেন এবং সেই দায় মেটাতে যুগপৎ সাফল্য ও ব্যর্থতা তাদের প্রকাশিত কবিতাবইগুলোতে হাজির রয়েছে।

‘একাকী, শব্দ নৈঃশব্দ্য’ জওয়াহের হোসেনের এ-পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতাবইগুলোর মধ্যে তৃতীয় ও সর্বশেষ তরঙ্গ। পূর্ববর্তী বইগুলো যথাক্রমে ‘যুগিভাব সঙ্গ’ এবং ‘নগরমুসাফির ও মোনাজাত’ কবির নৈঃশব্দ্য ধরবার আরাধনার দুই নিদর্শন। কবিতাচর্চার তিন দশকে একুনে এই তিনটা মাত্র কবিতাবই, সতীর্থদের প্রকাশিত গ্রন্থতালিকা যেখানে দুইহাতের অঙ্গুলিরেখায় ক্যাল্কুলেইট করে কুলানো যায় না, জওয়াহের হোসেনের কবিপ্রতিকৃতি চিনতে এই ইঙ্গিতটি নিশ্চয় কিছুটা গ্রাহ্য হয় পাঠকের কাছে।

এই বইয়ের ব্যাপারে একটা বাক্য সন্দেহাতীতভাবে উচ্চার্য, আর সেটা এ-ই যে, এখানে লক্ষ করব কবির একইসঙ্গে ডেব্যু ও ডিপার্চার; নব্বইয়ের বহুল আচরিত ভাষা থেকে ডিপার্চার, যার নজির লভ্য বইয়ের বৃহদাংশ জুড়ে, প্রস্থানাঙ্কগুলো সবিস্ময় দাগিয়ে রাখার মতো; এবং ডেব্যু, অভিষেক, নয়া ভাষাহার্বারের দিকে যেখানে একটা আসক্তিজনিত আচ্ছন্নতা যেমন রয়েছে তেমনই নির্মোহ কবিতাভাষার জাদুবিস্তারটুকু দুর্নিরীক্ষ্য নয়।

এক অর্থে এই বই একের ভিতর দুই : দ্বিতীয়াংশ ‘সুরা ও জাদুমোহ’ বাংলাদেশের ডামাডোলভরা কাব্যচর্চায় মার্ক করে রাখবার মতো। পয়লা পার্টে, যেইটা আগেই নিয়েছি বলে, ল্যাঙ্গুয়েজের দিক থেকে আগের দুই বইয়ের কন্টিন্যুয়েশন লক্ষণীয়। দোসরা ভাগে, এই ভাগটা কবিকৃত নয় জানব, পড়তে পড়তে এই বিভাগকরণ সম্পূর্ণ পাঠকের পার্টিসিপেইটরি রিডিঙের অপেক্ষায়, রিডারকল্পিত দ্বিতীয় ভাগটা আর কিছু নয়, একটি বিশেষ ও বইয়ের শেষ কবিতা, আসলে একটা মালা, গাণিতিক নামতাসংখ্যায় সূচিত কবিতাশতক, যাদের একটাই টাইটেল, ‘সুরা ও জাদুমোহ’।

ওয়ানলাইনার, একপঙক্তির কবিতা, অনেক পড়েছি আমরা, তাতে পেয়েছি বিস্তর ভাবালুতা সরলতা জটিলতা চটুলতা জঙ্গমতা চমকপ্রবণতা, ‘জাদুমোহ’ কবিতাগুলো ওয়ানলাইনারের চেয়ে বেশি কিছু। ফলে, বেশি কিছু হওয়ার ফলে, এরা আদতে একটা আলাদা বইয়ের দেহ দাবি করে। এর আধ্যাত্মিকতা, সাংকেতিকতা, বাঙময় চিত্রকল্পাত্মকতা আলাদা বই হিশেবেই রিপ্রেজেন্টেশন চায়। এই বইয়ের কবি বইটিকে দুই ভাগে ভাগ না করলেও দুই ভাগ হয়ে যায় ‘জাদুমোহ’ প্রবাহ পড়বার সময়।

এমনিতে চৌষট্টি পৃষ্ঠা বা চাইর ফর্মায় আঁটানো কবিতারা সংখ্যায় চুয়াল্লিশ পঁয়তাল্লিশ, ও/অথবা তার সঙ্গে অ্যাড হবে ‘সুরা ও জাদুমোহ’ তোড়ায় একশ। অন্তিম কবিতাটা ক্যান্ডিড একশ কবিতাবীজের একটা আকরিক। কম্প্যাক্ট অ্যান্ড ক্যান্ডিড। মরমি, কিন্তু নব্বইয়ের ট্রেডমার্ক মরমিপনা নয়। ইঙ্গিতময়, কিন্তু নব্বইয়ের ইঙ্গিতের ইড়িঙ্গি নয়। কেমন যেন গজল ঠুমরির বোল বলে মনে হয়। টাইমের অ্যালিয়েনেশন ও অ্যাবসার্ডিটি রেখে, ফেলে দিয়ে নয়। এখানে এই সিঙ্গল পঙক্তিসুরা পানোত্তর আচ্ছন্নতা এক্সপেরিয়েন্স করতে একটি পৃথক পানশালা আবশ্যক। মূলত গদ্যফর্ম্যাটেড, হলেও কোথাও কোথাও কদাচ কাপ্লেটও ফুটতে দেখা গেল। চমৎকার। ধরা যাক, সুরা ও জাদুমোহ, দুয়েকটা এবার :

