বেঁচে থাকলে তেপ্পান্ন উমর হতো। বর্তমানে এই যিশুজন্মের ২০১৭ অব্দ। বছর অবশ্য অন্তিমেরই দিকে। বেঁচে থাকলে চুয়ান্নই হয়ে যেত; হয়েছিল জীবনানন্দের যেমন, এক্স্যাক্টলি চুয়ান্ন। জনৈক সংবাদজীবীর ন্যায় — হাওরের ভাটিতে জন্মে যেই নিউজবণিক ভদ্রপুত্র উড়িয়া-সাঁতরিয়া বেড়াইছেন ক্ষমতার নদীনালাঘেরা রাজধানীর উজানে — ডেইলি নিউজপেপারে এই সিলেটিয়া জালালি কৈতর এই সুনামগঞ্জের কুড়া সাংবাদিক স্তম্ভ/কলাম লিখিয়া মালপানি ইনকাম করেন দেদার আর মন্ত্রীমিনিস্টারের সনে অম্লমধুর মধ্যস্থতা রাখিয়া সারিয়া হাভেলিদেয়ালে বেগুনি ডিস্টাম্পার লেপেন এক্সপেন্সিভ বছরের ইতিউতি ঈদে-পরবে — এই হিল্লি এই দিল্লি এই ইউএসএ-ক্যানাডা রাজসাংস্কৃতিক সফর মারেন হফতায়-মাসে — সেনাকুঞ্জে সেলিব্রেইট করেন জমকালো জন্মদিনের মুহূর্তে মাহেন্দ্র পঞ্চাশপূর্তি; — আমাদের সঞ্জীবও (Sanjeeb Chowdhury) প্রোফেশনবিবেচনায় জার্নালিস্ট ছিলেন মুখ্যত, মন্ত্রীমিনিস্টারের চৌসীমা মাড়ানোর মুরদ ছিল কি ছিল না তা জানি না, ক্ষ্যামতাকাঠামোর লগে তলে তলে আশনাই ছিল কি না তা-ও অজানা, বা থাকলেও গোচরে আসে নাই আমাদের কখনো, তবু প্রকাশ্য ক্ষমতাতোষণ কদাপি ছিল বলে এভিডেন্স পাওয়া যায় না, আম্রিকা-ক্যানাডা খ্যাপ মেরে বেড়াইবার তাক্কতও হয় নাই তার, মদখাওয়া আর গানগাওয়া ছাড়া আর-কোনো মহত্তর তৃতীয় শখাহ্লাদ ছিল না বলিয়াই নির্ভরযোগ্য দূরত্বের ইনফো বলছে; বেঁচে থাকলে আমাদের সঞ্জীবও কি তবে সেনাকুঞ্জে সেলিব্রেইট করতেন নিজের আয়োজনে স্বীয় অর্থায়নে একগাদা গাব্দাগোব্দা স্তাবক ডেকে এনে হ্যাপি ফিফটি-থ্রি? কিংবা সামাজিক বাকবাকুম মিডিয়ায় তার জন্মশুভক্ষণে সেলিব্রেশন্যাল ট্রল হতো কি তিনসহস্রচুয়ান্ন? মরিয়া না-যাইলে, বেঁচে রইলে, এই দিবসের প্রাক্কালে একগাদা লোকেরে ইনবক্স করে নেমন্তন্ন জানাইতেন কি নিজেরে লইয়া বাদ্যবার্তা বাজাইবার? বলতেন কি, অয়ি মম বদ্ধবন্ধু ছদ্মশত্রুবৃন্দ, স্মৃতিগল্প লেখো মোরে লয়ে! তেপ্পান্ন/চুয়ান্ন রগড়মার্কা বাদ্যরচনার সমাহারে একটা সাইটই বানায়া ফেলতেন কি আস্ত? বলা যাচ্ছে না, যা দিনমাদান পড়েছে আজকাল, আস্থা রাখার যোগ্য পাত্রগুলোও চোখের সামনে হেঁজে যেতেছে ক্রমশ! সুতরাং, ভেবে দ্যাখো, মরে যাওয়াই ভালো। অতএব, অনেক কবিতা গান গল্প ম্যুভি ও মর্সিয়া সাঙ্গ করে ভেবে দ্যাখো, মরে যাওয়াই ভালো। মরে গেলে পচে যাওয়ার ব্যাপার থাকে না আর। পঞ্চাশে পদার্পণের এক-দেড়দশক আগেই আমরা পচা চালকুমড়া আর নষ্ট শসা হয়ে বেহতর জিন্দেগি জিনে চলেছি। সঞ্জীব বিয়াল্লিশ পর্যন্ত অপচা থাকতে পেরেছেন যদ্দুর জানা যায়। এর অনেক আগেই গেয়েছিলেন “তুমি আমার বায়ান্ন তাস / শেষ দানেও আছি / তোমার নামে ধরেছি আমার / সর্বস্ব বাজি” … ফিফটি-থার্ড/ফিফটি-ফোর্থ বার্থডেতে এই স্বপ্নবাজ সুরের খোঁয়ারিতে বেঁচে-যাওয়া বাবু সঞ্জীব চৌধুরীকে হ্যাপিবার্থডে জানাই।
