অনেকদিন পর, আবার || সৈয়দ আফসার

অনেকদিন পর, আবার || সৈয়দ আফসার

শেয়ার করুন:

 


রাত্রি ফুরাবার আগে ছন্নছাড়া কিছু কথা বেশি মনে পড়ে।
যদিও জানি একাকী কিছু শূন্যতা সময়ের শবদাহ শেষে
ঘুমিয়ে পড়ে নতুন একটি ভোরের আকাঙ্ক্ষায়। ভাবি—
আজকের সকাল হবে সহস্র সকালের চেয়ে সুন্দর; তুমি বলো—
‘যায় দিন ভালো’…যেটুকু মনে আছে সেটুকুই আলো, ঝলোমলো
রজনির চাঁদটাকে খোলাচোখে দেখি আর পরস্পর মিশে থাকি
নিজস্ব দৃষ্টি আঁকড়ে, একা ও অনেকের মাঝখানে, যেন ভাবলেশ নাই
কিন্তু আশ্চর্য প্রকাশ্য দিবসে সূর্যের দিকে তাকাতে পারি না
রাতের পর আসে দিন…এ-ও বলা প্রকৃতির নিয়ম…আমিও
প্রকৃতির রূপে ডুবি, ঘুমিয়ে পড়ি, ঘুমের ভেতর স্বপ্নডুবুরিরা
নানাবিধ স্বপ্ন বাঁচাবার আশায় নিদ্রাজাগর নিশাচর প্রাকৃতজনের প্রতিবেশী।

 


স্পর্শের কোনো অভিজ্ঞতা নেই, মনে পড়ে, সেই পূর্ণিমা
রাতের কথা, যে-রাত একফালি আশার জ্যোৎস্না টুপ করে গিলে
ফেলল ঘোর অন্ধকার, অন্ধকারে অন্ধকার বেশি সুন্দর দেখায়, কারণ—
অন্ধকার ছুঁয়ে দেখার আগে চাঁদের পাশে আমার ছায়াও কখন যে
মিলিয়ে গেল! অপেক্ষায় মিইয়ে এল! শরীরে পেলো লঘু হাওয়াদের দোল…
সে-হাওয়ায় আমি এঁকে রাখি কোলাহল; যেভাবে জলে আঁকি
জলেরই ছায়া…আর, ভগ্নমনোরথ, ব্যর্থ, ঐখানে দেখিনি অস্তসূর্য
দেখিনি ঋতুর কোন পাশে লেগেছে জল, কোন পাশে দুলছে ছায়া।

 


একদিন শেষবিকেলের রোদে আমিও হারিয়ে গিয়েছিলাম
তুমি এই হারানোর শব্দটি জপে জপে আমার পাশে চলে
এলে, বিস্ময় চোখে। আলো খুলে ভেসে গেল বিশ্বস্তপাড়ায়…
দরকারি অদরকারি যত প্রসঙ্গ সবই ঠিক ছিল, কিন্তু একটু
বিপাকে পড়েছি, শেষটানের তৃপ্তি নিচ্ছে না সিগ্রেটের ধোঁয়া
সারাদিন হেঁটে আনমনে আমরা কতকিছু খুঁজেছি,
খুঁজিনি শুধু মোহন সময়ের সংক্রমণ, মৌন ব্যাকরণ…
ওভারকোটের পশমে এলিয়ে পড়া তার আচমকা আকাঙ্ক্ষাগুলো
জেগে উঠছে, শীতফুল ঝরছে, বরফফুল ঝরছে, এই নিঃসীম বিদেশে।

 


