হৃৎকলমের টানে রবীন্দ্রনাথের গানে || সৈয়দ শামসুল হক

হৃৎকলমের টানে রবীন্দ্রনাথের গানে || সৈয়দ শামসুল হক

অনেকদিন থেকে একটি স্বপ্ন লালন করছি; রবীন্দ্রসংগীতে যাঁর নাম এদেশে সর্বাগ্রে উল্লেখ করতে হয়, রবীন্দ্রগবেষণায় যিনি নতুন পথের পথিক, সেই সনজীদা খাতুনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বহুবার কথা বলেছি যখন তিনি ‘ধ্বনি থেকে কবিতা’ বিষয়ে শান্তিনিকেতনে গবেষণা করছিলেন। সনজীদাকে আমি বলেছিলাম, এবং এটি আমার আপন লেখার অভিজ্ঞতা থেকেও উচ্চারিত, যে, একই শব্দ একই কবি কখনোই এক স্তরে দু’বার ব্যবহার করেন না; প্রতিবারই শব্দটির সঙ্গে তাঁর দূর-নিকটের পরিবর্তন ঘটে, শব্দটির সঙ্গে কবির কৌণিক সম্পর্কটি ভিন্ন হয়ে যায়; শব্দের চেহারায় বানান ও আভিধানিক অর্থ এক হলেও প্রতি ব্যবহারে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যায়; অনন্য ও সদ্যোজাত হয়।

‘গান’ — এই শব্দটি তো আমাদের কত চেনা; রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গান থেকে আমি কয়েকটি পদ তুলে দিচ্ছি এবং ভেবে দেখতে বলছি, এই সরল, সহজবোধ্য, জীবনের বহুব্যবহৃত শব্দটি কি একই স্তরে, একই অর্থে, একই দূরত্বে বা নৈকট্যে এবং একই দৃষ্টিকোণে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছেন?

‘আমার মনের মাঝে যে-গান বাজে শুনতে কি পাও গো?’
‘তোমায় গান শোনাব তাই তো আমায় জাগিয়ে রাখো ওগো ঘুম-ভাঙানিয়া।’
‘কাল রাতের বেলা গান এল মোর মনে।’
‘নিদ্রাহারা রাতের এ-গান বাঁধব আমি কেমন সুরে?’
‘আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিলো ভুলায়ে?’
‘গান আমার যায় ভেসে যায়। চাসনে ফিরে, দে তারে বিদায়।’
‘অনেক দিনের আমার যে-গান আমার কাছে ফিরে আসে।’
‘তবে শেষ করে দাও শেষ গান, তারপরে যাই চলে।’

গোড়াতেই যে-স্বপ্নটির কথা বলেছি, সেটি এই যে, রবীন্দ্রনাথের গান এবং কবিতা থেকে যাপিত জীবনে বারবার ব্যবহৃত কিছু শব্দ — যেমন ‘গান’, ‘প্রেম’, ‘আলো’, ‘তুমি’ — একজন শব্দঋষির উচ্চারণ থেকে তুলে এনে পরীক্ষা করে দেখি।

স্বপ্ন দীর্ঘ হয়, কিন্তু বড় হ্রস্ব এ জীবন।

+

কাদেরী কিবরিয়া আর রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গাওয়া রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কয়েকটি গান নিয়ে বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্প্যানি তাদের ‘উইলস’ সিগারেটের নিবেদন হিসেবে প্রকাশ করেছে একটি ক্যাসেট; ক্যাসেটের নাম দেয়া হয়েছে “দু’জনে দু’জনায়” — এই বিশেষ বর্ণনাটি ঐ সিগারেটেরই বিজ্ঞাপনে স্লোগ্যান হিসেবে অনেক দিন থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, সম্ভবত তামাক আর ফিল্টারের সম্পূরকতা বোঝাবার জন্যেই বিজ্ঞাপনটির লেখক এই সহজ সুন্দর বাক্যবন্ধটি রচনা করেছিলেন।