ওড়ে রক্তচোষা, ডাকছে পেঁচা, যায় দিন ড্রাকুলাডানায়
“হে অসভ্য, কুলাঙ্গার, লিঙ্গবান ধর্ষক রাষ্ট্রের নাগরিকবৃন্দ, তোমরা কি ইয়াসমিনকে ভুলে গেছো? ইয়াসমিন — যে-মেয়েটি ভুল করে বাড়ি ফেরার জন্য ভুল গাড়িতে চড়েছিল। সেই অচেনা স্টেশনে অসহায় মেয়েটাকে একা পেয়ে ধর্ষণ করেছিল রাষ্ট্রের নিরাপত্তারক্ষাকারীরা।
১৯ বছর আগে, ১৯৯৫ সালে, দিনাজপুর শহরের রামনগর এলাকার গরিব ঘরের শরীফা বেগমের মেয়ে ইয়াসমিন কাজের জন্য ঢাকায় এসেছিল। মাত্র ক্লাস্ ফোরে পড়ত সে তখন। কাজ করে আবার টাকা জমিয়ে পড়ার জন্যই সে ঢাকায় এসেছিল; কিন্তু তার সেই স্বপ্ন ভেস্তে গিয়েছিল এই ধর্ষক রাষ্ট্রের পাহারাদার পুলিশের হাতে। রাতভর ধর্ষিতা ইয়াসমিনের মৃতদেহ সকালে ফেলে রাখা হয়েছিল ভ্যানের উপর। এই নিয়ে মাহমুদুজ্জামান বাবু-র একটা গান আছে ‘নিরাপদ হেফাজতে মারা যায় ধর্ষিতা ইয়াসমিন’। তারপরের বাকিটা তো ইতিহাস এখনো।
সেবার ধর্ষক পুলিশের বিরুদ্ধে সারাদেশ ফুঁসে উঠেছিল, এইবার ঘটনা হয়েছে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে, আবার সময় এসেছে ফুঁসে ওঠার।”
উপরে-ঝুলিয়ে-রাখা এপিগ্র্যাফটা আদতে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস, আপডেটেড বাই কাজল দাস, ২৩ মার্চ ২০১৬ তারিখে ইয়াসমিন নাম্নী কিশোরীটির খুন হবার দুইদশক পূরণের প্রাক্কালে একই ঘৃণিত ঘটনার পুনরাবর্তন ঘটে আরেক উজ্জ্বলপ্রাণ তনুর ক্ষেত্রেও। জলপাইপ্রিন্ট উর্দিপরা বাহিনীর জওয়ান কর্তৃক তনু ধর্ষণঘটনা ধামাচাপা দিতে মেয়েটাকে খুন এবং অতঃপর নির্যাতিতের পরিবারটিকে হেয় করা আর নানা ভ্যান্তারা নাটকের ভিতরে বেতালা নাটকে দেশের মিডিয়াচাঞ্চল্য ও কয়েকদিন একটানা টালবাহানা তারপর পুনরপি ‘নিশ্চুপ মাঝরাত চারিদিক চুপচাপ’ … ‘আর নীল লাল রূপালি নীরব’ … ধান ভানতে সোশ্যাল স্পেসে কতই-না শিবের গান … নব নব কুমার-কুতুবদিগের নব নব অপমান … নতুনতর ঘটনা … আবারও সব চুপ … সমস্ত সুনসান … চরাচরে রেশমকোমল চাদর নীরবতার … কবি-চিত্রী-শিল্পক্রিটিক-চলচ্চিত্রকার … বদলের ব্যজস্তুতিভরা বাস্তুভিটায় এ-ই তো অপরাজিত অপুর সংসার …
নো, সভয় জানাই, ইয়াসমিনকে ভুলি নাই। কিন্তু বাঁচতে চাইলে, রসেবশে থাকতে চাইলে, এই অপরূপী শিল্পসাহিত্যের দেশে, ইয়াসমিনকে ভুলে যাওয়াই ছিল ব্যক্তিক বিকাশের জন্য উন্নয়নকর। কেননা আমিও চাই একের পরে এক ধর্ষণঘটনা নিয়া সাহিত্যিক নৃশংস রঙ্গব্যঙ্গ রচিবারে, যেমন রচনা আশ্চর্য হা হয়ে দেখি নিত্য। উন্নতি হতো, যদি পারতাম ভুলে যেতে ইয়াসমিনকে, রঙ্গরস উপচে উথলাতো বন্ধুদের মতো আমাদেরও। ভুলতে পারি নাই, ইয়াসমিনকে, সীমাকে, তানিয়াকে … এবং, হায়, শত শত শবমেহেরকে!
