২৩-২৪ বছর আগের কথা। বাউল ক্বারী আমির উদ্দিনের (Kari Amir Uddin) বাউলগানের মজমা বসবে আমাদের এলাকায়। পেন্ডাল বাঁধা হয়েছে মাঠ জুড়ে। টিকেট কেটে আমপাব্লিক দেখবে, শুনবে সেই গান। পেন্ডালের বাইরে আরো আরো বেশুমার মানুষ কান পেতে ক্বারী আমিরের কণ্ঠসুধা পান করবে। কিন্তু, বাধ সাধলো স্থানীয় মোল্লামৌলভিরা। ‘মুরতাদ আমিরুদ্দি’ ছেলেপুলেরে বিপথগামী করবে, তাই তারে প্রতিরোধ করতে হবে। কিছু মানুষ ও অল্পবয়েসী তালেবেইলেমদের জড়ো করে এক পক্ষ; আরেক পক্ষ গু-গোবরের প্রাকৃতিক স্প্রে নিয়ে রেডি! প্রতিরোধের জন্য এলে ঘাড়ত্যাড়া যুবকেরা স্প্রে ছিটাবে! দু-পক্ষের প্রস্তুতি এমনই!
ঠিক এমন অবস্থায় গু-গোবরের ইটাইটির (ঢিল ছোঁড়াছুঁড়ির) মুখে ক্বারী আমির উদ্দিনের গান প্রথম শোনা হয়েছিল আমার দূরন্ত কৈশোরবেলায়। গানের জন্য গ্রামের সাধারণ মানুষ চাষাভূষার সে-কী বিশাল আয়োজন! মাঠ জুড়ে শামিয়ানা টাঙানো, চারদিকে টিনের বেষ্টনী। টিকেট কেটে গান শুনতে আসবে লুঙ্গি-মালকোচা চাষাভূষারা! এর আগে গ্রামে গ্রামে মুখে মুখে বিজ্ঞাপন হয় ক্বারী আমির উদ্দিনের গানের। মানুষ কাঙ্ক্ষিত দিনটির জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে রাখে। ‘বালবাচ্চা’ পর্যায়ের আমরাও বিশেষভাবে আকৃষ্ট হই। যদিও গানপাগল মানুষের দঙ্গল পেরিয়ে আমাদের বয়েসীদের অনেকের গানশোনা অসম্ভব ব্যাপার ছিল। আছে পরিবারের ও আসরে-যাওয়া মুরুব্বিদের চোখরাঙানি। তারবাদেও সাহস নিয়েই শুনেছিলাম গান, পেন্ডালের বাইরের জনসমুদ্রের মাঝ থেকে।
ক্বারী আমির উদ্দিনকে তখন ‘আমিরুদ্দিন’ ডাকতেন মানুষেরা, গানবিরোধীরা ব্যঙ্গ করে ডাকত ‘আমিরুদ্দি’। তার নামে উন্মাদ থাকত গ্রামের সহজ-সরল মানুষ। সদ্য কলের-গান পেরিয়ে আসা রেডিও-টেপরেকর্ডারের সেকালে বেশুমার গেঁয়ো মানুষের হৃদয় সহজ কথার গানে, সহজিয়া সুরে জয় করেছিলেন তিনি। বাউলগানে সাধারণদের উন্মাদ বানিয়ে রাখতেন রাত্রির আসরে।
গানপাগল গ্রামের আমমানুষ। আয়োজনের পর চিন্তা কেবল কিভাবে ক্বারীর মালজোড়া, পালা বা একক গান সফলভাবে সম্পন্ন করা যায়। ঠিক তা ভণ্ডুল করার প্রচেষ্টাও নিত স্থানীয় মাদ্রাসার হুজুরগণ। অল্পবয়সী তালেবেইলেমদের মধ্যে ঈমানী জোশ উস্কে দিয়ে তাদের মাঠে ঠেলে দিতে চেষ্টা করা হতো। তবে একটু বুঝনেঅলা তালেবেইলেমরা ‘নাফরমানী’ গানাবাজনা ভণ্ডুলের আন্দোলনে থেকেও মধ্যরাতে পাঞ্জাবি-টুপি গুটিয়ে ক্বারীর গানের মজমায় বসে যেতেন! এই দৃশ্য দেখে তাদের স্বজনরা খোঁটাও দিতেন। চুপ করে ক্বারী আমির উদ্দিনের গান শুনতেন তারা। গান শুনে ইসলামের কি অবমাননা করলেন শিল্পী তা নিয়ে এই তালেবেইলেমদের অনেকে আলোচনাও করত। এ ওর মুখের দিকে চাইত। কোনো উত্তর মিলত না। এসব গল্প আমরা শুনতাম বড়দের মুখ থেকে।
