বেতার সংগীত বিভাগ || আরিফ সোহেল

বেতার সংগীত বিভাগ || আরিফ সোহেল

[আজি এ প্রভাতে রেডিয়োর স্বর কেমনে পশিল প্রাণের ’পর … না, এমন পঙক্তি রবীন্দ্রনাথ রচেন নাই; কিন্তু একদা আমাদের সকাল শুরু হতো রেডিয়োর সংগীতে – এই কথাটা তো মিথ্যে নয়, – একদা আমাদের দিন শেষ হতো রেডিয়োর গানে ও বাজনায়, একদা আমাদেরে ঘুম পাড়াত রেডিয়োর সংগীতাসর। আর এখন, ইদানীং, এই ২০১৭ সনে এসে কেমন চলছে বেতার বাংলাদেশ? কেমন চলছে বেতারের সংগীত বিভাগ?

চলছে সে, যেভাবেই হোক, এই পরিবর্তিত জমানায় রেডিয়োশ্রোতা কারা বা আদৌ শ্রোতা আছে কি না এবং কি তাদের চাওয়া-পাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের নাগালে কোনো সমীক্ষা হালনাগাদ নাই। বিশেষভাবেই মিউজিক তথা গানবাজনা সম্প্রচারে এফএম রেডিয়ো সম্প্রতি নতুন সময়ের নবীন শ্রোতাদেরে টানতে পেরেছে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু এফএমের এই লিস্নারদেরও মনোযোগ দিয়ে এখনও জরিপ করছি না আমরা, তারা কি শুনছে বা কিসে তারা সাড়া দিচ্ছে – এইসব লক্ষ করে গেলে আমরা আমাদের যাপিত সময়ের আদলটুকু ধরতে পারব। যখন-যেভাবে এবং সম্ভাব্য যত মাধ্যম আছে সেসব থেকে ইঙ্গিত গ্রহণ করেই চিনতে পারব আমরা আমাদের সময়টাকে এবং সেই চিনপরিচয় মোতাবেক আগাবে আমাদের মনন আমাদের যাবতীয় সৃজন।

এহেন প্রত্যয়ের ভিত্তিতে আমরা খোঁজ নিতে চাই রেডিয়োর, টেলিভিশনের, এফএমের এবং অন্যান্য সমস্ত গণসংশ্লিষ্ট সম্প্রচারমাধ্যমের; খোঁজ নিতে চাই সেসব জায়গায় গানের দিনকাল চলছে কেমন এবং শ্রোতাসাড়া তাতে পাওয়া যাচ্ছে কি না। ‘গানপার’ এই দিকগুলো নিয়া ভাবতে চায় এবং এই লক্ষ্যে লেখক-প্রতিবেদক-পাঠক সকলের অনুসন্ধানজাত রচনা আশা করে।

এই রচনাটা, ‘বেতারের সংগীত বিভাগ’ শীর্ষক নিচে পত্রস্ত রচনাটা, পাক্ষিক ‘আনন্দভুবন’ ২ বর্ষ ১৯ সংখ্যা থেকে নেয়া হয়েছে। এইটা ছাপা হয়েছে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে; কাজেই, রিপোর্ট হিশেবে এইটা হালনাগাদ নয়, এখানকার তথ্য ও পরিস্থিতির বিবরণ দুইদশকের পুরনো। সময় গড়িয়েছে এর মধ্যে অনেক এবং বেতারের ভাবগতিকে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে বলিয়া আমাদের নজরে ঠেকে নাই। কিন্তু প্রযুক্তিস্ফীতির সুবাদে সংগীতসম্ভোক্তা বেড়েছে যে, এইটা আমরা খালিচোখেই দেখতে পাই। ইউটিউবে, এফএমে, টেলিভিশনচ্যানেলে এবং এমনকি সেলফোনে গানবাজনারর অনুষ্ঠান প্রযোজনার বহরে-গতরে বাড়বৃদ্ধি দেখেই অনুমান করা যায় কেমন সংখ্যায় বেড়েছে গানশ্রোতা এবং কি তারা শুনছে বা শুনতে চায়। – গানপার]

radio 2.jpg

শুরু থেকেই বেতারে গান অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেই সূচনাসময়েই বেতারে শিল্পীসংকট ঘোচানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এমনকি নিষিদ্ধপল্লির মেয়েদের দিয়েও নারীকণ্ঠের অভাব পূরণ করা হয়েছিল। ১৯৪৭-এর শিল্পীসংকট মোকাবিলায় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পরিজন আন্তরিকভাবেই এগিয়ে আসেন। সাতচল্লিশের ধাক্কা সামলিয়ে বেতারে ৬০-এর দশকেই একঝাঁক শিল্পী সম্পৃক্ত হন। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আমাদের দেশের সংগীতাঙ্গনে আজ যারা প্রতিষ্ঠিত নামীদামী তাদের অনেকের শুরুটা হয়েছিল বেতারের মাধ্যমে। দেশের সকল স্বনামধন্য সংগীতশিল্পীই বেতারের সাথে যুক্ত।