ইয়াসমিনকে ভুলতে পারি নাই, ইয়াসমিনকে প্রতিদিন মনে পড়ে, গুনগুনিয়ে স্মৃতিচারণ করি ইয়াসমিনের — অবলা আমিও — একটা গানসূত্রে, একটা গানের করাল গ্রাসে এতটা আচ্ছন্ন হয়ে গেছি সেই পয়ালাবার শোনার মুহূর্ত থেকে, ব্যাটা সঞ্জীব তো সুর উড়িয়ে গুঁফে তা দিয়ে গানটা লিখে গেয়ে পগারপার পালিয়েছে। য পলায়তি স জীবতি। আমাদের তো মুক্তি নাই। চিরদিন সঞ্জীব তাড়া করে ফিরবে — আমার, আমাদের — পিছে পিছে, “আহ্ ইয়াসমিন, আহ্ ইয়াসমিন, আহ্ ইয়াসমিন / … ওড়ে রক্তচোষা ডাকল পেঁচা অলক্ষুণে চোখ / সুখের মাঝে হামলে পড়ে নিষিদ্ধ অসুখ” … কী সুর, কী অতিজাগতিক ভয়াল আবহ, শুধু ওই ‘আহ্’ শব্দটুকু সঞ্জীবের মেটালিক ভোয়েসে এমনভাবে রেন্ডিশন্, আজও ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠি গিল্টি ফিলিং নিয়ে, কেঁপে কেঁপে মিইয়ে যাই ঠুঁটো জগন্নাথের ক্রোধে, এবং শিল্পসাহিত্য করি, পড়ি, পড়াই, প্রীতি ও প্রণয়ে হামেহাল নিজেরে দেই ভাসাইয়া, গান শুনি শাস্ত্রীয়, রক্-ফোক্-মেটাল্ লইয়া টালমাটাল স্তবকীর্তনে রহি সদা ব্যস্ত, কোকস্টুডিয়ো আর নেস্ক্যাফে বেইস্মেন্টের প্রশংসা গাহি। ইত্যাদি। সিন্স লাস্ট ঊনিশ ইয়ার্স। গানটা কিন্তু ভুলি নাই। ইয়াসমিনকে ভুলি নাই।
কী আশ্চর্য উদ্ভাস দেখেছিলাম আমরা বাংলা গানে সেই-সময় ব্যান্ড দলছুটসূত্রে তাদের অভিষেক অ্যালবামে! এখনও মনে পড়ে সে-বছর, ১৯৯৭ সনে, অ্যাকাডেমিয়ার বইমেলাকালীন ফেব্রুয়ারিতে বেরিয়েছিল দলছুটের ‘আহ্’ এবং আরেকটি যুগন্ধর অ্যালবাম — জেমসের — ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’; বাংলা গানে এক নতুন বসন্তবাতাস এনেছিল দলছুট, পরের দিনগুলোতে এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পেরেছিল তারা। বাপ্পা-সঞ্জীব ছাড়াও সূচনাঅ্যালবামে আরেকজন গেয়ে ও বাজিয়ে ছিলেন — মিঠু — পরে উনি আর কন্টিনিউ করেন নাই যদিও। ওই সময়টায় অ্যালবামনামেই দলছুট স্তব্ধ করে দিয়েছিল অনেককেই, আমার মনে পড়ে, কেননা ‘আহ্’ শব্দটা আমরা সাধারণত এক্সক্ল্যামেটোরি অব্যয় ধ্বনি হিশেবে আনন্দোচ্ছ্বাস-পুলক-পুরিতুষ্টি প্রকাশের সাউন্ড বলিয়াই ইউজ্ করতাম অধিকাংশত। যদিও এর বেদনাসূচক, বিরক্তিসূচক, ব্যবহারও দুর্লভ নয় অন্তত অভিধাননির্দেশিত। ‘দলছুট’ শুধু শব্দটাকে ব্যবহারিক যাপনে আমাদের আবেগমজ্জার অন্তর্গত করে দিয়েছিল অপারগতা আর আফসোসের আওয়াজ হিশেবে। এই এক আক্ষেপের আওয়াজ, খেদের আওয়াজ, অক্ষম অপারগতার আওয়াজ হিশেবে ‘আহ্’ অব্যয় পদটাকে সঞ্জীব তাঁর লেখা গানটায় চিররোপিত করে গেছেন। যতবার এই ধ্বনি শুনি, রিফ্রেইন্ হিশেবে বারবার এর ব্যবহার হতে দেখি গানটায়, হাহাকারে ছেয়ে যায় আমাদের না-পারা আত্মপ্রতারণাপূর্ণ বড়াইয়ের অভিজ্ঞানঋদ্ধ জনগণতন্ত্রধর্মাবলম্বী দিনাতিপাত। “আহ্ ইয়াসমিন, আহ্ ইয়াসমিন, আহ্ ইয়াসমিন / আহ্ ইয়াসমিন, আহ্ ইয়াসমিন, আহ্ ইয়াসমিন” … অবশ করে দ্যায় বেদনায়, বিপন্নতায়, বিষাদে এবং বিহ্বল লজ্জায়।