শুধু তালেবেইলেমরাই নয়, স্থানীয় কিছু ধর্মান্ধ মানুষও (যারা ধর্মের কথা বললেও আদতে ধর্মীয় রীতিনীতিবিরোধী কাজই করত) নানা কারণে মৌলভিদের সঙ্গ দিত। এই শ্রেণির সঙ্গঅলাদের বেশিরভাগই গ্রামের সমালোচিত, ঘুষখোর, জিনাখোর, সুদখোর ও দুমুখী স্বভাবের দোনছলা বাটপার মানুষ। এরা ক্বারীর গানের আয়োজন থেকে ছিটকে পড়ে মওকা না-পেয়ে হুজুরদের সঙ্গে ভিড়ত বলে অভিযোগ ছিল কারো কারো। তারা বাইরে শেয়ালের হুক্কাহুয়া করতো। তবে যতই দুয়ো তুলুক-না কেন গানপাগল হাজারেবিজারে মানুষের সামনাসামনি মোকাবেলা করার হিম্মত তাদের থাকত না। তারা জানত ক্বারীর গান নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে প্রস্তুত স্বেচ্ছাসেবী ডাণ্ডাবাহিনী। তাদের কাছে রয়েছে গু-গোবরের স্প্রে! তাই সাবধান! এই দুমুখোরা উস্কে দিয়েও কেটে পড়ত। গ্রামের প্রভাবশালী মানুষদেরও গানবাজনা বন্ধ করতে সঙ্গে ভেড়াতে চাইত তারা। কিন্তু এই পরিবারের অনেক ‘ঘাড়ত্যাড়া’ বা ‘উফ্রা’ যুবকেরা আয়োজনে যুক্ত থাকায় প্রভাবশালী পরিবারের কর্তারাও চুপ থাকতেন। তাদের গিন্নীরা কানে কানে বলতেন, “ফুয়া ইকানো আছে যাইয়ো না। আমিরুদ্দিন কিতা গান গায় না-বুইজ্যা এমন ফালাফুলি করো”। নিজেদের অনেক স্বজনদের মুখ থেকেই এসব শুনতাম। এতে তার গান শোনার প্রতি আরো প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল।
গানের প্রস্তুতিসময়ের মধ্যেই হুজুরের হুঙ্কারে গানের দিন বিভিন্ন বাড়ির কাঁচা পায়খানা ও গোবর সংগ্রহ করে টিন ভরে রাখার উদ্যাগ নেয় ‘উফ্রা’ যুবকেরা। ক্বারীর একাধিক গানের আসরে এভাবে গু-গোবর ছিটানোর খবরও আমরা ইতোমধ্যে অবগত হই। সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের প্রয়োজনও মনে করতাম না, কেবলই হাসতাম। গান ভণ্ডুলের চেষ্টা হলে তাদের বিরুদ্ধে ছুঁড়ে দেওয়া হতো এই প্রাকৃতিক স্প্রে। মাইকে ক্বারীসাব স্বভাবসুলভ রঙ্গেঢঙ্গে গান গাইতেন। খোঁচা দিয়ে চলতেন নিয়ত। প্রকাশ্যে তাদের ভণ্ডামির সমালোচনা করতেন। তাদের উদ্দেশে বাহাস করার জন্য ওপেন চ্যালেঞ্জও ছুঁড়তেন। তিনি বারবার এই চেষ্টা করলেও বিরোধী কাউকে চ্যালেঞ্জ নিতে দেখা যায়নি। বরং ‘কাফের-মুরতাদ-নাস্তিক’ বলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেন তারা। মুরতাদের সঙ্গে কিসের বাহাস বলে কর্মীদের সান্ত্বনা দিতেন। ক্বারীসাবের লগে মোকাবেলা করার সামর্থ্য তাদের কারো ছিল না। যুক্তিতক্ক তো বহু দূর। নাস্তিক-মুরতাদ ফতোয়ার বাজার তখন প্রসারিত ছিল না। হালের ব্লগারদের মাধ্যমে এবং গণজাগরণ মঞ্চের জন্মের পর বাজারটি সম্প্রসারিত হয়। এর আগে ঘাড়ত্যাড়া বাউল বা ওরস মোকাম সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশে এই ফতোয়া চালু ছিল।
