বাউলের এই জীবনধর্ম || সৈয়দ আফসার

বাউলের এই জীবনধর্ম || সৈয়দ আফসার

এই ব্রহ্মাণ্ডে সবকিছু জাগতিক নিয়মে চলে। জলের খলবল ধ্বনি, মাটির সোঁদা ঘ্রাণ, বাতাসের শনশন শব্দ, নদীর থৈথৈ জলের খেলা, ধানের মৌ মৌ গন্ধ, — সমস্তকিছুই গান ও সুরে ভরপুর। ষড়ঋতুর রূপঘটা অপরূপ সৌন্দর্য আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির। এই আলোবাতাসের সঙ্গে মিলেমিশে আছে রবীন্দ্র-নজরুলসংগীত, পল্লিগীতি, জারি-সারি ভাটিয়ালি-ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী-মারফতি আর বাউলা গানের ভাণ্ডার।

ছোটবেলা থেকেই বাউল গানের প্রতি প্রচণ্ড টান আমার। স্কুল বন্ধের দিনে বাবা যখন মাঠে কাজে যেতেন, আমারও বায়না তাঁর সাথে যাবার। বাবা কাজ করতেন, বোরো জমির আইলে বসে থাকতাম আমি, বকপাখি উড়াউড়ি, পানকৌড়ির কিচিরমিচির শব্দ আর শুনতাম থেমে থেমে বাতাসে উড়া গানের সুর ও কথাগুলো। ছবিগুলো আজও স্পষ্ট আমার মনে।

সুনামগঞ্জ জেলায় জন্ম বলে গর্ব আমার। পুরোটা অঞ্চলের আলোবাতাস, পাখির কলতান, খালবিল, মাঠঘাট জুড়ে বাউলগানের আবহ। বাউলগান আমাকে টানে, বেঁধে রাখে সারাক্ষণ ভাবের ভিতর। বাউল পদকর্তারা তাদের পঙক্তিমালায় ব্যক্তি ও বস্তুকে ধারণ করেন। তনের সাথে মন মিশায়ে যারা সারাজীবন তপস্যায় ব্রত থাকেন, তারাই প্রকৃত বাউল। বাউলদের কোনো জাতধর্ম নাই। অনেকে তাদের ভণ্ড, পাগল, বেশরা ভাবেন। কিন্তু ক’জন বাউলগানের ভাবতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গূঢ়তত্ত্ব বোঝেন? এই ইহলোকে তারা — বাউলেরা — নিজের ভিতর, গানের ভিতর ডুবে থাকেন। খোদাকে ডাকেন। রাধাকৃষ্ণের নাম মনে দেহের সাথে দমের খেলায় মত্ত থাকেন।

পেটখোরাকির জন্য কাজ, আত্মাখোরাকির জন্য গান। দুইটা নিয়াই প্রাত্যহিক জীবন আমার। কিন্তু সব গান আমার ভালো লাগে না। মনেরও প্রশান্তি মিলে না। গান মন জাগিয়ে তোলে, মনগভীরে লুকানো কথা ও উপলব্ধি এমন যে, — গান শুনলে অস্থিরতা বাড়ে, চোখ ঘন হয়ে ওঠে। ভাবি, — ভাবতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্বকথা, এইসব তো আমারই কথা। আমার হৃদয়ে দোলানো ব্যথা, কেন যে আমি বলতে পারিনি এভাবে!

Baul 2“কেউ মালা কেউ তসবি গলে / তাইতে কি জাত ভিন্ন বলে / আসা কিংবা যাওয়ার কালে / জাতের চিহ্ন রয় কি রে” … “সময় গেলে সাধন হবে না” … লালনের কথা মর্মগাথা। শুনি যত রাত্রি ঘনালে, দিলের সব দরোজা-জানালা যায় আপসেআপ খুলে। “জিজ্ঞেস করি তোমার কাছে বলো ওগো সাঁই / এই জীবনে যত দুঃখ কে দিয়াছে বলো তাই” — করিমের গানে অবহেলিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আঁকা, কথার বাইনে-বাইনে। “হাসন রাজায় কয়, / আমি কিছু নয় রে, আমি কিছু নয় / অন্তরে-বাহিরে দেখি কেবল দয়াময়” — হাসনের গানে মরমী কথার বাঁকে বাঁকে মন করে চনমনে, ঘোর লাগা প্রাণে …। “বন্ধু তোর লাইগ্যা রে, আমার তনু জরোজর / মনে লয় ছাড়িয়া যাইতাম থুইয়া বাড়িঘর” — সৈয়দ শাহনুর শাহের জারি-সারি গানে আছে যত ক্লেদ, তারচেয়ে বেশি মারফতি ভেদ। মৌলানা ইয়াসিনের গানে তত্ত্বের সাগরে ডুইব্যা থাকি আনমনে। আরকুম, শীতালং, দুর্ব্বিন শাহ — এদের অধিকাংশ গানের দেহতত্ত্বে গূঢ়তত্ত্বে বুঁদ আমি। “আজ কানাইর ফান্দে শ্রীরাধিকা দিয়াছে গো ধরা / রাই বিহনে কৃষ্ণকানাই হইয়া চিতে মরা” — রাধারমণ দত্ত রসভরা তত্ত্ব মিশাইলেন ধামাইলে। “আমার প্রাণবন্ধু আসিয়া, কাছেতে বসিয়া, / নয়নের জল আমার মুছিয়া দেবে / এমন সুদিন আমার কোনদিন হবে” — বিরহী গানে উকিল মুন্সি ছাড়া কে আছে এমনভাবে টানে! “আমার অনেক বাঁশের বাঁশি আছে / মিছে কেন কিনবি চাটাই বাঁশ” — আহা! বারী সিদ্দিকী, প্রণাম! প্রাণ খুইল্যা গেয়েছো বাউলদের গান। তোমার বাঁশির সুরে, আমার যৌবন গিয়াছে উড়ে।

অধিকাংশ বাউলগান শুনলে মন ছটফট করে, থাকি মনমরা দিনরাত। অথচ এখন? কোথায় সেই দিনগুলা? বাউলগান হইয়া গেছে অর্ধেক কাত, ফান্দে হারাইয়াছে যতটা পথ; ভিনদেশী আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে এখন বাউলগানেরও দেখি শ্বাসরুদ্ধ দশা।

… …

সৈয়দ আফসার

পরের পোষ্ট
আগের পোষ্ট

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you