তামাক ও ফিল্টারের সমাহার ছাড়িয়ে এখন স্লোগ্যানটি এ-ক্যাসেটে উপস্থিত হলো প্রেমের গানে এক পুরুষ ও এক নারী কণ্ঠের যুগলবন্দীর বর্ণনা হিসেবে। ধূমপানের বিরুদ্ধে যখন মানুষকে সচেতন করবার কাজ চলছে বিদেশের মতো এখন আমাদের দেশেও, তখন রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করে সেই ধূমপানের দিকেই মানুষকে আকর্ষণ করবার ব্যবসায়িক কৌশল এই ক্যাসেট প্রকাশে আমরা লক্ষ করেছি। আমি না-বলে পারছি না যে, সিগারেটের প্রচার মানসে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করা কেবল কুবুদ্ধি ও কুরুচিরই প্রকাশ নয়, সেই মহান ব্যক্তিটির পক্ষে রীতিমতো অবমাননাকর। রবীন্দ্রনাথ, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তর ভাষায় যিনি বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের ‘সিদ্ধিদাতা’, হায়, সেই তাঁকেই আজ যে-দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, যে-দেশের জাতীয় সংগীত তাঁরই রচনা, সেই দেশে সিগারেটের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর বস্তুর ব্যবসায়ে সিদ্ধিদাতা হিসেবে ব্যবহার ও ভজনা করা হলো!

এবং ক্যাসেটে যে যন্ত্র-অনুষঙ্গ আমরা শ্রবণ করছি, তাও রবীন্দ্রসংগীতের কতখানি চরিত্রবিরোধী সে-বিচারের ভার বিশেষজ্ঞদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি। “সেদিন দু’জনে দুলেছিনু বনে” যদিওবা কিবরিয়া ও বন্যার যুগলকণ্ঠে উপভোগ্য, “মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে” কি যুক্তি ও অনুভববিচারে যুগলকণ্ঠে উপস্থাপিত হতে পারে তা আমার পক্ষে বোঝা একেবারেই অসম্ভব। শ্রদ্ধেয় কলিম শরাফী ক্যাসেটে মুদ্রিত ভূমিকায় সার্টিফিকেট দিয়েছেন, “এই ক্যাসেটটি অবশ্যই কেবল সংগ্রহযোগ্য নয়, রীতিমতো সংরক্ষণযোগ্য হয়ে উঠবে, এ বিশ্বাস আমার আছে।” না, কলিমভাই, সিগারেটের ব্যবসায়ে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করার আপত্তি সাময়িকভাবে ভুলে গিয়েও শুধু গায়ন মনে রেখেই বলছি, এরচেয়ে অনেক স্মরণীয় গায়ন এই দুই শিল্পীর কণ্ঠে আমি শুনেছি এবং এই গানগুলোরই; তাই আপনার আশার সঙ্গে আমাদের, অন্তত আমার, আশা মিলল না।

+

রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের কাছে বারবার ফিরে যাই; অকস্মাৎ সেদিন আবিষ্কার করি প্রতিদিনের উচ্চারিত কিছু শব্দ; জন্ম থেকে দেখা চারিদিকের দৃশ্য ও বস্তু এবং সংসারের নিত্য ব্যবহৃত কত শব্দ তিনি গ্রহণ করেছেন এবং করে তুলেছেন অবিস্মরণীয় চিত্রকল্প, আর এ-সবের ভেতরেই তিনি আবিষ্কার করেছেন অস্তিত্বের জটিল গভীর ভাব প্রকাশের সামর্থ্য; আমার মনে হয়, এখানেই রবীন্দ্রনাথের মূল শক্তি, এখানেই রবীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভা। এ কাজটি তাঁর আগে আর-কেউ করেননি বাংলা ভাষায়, তারপরেও আর-কেউ এভাবে আর নয়; আর এই কারণেই তিনি বাংলা ভাষা ও বাঙালির জীবনে এত বিপুলভাবে অধিষ্ঠিত; বিপুল কিন্তু বিনম্র, প্রবল অথচ নিঃশব্দ; এবং তাঁর কবিতা ও গানের পরে তাই বাংলা ভাষার বহু শব্দ আর আগের মতো নয়, তারা হয়ে উঠেছে নতুন, রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব এবং একইসঙ্গে বাঙালিমাত্রেই সবার সাধারণ উত্তরাধিকার।

রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান থেকে, যেমন মনে আসছে এখন স্মৃতিতে, কিছু শব্দের দিকে দৃষ্টিপাত করি — আকাশ, গগন, নিখিল, অসীম, সীমা, বিশ্ব, রাত্রি, দিন, রজনী, প্রভাত, ভোর, গোধূলি, নিশীথ, চন্দ্র, সূর্য, তারা, মেঘ, কিরণ, আলো, প্রদীপ, ছায়া, নদী, পাতা, ফুল, গান, নাচন, মালা, রাজা, দূত, রথ, প্রহরী, ডাকঘর, পথ, পথিক, জানালা, দীপ, অশ্রু, আঁখিজল, হাওয়া, পবন, নৌকা, তরণী, তরী, শ্রাবণ, আষাঢ়, বৈশাখ, বসন্ত, পাখি, বিহঙ্গ, বীণা, কানন, শঙ্খ, তৃণ, দুয়ার, দ্বার, তোরণ, প্রেম, উদাস, ভালোবাসা, হাত, চোখ, চরণ, বুক, নয়ন, ধূপ, ছন্দ, রূপ, নীরব, বেলা, দেবতা, পূজারী, গীত, গন্ধ, অভিষেক, দুঃখ, সুখ, শান্তি, রতন, আঁচল, জীবন, মরণ, একা, আনন্দ, পাত্র, প্রবাস, পূর্ণ, নমস্কার — নিঃসন্দেহে এই শব্দতালিকা হবে দীর্ঘ, অতিদীর্ঘ; এখানেই যে-শব্দগুলোর উল্লেখ করেছি, আমরা যদি একবার শুধু ভাবি যে, রবীন্দ্রনাথের আগে এই অতিপরিচিত শব্দগুলো আমাদের কাছে কি বলত এবং রবীন্দ্রনাথের পরে আমাদের তারা কি বলে, তাহলেই অনুভব করব অমোচ্যভাবে তিনি এই শব্দগুলোকে কী নতুন অর্থ দিয়েছেন, যেন এই শব্দগুলো প্রথম তাঁরই হাতে জন্ম নিয়েছে।

+

সেই ভোরবেলাটির কথা মনে পড়ে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি; শ্রীনিকেতনের আদর্শে ইংল্যান্ডের ডার্টিংটন গ্রামে লেওনার্ড এলমহার্স্ট প্রতিষ্ঠিত ডার্টিংটন হ্যলের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে উৎসব; দেশবিদেশ থেকে অনেকেই এসেছেন সেই উৎসবে; রবীন্দ্রনাথের নাতনীজামাই ও তাঁর জীবনীকার কৃষ্ণকৃপালনী প্রস্তাব করলেন, “কাল সকালে সূর্যোদয়ের আগে আমরা মিলিত হব, গান গেয়ে প্রদক্ষিণ করব প্রাঙ্গণ আমরা বৈতালিকের দল।” সেই নিবিড় মেঘজড়ানো ভোর, শীতের সেই কামড়, কুয়াশার সেই চাদর; কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আমরা জনা-পনেরো গাইতে গাইতে বেরিয়ে পড়লাম — ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিষ্ঠুর, দ্বন্দ্ব’; সবচেয়ে অপটু কণ্ঠ ছিল আমার, সেই আমিও সুর ও বাণীর বিদ্যুতে স্পৃষ্ট হয়ে নির্ভয় স্বচ্ছন্দে গেয়ে উঠলাম ‘ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভজটিল বন্ধ।’ ভিজে-সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে ডার্টিংটন হ্যল প্রদক্ষিণ করে আমরা প্রবেশ করলাম যত্নে-রচিত ঘনঝোপঘেরা ছোট বৃত্তাকার একটি নিভৃতির ভেতরে — সেখানে রক্ষিত আছে এলমহার্স্টের দেহভস্মপুরিত একটি পাত্র। অদূরেই হেনরি ম্যুরের একটি ভাস্কর্য রাতের বৃষ্টিতে ধোয়া — মানবজীবনের উন্নত একটি অনুভবনের নির্মাণ।

রবীন্দ্রনাথের এই গানটিতে সেই ভোরের মতো এত বিপুল করে হৃদয়ের ভেতরে — যেন এক হৃদয়ে তার স্থান কুলান হবে না — আর কখনো অনুভব করিনি। কেবল বিশ্বের বিপর্যয় নয়, সেই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকবার প্রত্যয় শুধু নয়, ডার্টিংটনে গীত এই গান আমার মনের মধ্যে ঘুচিয়ে দিয়ে যায় রাষ্ট্রসীমানা, ভাষাসীমানা, মানুষের তৈরি সকল সীমানা; গোটা বিশ্বকে আমি অনুভব করে উঠি; যেখানেই অনাচার, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা, নিপীড়ন সেখানেই যেন আমি উপস্থিত বলে বোধ করি সেদিন সকালে।

রাজীব গান্ধীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের সংবাদ শুনে আমার মনে পড়ে যায় সেদিনের সেই ভোরবেলাটির কথা; সেই বৈতালিক, সেই অনুভব, সেই সকলকিছু, রবীন্দ্রনাথের সেই গানটির শেষ দু’টি চরণ — “শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য / করুণাঘন, ধরণীতল করো কলঙ্কশূন্য।”

