৩.
সুহৃদ অথবা আগন্তুক, কনফর্মিস্ট অথবা আউটসাইডার, এইসব হেজিমনি- মানমানির অভিমানী দিনরাত্তিরে চলেন পুনরায় ফেরত যাই নাইন্টিন সিক্সটি সেভেন, ১৯৬৭-র উইন্টার-অটাম, কার্তিক-শ্রাবণ, অনুপ্রাস অগ্রহায়ণে।
’৬৭-র জানুয়ারি ৪, Doors-এর পয়লা অ্যালবাম The Doors রিলিজ করার পর সাইকাডেলিক মায় অ্যাসিড রক মায় ব্লুজ রকের শ্রুতি ও উচ্চারণের ধরন-ধারণে যেটা ঘটেছিল, যা ঘটেছিল, যা ঘটল অথবা যেভাবে ঘটেছিল, সেটাকে রিভার্স করার কিংবা রিক্রিয়েট করার কোনো পথ ছিল না। মানে, ওই পয়লা অ্যালবামেই Doors যেটা করল সেটা একটা ডিস্টিঙ্কশান, একটা একম ও অদ্বিতীয়ম। যেই ব্যাপারটা পিঙ্ক ফ্লয়েড করতে পারছিল ’79-এ The Wall কিংবা কিং ক্রিমসন ’69-এ In the Court of the Crimson King-এ।
তো, সেই অনঙ্গ ঘোর অথবা বিহ্বলতার মাঝেই, সেপ্টেম্বরের দিকে, একজ্যাক্টলি সিক্সটি সেভেনের টোয়েন্টি ফিফ্থ, ২৫ সেপ্টেম্বরে রিলিজ করে Strange Days, Doors-এর সেকেন্ড অ্যালবাম। তো আজকে যেই মরিসনরে আপনি চিনেন বা চিনেন না, টি-শার্ট অথবা পোস্টারে বহন করেন (যাপন করেন না), সেই আড়ালবিহীন কায়াতে দু-হাত ছড়ানো ইয়ং লায়ন মরিসনকে যিনি ফোটোগ্রাফে ধরে রাখলেন — তিনি — জোয়েল ব্রডস্কিই Strange Days-এর আর্টওয়ার্ক করলেন একদল স্ট্রিট পারফর্মার — ক্লাউন, জোকার — দিয়ে। ব্যাপারটা নতুন না-হলেও দি দেন রকসিনের জন্য ট্রাডিশনাল ছিল না। তো এই-যে একটা প্রথা ভাঙনের প্রথার অংশ হিসেবে, হিস্ট্রির পার্ট হিসেবে, সিক্সটিজের শেষ হাফে Doors-এর আবির্ভাব বা মরিসনের ডেমিগড হয়ে ওঠা, অকাল্ট পোয়েট-এর কাল্ট-এ রূপান্তর হওয়া — সেই ওয়েভ-এ Strange Days এর কাছে ফিরতে হবেই, না ফিরে উপায় নাই — ট্র্যাক Strange Days, Moonlight Drive, People Are Strange আর তেত্রিশ মিনিট ২৫ সেকেন্ডের অ্যালবামের লংগেস্ট ট্র্যাক When The Music’s Over-এর লিগা।
৪.