এমন টানটান উত্তেজনার মধ্যেই ক্বারীসাব গান শুরুই করতেন তার সুরেলা কণ্ঠে, আল্লা-রসুল ভজনার মধ্য দিয়ে। জিকিরে মাতোয়ারা হয়ে যেত সামনে-থাকা অধিকাংশ মানুষ। ক্বারীসাবও সুরের তুফান তুলে বেহুঁশ হয়ে যেতেন। বেফানা মানুষজন তখন তার গানে উন্মাদ। জাগতিক কোনোকিছুতেই কুচ পরোয়া নেই তাদের। কেন এমন উন্মাদ হতো সাধারণ মানুষ কিছুই বুঝতাম না। তবে এটুকু আঁচ করতে পারতাম, সহজ-সরল কথা ও সুরের গানে তিনি তাদের সবার হৃদয় জয় করতে পারতেন। সাধারণের জন্য লেখা সাধারণ কথামালা। সহজ সাধনাই যে এই সাধারণের পথ। আমমানুষেরও এই সহজ-সরলতাই পছন্দ।
যতদূর মনে পড়ে আমার গ্রামের পাশের সরদারপুর বা ধনপুর গ্রামে ক্বারী আমির উদ্দিনের গানের ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। টিকেট কেটে বাউলগান দেখতে সাধারণ মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। কেন দলে দলে মানুষ সাধারণ বাউলগান শুনতে আসছে, আমার মনে প্রশ্নের উদয় হয়। কি আছে শাদামাটা কথার এই গানে? আর ক্বারীরেই বা কেন ভয় পান তিনারা? এসব ভাবনা মনে ঘুরপাক খেতো।
পেন্ডালের একদিকে দুইধাপের প্রবেশপথ। দুইদিকে টিকেট কাউন্টার। আশপাশের গ্রাম ভেঙে মানুষ ছুটে আসতে শুরু করে বিকাল থেকেই। টিকেট কেটে যত মানুষ ভিতরে ঢুকেছে তারচেয়ে বেশি মানুষ মাঠের বাইরে অপেক্ষমান। কান পেতে অপেক্ষায় তারা ক্বারীর সুরেলা কণ্ঠে অবগাহন করবে। আমরাও বালবাচ্চারা বাইরে গানশোনার জন্য ক্ষেতের আইলে বসে ছিলাম। কখন গান শুনতে পাব সেই প্রতীক্ষায়, উত্তেজনায় যেন প্রহর থম মেরে আছে। মনে আছে বিরোধীদের আস্ফালন। তাই চোরা ভয় কাজ করছিল ভিতরে। বুকে ফুঁ দিয়ে সেই ভয় তাড়িয়ে দিয়েছিলাম!
প্রায় দেড়কিলোমিটার দূরে আমাদের বাড়ি। ভাগ্নে আলী আমজাদ, বন্ধু আজিম, সাজু সহ কয়েকজন মিলে ক্বারী আমির উদ্দিনের গান শুনতে রওয়ানা হই রাতে। পরিবারের চোখ ফাঁকি দিয়ে। বাবা-চাচা-ভাইদের চোখ এড়িয়ে টিপিটিপি পায়ে সন্ধ্যায় আমরা রওয়ানা দেই, ২০-২৫ মিনিটের মধ্যেই মাঠে এসে পৌঁছি। মাঠে তখন উত্তেজনা চলছে। শত শত যুবক নির্বিঘ্নে গানের অনুষ্ঠান চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। কারো হাতে লাঠি। গান করার হিম্মত ঝরছে কথায়। অন্যদিকে বাজারে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার কিছু ছাত্রদের নিয়ে ক্বারীর গানের বিরুদ্ধে গলা-ফাটানো বক্তৃতা চলছিল। তাদের ঈমানী জোশ এতটাই তুঙ্গে যে, হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে ক্বারীর অনুষ্ঠান।
রাত যত গভীর হচ্ছে লম্ফঝম্প তত বেড়েই চলছে। তবে বিপরীতে লাঠি-হাতে দাঁড়িয়ে-থাকা শত শত ঘাড়ত্যাড়া যুবকের প্রস্তুতির কথা জেনে মাঝেমধ্যে তাদের জোশ থেমে যাচ্ছিল বলে মাঠে খবর আসছিল। ধর্মীয় রীতিমতো মসজিদের বিষয় ছাড়া মাইক অনুমতি ধর্মে নিষিদ্ধ থাকলেও গানবাজনা বন্ধ করনেঅলারা সেই বিধি না-মেনে কানফাটা চিৎকারে উত্তেজনার পারদ বাড়িয়েই যাচ্ছিলেন। গান শুনতে আসা ‘অশিক্ষিত’ মানুষেরা এসব নিয়েও কথা বলছিলেন। আমরা গান শুনতে এসে আমজনতার কাছ থেকে ধর্মীয় ফতোয়াও অবগত হই!