+

“দিন চলে যায়, বন্ধুদের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসে, অধিকতর নিকটে আসি নিজেরই, এখন নিজের ভেতরেই বসবাস” — এই মতো একটি বাক্য উচ্চারণ করলেন এক সখা সেদিন কোনো-এক গানের আসরে; অমৃততুল্য রবীন্দ্রগানের দিকে কান রেখে —  ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না’ — তিনি নিচু স্বরে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, “একদা যখন ছিলাম যুবক, তেমন করে চোখে পড়ত না মানুষের ক্ষুদ্রতা, সে ছিল এমন এক কাল যখন ভালোটুকুই দেখে নিত আমার চোখ, কিন্তু এখন কেবলই আমি দেখি মানুষের আত্মা ও মূল্যবোধের পতন ও ধ্বংস”; আর্ত কণ্ঠে তিনি প্রায় স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন, “এ কি আমার বয়স হয়ে যাবার জন্যে, সৈয়দ হক?”

আমি তাকে কী দেবো উত্তর? বয়স আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করে, তুলনা ও প্রতিতুলনা করবার দিকে আমাদের টেনে নিয়ে যায়, এবং আরও যেটি করে থাকে আমাদের বয়সের অগ্রসরতা — আমাদের স্বপ্নসমূহের ক্রমাগত ক্ষয় করে তোলে খিন্ন, জিহ্বায় তুলে দেয় হতাশার নিম, চারদিকে আমরা প্রতিফলন দেখি আমাদেরই ব্যর্থতার; কিন্তু তারপরও কথা থাকে এবং সে-কথাটি এ-ই যে, বয়সটা আসলেই শরীরের নয় মনের হয়ে থাকে; আমি এমন মানুষ জানি যিনি আশি পেরিয়েও যুবক, আমি এমন অপরাহ্নমানুষের সন্ধান রাখি যিনি প্রেমে ও আলিঙ্গনে তরুণ সূর্যের চেয়েও রশ্মিমান; এমন মানুষ আমাদেরই চারপাশে আছেন যারা স্বপ্ন আর আশাবাদে যে-কোনো যুবার সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে পারেন।

গান শেষ হয় — গান কী সত্যি সত্যি শেষ হয়ে যায়? আমাদের দিনগুলো সোনার খাঁচায় নাইবা আর রইল, রবীন্দ্রনাথ তো এই গানে পুরে দেননি জীবনের প্রতি হতাশা? আমি তো বরং মনে করি, সোনার খাঁচা থেকে মুক্তি পেয়ে আমার দিন এখন মহাবিশ্বের স্বচ্ছ নীল আকাশের জ্যোতির্ময় পথে পথে ভ্রাম্যমাণ। বন্ধুটি আমার সঙ্গে একমত হলেন না; তিনি বললেন, “রবীন্দ্রনাথের কোনো রচনায় যদি হতাশা স্ফুটিত হয়ে থাকে তবে সে এই গানে এবং এই গানেই।” — হা, কি করে তাঁকে আমি বোঝাবো যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ রচনাতেও যখন উচ্চারণ করেন, ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী’ তখনও তা আশাভঙ্গের স্বর নয়, প্রতারিতের কণ্ঠ নয়, যদিও আমাদের চমকে উঠতেই হয় ‘ছলনাময়ী’-র মতো শব্দপ্রয়োগ লক্ষ করে যা তাঁর সারাজীবনের সমস্ত রচনায় এসেছে প্রথম ও শেষবারের মতো; কবিতাটি আবার পড়ে উঠবার পর যখন আমরা তাকাই এই মহাকবির বিপুল রচনার দিকে, আমরা আবিষ্কার করি — করি না কি? — এক গূঢ় গভীর সাবধানবাণী, যে, চরৈবেতি, চরৈবেতি, চলো, চলো, চলেই চলো, চলাই শুধু সত্য, মনে রেখো ছলনার জাল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবার নামই হচ্ছে জীবনযাপন।