*আমার সর্বস্ব নিয়ে যে আগুন জ্বলছে তা নিভিয়ো না, ওই ছাইটুকু আমি
*তুমি পাতালে ঘুমিয়ে আছ আর আকাশেও এক অবিনশ্বর
*একটা মৃত্যু অবলোকন করে আমরা হেঁটে যাচ্ছি কবরের দিকে প্রতিদিন আমাদের দিবারাত্রি বলে কিছু নেই
*আজ পৃথিবীর কাঁধে ভর করে নামছে লাল রক্তের অধ্যায়
*আমি প্রতিবার যে গ্রামপড়শি দেখতাম ঝিরিঝিরি হাওয়া প্রেমিকার মুখ নদী কিংবা সমুদ্র আজ কিছুই দেখছি না
*মৃত্তিকার উপরে এই জলরেখা দীর্ঘ হয়ে এল ধানের মিনতি করি আমি বারবার ব্যর্থ কৃষক
*ক্ষত আমাকে ব্যথা দেয় না, ব্যথা দেয় তোমার বদলে যাওয়া সময়
*আমি খুশি হতাম যদি তুমি আমাকে ঈশ্বরের মুখোমুখি করতে পারতে, আর একফোঁটা চোখের নোনাজল ফেলতে পারতাম তাঁর পায়ে
*নিঃসংসার হয়ে আছি, তার স্বাদ এখনও ভুলতে পারি না
যতদিন থাকব, আমার আর দুঃখ নেই, অভিমান নেই
*তোমার চোখ ভরে উঠত রক্তে, আমি যখন গহিন জঙ্গলের ভিতর পশুপালের সঙ্গে বসবাস করতাম
*বহুরাত অবসাদে ম্রিয়মাণ, নিজেকে অচেনা লাগে বহুদিন
*তোমার প্রেম আমাকে আতঙ্কিত করে, বিস্ফোরণ ঘটায় নতুন এক পৃথিবীতে
*আমি গভীর কূপে ফেলে যাওয়া ইউসুফের দুঃখ নিয়ে বিলাপ করছি মরুভূমির দীর্ঘ প্রহেলিকায়
*তোমরা এখনও ছুঁড়ে ফেলতে পারোনি তোমাদের পশুত্ব এখনও আদিম বর্বর
*জওয়াহের, দুঃখের পরিমাপ করতে যেয়ো না কখনও, দুঃখ তোমার সমান, দুঃখে দীর্ঘজীবী হও
*ছদ্মদেশে বনবাসে যায় ইশকে রূপবান আর পুথি হাতে শিশু রহিম মার্কেজ মুখস্থ করছে
*কবি তোমাকে স্বাধীন লাগে না এই টেকনোলজিযুগে হিংস্র কিলার মনে হয়
*নৌসফর শেষে যে-পথ দুজনে ফেলে এসেছি, তা এখন পরিহাসের, তবু গোধূলিমর্মর থেকে মনে পড়ছে প্রস্ফুটিত জলের ঘোর জলসা
*তুমি ছাড়াও তুমি কিছু সময় বসে থাকো বাকি অর্ধেক জীবন
*কাঁপাকাঁপা দূর-গৃহবাসের পাশে পরাক্রম গেয়ে উঠছে কতিপয় শীতের আগুন ও মোটিফ
*অধম জেনো এই জওয়াহেরকে, একা-একা পরবাসে যে এক চিরকাঙাল…

উৎকলন অধিক মনে হলে লেখার উদ্দেশ্য/অভিপ্রায় ব্যাহত হয়। লেখায় পাঠকের অংশগ্রহণ কমে যায়। কাজেই, বিরত হই। নিরুদাহরণ রই। কিন্তু, ‘সুরা ও জাদুমোহ’ ততটাই ম্যাজিক্যাল যে এর ভিতরকার পঙক্তিগুলির বিক্ষিপ্ত উৎকলন কঠিন। শতে শত তুলে দিলে তো আর উৎকলন/সিলেকশন হলো না। ক্ষান্তি দিই। কিন্তু বলি, এই কবিতাগুলি পৃথক বই হবার সম্ভাব্য সমস্ত গুণাবলিই ধারণ করে। একেকটা লাইন একেকটা আস্ত পৃষ্ঠা দাবি করে এমন কবিতা এইগুলি।