কেমন করে বেমালুম ভুলে গেছি আমার অর্ধেক স্বপ্ন লেখা আছে জলে
বাকিটুকু লিখছি দিনে, এই স্মৃতিময় দিনে, একান্তই দিনের অধীনে
এ-রকম অনেক অনেক স্মৃতিকথা পূর্ণ হয়ে ওঠে, অনাশ্রয়ে;
যা মনে আসে তা, তা-ই লিখি, প্রাকমুহূর্ত বলতে তেমন স্পষ্ট কিছু নেই,
বিশেষ কিছুই জীবনের জানি না, জামার হাতা, জুতার মাপ
তবু জীবনেরই নিশ্ছিদ্র প্রহরায় বাঁধা পড়ে আছে আমার ছায়া
আমার সঠিক উচ্চতা জানে বলেই পায়ের নিচে মাটি মৃদুভাষী আরও;
সকল আশা, সহজ পিপাসা, এখনও ভালো লাগে।
ভালো লাগে শীততাড়ানো রোদে পিঠ মেলান করে বসা।

 


আমি আমার ভেতর অন্যআমিটাই খুঁজি, বলি ওঠো, খুলে দেখো চোখ
কতটুকু উচ্চতায় উঠলে আমাকে তাড়ায় পরিচিত ভয়
কতটুকু পাতালে নামলে উচ্চতাও তোমাকে এসে বলে যায়—
এইবার তুই উঠে দাঁড়া, আজ না-হয় একটু আগেভাগে উঠলে
ফ্রেশ হয়ে এলে একসাথে নাস্তাপানি খাবো দুইজনায়…
আমার আমিটা অসংহতি টেনে নিরেট শব্দ বুনে চলে চুপচাপ;
বাঁচার তাগিদে খুঁটে খাই সমূহ নিয়তি, দিনের শ্বাস, নিশীথ-উদ্ভাস।
এ-বয়সে খাবারদাবারে এত নিয়মনীতি নিষেধাজ্ঞা ভাল্লাগে না;
আপনি বেঁচে থাকবেন মানে কাঁদবেন, তাহলে একটু বেশি করে কাঁদুন
এ-জীবনে হায় খেতে পারব না অনেক অনেক অনেকদিন
চিংড়ি সহ মাংসভুনা…অতীতকথা আর নিয়মচাকা নানা বাহানায়
বলছে : কত সহজেই-না পাল্টে যেতে পারে ভবিষ্যৎ!

 


পথে কিছু অচেনা গাছ, অদেখা পাখি, হাওয়া ভরে বসছে ডালে
তাই কি না তুই আমাদের বুঝিয়েসুঝিয়ে বসতে বলিস একেলা হাওয়ায়
জানাবোঝাটা প্রাপ্য সময়ের কয় ভাগ? এই মুভমেন্ট, এই ধাক্কা
হাওয়া বলব না, হাওয়া বলতে ভয়, যদি গতিবিস্তারে হয়ে যাস একা…
ওই যে উড়ছে ব্যাপক হতাশা, পাখির গলায় গান ঝুলছে, মেঘদল আর মায়াবৃষ্টিজল
শুনছি জলপরী আর শব্দধ্বনি কানে তুলছে গোপন আলোড়ন
মন হা-ডু-ডু খেলে ছড়াচ্ছে স্তব্ধ বিবরণ ও ছোটছোট অনেক আখ্যান;
ঘুমপুঞ্জ উদ্বেগে তৈরি হচ্ছে, কান্নাপথে, সকাল আর সন্ধ্যাকাল, মৃদু আলো
পূর্ণগতিচক্র মেখে কতদূর যাবে, যেতে পারে কত দূরে আর…

 


সঙ্ঘবদ্ধ ছায়ার হাড়ে দাঁড়িয়েছে গাছ, গাছের হাড়গুলো
পাতা ও কাঁটাগুলো ঝুলে আছে রোদ খুলে উঁচা দেয়ালে
জানালায় দাঁড়িয়ে জানলাম বহু জিজ্ঞাসা, দেখলাম পরিকল্পনা;
হাওয়াগাছের শেকড় ধরে বসে আছে জল, জল বেঁচে আছে
শিকড়ে, মাটি আঁকড়ে, বেঁচে আছে দৃষ্টির অগোচরে ফরিয়াদি
চোখ; জেনেছি জীবনজিজ্ঞাসা…জানাবোঝায় জীবন অতিসহজ;
স্বার্থফল বড় মিষ্টি জানি, এ পৃথিবীর আলোবাতাস মিশে আছে
মানুষগাছে; এভাবে ফুরাবে না জেনে সম্পর্কগাঢ়তা আরও ছুঁই…