+

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের শেষ গানটি রচনা করেন আপন জন্মদিন উপলক্ষে — ‘হে নূতন, দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’ — বাংলা ১৩৪৮ সালের ২৩শে বৈশাখ; নতুন রচনা ঠিক নয়, তাঁরই আগেকার একটি কবিতার কিছু অংশ তিনি সামান্য বদলে নিয়ে সুরের শরীরে স্থাপন করেন। কিন্তু এ কি সত্যি তাঁর নিজের জন্মদিনের কবিতা? নাকি জন্মের অপেক্ষায় যে আছে, কবি নয়, শিল্পী নয়, কর্মী নয়, নেতা নয়, নতুন কেউ, নতুন দিনের কেউ, নতুনের দিকে আমাদের ফেরাবে এমন কেউ, তারই দিকে হয় বটে বাংলার জ্যেষ্ঠ সন্তানের এই প্রার্থনা? রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের জন্মদিনের সার্থকতা দেখতে চান নতুন কারো জন্মগ্রহণের সম্ভাবনার ভেতরে, নইলে ব্যর্থ তাঁর জন্মগ্রহণ।

তুমুল কর্মময় একটি জীবন পেরিয়ে এসে রবীন্দ্রনাথ — সেই নিঃসঙ্গ মানব, সেই গৃহহীন কিন্তু বিশ্ববাসী সেই পুরস্কারহীন কর্মী — দেখতে পান তাঁর স্বদেশে এখনও কুহেলিকা, রিক্ততা, জীবনের পরাজয় চতুর্দিকে এবং তাঁর নিজের প্রবল অভিধায় পূরিত শব্দ ‘বিস্ময়’-এর অনুপস্থিতি; এখানেই তিনি সনাক্ত করেন তাঁর নিজের গভীর ব্যর্থতা, জীবনশেষে কামনা করেন নতুন কোনো রবীন্দ্রনাথের, যাকে তিনি তাঁরই অসামান্য শব্দপ্রতিভায় বর্ণনা করেন কেবল ‘চিরনূতন’ এবং বলেন — “তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদ্ঘাটন / সূর্যের মতন / সরিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন / ব্যক্ত হোক জীবনের জয় / ব্যক্ত হোক তোমা মাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।” তারই অপেক্ষায় আছেন বলে তিনি আপন-সূর্যাস্তের লগ্নে শুনতে পান ‘উদয় দিগন্তে শঙ্খ বাজে’ আর তাই তিনি পঁচিশে বৈশাখে নিজের ‘চিত্তমাঝে’ নতুনকে এইভাবে স্বাগত করেন — “মোর চিত্তমাঝে / চিরনূতনের দিলো ডাক / পঁচিশে বৈশাখ।”

এই গান রচনার মাত্র বাইশ দিন আগেই আরেকটি গানে রবীন্দ্রনাথ গেয়ে উঠেছিলেন, যেনবা তাঁর চারদিকে বিলীয়মান আলোর ভেতর থেকে হঠাৎ জেগে উঠে — “ওই মহামানব আসে / দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে / মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে।” আর তিনি বালকের মতো ঘটনার আগেই ঘটনাটি ঘটে গেছে বলেই নির্ণয় করেন — “আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত / ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।”

রবীন্দ্রনাথের শেষ রচনায় বারবার যে-জন্মের কথা এসেছে, কবিতায়, গানে, বিশেষ করে গানে, একটি বিদায়কালে অন্য এক আবির্ভাবের কথা বারবার ব্যক্ত হয়েছে, এটি আকস্মিক নয়; এক দীর্ঘ জীবনের আহরিত অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসবোধ থেকেই তা উৎসারিত।