উত্তেজনার মধ্যেই ক্বারীসাবের গান শুরু হয়। গানের ফাঁকে-ফাঁকে কোরান-হাদিসের সম্প্রীতির বাণী তিনি তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে শ্রোতাদের শুনিয়ে যান। সঙ্গে যুক্তিপূর্ণভাবে চোদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেন ভণ্ডদের। এতে তুমুল হাততালি পড়ে। ঈমানী জোশের কাছে সংগীতজোশও যেন কম নয়। মাঠে খবর আসে, রাত যত গভীর হতে থাকে গানবিরোরধীদের মজমা তত কমতে থাকে। না-বুঝনেঅলা তালেবেইলেমরাও নাকি টুপি খুলে পাঞ্জাবি গিট্টু দিয়ে ক্বারীর গান শুনতে এসেছে। একপর্যায়ে নাই হয়ে যাবে এই ভয়ে ভীরু পায়ে তারা গানভঙ্গ করতে এগিয়ে আসতে থাকে। পেন্ডাল থেকে অনেক দূরে তাদের জিকির শুনেই গু-গোবর নিয়ে প্রস্তুত যুবকেরা। যেই তাদের শব্দ শোনা গেল অমনি বৃষ্টির মতো ছোঁড়া হলো গু-গোবর। ওহ্! সে-যে কী দুর্গন্ধ! লাঠিগল্লার প্রয়োগ না-করেই ডাণ্ডাবাহিনী সহজেই সামাল দিলো পরিস্থিতি। গু-গোবরের গন্ধেই দিগ্বিদিক পলায়ন করে তারা। মুহূর্তেই নাই হয়ে যায় জমায়েত। থেমে যায় উত্তেজনার তকবির। বিপরীতে ক্বারীর কণ্ঠে বাড়তে থাকে রহিমুর রহমানের বন্দনা। মনপবনে আরশ-এ-মুআল্লা কাঁপানো সেই বন্দনায় উত্তেজনার মাঠে হঠাৎ নীরবতা নেমে আসে। হঠাৎ সুর কান্নায় রূপ নেয়। সুরেসুরে বেহুঁশ হন ক্বারী। ‘ঈকার’ দিয়ে ওঠে মাঠের জনতা।
ভিতরে ঢোকার সুযোগ না-পেয়ে আমরা বাইরেই খেতের আইলে বসে গান শুনছি। এর মধ্যে উত্তেজনায় আমরাও কাঁপতে থাকি। দৌড়াতে হবে এই ভয়ে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে প্রস্তুতও। আমজনতাকে পাগল-করা ক্বারীসাবের জয় হয়। গানের তুফান উঠতে থাকে মাঠজুড়ে। রাতের নীরবতায় কইলজাছেঁড়া বিচ্ছেদী গানে সুর তোলেন ক্বারী। মাঝেমধ্যে কিছকামি (সমাজের অসঙ্গতি নিয়ে রচিত গান) হাজার হাজার শ্রোতাদের গেয়ে শোনান। নানা ধরনের নানা রঙের গানে মজমা জমে ওঠে বেশ। আসরে এসে আমমানুষের জ্ঞানগরিমা বোঝারও সুযোগ পাই আমরা।
কিছু মুরুব্বি বা প্রাপ্তবয়স্ক যুবকেরাও বাইরে গফসফ করছে। হয়তো পকেট খালি থাকায় অথবা কোনো কারণে সুযোগ না-পেয়ে তারা বাইরে থেকেই গান শুনছে। দ্বিধাদ্বন্দ্বে-ভোগা কিছু যুবকও অবশেষে আমতা-আমতা করে বলতে থাকে, “আমিরুদ্দিন তো খারাপ কুন্তা গায় না। মোল্লারাউ বেজাল করে কেনে?” আরেক মধ্যবয়স্ক লোক বলেন, “ইতা খইয়া লাভ নাই। মোল্লারার হিম্মত নাই ক্বারীর লগে মোলাকাত করার। এরা খামোখা ফাইল্যায়।” তিনি আরো এককাঠি এগিয়ে বলেন, “এমন কিতা গাইছে আমিরুদ্দিন ফায়পুরুতা খারাপ অইজিব? পরের বাড়ি খাইয়া-খাইয়া আর কোনো খাম নাই তারার।”
সেই কৈশোরে, সংগীতের উল্টাসিধা কিছু বুঝবার আগেই, গ্রামের সাধারণ মানুষজনকে মনে হয়েছে লোকসংগীত বা বাউলগানের প্রধান সমঝদার। নিজের মতো ব্যাখ্যা করে নেন তারা প্রতিটি গানের। কখনো হাসেন, কখনো চিন্তায় ঝিম মেরে যান। আর সুরের বুদবুদে কেমন-কেমন মনমরা হয়ে যান। কেউ বিচ্ছেদী গানে চোখ ভেজান। কেউ-বা কিছকামি গানে হাসিতে ফেটে পড়েন। কেউ-বা বিরহ-মিলনের গানে উতলা হন।