এরপরও, স্মরণ করব নিশ্চয়, সঞ্জীবের গানে এই ‘আহ্’ ধ্বনি ফিরতে দেখেছি আমরা; তাঁর সোলো সংকলন ‘স্বপ্নবাজি’, যতটুকু মনে পড়ে, যেখানে একটা গান আছে ‘রিকশা’ শিরোনামে, সেইখানেই ফিরতে দেখি ধ্বনিজালটাকে একটা আনন্দদ্যোতিত আফসোসের ধ্বনি হিশেবে — “একপলকেই চলে গেল / আহ্ কী যে তার মুখখানা / রিকশা কেন আস্তে চলে না” — সেই বিষাদস্ফূরিত গলাটা দিয়েই জীবনভর গেয়ে গেলেন সঞ্জীব। মজ্জমান প্রেমের গানেও জগৎপ্লাবী বিষাদের বহতা ভাসান আমরা আবহমান বাংলা গানে পেয়েছি এই ক্ষণজন্মা গানশিল্পীর কাজের মাধ্যমে। সেই ইয়াসমিনকে বাঁচাতে না-পারাজনিত অবোধ বিষাদই কি? নয়? গেল ঊনিশ বছরে এই অক্ষমতা, এই বিপন্নতা, এই ঠুঁটোপনা আমাদের আরও অবশ করে ফেলবার কথা। আর কে না জানে যে প্রেমে পড়লেই বিষাদ জন্মায় দৃশ্যত, প্রকৃত প্রস্তাবেও, এবং বিষাদের গর্ভ ফেটে একসময় বিদ্রোহ গর্জায়। প্রেমে আমরা পড়ি না আর, বিষণ্ণ হই না, অপারগতায় মিইয়ে যেয়ে একবারও হাত কামড়াই না; আমরা স্মার্ট অ্যাক্টিভিস্ট অধুনা।
‘আহ্’ — ছোট্ট এই ধ্বনিটুকু সঞ্জীবের গলাবাহিত হয়ে যে-অতিজাগতিকতা জাগায়ে রাখে আমাদের মরমে, এতদস্থলে এখন আমরা নানাবিধ প্রতিক্রিয়াকার্যক্রম করেই বিবেক বাজাই নিত্য। তনু মরে যায় এই ফাঁকে। গেল ঊনিশ বছরে একসহস্রঊনিশজন তনু মরে গেছে। একশলক্ষ অনন্ত তনুর পরিবার লাঞ্ছিত হয়েছে। এই স্থিতাবস্থার, — হেন অফুরান স্ট্যাটাস-ক্যু — শোকরগোজার আপনি বা আমি কীভাবে করব! সঞ্জীব পাততাড়ি গুটিয়ে ভেগেছে বহুকাল হয়। য পলায়তি স জীবতি, বোধহয়।
আমরাও পলায়নভাষ্য রচনা করি মহাসমারোহে, ক্ল্যাপ্স কুড়াই, ক্ল্যাপ্স কুড়াতে কুড়াতে বেঁচে থাকি বিন্দাস্। লোকান্তরিত স্বজনের সৎকারের মাধ্যমে আমরা সাধারণত গতায়ু স্বজনের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখি, সম্মান জানাই মৃত স্বজনটিকে, মৃতদেহের সম্মান জানায় সভ্য সমস্ত জনগোষ্ঠীই পৃথিবীতে। তনুকে জীবদ্দশায় না-হোক মৃত্যুপরবর্তী তাঁর সম্মান উদ্ধার করে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতাম, জরুরি ছিল এইটা আমাদের নিজেদেরই নিরস্বস্তি জীবন তথা বেঁচে থাকার খাতিরে। এইটা পারা যায় নাই, দুঃখিত, স্থিতমস্তিষ্ক দশায় আমরা আরও তনুখুন অনিবার্যভাবেই দেখব। ভয় নয়, নিরেট বাস্তবতা, আর আ মরি বাংলাদেশ বলতে সংক্ষেপে এইটাই। জীবন্মৃত হুল্লোড়ে বুদ্ধিবৃত্তিজীবিকাবদ্ধ জনগোষ্ঠীর ভয় থাকে না, ল্যাংটার থাকে না যেমন বাটপারভীতি।
দলছুট দর্দ ও অন্যান্য রিশ্তা
“আর আমি বলিলাম, শোনো দেখি, হে যাকোবের প্রধানবর্গ ও ইস্রায়েলকুলের অধ্যক্ষগণ, ন্যায়বিচার জ্ঞাত হওয়া কি তোমাদের উচিত নয়? তোমরা সৎকর্ম ঘৃণা করিতেছ, ও দুষ্কর্ম ভালোবাসিতেছ, লোকেদের গাত্র হইতে চর্ম ও অস্থি হইতে মাংস ছাড়াইয়া লইতেছ। এই লোকেরা আমার প্রজাগণের মাংস খাইতেছে; তাহাদের চর্ম খুলিয়া অস্থি ভাঙিয়া ফেলিতেছে; যেমন হাঁড়ির জন্য খাদ্যদ্রব্য, কিংবা কটাহের মধ্যে মাংস, তেমনি তাহা কুচিকুচি করিয়া কাটিতেছে। … যে-ভাববাদীগণ আমার প্রজাদিগকে ভ্রান্ত করে, যাহারা দন্ত দিয়া দংশন করে, আর বলিয়া ওঠে ‘শান্তি’, কিন্তু তাহাদের মুখে যে-ব্যক্তি কিছু না-দেয়, তাহার সহিত যুদ্ধ নিরূপণ করে, তাহাদের বিরুদ্ধে সদাপ্রভু এই কথা কহেন, এই কারণে তোমাদের কাছে রাত্রি উপস্থিত হইবে, তোমরা দর্শন পাইবে না; তোমাদের কাছে অন্ধকার উপস্থিত হইবে, তোমরা মন্ত্র পাঠ করিবে না; এই ভাববাদীদের উপরে সূর্য অস্তগত হইবে, ও ইহাদের উপরে দিন কৃষ্ণবর্ণ হইবে। তাহাতে এই দর্শকেরা লজ্জিত ও এই মন্ত্রপাঠকেরা হতাশ হইবে, সকলে আপন আপন ওষ্ঠাধর ঢাকিবে, কেননা ঈশ্বর উত্তর দিবেন না।”
