[বলা যায় যে এই লেখাটা বাংলায় র্যাপ/হিপহপ মিউজিক নিয়া আরেকটু বড়সড় কলেবরে একটা আশু রচনার প্রস্তাবনা মাত্র। শুরুয়াতেরও শুরু, প্রস্তাবনারও প্রস্তাবনা, বলা ভালো। অবশ্য বোঝাই যায়, না বললেও, দেখে এবং অঙ্গুলিমেয় গুটিকয় লাইনগুচ্ছের এই ক্ষীণকায় নিবন্ধপ্রতিম ন্যানো-রচনায় একটাবার চক্ষু দৌড়ায়ে নিলে। এই প্রস্তাবনাকার এতদপ্রাসঙ্গিক সম্ভাব্য রচনাটার জন্য অচিরেই লিখনবৈঠকে ব্যাপৃত হবেন মর্মে আমরা আশায় বসত করতে চাই আপাতত। ততক্ষণে ন্যানোগদ্যে একটু উশখুস নজর দৌড়ানো।
কখন লিখবেন, কোথায় লিখবেন, কতটা কাভার করবেন আর কতটা না — তা তো বলতে পারি না; বা, আদৌ হয়তো লিখবেনই না — তা-ও হতে পারে; সেক্ষেত্রে এক-দুই-তিনটে এক্সপেক্টেশন আমরা আদবের খেলাপ করে আগেভাগেই জানায়া রাখতে পারি, কিছুটা আব্দার হয়তো, ইনি লিখুন বা অন্য কেউ যিনিই লিখবেন ব্যাপারটা মাথায় রাখতে পারেন ফের ফেলে দিয়ে ভেঙেচুরে অভাবিত মোড়ের দিকেও রচনা হাঁকাতে পারেন।
কথাটা হচ্ছে, র্যাপ এবং হালের হিপহপ ইত্যাদি দিয়া বাংলায় এখন-পর্যন্ত খুব বেশিকিছু করতে পারার জমিজিরাত হাজির কি না; মানে, ব্যাপারটা আমাদের কাছে সেভাবে ক্লিয়ার না যে ইংরেজি মিউজিকে বা আর্টে বা লাইফে-লিভিঙে যেভাবে ব্যাপক সংখ্যায় এবং বিস্তর মাত্রায় সাবকালচারের হাজিরানা পাওয়া যায়, সেই সংখ্যায় এবং মাত্রায় সাবকালচারের উপস্থিতি ব্যাতিরেকে র্যাপচর্চা স্রেফ উল্টানো-টুপি ইংরিজিকপ্চানো বড়বাপের পোলার মিঁউমিঁউ শৌখিনতায় পর্যবসিত হয় কি না। আশঙ্কা, অবস্থাদৃষ্টে, তা-ই। ইদানীং মমতাজ আর কুদ্দুস বয়াতি প্রমুখ শিল্পীদেরে নিয়া র্যাপার/‘হিপহপার’ শখিনদারদের খানিক রগড়তামাশা হেরিয়া আশা-ভরসা আরও চুপ্সায়া যাচ্ছে আমাদিগের ন্যায় সিঁদুরে-মেঘে ভীতু ঘরপোড়া গাইগোরুদের।
আশায় লিভস্ লক্ষ্মী। কাজেই নিরাশ না-হই। কিন্তু খুব-একটা বল পাই না এক্ষেত্রে। কেননা এখন অব্দি চিহ্নাদি যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে র্যাপ বলতেই কিছু ‘ছন্দমেলানো’ অথবা ‘আছন্দা’ (র্যাপার অবশ্যই বলবেন ‘আচোদা’, স্ল্যাং মাস্ট বি দি প্রাইম অলঙ্কার/উয়েপ্যন ইন র্যাপিং) ব্যাপারস্যাপারকেই বুঝিয়া নিতেছেন বাংলার উল্টা-ক্যাপ-পরিহিত তুর্কিঘোড়া র্যাপারবৃন্দ। বঙ্গজ কবিদের গরমকালে শালপরিধানের মতো উল্টো করে টুপি পরানোর মধ্যেই ঢাকাই র্যাপাররা তাদের মেধা-মেদমজ্জা ঢালিয়া দিতে যেন মরিয়া। র্যাপ কি তা-ই? ইংরিজি র্যাপ তা তো বলে না। ধানশীষ-নৌকা টাইপের রাজনীতিশীর্ণ বাংলাদেশে শিল্পে-সাহিত্যে-চিন্তাচৈতন্যে সর্বত্র দ্বিকোটিক স্থিতাবস্থার দৈন্য বহুদ্দিন হলো। ফলে এখানকার গানে-প্রাণে সবখানে এই দ্বিমেরুদুর্দশা। র্যাপ কি থিয়োরিটিক্যালি সম্ভব মিঠা-মিঠা বাতেচিতে, সুললিত স্বরে, আব্বি-আম্মি-ফিয়াঁস্যেখুশ পঙক্তিনির্মিতিতে? গ্রে-অ্যারিয়া নাই যেখানে, র্যাপারও যদি সবকুচ ভালো-মন্দ নিক্তিতে মেপে দুনিয়া বানাইবার মহত্তর ব্রত নিয়া মাঠে খেলতে নামেন, সেখানে র্যাপের বিতং-করা নামধাম আর হাজার রেলার কথাবার্তাই হবে শুধু, হচ্ছে যেমন বঙ্গে। এরপরও জলের গানের নাট্যপনা আর চিরকুটের চ্যুয়িংগামস্যুয়িট গানাবাজানার মোচ্ছবে এইটুকু ‘সব চুপ’ লিরিক্স-রেন্ডিশনও উমদা ব্যাপার। ফিডব্যাকের বা ম্যাকের ঢাকা ব্যান্ডের কন্টিন্যুয়েশন হলো না যেহেতু, অগত্যা।