কিন্তু অন্য অংশে, যে-অংশটি বইয়ের মূলভাগ হিশেবে প্রেজেন্ট করেছেন কবি নিজে কিংবা তার এডিটার, সেখানকার কবিতাগুলি কেমন? ঘনসন্নিবদ্ধ, অতিমিতশব্দ, পরাঙ্মুখ বাকসিদ্ধ। উদাস, অপ্রতিভ, উন্মন। অথচ অনুধ্যানস্থ। সমুন্নত। মুসাফিরানায় স্মিত, তদ্গত। উদাহরণ চয়নে আলসেমির কারণে ফ্ল্যাপের কাব্যাংশটুকু উদ্ধার করলেই যথেষ্ট হবে, আপাতত :

গন্তব্যে রাত্রিজাগা গুটিপোকাদের নির্জন খেলা
পুরো গ্রাম লুটিয়ে পড়েছে

বিদগ্ধ বিহারে—
জমি খুঁড়ে খুঁড়ে এঁকে নিচ্ছি অবসর

অনুভূতিহীন ভস্ম দিনকূলে

উপরের অংশটুকু বইয়ের ‘কুয়াশাবিদ্যুৎ’ কবিতা থেকে বেছে ফ্ল্যাপে ব্যবহার করা হয়েছে। এই কবিতাটা সাতলাইনের সাকুল্যে। এমন সমস্ত অনুভূতিপ্রধান ভাষ্য ব্যক্তিক একটা গাঢ় অথচ মোহমুক্ত গলায় এই কবি হাজির করতে পারেন। ইন ফ্যাক্ট, বইয়ের ফার্স্ট তিনফর্মা তা-ই করেছেন। অবিভক্ত বইয়ের প্রথমদিককার চল্লিশোর্ধ্ব পৃষ্ঠায়। এই ভাগের সব কবিতাই মিতায়ত, হ্রস্ব। শুধু ‘কাব্যাশ্রয়ী ও নিশাচরগণ’ কবিতাটা দুই পৃষ্ঠার একটু বেশি আয়তন জুড়েছে। এ এক চরিত্র, জওয়াহের হোসেনের কবিতার; এবং, কবিরও, জওয়াহের হোসেনেরও; সংহত, স্বল্পবাক, সম্পন্ন।

বইয়ের প্রচ্ছদচিত্র অত্যন্ত গোবেচারি বিরক্তিকর হলেও ব্যাকগ্রাউন্ড কালার আরামদায়ক। ছাপা, কাগজ ও বাঁধাইয়ের মান সন্তোষজনক। বইয়ের গায়ের দাম বাংলাদেশি টাকায় আড়াই শ। প্রকাশক নাগরী, সিলেট থেকে, ফেব্রুয়ারি দ্বিসহস্রচব্বিশে প্রকাশিত।

বইপুস্তকের পড়ুয়া কাস্টোমাররা মার্কেটে বই কিনতে যেয়ে এর বহিরঙ্গ দেখার পাশাপাশি ভিতরের কন্টেন্টের এডিটিং পার্টটা আপ-টু-দ্য-মার্ক আছে কি না আন্দাজ করতে চান। দৈবচয়নে একটা পাঁচলাইনের কবিতা সামনে এনে দেখাই—

এই বোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে কার্ল মার্কস
কতবার হাত উঁচু করে তুলবে আর নামবে বিপব
আমাদের মহাকালের পথে মানবকল্যাণ
রেখেছিল জনমিছিল
সমস্ত বিশ্বে এরকম বিস্ময় মানবতার কথা বলে।

এই কবিতায় কবিতা কোথায় তা জিগানো উদ্দেশ্য নয়, একটা শব্দ নিয়া সংশয় জানাতে হয়। কেউ হয়তো শব্দটি খিয়াল করেন নাই, ‘বিপব’, দ্বিতীয় পঙক্তির শেষ শব্দ। পড়ে বেশ ধন্দ জাগে, এহেন শব্দ অভিধানে থাকলে থাকতে পারে, প্র্যাক্টিক্যালি শব্দটা ‘বিপদ’ না ‘বিপ্লব’ বোঝাতে চাইছে হেন ধন্দ রয়েই যায়। কার্ল মার্ক্স আগের লাইনে এসেছে যেহেতু, তো ওই ‘বিপ্লব’ হবে হয়তো। অথবা হাজারচব্বিশ, বিপদে বিপ্লবে একাকার। ফারাক আছে দেখাবে, অ্যাট লিস্ট বানানে, কই সেই এডিটার? চয়িত কবিতার নাম ‘মানবকল্যাণ’। গোটা বইটায় বানান যতিচিহ্ন প্রভৃতি রিলেইটেড কনফিউশন আরও কতেকবার হয়েছে, মোট কতবার তার টালি রাখি নাই।

জওয়াহের হোসেনের কিমিয়ায় নির্মিত কবিতার জাজ্বল্য জগতে পাঠক মাত্রই নিরুচ্চারে স্বাগত।

জাহেদ আহমদ ২০২৪-২০২৫

নব্বইয়ের কবি, নব্বইয়ের কবিতা
জাহেদ আহমদ রচনারাশি

জাহেদ আহমদ
Latest posts by জাহেদ আহমদ (see all)
শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you