বাইবেলের ভাষাভঙ্গির মধ্যে একটা আলাদাত্ব শ্রুতির অগোচর থাকে না বাংলায় বাইবেলানুবাদ পড়ার সময়। ভালো লাগে এর এলানো ভঙ্গিমা। বাংলার পুরনো গেঁয়ো কলমিদাম-শ্যাওলার গন্ধ যেন অনুবাদে লেপ্টে থাকে। ব্যাপারটা ভালো বলতে পারব না এ-মুহূর্তে যে এর সঙ্গে উইলিয়্যমকেল্লার বাংলাটা পার্সেন্টেজে কতটুকু। তোরঙ্গে-রাখা কাপড়জামার মধ্যে ন্যাপথলিনের যে-একটা ঘ্রাণ, ওই ঘ্রাণটা ছাড়া বাইবেলের ভাষিক প্রাচীনত্ব শব্দে-বাক্যসংগঠনে তেমনটা নাই। কিন্তু অদ্ভুত কিছু এক্সপ্রেশন আছে যেগুলো অন্যত্র সুলভ নয় এই স্টাইলে। যেমন আহ্বানসূচক পদ ‘এসো’ না-বলে এখানে ‘আইসো’ বলা হয় এবং বাইবেলে এর ব্যবহার প্রচুর। অথবা ‘আর’/এবং সংযোজক অব্যয়ের ব্যবহার। শেষোক্ত অব্যয়প্রযুক্তি পঙক্তির/প্যারাগ্রাফের সূচনায় ব্যবহৃত হলে একটা অ্যাব্র্যাপ্টনেসের উদয় হয়, যে-কারণে পাঠকমনযোগ আকর্ষিত হয় বেশি।
কিন্তু শব্দ বা সিন্ট্যাক্স খুব-যে অ্যানশিয়েন্ট বাংলা ধাঁচের এমন নয়। এমনকি সাধুরীতির যে হার্ডকোর প্রয়োগ দেখি বাংলার সাহিত্যলেখাকৃতিতে কিংবা আরও সমস্ত দলিলদস্তাবেজে, এখানকার সাধুশৈলী তেমন নয়। একেবারেই সহজ স্বতশ্চল বাক্যস্রোত। যদিও কমা-সেমিকোলন ইত্যাদি যতিচিহ্নের উপর্যুপরি প্রয়োগে বাক্য সর্বদাই দীর্ঘ ও জটিল/যৌগিক, তদুপরি বিস্ময়কর নরম ও নমনীয় এবং ভাবগম্ভীর। এহেন গদ্যের উদ্ভব কোন প্রক্রিয়ায় এবং এর বিকাশ কতটুকু হয়েছে, একটা জায়গাতেই কেন এর ঘুরপাক, বাইবেলের অনুবাদ ছাড়া আর-কোথাও এই বাংলা নাই কেন, বরিশালের কলোক্যুয়্যাল্ ল্যাঙ্গুয়েজের ছাপ এর কোথায় কোথায় আছে নাকি কোত্থাও নাই ইত্যাদি নিয়া বাংলাভাবুকদের রচনাপত্র নিশ্চয় আছে। বাংলা গদ্যের কালান্তর কিংবা ঊনিশ শতকীয় বাংলা গদ্য নিয়া ম্যালা কাজকর্ম তো সুলভ এবং ওইসব বইপত্রে ঢুঁ দিলে এতদসংক্রান্ত খবরান্তর মিলবে সার্টেইনলি।
স্ক্রিপ্চারগুলো অনূদিত হবার সময় একটা ভাবগম্ভীরতা রাখার গরজে দেখা যায় সাধুভাষারীতি ছাড়াও প্রভূত পরিমাণে আর্কেইক্ ইডিয়্যম্ এবং তৎসম-তদ্ভব শব্দের ব্যবহার হয়ে থাকে। বাইবেলে দেখা যাবে একদম গেঁয়ো আকাঁড়া শব্দ ব্যবহৃত হতে। এইটা ভারি ইন্ট্রেস্টিং। আরেকটা ব্যাপার ভাবায়, সেইটে এ-ই যে, ট্র্যান্সল্যাশনের সময় একই সাধুরীতির শৈলী ইউজ্ হলেও ভিন্ন ভিন্ন স্ক্রিপ্চারে ভিন্ন ভিন্ন ধ্বনিদ্যোতনা ব্যঞ্জিত হয়। যেমন কোরানের বঙ্গানুবাদও মোস্টলি সাধুবাংলায়; যদিও কোরানের চলিতরীতির অনুবাদ বাংলায় একাধিক রয়েছে এবং সেগুলোতে ভাবগাম্ভীর্যেরও খুব-একটা ক্ষতি হয়েছে বলা যাবে না; বাইবেলের চলিতভাষারীতির অনুবাদন একটাও চোখে পড়ে নাই; কিন্তু কোরানের চলিতভাষায় বাংলান্তর মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ছাড়াও অন্য কয়েকটা ভালো ও সুশ্রাব্য হয়েছে; ‘সেবা প্রকাশনী’ থেকে সম্প্রতি ‘আল কোরানের মর্মানুবাদ’ নামে একটা বাংলা বেরিয়েছে। এবং কোরানের অনুবাদবাক্যাবলির প্রাচীনতা আর ঋজুতা, তার ভাবগাম্ভীর্য ও গন্ধবর্ণসুর, বাইবেলের থেকে আলাদা। সাধুরীতিতেই অনুবাদিত উভয়ে, তারপরও এই ভিন্ন ব্যঞ্জনা আসে কোত্থেকে? এর কারণ ভাষারীতি নয়, যতটা ভাষার চাল, বাক্যসংগঠনের চাল। এইটা, ভাষার চাল ব্যাপারটা, খানিক ব্যাখ্যা করা গেলেও পুরোপুরি ব্যাখ্যেয়ও নয় বোধহয়। এ নিয়েও কোনো অবকাশে একদিন আরও কিছুদূর পর্যন্ত খুঁজে দেখা যাবে।
এইখানে সঞ্জীব মেমোরিয়্যাল্ নিবন্ধ লিখতে যেয়ে এসেছে বাইবেল প্রসঙ্গ। উড়ে এসে জুড়ে বসা না কিন্তু! ঘটনাটা আরেকটু বলি। শিল্পী হিশেবে ক্যারিয়ার শুরুর আগে সঞ্জীব জার্নালিস্ট হিশেবে ডেইলি নিউজপেপারগুলোতে যেসব ফিচার লিখতেন, সেগুলোর গদ্য তখন আমাদের নজর কেড়েছিল। গস্পেল্ ঢঙের গদ্যভঙ্গি। ‘এবং’ অব্যয় দিয়া প্রায়শ অ্যাব্র্যাপ্ট স্টার্টিং দেখা যেত ফিচারগুলোতে, প্যারাগ্রাফের পর প্যারাগ্রাফে এই ধরনের অব্যয় পার্টস্ অফ স্পিচের দেখা মিলত। তুচ্ছাতিতুচ্ছ দৈনন্দিনমুখর বিষয়াদি, বিনোদনের বিচিত্রাদি, ফিচারগুলোর প্রতিপাদ্য হলেও সঞ্জীবের গদ্যগুণে সেসব প্রাঞ্জল অথচ রাহসিক হয়ে উঠত এবং পাঠক টানত। সম্ভবত সংকলিত হয় নাই সঞ্জীবের এই ফিচারগুলো; হলে পরে একবার রিক্যাপ্ করে দেখা যেত অনুমানের সত্যাসত্য। পুরনো দৈনিক পত্রিকার ফাইল ঘেঁটে একদিন এই জিনিশগুলোর দুইয়েকটা সামনে নিয়া আরও বলা যাবে।
এইবারই ন্যোটিস্ করলাম, সঞ্জীবের জন্ম হয়েছে ২৫ ডিসেম্বর তথা বড়দিনে। এবং তৎক্ষণাৎ ইয়াদ হলো সঞ্জীবের ফিচার-রিপোর্টাজগুলোর বিব্লিক্যাল্ প্রোজস্টাইল্। পরিমাণে খুব বেশি না-হলেও বড় কমও নয়। এইটা আন্দাজেই বলছি যে, এমন হতেই পারে সঞ্জীব যিশুজন্মদিনে জন্মেছেন বলেই হয়তো বঙ্গানুবাদে-বাইবেলের প্রতি ফ্যাসিনেশন্ তৈরি হয়েছিল আর্লি দিনগুলোতেই। কিংবা ভাইস্-ভার্সা। সঞ্জীবের জন্মদিনে যেসাস্ জন্মেছেন বলেই বাইবেলের বাংলা অনুবাদের প্রোজস্টাইল দেখতে দেখতে একসময় সঞ্জীবেরও কলমডগায় এর কিছু চারিত্র্য রক্তের ন্যায় মিশে গিয়েছে। কে জানে, আন্দাজিও হতে পারে, এইভাবেই তো হয় ব্যাপারগুলো সো-ফার।
স্ক্রিপ্চারগুলো তো আর আমরা আদ্যোপান্ত পড়ি না বুজুর্গ না-হলে, কিংবা আগাগোড়া রেফ্রেন্সেস্ ডিকোড করে করে পড়ার মতো দরদ ও ধৈর্য কোনোটাই আমার ন্যায় পামর-পাতকেরে আল্লা এখনো দান করেন নাই। কিন্তু ধ্বনিবলয় যেটুকু টানে, সেটুকু লোকমায় তুলে দেখি মাঝেমধ্যে এবং সুরসংশ্রয়ে আবিষ্টও হই, যেমন কদাচিৎ কবিতায় আবেশ জাগে এখনও মধ্যেমধ্যে। যে-বাইবেলপুস্তক থেকে এপিগ্র্যাফ টাঙানো হয়েছে, সেইটার ফিনফিনে একপৃষ্ঠার প্রিন্টার্স ক্রেডিটলাইনে দেখা যাচ্ছে এইটা নাইন্টিন্ এইটিফোরের ছাপানো, মুদ্রণ দুইবার যথাক্রমে তিরানব্বই এবং চুরানব্বই, ‘পবিত্র বাইবেল / পুরাতন ও নূতন নিয়ম’, ছেপেছে ‘দি বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটী ঢাকা’; ঢাকা অবশ্য পুরানা আমলের ইংরেজি স্পেলিং দিয়া লেখা, ডি-অ্যা-সি-সি-অ্যা, আর সোসাইটি দীর্ঘিকার দিয়ে। কে বা কারা অনুবাদ করেছে এবং সর্বপ্রথম এই অনুবাদ কখন প্রকাশিত হয় ইত্যাদি আর-কোনো তথ্য নাই।