আরেকটা ব্যাপারে একটু ‘ঐতিহাসিক’ রেফ্রেন্সেস টানার দাবিটা আমরা জানায়া রাখি ইমরান ফিরদাউসের আপকামিং বৃহত্তর-কলেবর রচনাটার কাছে; সেইটে এ-ই যে, র্যাপগানের একটা ভালো শুরুয়াত হয়েছিল গত শতকের নব্বইয়ের বাংলাদেশে। সেইটা ব্যান্ডেরই ‘মূলধারা’ আদরার মিউজিশিয়্যানরা করেছিলেন হয়তো, র্যাপের আলাদা ‘গ্যাং’ তো তখন ছিল না যেমন এখনও নাই ইউটিউব-ড্রয়িংরুম ছাড়া। আমাদের মনে পড়বে অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানের হুবহু অনুসরণে ‘ত্রিরত্নের ক্ষ্যাপা’ দিয়া আরম্ভ-করা র্যাপ পরে ‘বায়ুচরা’ ইত্যাদি আরও অনেক র্যাপ অ্যালবামের বাজারপ্রেজেন্স এমনকি বিস্তর কাটতি নিশ্চিত করেছিল। কমিক রিলিফের দিকেই ছিল ঝোঁক মূলত, তবু অভিজ্ঞতা হিশেবে সেইটা আদৌ মন্দ হয়েছিল বলা যাবে না। আজকের র্যাপার/হিপহপার যারা ক্লেইম করছেন ‘গত-একদশকে’ র্যাপগান বাংলায় ইন্ট্রোডিউস করেছেন ‘প্রথমবারের মতো’, পুরাকালে ছিল না তাহা বাংলাভাণ্ডে, উনাদিগেরে এই ইতিহাসজ্ঞান প্রোভাইড করা আবশ্যক। ব্যাপার আরেকটা আছে এ-ই যে, র্যাপ দিয়া যা ফলিয়ে তুলতে চাইছেন আজকের ইউটিউবআর্টিস্টরা বাংলায়, তা কি তিন-চারদশকে একের পরে এক অ্যালবাম দিয়ে ব্যান্ডগুলো ফলাইয়া যায় নাই? বিছড়াইয়া দেখতে হবে ভালো করে। মেইনস্ট্রিম আর্টিস্ট বা ব্যান্ড যা আরও ভালোভাবে দিতে পারে, তা-ই কি ডিজে কায়দায় দিয়া যাওয়ার নামই হিপহপ বা গ্যাংস্টা-র্যাপ? ফয়সালা সারা দরকার। অন্তত গত একদশকে লালমিয়া নামের এক র্যাপারের কাজ আমরা শুনে এসেছি, এবং এই একটা জায়গায় বেশ আশান্বিত হওয়া গিয়েছিল যে র্যাপের ব্যাপারটা বাংলায় আসতে লেগেছে এইবার। ‘দেশী এমসিস্’, ‘শ্যাক্’, ‘এক্সপ্লোসিভ’, ‘এমসি মাগস্’ ইত্যাদি নিয়া আলাপকালে এই লালমিয়ার লাইনঘাট, লালের স্ল্যাং ও কলোক্যুয়িয়্যাল ডায়ালেক্ট, লালের লিরিকের ধক ইত্যাদি বিষয়াদি ডিসকাশনে না-এনে উপায় প্রায় নাইই বোধহয়।
আর র্যাপ কি কথিত ‘মূলধারা’ হইবার লক্ষ্যে নেচেগেয়ে মাত করে বেড়াবে? মেইনস্ট্রিমই কি র্যাপের মঞ্জিল-এ-মকসদ? অন্তত এই শিল্পী, স্কিবখান প্রমুখ র্যাপ/হিপহপ শিল্পী, কিংবা তার ইয়ারদোস্ত তা-ই মনে করেন দেখা যাচ্ছে একটা সাক্ষাৎকার সুবাদে। সেখানে এমনকি এই কথাগুলোও অযাচিত শুনতে হয় এই মিষ্টি লিরিকের মিঠে রেন্ডিশনের শিল্পীর মুখে, “I am NOT anti-establishment, I simply want accountability and transparency. I want things to be right. I don’t want to put those labels on me. As an artist I try to give people a little joy and still make them think about our problems.” শুনিয়াই মনে হয়, এইবার শুরু হলো বুঝি-বা বাংলাদেশে এনজিও কিসিমের নন-গোবার্নমেন্ট মিউজিক্যাল অর্কেস্ট্রা! তা না-হলে অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি, ট্র্যান্সপ্যারেন্সি, প্রোব্লেম … সল্যুশন … ব্লা ব্লা … কী-সব হতচ্ছাড়া হাস্যতামাশ্য! হায়! এদেশে র্যাপারের মনেও খোয়াইশ দ্যাখো ‘আর্টিস্ট’ হইবার! সার্থক জনম, জন্মিয়া এই দেশে, মাগো!