Strange Days–এর টাইটেল ট্র্যাক পার হওয়ার আগে আমরা ফিরে যাবো Moog synthesizer নামক বস্তুর কাছে। প্রাচ্যে যেমন সুরের শরীর, শরীরী ভাবে মিলে গেছে মিশে আছে বাঁশি, তেমনি সিক্সটি সেভেন থিকাই এক্সপেরিমেন্টাল মিউজিকের একটা ইম্পর্ট্যান্ট পার্ট হ্য়া উঠল Moog Synthesizer. ইভেন কুব্রিক-এর 1971-এর নটোরিয়াস মাস্টারপিস A Clockwork Orange অথবা এইট্টির The Shining-এর সাউন্ডট্র্যাকে ইউজ করা হইল বিটোভেন, বেরিলোজদের মিউজিকপিস-এর Moog Synthesizer ভার্শন।
তো, মিউজিক ফ্রন্টে Moog Synthesizer-এর এইভাবে ছড়ায়া পড়ার বিগিনিং পিরিয়ডের সবথিকা নোটিসেবল একজাম্পল বোধ করি — Strange Days. যেইখানে মরিসন ডিক্লেয়ার করতেছে, অমোঘ স্বরে জানিয়ে দিচ্ছে —
“Strange days have found us
Strange days have tracked us down
They’re going to destroy
Our casual joys
We shall go on playing
Or find a new town”
এই যে অদ্ভুতুড়ে অনুভূতি, অচেনার অনুভব, বেদনা কিংবা বিষাদ সেটা আরো বিস্তৃত হয় Moonlight Drive -এ এসে।
এইখানে মরিসন বলতেছে —
‘চলো, আমরা চাঁদের কাছে সাঁতারায়া যাই
চলো, আমরা ঢেউয়ের শরীর বাইয়া উঠি’
যেটারে ধরা হয় মরিসনের শুরুর দিকের লেখা; যখন জীবন সহজ ছিল, যখন ক্যালিফোর্নিয়ার বালুকাবেলায় ভেনিস বিচের ছাদে শুয়ে চাঁদের কাছে সাঁতরে যাওয়ার স্বপ্ন ছিল, যখন দৃষ্টি বৃষ্টি মেখে সবুজ ছিল।
তো, সিক্সটিজ এবং সেভেন্টিজের পপ কালচারে, আর্ট মিডিয়ামে বারবার যেই বেদনা, যেই হাহাকার অনুরণিত হচ্ছিল, সেইটা হলো — কেউ কাউরে চিনি না, কেউ কাউরে দেখি না। একটা অতনু বিষাদ, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব আর অথোরিটির উপ্রে জমানো ক্ষোভ; হইতে পারে সুপারফিশিয়াল, আমি যদিও বলি — ইনহেরেন্ট। পোস্টওয়্যার ইল্যুশন-ডিল্যুশন, সিক্সটিজ এবং সেভেন্টিজের কনটেম্পোরারি আর্টিস্টদের মাঝে একটা ফোর্স ক্রিয়েট করছিল। এক্সট্রিম নিজের অজান্তেই মোর দ্যান ইউজুয়াল টাইম্স সাবলাইমে পৌঁছাই যাচ্ছিল। নিউ হলিউডে স্করসেজি, কোপোলা, উডি, ডি পালমারা যা করতেছিল, বা তার আগে 1960-তে মাইকেল পাওয়লের Peeping Tom দিয়া ভয়্যার ও ভয়্যারের দ্রষ্টাকে সমান্তরালে এনে ফেলা, হিচককের Psycho–এর ধাক্কা, আন্তোনিওনির Blow-Up; মডার্নের উপ্রে পোস্টমডার্নের ভেক ধরে থাকা আর্বান ইন্টেলেক্টদের ন্যাংটো করে দেওয়া ফেলিনি, কিংবা গদার-ত্রুফো-পোলান্সকিদের একের পর এক অনিন্দ্য উন্মোচন, Dr. StrangeLove, Easy Rider, The Graduate–এ সাইমন আর গারফাঙ্কেলের সাউন্ডট্র্যাক; মাইকল জ্যাকসনের মাথা ঘুরাই দেওয়া ওয়েস্ট সাইড স্টোরির Cool, যেটা কিনা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে জ্যাকসন থেকে শুরু করে ঢাকাই ছবি, বলিউডি ড্যান্স সিনে; অথবা বার্গম্যানের পার্সোনা — এ-রকম একের পর এক বহুমাত্রিক রেবেলিয়ন খুব ইউজুয়াল হয়ে উঠেছিল সেই সময়ে।
মানে, ব্যাপারটা অনেকটা এ-রকম, — রবীন্দ্রনাথকে সম্ভ্রম, শ্রদ্ধা কিংবা রবীন্দ্র-অস্তিত্বকে অনস্বীকার্য মেনে নিয়ে (কিংবা না-মেনে), ত্রিশের পাঁচ কবি যেমনভাবে আমাদের কাছে চলে এসেছিলেন — কারো বেলায় সুধীন্দ্রনাথ, কারো-বা বিষ্ণু দে, কারো-বা অমিয়, কমবেশি অনেকেরই কল্লোলিত বুদ্ধদেব এবং বোধ করি, সম্ভবত এবং অবশ্যই, ইউনানিমাস কাল্ট হয়ে ওঠা জীবনানন্দ (ধারন-যাপন হোক না হোক, কোটেশন শেয়ারের মাধ্যমে ইমেজ তৈয়ারের দায় বব মার্লির লাহান যে-কবির অপমৃত্যু দেখতেছি এই সময়ে), তেমনি — টু থাউজেন্ড সেভেন্টিনে এসে, অ্যাজ অ্যান ইয়াং অ্যাডাল্ট অর আউটসাইডার ইয়ুথ-এর জায়গা থেকে, কালচারাল মুভমেন্ট, কনজুমিং প্যাটার্ন কিংবা শ্রুতি ও দৃষ্টির যে-ঐতিহ্য আমি বহন করি, সেটাকে বুঝাইতে গেলে, প্রকাশ করতে গেলে — সবার আগে আমারে ফিরতে হবে সিক্সটিজ ও সেভেন্টিজে; — অতঃপর সেই মোহাঞ্জনের কিংবা মোহমুক্তির সময় থেকে পদব্রজে, শব্দে আমি গততে যাব নাকি ইউটোপিয়ায় সেটা পরের কথা।
৫.