বাইরের লোকদের এই পাঁচমিশেলি গায়গল্পের মাঝেই ক্বারীসাব টান দেন ‘ও মিয়াছাব বিছমিল্লাহ জানোনি’। প্রথম লাইন শেষ না করতে করতেই পুরো পেন্ডাল উম্মাত্তি (বিকট কোরাস শব্দে হল্লা করে) ওঠে। বাইরের মানুষজনও ভেতরের পরিস্থিতি অনুধাবন করে সেই চিৎকারে শরিক হন, বুঝে না-বুঝেই। মানুষের উন্মাদনায় গানের সুর-কথা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। আকাশও হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আশপাশের মানুষগুলো এ ওর দিকে চায়। এভাবেই ক্বারীগানে কাছে-দূরে থেকে সঙ্গ দেন তারা। একসময় গানের চেয়ে বাইরের মানুষদের ক্বারীসাব, তার গান ও জগৎসংসারের বিচিত্র জিনিশ নিয়ে ডায়লগ করার দিকে আমার কিশোরমন চলে যায়। কী ভারী ভারী কথা আমমানুষের! এই লুঙ্গি-স্যান্ডেলের মানুষ এত জানেন বাউলগান বিষয়ে? কৈশোরে মনে হয়েছে, এরাই লোকায়ত গানের প্রকৃত সমঝদার ও দরদি শ্রোতা। কত জান্তা তারা! তারাই মূলত পরম্পরায় মুখে মুখে ফেরি করছেন মূল সুরের লোকগান। তাদের কল্যাণেই প্রকৃত বাউলরা প্রকৃত মর্যাদা পেয়ে থাকে।
আমাদের পাশের বাড়ির ফরিদভাই, যাকে আমরা ফয়জুদ্দিনভাই ডাকতাম, তিনি গত অক্টোবর মাসে মারা গেছেন। বিভিন্ন স্থানে পালা করে ঘুরে বেড়ানো ফয়জুদ্দিনভাইর লগেও ক্বারীসাবের পরিচয় ছিল। তিনি বাড়ি আসলে ক্বারীসাবের গল্প করতেন। তার ৫৪৩ মডেলের ন্যাশনাল টেপরেকর্ডারে ক্বারীর গান শোনাতেন। তিনি বাড়ি আসলেই আমি ক্বারীর গান শোনার জন্য হানা দিতাম। ক্বারী আমির উদ্দিনের অন্তত ৩০টিরও অধিক একক-ডুয়েট গানের ক্যাসেট ছিল ফরিদভাইর কাছে। ফরিদভাই জীবনের প্রয়োজনে গানবাজনা ছেড়ে দিয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শহরের একটি আবাসিক হোটেলে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে ক্বারীর লগে সান্নিধ্যের কথা কখনো ভুলেননি। আমিও কৈশোরের ক্বারীর গান শোনার প্রসঙ্গ তুলি। তিনি তৃপ্তি পান। অতীত গহন থেকে তুলে আনতেন কিছু ম্লান স্মৃতি।
প্রায় ২০ বছর পর ক্বারী আমির উদ্দিনের আসরের গানের সমঝদার এক বন্ধু আমাদের আরো কিছু অভিজ্ঞতা বলতে থাকেন। সুনামগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের প্রথম যৌবনের বন্ধু ক্বারী আমির উদ্দিন। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার টুকেরবাজার এলাকায় ১৯৭৪ সনে গান গাইতে এসে পরিচয়। সেখানে হুজুররা ফালুম-ফুলুম করলে সুফিয়ান সহ ‘রগত্যাড়া’ যুবকেরা প্রতিরোধ করে দাঁড়িয়েছিলেন। তখনও আমিরুদ্দিন নামকরা আমির উদ্দিন হয়ে ওঠেননি। একহারা লিকলিকে গড়নের এক ছেলে : বাউল সফর আলী, দুর্বিণ শাহ, শফিকুন্নুরের লগে ঘুরে বেড়াতেন ভেলা (বেহালা) নিয়ে। এমনই একদিন টুকেরবাজার এলাকায় গান গাইতে এসে শফিকুন্নুর দেখা করেন আবু সুফিয়ানের জগাইরগাওস্থ মিলঘরে। এই মিলঘরে জম্পেশ আড্ডা দিতেন সুফিয়ান। ওরসের লোক আর গানের লোকেই ভরা থাকত মিল। আসরে গান গাইতে এসেছিলেন আমির উদ্দিন। অন্যান্য সিনিয়র শিল্পীদেরকে আয়োজকরা সম্মানী দিলেও আমির উদ্দিনকে কোনো সম্মানী দেয়া হয়নি। পূর্বপরিচিত হওয়ায় আবু সুফিয়ানকে খুঁজে মিলঘরে আমির উদ্দিনের গানের আসর নিয়ে কথা বলেন তারা। বাউল শফিকুন্নুর অুনরোধ জানান, সুনামগঞ্জ শহরে আমির উদ্দিনের একক গানের আয়োজন করার। পরে সুনামগঞ্জের যুবনেতা মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার বখত নেক সহ শহরের কয়েকজন যুবকের মাধ্যমে একরাতে ঘরোয়া একক গানের আয়োজন করা হয় আমির উদ্দিনের। আমির উদ্দিনের ভরাট গলার গান শুনে শহরের বাউলগানের শ্রোতা ও বোদ্ধা সবাই মুগ্ধ। পরে ওই আসর থেকেই আমির উদ্দিন আলমপুর এলাকায় গান গাওয়ার আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ পান। ওই অনুষ্ঠান ভণ্ডুল করতে আসেন গ্রামের কিছু মানুষ। পরে আবু সুফিয়ান, মনোয়ার বখত নেক সহ যুবকেরা শহর থেকে গ্রামে গিয়ে স্থানীয় যুবকদের নিয়ে ওই অনুষ্ঠান সফল করেন।
আমির উদ্দিনের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে জেলার সর্বত্র। একপর্যায়ে সিলেট বিভাগে নামডাক হয় তার। পরবর্তীকালে সারা বাংলায় তার বিশাল পরিচিতি ও ভক্তগোষ্ঠী জুটে যায়। দীর্ঘদিন চিঠিচালাচালি ছিল মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান ও ক্বারী আমির উদ্দিনের মধ্যে। সুনামগঞ্জের আশপাশে কোনো অনুষ্ঠান হলেও বন্ধুকে আমন্ত্রণ জানাতেন ক্বারী। স্থায়ীভাবে লন্ডনে চলে যাওয়ার পর আর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ নেই আমির উদ্দিনের।
এখন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আষ্ফালন প্রত্যক্ষ করে যৌবনের এই গায়েন বন্ধুকে মনে করেন সুফিয়ান। তার মতো হাজার হাজার চাষাভূষা মানুষও স্মরণ করেন অকুতোভয় বাউলশিল্পী ক্বারী আমির উদ্দিনকে। যদিও এই প্রজন্মের সবাই ক্বারী আমির উদ্দিনকে চেনা না, তবে লোকসংগীতসচেতন অনেকেই তার গানের খোঁজ করে। তার গানে গেয়ে প্রগতিপ্রিয় জনমানুষ প্রতিবাদ করে ধর্মান্ধতার। তার যৌবনের সেই শত্রুরা যারা সাধারণ মানুষের অসাধারণ গু-গোবরের প্রতিবাদের মুখে পালাতেন তারা এখনো নীরব নয়। সুযোগে এই কুচক্রীরা আমির উদ্দিনের চোদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে। ইনিয়েবিনিয়ে বলে, ক্বারী আমির উদ্দিন টাকা পেয়ে খ্রিস্টান হয়ে গেছে! এই গাঁজাখুরি গল্প অনেকেই এখনো বলে বেড়ায়। হাটেঘাটে শুনতে পাওয়া যায় তাদের মিথ্যা বর্ণনা। অথচ কেউ জানল না বৃহত্তর সিলেটে প্রথম কোনো বাউল যিনি প্রকাশ্যে মৌলবাদ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে দেশছাড়া হয়েছিলেন।
