হারানো হিরোর গল্প, একটা গান ও ঢাকাই সিনেমার একদা উত্থান ||  প্রাণকৃষ্ণ চৌধুরী

হারানো হিরোর গল্প, একটা গান ও ঢাকাই সিনেমার একদা উত্থান ||  প্রাণকৃষ্ণ চৌধুরী

ভায়োলেন্সের পর ভায়োলেন্সে রোমান্টিকতা বিস্মৃত হয়ে যাওয়ার সময়ে, শাহরুখ আমির সালমান অজয় দেবগনের মতন রোমান্টিক হিরো মারদাঙ্গা ইমেজ তৈরি করতে শরীর সিক্সপ্যাক করে জানপ্রাণ সঁপে দেয়ার সময়ে, এমনকি এও বলা যায় যে দুনিয়াবি ইন্ডাস্ট্রিবেইজড সিনেমায় রোমান্টিক হিরোদের মরণদশার সময়ে ঢাকাইয়া সিনেমার ‘সবেধন নীলমণি’ এক লিজেন্ডারি হিরোকে নিয়ে কথা বলার কি মানে থাকতে পারে! মানে কি এই যে, এই হিরো থাকলে আমাদের সিনেমায় হেনতেন কতকিছু ঘটতে পারত — সেই আকাশপাতাল চিন্তার বিস্তার ঘটানো, নাকি কথার কথায় সেই অব্যক্ত কান্নাটাকে ছড়িয়ে দেওয়া যাতে আমরা নিজেরা যার যার ব্যক্তিগত জীবনে হিরো হয়ে উঠতে না পারার ব্যক্তিগত ও সামাজিক ব্যর্থতাকে উদযাপন করতে পারি। বাঙালির শত বছরের দুঃখবিরহকাতরতার যথাযথ মূল্য যোগাতেই কিনা তার সাহিত্যের হিরো রাজনীতির হিরো এবং সিনেমার হিরো ঘাতে-অপঘাতে মারা যায়!

এ যুগের শাজাহান আমি যে তোমার
তুমি আমার মমতাজ
এ বুকে যমুনা তাজমহল
প্রেম দিয়ে গড়েছি আজ।

আমার হৃদয়সিংহাসনে
তুমি যে এক মহারানী
একটি প্রজা তোমার সেবায়
সে-ই তো আমি এই-তো জানি।

আমার মনের লাল গালিচায়
রাখো তোমার কোমল চরণ
ধন্য করো জীবন আমার
এই তো আমার সুখের মরণ।

ঢাকাইয়া সিনেমায় সালমান শাহ ফ্যাক্ট এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে তাঁর অভিনীত সিনেমার গানকে দর্শক নায়কের গান হিসেবেই গ্রহণ করত; এমনকি কখনো কখনো গানের দৃশ্যায়নে তার উপস্থিতি বা লিপ ইউজ না হলেও সেই গান হয়ে থাকত সালমানের সিনেমার গান। সালমানকাল্ট যে-কয়টা ফ্যাক্টের নির্ভরতায় সৃষ্টি হয়েছিল তার অন্যতম ছিল সালমানের দ্রুত প্রভাববিস্তারী উপস্থিতির সাথে মানানসই গানের উদ্বোধন। আগুন, এন্ড্রু কিশোরের মতন স্পেশাল ইফেক্টের গলার সাথে সালমানের হিরোয়িক সিমিলারিটি একটা ‘ইউরেকা’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু নায়কের চেহারা আর শিল্পীর ভয়েসের চমৎকার যোগসাজশ হলেই তো হলো না, গানের কথা ও সুরবাহী হয়ে যে চিন্তা তখন প্রকাশিত হতে চেয়েছে সেটাই তো ছিল মূল কারিগর। বাংলা সিনেমায় সালমানের আগমন বোম্বে বা বলিউডি ফিল্ম রিমেক করার সূত্র ধরে এবং বলাবাহুল্য সালমানের জীবনকালের সাড়ে-তিনবছরের সাথে মৃত্যর পরের আরো সাড়ে-তিনবছর মিলিয়ে এই অর্ধযুগের বেশি সালমানীয়তা এই দেশের বাণিজ্যিক সিনেমার জন্য ছিল বলিউডের বিভিন্ন আইডিয়াকে গ্রহণবর্জনের মাধ্যমে নিজস্ব বলয় তৈরি করার সময়।

সোভিয়েত পতনের নিরুৎসাহী বাস্তবতা আর এরশাদ পতনের আশাপথের সাথে ওপেন ইকোনোমির যে নয়া আইডিয়ার আমদানি ঘটল তার আশানিরাশার ডামাডোলের মাঝে আমাদের শিক্ষিত ও আধাশিক্ষিত তারুণ্য একটা মানসিক মুক্তি চাইছিল তখন। সালমানের সিনেমায় তরুণদের একটা বিরাট অংশ সেই মোহমুক্তির আস্বাদ পাইল। সালমানের গ্ল্যামার ফ্যাশন অ্যান্ড স্টাইলিশ অ্যাক্টিং তরুণদের জীবনযাত্রায় একটা স্ট্যান্ডার্ডিটি এস্টাব্লিশ করল। আর এর মধ্য দিয়ে বলিউড রিমেক করার পরপর যেন সে আবার বলিউডের প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়ে উঠল। ঢাকাইয়া সিনেমার জন্য এ এক অসাধারণ ঘটনা এবং সেদিনের নতুন হিরো নতুন হিরোইন নতুন মিউজিশিয়ান নতুন ফিল্মডিরেক্টার সবাই মিলে এ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার জন্ম দিয়েছেন।