বেতারের প্রচারিত অনুষ্ঠানের প্রায় ৫৫% সংগীত। এই বিভাগ পরিচালনা করছেন একজন পরিচালক এবং মাত্র পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারী। অথচ এর সাথে জড়িত হাজার হাজার শিল্পী, সংগীতপরিচালক, গীতিকার, বাদ্যযন্ত্রী। সারাদেশের তালিকাভুক্ত শিল্পীর সংখ্যা ২হাজার ৩শ ৬৬ জন। এর মধ্যে নিজস্ব শিল্পী ৫শ জন। নিজস্ব ও অনিয়মিত হিসেবে ৮শ ৫৮ জন গীতিকার কাজ করছেন। প্রতিমাসে সমস্ত স্টেশন মিলিয়ে ৭৯হাজার ২শ মিনিটে গান বাজানো হয় প্রায় ১৯হাজার ৮শ। প্রতিনিয়তই গান রেকর্ডিং চলছে কেন্দ্রীয় ও অঞ্চল ভিত্তিতে। সংগীত সংরক্ষণে টেপ লাইব্রেরি মেন্টেন করা হয়। এছাড়াও ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসের নিজস্ব সংগ্রহশালায় প্রচুর গানের টেপ রয়েছে।

সংগীত বিভাগের উদ্যোগে দর্শকদের উপস্থিতিতে ত্রৈমাসিক সংগীতানুষ্ঠান এবং জাতীয় পর্যায়ে সংগীত সম্মেলনের আয়োজনের কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে হয়ে ওঠে না। বাৎসরিক উৎসবগুলোর মধ্যে রয়েছে লোকসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, উচ্চাঙ্গসংগীত, যাত্রা, নৃত্যনাট্যের উৎসব ও উপজাতীয়দের সংগীত উৎসব ইত্যাদি। এছাড়া বৃন্দ বাদ্যদল গঠন, লোকসংগীত ও উচ্চাঙ্গসংগীত — এই দুই পর্যায়ে বৃন্দনাট্যের অনুষ্ঠান আয়োজনও রয়েছে কার্যক্রমের আওতায়।

ধারাবাহিক কার্যক্রমের মধ্যে বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ধারণকৃত ও সংগ্রহকৃত গান জাতীয়ভাবে প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। শিল্পীদের শ্রেণি নির্ধারণের উদ্যোগও বিভাগের অন্যতম কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে। স্টেশনগুলোর চাহিদা ও বাস্তবতার ভিত্তিতে বাদ্যযন্ত্র ও টেপ প্রদান ছাড়াও সর্বোপরি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রতিশ্রুতিশীল ও সম্ভাবনাময় শিল্পী অন্বেষণ এবং তাদের সুযোগ দেওয়ার কাজটা বেতারের নিয়মিত উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে। বেতার সংগীতশিল্পীদের জীবনবৃত্তান্ত সহ তালিকা প্রণয়ন এ-বিভাগের সামগ্রিক কাজের অন্তর্গত।

এ-যাবৎ বেতারের সংগীত বিভাগে শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, বাদ্যযন্ত্রী হিশেবে প্রতিষ্ঠিত সকলেই যুক্ত থেকেছেন। শিল্পীদের মধ্যে আব্বাসউদ্দিন আহমদ, লায়লা আরজুমান্দ বানু, ফিরোজা বেগম, ফেরদৌসী মজুমদার, ফরিদা ইয়াসমিন, খালিদ হোসেন, নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী, রফিকুল আলম, শাম্মী আখতার, আবিদা সুলতানা, শাহীন মাহমুদ, তিমির নন্দী, আঞ্জুমান আরা বেগম, নীনা হামিদ, সৈয়দ আব্দুল হাদী, আব্দুল জব্বার, মাহমুদুন্নবী, সুবীর নন্দী, ফাতেমা-তুজ-জোহরা, তপন মাহমুদ, বেবী নাজনীন, কনকচাঁপা, শুভ্র দেব, সুমনা হক, সামিনা চৌধুরী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। গীতিকার হিসেবে সিকান্দার আবু জাফর, আশরাফ সিদ্দিকী, আব্দুল লতিফ, কে.জি. মোস্তাফা, রাহাত খান, ফজল-এ-খোদা, শহীদুল ইসলাম, আবু জাফর প্রমুখ রয়েছেন স্মরণীয়। এছাড়া সুরকার হিসেবে যারা বেতারকে সময় দিয়েছেন তাদের মধ্যে আব্দুল আহাদ, সমর দাস, সুধীন দাস, খান আতাউর রহমান, সোহরাব হোসেন, আনোয়ার উদ্দিন খান, মোবারক হোসেন খান, মোস্তফা জামান আব্বাসী, আসাফউদ্দৌলা, সত্য সাহা, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান, ধীর আলী, মনসুর আলী, দেবু ভট্টাচার্য্য, আজাদ রহমান, আলাউদ্দিন আলী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য অগ্রগণ্য।

তবু ’৬০ ও ’৭০ দশকে যে মানসম্পন্ন শিল্পীরা বেতারে নিয়মিত গাইতেন, লিখতেন এবং সুর দিতেন তাদের শূন্যতা ক্রমাগত উপলব্ধি করা যাচ্ছে। দেশে প্রচুর শিল্পী থাকলেও মেধাবী ও সম্ভাবনাময় শিল্পীর সংকট ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সেই দিক থেকে সংগীত বিভাগকে আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। পরিকল্পনার বিষয়গুলো বাস্তবিকভাবেই কার্যকর করতে হবে তা না হলে সংকট অনিবার্য।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you