গত বছর লন্ডনপ্রবাসী বন্ধু এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক, কবি ও নির্মাতা আ স ম মাসুমকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ক্বারী আমির উদ্দিনের বিষয়ে। সে জানাল, ৪-৫ বছর আগে ক্বারী আমির উদ্দিনের একটি ইন্টার্ভিয়্যু করেছিল চ্যানেল এসে। গানবাজনা নিয়েই ব্যস্ত আছেন ক্বারী, নীরবে। এখনো ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সোচ্চার। ধর্মের এবং শান্তির ও সম্প্রীতির বাণী এখনো তিনি ফেরি করেন। গানে আর সুরে। মানুষকে মানুষ হয়ে ওঠার, মানুষের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।
কৈশোরের সেই রাতটি এখনো আমি বুকের গহীনে বাজাই। পুলকিত হই স্মৃতির জাবর কেটে। সে-রাতে কেবল ক্বারী আমির উদ্দিন ভরাট কণ্ঠে গানই গাননি, আমার মনটিও বাউলগানের সঙ্গে চিরতরে বেঁধে দিয়েছিলেন। তার নিখুঁত হারমোনিয়ামে আমাদের তন্ময় করেছিলেন। মাঝেমধ্যে বেহালায়ও যে টান দিয়েছিলেন বাইরে থেকে অনুধাবন করেছি। সে-রাতে শুনেছিলাম নবি মুহম্মদকে নিয়ে লেখা তার অসাধারণ গান ‘লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে’, ‘শা-জলালের পূণ্যভূমি নাম জালাল শরিফ’, ‘শিখাইয়া পিরিতি, করিল ডাকাতি’ ‘আমারে খুঁজিয়া দেখি আমি নাই’, ‘ও মোল্লা তর নাই কল্লা’, ‘ ও মিয়াছাব বিসমিল্লা জানোনি’, ‘আমানত খিয়ানত অইব রে, ও-ভাই কিয়ামতের আলামত আইব রে’, ‘এমন এক রূপসী কইন্যা’ ও ‘দইকনর বাড়ির নানী গো’ সহ আরও বেশকিছু গান। অন্য বাউল-মহাজনের গানও তিনি করেছিলেন। এই আসরে উপস্থিত আমাদের গ্রামের বশিরভাই ক্বারী আমির উদ্দিনের কয়েকটি গান শিখে এসেছিলেন। অনেকবার তিনি আমির উদ্দিনের কণ্ঠ ও গলা নকল করে সেই গান আমাদের শুনিয়ে আনন্দ দিতেন।
কৈশোরের এমন উন্মাদ রাত আর আমার জীবনে আসেনি। বুকে দিরিম-দিরিম উত্তেজনা এখনো টের পাই। উত্তেজনার মধ্যে যে অমৃতরস আস্বাদন করেছিলাম তা এখনো সমান তৃপ্তি দেয়। সেই রাতে আমার মধ্যে অসাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনে দিয়েছিলেন ক্ষণজন্মা এই বাউল মহাজন ক্বারী আমির উদ্দিন।
সেই মাতাল রাতে কিছু আমপাবলিকের মুখ থেকে আমির উদ্দিনের গান শোনার পর তাদের নিজেদের ভারী বিষয়ে কথোপকথন শুনেছিলাম। দুই দশকেরও বেশি আগের সেই গফসফ অনেকটাই মনে নাই। যে-দুয়েকজনকে চিনতাম স্মৃতি হাতড়ে তাদের বয়ানে সে-রাতের বাউল আমির উদ্দিনকে নিয়ে কিছু ওজনদারী কথা আমাকে এখনো ভাবায়।