 


রাত্রিশেষে রাত্রিভাষা শব্দে লিখি, লিখি না কেবল মর্মবার্তা
বাক্য প্রকাশের আগে আরো কিছু লিখি, লিখি সহস্র মূর্খতা
শুধু লেখা হয় না কোন পথে তা র আসাযাওয়ায় পুড়ে-ওড়ে
ধ্বংসাবশেষ; বরফ ভ্রমণের শেষভাগে খুলে রাখছি উষ্ণতা,
মায়া বাড়ে, সহজেই বোঝা যায় তার অনুভূতি ও নিঃসঙ্গতা…
সবকিছু লিখে রাখা পাপ। ইচ্ছের চুমু খেয়ে আসক্তি মনে মাখি,
প্রত্যক্ষ করি, তাকিয়ে থাকি, দেখি সর্বনাশী তটক্লান্তি আগুনভরে
কোনদিকে দাঁড়াল—কোনদিকে দাঁড়াল মায়াগ্রাহী স্বপ্নস্মৃতি…
প্রতিমুহূর্তের অপেক্ষা, তার ফেরার আবেগে দরকারি কোনো কথা
ছিল না, ফেরারী মোহদর্পণে জ্বলছে গ্রহণ, আহা! সাধের বৃন্দাবন
সহস্র বছরের ইতিহাস ভেঙে শীতপাখি কাঁপিয়ে তুলছে শব্দব্যঞ্জন
কাঁথাবালিশের নিচে মুখ তার, অর্থহীন কথালাপ, আলাপনগুনগুন।

 


প্রাত্যহিক কথার ছিঁটেফোঁটা কিছুই মনে পড়ে না
অথচ মায়ামমতা টেনে রাখছ যে চোখে, আজ তারই
ছুটির আয়োজনে বাজছে স্মৃতিগান, অহর্নিশ পোড়াক্ষতে…
ভবিষ্যৎ জানি না বলে যত অপেক্ষা কাঁধে তুলে রাখি
শরীর থেকে তুলে রাখি রাত্রিভ্রম, গোপন মন্ত্র, রহস্যকাহিনি…
জানি গ্রহণের আগে এইখানে খুব জরুরি ছিল কথোপকথন,
দেখা ও নির্দেশনা—ধরে রাখার এমনই তাড়না ভেতরে—
এর থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই পাপখাতা ও হাওয়ার বিশ্রাম।

 


আমি কোনো কবি নই যে আমার শুরুটা হবে নিজস্ব নিয়মে
আমার কাহিনিরা আমাকেই জ্বালিয়ে রাখে দীর্ঘরাত্রির আলোয়
অবোধ বালকের মতো আয়নার দিকে ফ্যালফ্যাল তাকাই
কিছু বুঝি না! ভেসে যেতে-যেতে পুরাণের জলে পিছলে পড়ি
বুঝি না কোথায় হারাল পায়ের দখল, দোলা, অবুঝপনা…
পথপ্রবাহ কোনদিকে ঝুঁকে পড়ল আমার দু-চোখের নিস্তব্ধতা
বেয়ে ওঠা অশ্রু, অর্ধেক দ্বিধা…শূন্যে জমুক না-বলা কথা,
ভুলের শহরে আরো আরো জমুক সন্দেহবোধ; শেষাংশটুকু
স্পষ্ট জানি না বলেই তো এত দেখার নেশা, হাওয়াঘরের হ্রেষা…


সৈয়দ আফসার রচনারাশি

সৈয়দ আফসার
শেয়ার করুন:

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you