এই সংকলন করা ছিল একটা অভিজ্ঞতা; প্রতি পদে কিছু অজানাকে জানা, কিছু ভুলজানাকে শুধরানো আর কিছু অসম্ভব গুণী মানুষজনকে কিছুটা চেনা, কিছুটা জানা; তাদের সেই ইতিহাস গড়ার সময়টাকে। সেখান থেকে এখন।
যাদবপুরে ঢোকা থেকে যে-গানকে প্রায় অ্যান্থেম জেনেছিলাম, মেনেছিলাম, যে-গান তৈরি করে, বদলে দিয়েছিল অনেককিছু, কিন্তু তার স্রষ্টাকে জানিনি, স্রষ্টা কে — জানিনি, শুধু মহীনের গান বলেই জেনে রেখেছি, মনে রেখেছি, সেই ড. দিব্য মুখার্জির সন্ধান যখন পেলাম, এই সংকলনসূত্রে, আলাপ হলো, কথা বললাম, এই লেখা পেলাম, লেখাসূত্রে আরো কথা, আরো জানা, বহু লোকজন মিলে সেই একটা পেপার লেখার, রিভিয়্যু করার মতো সেই দিনরাতগুলো, সে কি আলাদা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে না?
গানটার মতোই। সেই প্রথম গান, যাতে কবিতা খুঁজে পেয়েছিলাম। সেই প্রথম কবিতা, যা গান হয়ে উঠেছিল। সেই ঠিকানাহীন বাড়ির গান, যে-বাড়িকে শূন্যে খুঁজে বেরিয়েছি। লাল সুরকির পথ ছাড়াই। দিব্য মুখোপাধ্যায়ের সেই গান —
আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি
দেখা যায় তোমাদের বাড়ি
তার নীল দেওয়াল যেন স্বপ্নবেলোয়ারী
তার কাচ দেওয়াল যেন স্বপ্নবেলোয়ারী
আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি
দেখা যায় তোমাদের বাড়ি …
চিলেকোঠায় বসা বাদামী বেড়াল বোনে শূন্যে মায়াজাল
ছাইরঙা পেঁচা সে চোখ টিপে বসে আছে কত-না বছরকাল…
কালো দরজা খুলে বাইরে তুমি এলে
বাগানের গাছে হাসি ছড়াবে বুনোফুলে
সেই বাড়ির নেই ঠিকানা
শুধু অজানা লাল সুরকির পথ শূন্যে দেয় পাড়ি
সেই বাড়ির নেই ঠিকানা
শুধু অজানা লাল সুরকির পথ শূন্যে দেয় পাড়ি
বাঁধানো সিঁড়িপথে সেখানে নেমে আসে চাঁদের আলো
কাউকে চেনো না তুমি তোমাকে চেনে না কেউ সেই তো ভালো
সেথা একলা তুমি গান গেয়ে ঘুরেফিরে
তোমার এলোচুল ঐ বাতাসে শুধু ওড়ে …
সেই বাড়ির নেই ঠিকানা
শুধু অজানা লাল সুরকির পথ শূন্যে দেয় পাড়ি
আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি দেখা যায় তোমাদের বাড়ি …
সেই দিব্য মুখোপাধ্যায় লিখলেন মহীন নিয়ে, তাঁদের বছর কুড়ি পরে মহীন সম্পাদিত গান নিয়ে :
শুধু আজ নয় প্রতিরাত, তোমাদের পরকাল ভেবে
তোমাদের কথা ভেবে ঘুমহীন রাত জাগি — নগরবাসীরা শোনো
তোমাদের অন্যায় আমাদের অবহেলে মিশে কোন নরক মাতায়
তা জানো কি?
শোনো সুধীজন … শোনো প্রিয়জন …মহীনের ঘোড়াগুলির গান যারা শুনেছেন তারা এই অসম্ভাব্যতার, বাস্তব থেকে পরাবাস্তবতার দোলাচলে মানিয়ে নিতে স্বভাবতই প্রাথমিকভাবে অস্বস্তি বোধ করে থাকবেন। কারণ হয়তো নিহিত আছে এই সান্ধ্য ভাষার অবলোকনের মধ্যে দিয়ে, আপাত জীবনধারণের ছিঁড়েখুঁড়ে-যাওয়া ওই নির্দিষ্ট সময়ের চলচ্ছবি ফুটে ওঠা — যা সেই সময়ের শ্রোতাদের কাছে প্রথম দর্শনে অস্বস্তিকর খটকা লাগা স্বাভাবিক, যার কারণ, তুলনামূলকভাবে একই সময়ের প্রচলিত বাংলা গানের ভাষা পাশাপাশি ফেললেই বোঝা যাবে। সাধারণের কাছে তাই প্রশ্ন থেকে গেছে হয়তো, যে এরা কী বলতে চাইছে? কিংবা এভাবে বলছে কেন? ফিরে দেখলে বোঝা যাবে, ভাষার বিবর্তনের সাথে সাথে বাংলা গানের ভাষা যেভাবে পাল্টেছে তাতে মহীনের ঘোড়াগুলির গান হয়তো থেকে গেছে একটি মাইলস্টোনের মতো, যে-মাইলস্টোনকে সাধারণ শ্রোতা বুঝতে সময় নিয়েছে অনেক, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের পালাবদলে সময় লেগে গিয়েছে হয়তো প্রায় তিনটি দশক। ভাষার চমৎকারিত্বের চেয়েও, নতুন বাংলা গানের ভাষার অভিনবত্ব বুঝতে হয়তো বহু সময় গিয়েছে, কিন্তু তাদের কাজ থেমে থাকেনি। সাময়িক বিরতি হয়তো ছিল, ছিল কিছুটা অভিমানে সরে যাওয়া —
বন জানে, অভিমানে গেছে সে অবহেলে
যে গেছে অশ্রুময় বনঅন্তরালে
যে গেছে অশ্রুময় বনবীথিতলে …
এই লেখার অন্তিমে, উপরোক্ত অনুচ্ছেদে, দিব্য মুখোপাধ্যায় লিখিত রচনার একাংশ উদ্ধৃত হলো, রচনাটি ‘অ(ন)ন্য মহীন’ সংকলনে লভ্য। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী হিরণ মিত্র। বইটি গুরুচণ্ডা৯ প্রকাশনা ভারত থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
[দ্রষ্টব্য : ‘অ(ন)ন্য মহীন’ সংকলন তৈয়ারি ও প্রকাশের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িতদের একজন হিশেবে লেখক মিতভাষে এই রচনাটি লিখেছেন এবং গানপারে প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন — গানপার]
… …
- দিব্য ঘোড়াগুলি || ঈপ্সিতা পাল - August 14, 2018
- গাহি নজরুলের গান || ঈপ্সিতা পাল - May 28, 2018
COMMENTS