গীতিকার, সুরকার, বাগগেয়কার
কোনটা কার লেখা, কার সুর, তা ভালো বুঝসমুজে না-এনে এমন দুম করে লিখতে লেগে যাওয়া কাজের কথা না। বাংলা গানে সিঙ্গার-স্যংরাইটার সংখ্যায় ব্যাপক তো নয়ই, গুটিকয় যে-কয়জন আছেন তাদের ভিতরে কেবলি নিজের লেখা গান গেয়েছেন এমন শিল্পী আরও অঙ্গুলিমেয়; উভয় বাংলা — সার্বভৌম বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ার প্রাদেশিক বাংলা — মিলিয়েই হিসাবটা টানা যায়। নিজের লেখা ও সুর-করা গান গেয়েছেন এবং পাশাপাশি অন্যের লেখা ও সুর-করা আরও প্রচুরসংখ্যক — এমন শিল্পীই বাংলাদেশে বেশি। গীতিকার, সুরকার ও সংগীতায়োজক প্রায়শই ভিন্ন তিন ব্যক্তি। কিন্তু ব্যতিক্রমও হয় নাই তা বলা হচ্ছে না। বাংলায় বাগগেয়কার সংখ্যাল্প হলেও আছেন যারা নিজের লেখা গান নিজেই সুর ও সংগীত বসিয়ে গেয়ে থাকেন স্বকণ্ঠে। এইটা আধুনিক বাংলা গানের ব্যাপার, যেখানে অ্যারেইঞ্জমেন্ট গুরুত্ব পায় বেশি, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির সামবায়িক সৃজন হয় যেইখানে গানটা প্রায়শ। লোকগানে একজনেরই হাতে বাঁধা হয়ে থাকে গোটা গানটা। বাউলদের সকলেই বলা যায় বাগগেয়কার। লোকায়ত বাংলার গানবাজনায় বাঁধাছাঁদাটা অত মহিমান্বিত হয় না, যার ফলে গান হয়ে থাকে অনেক বেশি কৃত্রিমতাবর্জিত, বাণীগত দ্যোতনা দিয়াই মিউজিকের মর্ম স্পর্শ করবার একটা আত্মাছোঁয়া কারবার বাংলার লোকসংগীতে লক্ষ করা যায়। বাউল-ফকিরদের কেউই সংগীতের ধাঁচা/খাঁচায় গানটাকে বেঁধে ফেলবার পেছনে ক্ষেপণ করেন না কাল। হইলে হইল, না-হইলে না-হইল, মর্ম খুলিয়া গাওয়াই মুখ্য। লোকসংগীত সে-কারণেই মুক্তবিহঙ্গ।
সঞ্জীব চৌধুরী নিজে যেমন বেঁধেছেন গোটা গান, কথা-সুর-সংগীত সমেত আদ্যোপান্ত, অন্যের বাঁধা গানও গলায় তুলেছেন। সর্বসাকুল্যে গেয়েছেনই তো গোটা-তিরিশেক গান, নিজের গলায়, এর মধ্যে অন্যের লেখা গানই বেশি। নিজের লেখা হোক বা অন্যের, সঞ্জীব যখন গেয়েছেন তখন সেইটা আশ্চর্য কিমিয়ায় সঞ্জীবেরই হয়ে গিয়েছে। রেন্ডিশনের অননুকরণীয় শৈলী দিয়া সাধারণ লিরিকটাকেও সঞ্জীব অসাধারণ করে তুলতে পেরেছেন। সঞ্জীব নিজে একজন কবি, বিধায় লিরিকের লবণ-মরিচ ডিটেক্ট করতে পারঙ্গম ছিলেন বলা যায়। যেজন্যে দেখব যে একের-পরে-এক তৎকালিক তরুণ কবিযশকামী লিরিসিস্ট সঞ্জীবের গীতিকার হিশেবে এসেছেন। সঞ্জীবের জন্যে গান লিখে তারা সাধারণ্যে ব্যাপক পরিচিতিও লভেছেন। এইটা আদৌ সম্ভব হতো কি, যদি সঞ্জীবের গানটা না দাঁড়াত? নব্বইয়ের দশকে বেশ-কয়েকজন উদীয়মান কবির লিরিক সফলভাবে সংগীতের পাখা লাগিয়ে উড়ানোর কৃতিত্ব সঞ্জীবের যেমন তেমনি জেমসেরও।