এ গানটির আয়োজনেও বলিউডি ধাঁচের সাথে বাংলা গানের ঘরানা বাহিরানার বহু টুইস্ট দেখা যায়। গানের কথাগুলিকে শাজাহান-মমতাজের প্রচলিত স্টোরির বিনির্মাণ (দেরিদাকে মনে না রেখেও এই কাজ করা যায়!!) বলা যায়। পিয়ানো ও ড্রামের ব্যবহারে হিন্দি ফিল্মী স্টাইলে একটা ড্যান্সিং অ্যাটিচিউড তৈরির চেষ্টা আছে বারবার। গানটাকে নাচের করে তোলার এই অতিপ্রচেষ্টা খুব সহজেই লক্ষণীয়। বাংলা মেলোডি যে সহজে ড্যান্সের সাথে যায় না সেই সমস্যাটা এইভাবে সমাধান করে ফেলার চেষ্টা সেটা গানের জন্য ভালো কি মন্দ হোক এই গানে সচেতনভাবে করা হয়েছে। এবং শুধু এই গান নয়, এই ধরনের অসংখ্য গানে বলিউডি রেশের ঢুকে-যাওয়া এবং বেরিয়ে-যাওয়া অহরহ ঘটেছে। বিশেষত সালমানের ক্ষেত্রে এই গ্রহণবর্জনের ব্যাপার সবচে বেশি পরিমাণে ঘটেছে। কারণ তাকে নিয়ে যে পরিচালকেরা সিনেমা করেছেন বলিউডের প্যারালাল হয়ে ওঠার একটা আকাঙ্ক্ষা তাঁরা সজ্ঞানে পোষণ করতেন এবং সালমান নিজেও এই আকাঙ্ক্ষায় গভীরভাবে উজ্জীবিত ছিল। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় তাঁর ইন্ট্রোডিউসিঙের সময় সে পরিচালককে ‘কেয়ামত স্যে কেয়ামত তক’ সিনেমা বিশ থেকে একুশবার দেখার কথা সগর্বে জানায়। তবে এই বলিউডমুগ্ধতা শেষাবধি তার মধ্যে টিকে ছিল কি না আমরা জানি না, বিশেষত সে যখন বলিউডের হিরোদের থেকেও বেশি মনোমুগ্ধতা জন্ম দিতে থাকল।

তো এই গানে এই ধরনের আরো অনেক গানে এবং সেগুলির সিনেআয়োজনে মিউজিক্যাল সেন্স এবং ফিল্মসেন্স যে এইভাবে পুরা নব্বইয়ের দশক জুড়ে বোম্বেঢাকা ঢাকাবোম্বে করে করে একটা স্বদেশীয় নির্মাণে পৌঁছাতে চাইল সেই গুরুতর ব্যাপারটা আমাদের বাণিজ্যিক সিনেমার ইতিহাসে লিখিত হওয়া জরুরি। এই ইতিহাসের মমতাজ বা মরণজয়ী মরণ হলেন সালমান যিনি বহু আগেই শুধু স্মৃতিময় হয়ে গেছেন আর শাজাহান হলেন ঢাকাই সিনেমার ক্ষয়শীল দর্শকসমাজ যারা আকুল শরীর ব্যাকুল মনের যৌবনকে বিগত করে দিয়ে নীরবে এখন শুধু স্মৃতিতর্পণ করেন। একের পর এক ব্যর্থ সিনেমাচেষ্টায় একের পর এক সিনেমাহ্যল বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময়ে টিভির রিমোট ঘুরাতে ঘুরাতে ক্লান্ত হয়ে আটকে গেলে, “এ যুগের শাজাহান আমি যে তোমার তুমি আমার মমতাজ” — শুনতে শুনতে নিজের ব্যর্থ প্রেম ব্যর্থ জীবনের কথা মনে হয় শুধু তার। আর এইভাবে বারবার মনে হওয়ার গোপন গভীর অসুখই হয়তো আবার উত্তরপ্রজন্মের তুখোড় তরুণকে সংক্রমিত করে যে ইন্ডিয়ান রাঘববোয়াল পুঁজির লগে আমাদের পুটিটেংরা পুঁজির কালচারাল মোটিফগুলা নিয়া গবেষণা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কিন্তু এতসব করে কি আর ঢাকাইয়া সিনেমায় আমাদের শিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত তরুণ-তরুণীর ঈপ্সিত যৌথ মুহূর্ত ফিরে পাওয়া যাবে? পথের মাঝে পথ হারালে আর কি পাওয়া যায়! গবেষণা হোক ইতিহাস লেখা হোক, কিন্তু হিরো তো মইরা গেছে, হিরোরা তো মইরা যাইতাছে। জাতীয়তাবাদী প্রজেক্টের যে বিউটিফ্যুলনেস সংস্কৃতিতে হিরোয়িজম চর্চার বীজতলা তৈরি করে তা আইনস্টাইন কথিত ‘বিস্ট’ হইয়া গেছে। হিরো মরে গেলে সিনেমার আর থাকে কি! তখন পড়ে থাকে ছোট ভিলেনের সাথে বড় ভিলেনের মিলনের নিষ্ঠুরতার ছবি, ছোট পুঁজির সাথে বড় পুঁজির লেনাদেনার রূপ রস স্পর্শ। এইভাবে ভেসে ভেসে কীর্তিনাশা কতদূর যাবে!?

… …

 

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you