আমপাবলিক তারা, জ্ঞানী মানুষ তাদেরে এমনটি ডাকেন। কোনো পড়াশোনা নাই। কেবল জীবনের পাঠ থেকেই তারা মূল্যায়ন করলেন ক্বারী আমির উদ্দিনের গানকে। একজন কিশোর এই কথার গূঢ়ার্থে ঢুকতে না-পারলেও এই মাটিমূলবর্তী আমজনতার জ্ঞানের পরিধি ঠিকই তাকে পরবর্তীকালে নাড়া দেয়। ক্বারীর গান শুনে ফাঁকে ফাঁকে নিজেরা বলাবলি করছিলেন তারা। নিজেদের মতো ব্যাখা দিচ্ছিলেন।
জয়নগর বাজারের ব্যাটারিচার্জ দোকানদার ও মাইক ব্যবসায়ী চান মিয়া, যার মূলত পেশা রেডিও-টেইপের মেইকারি করা। গান শুনছেন আর বন্ধুদের লগে ক্বারীর গানের বিষয়ে কথা বলছেন, তারিফ করছেন, “ফুনরায়নি, কিজাত কথা কর। জ্বিনভূতের কথা কর-না, মানুষের কথা কর। ফুনরায়, মাটির মানুষরে কত বড় কইরা দেখে হে। কুনু মোল্লা ইতা পারবনি? মাইনষের বাড়ি খাইয়া তো ইতার লাজলজ্জা নাই, ফকিরের থাকিও অধম অইগিছে। কিন্তু ক্বারীর কাছে মানুষ সত্য, মানবতা সত্য।” আমপাবলিকের মুখে এমন কথা শুনে আমার তেমন ভাবান্তর হয়নি। কারণ এগুলো গ্রহণের বয়স ও জ্ঞান কোনোটাই আমার তখন নাই। তবে মনে হয়েছিল শক্তিশালী কথা বলেছেন তারা। কী সাংঘাতিক সমস্ত কথা!
তার পাশেই চিল্লাচিল্লি করছিলেন আরেক ব্যক্তি। মনির উদ্দিন। এক/দুই লাইন বাউলগান জানেন। পুরোপুরি বাউল বা শিল্পী নন। কিছু পরিচিত গান জানেন, এই-আর-কি। তিনিও চান মিয়ার সঙ্গে যোগ দেন। “দেখো দেখো ক্বারীরে, তার উস্তাদরে কিলা ভক্তি করের! উস্তাদের নাম লইয়া সুর তুলছে। যেন উস্তাদের সুরই কণ্ঠে নিছে। আল্লাখোদাভগবানের ধার ধারে না হে। কিলা সহজে তার মনের ধনরে ছার। মারামারি না, কাটাকাটি না, হে মাইনষের মাঝে মিলন চার।” হুজুরদের গালি দিয়ে বলেন, “হেরা যে কেনে ঝামেলা করে! শান্তিতে গান ফুনতে দেয় না, হে কত সুন্দর হিন্দু-মুসলমান, খ্রিস্টান-বৌদ্ধর মিলনের কথা খর।”
মনির উদ্দিনের কথার আগামাথা না বুঝলেও পরবর্তীকালে মনে হয়েছে বাউলরা যে পরম্পরায় নিজেদের ভাবনা ফেরি করেন সেটাই সেদিন মনির উদ্দিন ওস্তাদরে স্মরণ করার কারণে বলেছিলেন। তারা যে বাকাত্যাড়া ধর্মীয় কিতাবী পথে না গিয়ে সহজে আরাধ্য সাধনাকে কামনা করে, জাতিধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানবতার পথে হাঁটে সেটাই যেন সঙ্গীদের বলছিলেন নিরক্ষর মনির উদ্দিন।
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমি সেদিন আমার মনোজগতে একটি বাউলছবি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। জাতিধর্মবর্ণবিত্ত ভেদমুক্ত অসীম মানবজীবন ও লোকসমাজ যে তাদের কামনা সেদিন পুস্তকি দুনিয়ার বাইরের মানুষের কাছ থেকে বুঝতে শিখেছিলাম। তাদের বাস যে অলৌকিক ঊর্ধ্বলোকের বদলে মানুষের অন্তর্লোকে সেদিন ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে শিখিয়েছিলেন তারা। সেই মানুষদের কাছে আমি আজন্মের অশেষ ঋণী।
… …
- গুরুদক্ষিণা || শামস শামীম - July 1, 2024
- পাগলের জন্য অপার হাওর চোখের পানি || শামস শামীম - May 3, 2024
- নভেম্বর হাহাকার || শামস শামীম - November 20, 2021
COMMENTS