তো, যে-কথা বলার জন্য কথা থেকে সরে গিয়ে কথায় ফেরা, সেই কথাটি হলো — People Are Strange
ম্যাট্রিকের আগ দিয়া এবং কলেজজীবনে আমার কাছে অ্যান্থেম হয়া উঠল। মুন্সিপাড়ার গলি দিয়ে হাঁটি, বেতারের সামনে যাই, দরগার পাশে কেমিস্ট্রি স্যারের বাসায় যাই, আম্বরখানা টু টিলাগড় যেখানেই যাই — সে আমারে ঘিরে রাখে, আমি তারে পারি না এড়াতে। এমনটা হয়। না হয়ে আর কোনো উপায় থাকে না। কোহেনের Bird On A Wire কিংবা সাইমন আর গারফাঙ্কেলের Sound Of Silence, ফ্লয়েডের Hey You কিংবা আকৈশোর জুড়ে থাকা উদিতনারায়ণ-নচিকেতা, অর্ণব কিংবা প্রিয় আকাশী — এসবই আমার ভাঙাগড়ার দিনগুলোর লুপরে ইন্ডিকেট করে। যেইটা অনিবার্য ছিল, ছিল মননের ডায়লেক্ট।
সেখান থেকে দেখলে People Are Strange আমার দেয়াল, শরীর, টাইমলাইন, ভোরের অ্যালার্ম, মায়ের রিংটোন সবই দখল করে নিলো। আমি সাইন ওয়েভে পড়তে থাকলাম —
People are strange when you’re a stranger
Faces look ugly when you’re alone
Women seem wicked when you’re unwanted
Streets are uneven when you’re down
মন্ত্রমুগ্ধ জপতে থাকলাম —
When you’re strange
Faces come out of the rain
When you’re strange
No one remembers your name
When you’re strange
When you’re strange
When you’re strange
আমি তখন আর কেমিস্ট্রি-ম্যাথ-ফিজিক্স স্যারের বাসায় যাই না। শহরে হাঁটি, শহরে থাকি না। আমি তখন একটা নেভারল্যান্ড-ওয়ান্ডারল্যান্ডে ঢুকে গিয়েছি, বেরোতে পারছি না, বেরোতে চাইছি না। অ্যা-প্লাস, মেডিকেলে চান্স, ফ্যামিলি এক্সপেক্টেশন, নানাজনের প্রিকশন-উপদেশ, কিছুই আমারে সেই লিম্বোর থেকে টেনে তুলতে পারতেছে না। আমি ডুবে গেছি — সিনেমা-কবিতা-সুরে। হইতেছে নাকি হচ্ছে না — ভাবছি না। আমি তখন Carpe Diem, আমি তখন Cogito ergo sum.
আমি তখন সোহান এবং কেবল সোহান —
আর কেউ নই, আর কিছু নই।
(চলবে)
… …
- বিয়িং জন মাল্কোভিচ || সাব্বির পারভেজ সোহান - December 30, 2017
- মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি : অভিযান, রাত, অন্ধকার, অব্যয় … বিচ্ছিন্নতার কাব্যচিত্র || সাব্বির পারভেজ সোহান - December 17, 2017
- মিথ এবং স্মৃতির নাক্ষত্রিক অনুরণন : স্টার ওয়ার্স || সাব্বির পারভেজ সোহান - December 3, 2017
COMMENTS