তবুও লক্ষ্মী লিভস্ ইন আশা … (গানের কথাপঙক্তিনিচয় নিশ্চয় আগে শ্রাব্য রচনাটা পাঠের প্রাক্কালে) … গানপারের তরফ থেকে একটা আশার বাণী ব্রডকাস্ট করে আপাতত ইমরান ফিরদাউস প্রণীত প্রস্তাবনা-গদ্যটুকু পড়ি এবং বিস্তারিত অপেক্ষা করি বৃহৎ-কলেবর রচনাটার। — গানপার]
বাকরুদ্ধ ভুবনের পোলিটিক্যাল অ্যান্থেম
যাগো অনেকেই ভাবত ভঙের দোকানদার, দেখা যাইতেছে তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাইতেছে বাকি সোসাইটিরে যে তারাই লাইনে আছে।
ঢাকা শহরের প্রান্তিক সংস্কৃতির চর্চাকারী হয়েও তারা দেশ-দশের হালচাল, বড়লোকের দাম্ভিক হুঙ্কার, মধ্যবিত্তের কারবার, গরিব মানুষের জেরবার জীবন নিয়ে প্রয়োজনীয় ভাবনাটুকু ভাবতেছেন, ভাবনারে কথায় সাজাইতেছেন, কথারে গীতে বয়ান করতেছেন।
তারচেয়ে বড় বিষয় হইলো, প্রশ্ন করতেছেন : সোনার বাংলা কি শুধুই কল্পনা? ভয়রে বে-তোয়াক্কা কইরা আওয়াজ তুলতেছেন, আর কত সুবিধাবাদের তেল চাষ করবে “তুমি আর আমি / বাকি সব হারামি”-মূলক এই দিগদার চাকুরে, নতজানু সিভিকো-কর্পোরেট গোত্র!!
এই প্রান্তিক কালচারচর্চাকারীরা আমাগো কানের ওপরে বইলা গেল, শিল্পসাহিত্য যদি সময়ের কথাই ধারণ না-করে, তাইলে সেই আর্ট-কালচার বহুৎ বাহবামূলক সৌন্দর্যের বিচ্ছুরণ ঘটালেও, তাতে যাপিত জীবনের মোনাফেকি থেইকা নাজাত মেলে না।
সময় বড় শয়তান — এইটা যেন না ভোলেন।
আজকে চুপ আছেন ঠোঁটে ঠোঁট চাইপা, একদিন আসিতেছে ক্রমশ — যেইদিন মন চাইলেও আপনের কণ্ঠ দিয়ে আওয়াজ বারাইব না; কারণ — ঘরের পোষা ফ্রাঙ্কেস্টাইন-যে টুঁটি চাইপা ধরবে আপনার, আমার, সকলের।
পোলিটিক্যাল অ্যান্থেমের জয় হোক। ওঁ শান্তি!!
… …
- পলিটিক্স অফ বেঙ্গল : দৃশ্যবাস্তবতার রাজনীতিতে কিছু গরহাজির আত্মা || অরিজিন্যাল : জেমস লিহি / অনুভাষ্য ও অনুবাদ : ইমরান ফিরদাউস - November 22, 2024
- চেতনার ভিত নাড়িয়ে দেয়া চলচ্চিত্র || ইমরান ফিরদাউস - September 29, 2024
- সুমন মুখোপাধ্যায় : এক মেইকার || ইমরান ফিরদাউস - September 25, 2024
COMMENTS