গানপারটীকা
ঠাকুর-সৈয়দ উভয়েই দৃশ্যপটে নেই আজ আর সশরীর, রচনায় আছেন যদিও হাজির, যার যার রচিত ভুবনে তারা আলোকের বর্তিকা হাতে পাঠকবেশী দিশাতালাশরত পথিকের অপেক্ষায়। উভয়েই তারা অমরলোকের বাসিন্দা, ঠাকুর সেথায় বিরাজিছেন কমবেশ চারকুড়ি বছর তো হয়ে গেল, সৈয়দের লোকান্তর হয়েছে একদম সদ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে, পঁচিশে বৈশাখে, সৈয়দ হকের যে-লেখাটা আমরা গানপারে দেখছি, এইটা ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ’ নামীয় সৈয়দের একটা অ্যান্থোলোজি থেকে কালেক্ট করা। ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ’ সৈয়দ হকের পূর্বপ্রকাশিত কতিপয় গ্রন্থধৃত রবীন্দ্রনাথকেন্দ্রী কিছু রচনার সংকলন, যেখানে বেশকিছু বক্তৃতাভাষণ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত সৈয়দের একটি কবিতা এবং একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট রয়েছে। এই রচনাটা স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ বইয়ের দ্বিতীয় রচনা ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ : হৃৎকলমের টানে’ থেকে নেয়া হয়েছে, যেই নিবন্ধগুলো হকের বিখ্যাত কলাম ‘হৃৎকলমের টানে’-তে উনিশশ নব্বইয়ের দিকটায় ধারাবাহিক ছাপা হয়েছিল এবং পরে গ্রন্থাকারে বেরিয়েছিল, স্বাদিত রবীন্দ্রনাথে সেই কলামবইয়ের রবীন্দ্রভুক্তিগুলোই শুধু গ্রহণ করা হয়েছে, এবং গানপারে প্রকাশকালে পঁচিশপৃষ্ঠা কলেবরের সেই রচনায় যে-ভুক্তিগুলো শুধু রবিগানকেন্দ্রী সেগুলোর একটি নির্বাচিত অংশ গ্রহণ করা হয়েছে। ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ’ বেরিয়েছে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে, ‘শুদ্ধস্বর’ ঢাকা থেকে, এর প্রচ্ছদ করেছেন শিবু কুমার শীল। সংকলনপ্রাসঙ্গিক একটি প্রিফেইসে সৈয়দ হক জানাচ্ছেন, “আমার রবীন্দ্রনাথ সোনার বেদিতে বসানো আরাধনার নন, তিনি আমার মহান অগ্রজ; তাঁর সাফল্য যেমন জানি, তাঁর ব্যর্থতাও আমার চোখে পড়েছে; ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলিনি কিন্তু শিখেছি তা থেকে, সাফল্যে সবার সঙ্গে থেকেছি। হয়তো কোনো-একদিন একটা বইই লিখব অগ্রজের ওই সাহিত্যিক ও সামাজিক ব্যর্থতা নিয়ে, যা তাঁর অসামান্য কৃতির আলোয় চোখ-ধাঁধানো আমাদের চোখেই পড়েনি। তাঁকে নিয়ে মুগ্ধ বা অধ্যাপকসুলভ উদ্দীপনে কিছু লিখে ওঠার তাড়া কখনোই ছিল না; আমার মেধা ও দৃষ্টি নির্মাণে তিনি ছিলেন আমার জন্যে অনেকখানির হাত-লাগানো মানুষ। আমার জীবনে ও কলম-ভেতরেই তাঁর বিষয়ে আমার কথাগুলো ধরা হয়ে আছে। কিন্তু একেবারে নীরবও থাকা যায়নি : বক্তৃতা করতে হয়েছে, কিছু অনুরণন টুকরো আকারে, একটি-দুটি কবিতাও কখনো, আর একদিন একটা গোটা নাটক তাঁরই ‘ছিন্নপত্র’ সহায়ে।” হ্যাঁ, নাটকটা, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ শীর্ষক, স্বাদিত রবীন্দ্রনাথে আগাগোড়া পাওয়া যাচ্ছে, যেমন পাওয়া যাচ্ছে ‘হৃৎকলমের টানে’ ছাড়াও সৈয়দের ‘মার্জিনে মন্তব্য ও গল্পের কলকব্জা’ বইয়ের কিছু অংশ, রয়েছে ঢাকা সুফি সোসাইটির একটি অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ ও সুফিকাব্য মধ্যকার অন্বয় নির্ণায়ক ছোট্ট একটি ইংরেজি বক্তৃতার উপস্থিতি। কিন্তু ‘অগ্রজের ওই সাহিত্যিক ও সামাজিক ব্যর্থতা’ হাজির করতে চেয়েছিলেন সৈয়দ যে-একটি পৃথক বই লিখে, সেই ইচ্ছাটা বাস্তবায়ন করে যেতে পারলে কেমন লাগত আমাদের, ‘স্বাদিত রবীন্দ্রনাথ’ পড়তে যেয়ে পাঠক হিশেবে এমনটা আফসোস আমাদের হবেই। কিন্তু সব মিলিয়ে এইটা সৈয়দ হকের অন্যান্য বইয়ের মতোই নিরুপম গদ্যে লেখা টানটান উত্তেজী বইই হয়েছে, যে-কোনো সময় পাঠক এই বই হাতে নিয়া উপভোগ করবেন তাতে একবিন্দু সন্দেহ হয় না।

ব্যানারে ব্যবহৃত রবীন্দ্রপ্রতিকৃতিটির চিত্রকর সত্যজিৎ রাজন 

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you