সঞ্জীব চৌধুরী নিজের গীতগুলোতে সুরারোপণ ছাড়াও অন্য কয়েকজনের গীতে সুর চড়িয়েছেন। অনবদ্য জনপ্রিয় হয়েছে সেগুলোর প্রায় সমস্তই। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের আধুনিক গানে যে-কবিতারিক্ততা, গানের গীতিভাগে এবং সুরযোজনায় যে-চর্বিতচর্বণ, সঞ্জীবের হাতে সেই রিক্ততা অপনোদিত হয়েছে। ব্যান্ডসংগীতের ধারায় গানের লিরিক্স কবিতাময় ছিল না, কাব্যময়তা ব্যান্ডগানে থাকার উপায় ছিল না, নানান কারণে। এই অভাববোধের সঙ্গে কথিত কাব্যময়তায় অভ্যস্ত হয়ে-যাওয়াজনিত সমস্যাটাও জড়িত বলতে হবে। সেহেতু সঞ্জীবের গানে এবং গায়নে শ্রোতারা আস্বাদন করতে পেরেছে এক প্রায়-ভাবিত এবং কাম্য জগতেরই নিরুপম রূপসৌরভ। খুব-যে অচিনা মাঠঘাটপ্রান্তরের সুর ধরেছেন তিনি তার গানে, এমন নয়; একেবারেই চেনা, আটপৌরে দিনদুপুররাত্রিভরা বাংলার সুরই সুলভ সঞ্জীবের কাজে। একদমই ভুঁইফোঁড় নয় তার সুরকীর্তিগুলো, অত্যন্ত পরম্পরাবাহিত সঞ্জীবের সুরগুলো। ফলে এতটাই নিঃসীম সুরসংগীতোজ্জ্বল হতে পেরেছে সঞ্জীবসমগ্র।
স্যংরাইটার সঞ্জীবের তুলনা খোঁজার দরকার আছে কোনো? মনে হয় না। ক্যারিয়ার মাত্র এক-দশকের, মিউজিশিয়্যান হিশেবে, রিলিজড অ্যালবামের হিসাবে ক্যারিয়ার অত্যন্ত হ্রস্ব। তবু যে-কয়টা গানের গীতিকার সঞ্জীব, সেগুলো চোখের সামনে নিয়া আলাপ তোলা যায়। এইখানে সেই চেষ্টা থাক, অন্যত্র খানিকটা হয়েছে এই নিবন্ধকারেরই কিবোর্ডে। যে-কথাটা এখানে বলবার তা এ-ই যে নিজে না-লিখে বাইরে থেকে যখনই লিরিক নিয়া গান বেঁধেছেন সঞ্জীব, মনে হয়েছে সেই গানগুলো সঞ্জীবেরই লেখা; এইটা কেমন করে হলো? হয়েছে সঞ্জীব চৌধুরীর কবিদৃষ্টির কারণে। এর ফলে সঞ্জীবের গলায়-তোলা গান কোনটা তার নিজের লেখা নয়, বের করা যায় না চট করে। গ্যুগল্ করলেই হয়, হ্যাঁ, তা হয়; গ্যুগল্ করে জেনে নেয়া যায় কোন গানের কে গীতিকার, সেই সুযোগ তো রইলই অবারিত।
তবু সঞ্জীবের স্বরচিত কথাভাগের গানগুলো কি ডিফ্রেন্স মেইক্ করে না উয়িথ আদার্স? শুনলেই বোঝা যায় যে, এ এমন টিউন যা আবহমান বাংলা গানের অনুবর্তী থেকেও অনন্য; এ এমন টিউন যেখানে আধুনিক বাংলা গানের চিহ্নগুলোর বিদ্যমানতা সত্ত্বেও সমকালিক এবং একইসঙ্গে ক্ল্যাসিক। সঞ্জীবের লেখা ছাড়াও কামরুজ্জামান কামু, টোকন ঠাকুর প্রমুখ নব্বইয়ের তরুণ কবিদের লেখা কাব্যসুষমাসম্পন্ন গীতাখ্য দলছুট সঞ্জীব-বাপ্পা ডুয়োর পরিবেশনায় এতটাই ইম্প্যাক্টসঞ্চারী হয়েছে যে জেমস-উত্তর বাংলা ব্যান্ডসংগীতে ব্রেকথ্রু আনয়নে এই নির্বাচিত মননের গীতিকবিতা কাজে লেগেছে। একটা শান্ত অথচ শাণিত কথাগীতের সংগীত আবাহনে সঞ্জীবের সামগ্রিক গানকাণ্ড অবদান রেখেছে।
চাঁদ ধরবার ফাঁদ
সঞ্জীবের গাওয়া গানগুলো, লক্ষ করলে দেখা যাবে, খুব-যে নতুন চিহ্ন বহন করছে তা নয়। লিরিকের ভিতরে একটা সাবেকিয়ানা আছে, একটা আবহমানের দোলা, একদমই চিরনূতনের দাগ রাখতে যেয়ে গানশ্রোতাদেরে ভড়কে দেয়ার ব্যাপার এই গানে সেভাবে দেখা যায় না। যা দেখা যায় তা সম্ভবত ঐতিহ্যের নবায়ন বলিয়া আখ্যায়িত করা যাবে। সেই ত্রিকালপুরানা আবহমানের স্কন্ধে চেপে যেমনটা খাড়া-বড়ি-থোড় সংগীতের ভ্যানগাড়ি আধুনিক বাংলা গানের গলি দিয়া ধাবমান, সঞ্জীবের কাজগুলো বুদ্ধিদীপ্ত ধরনে সেই গলিপথে একটা হাওয়াবাতাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেজন্যে একদমই কুস্তি করতে হয়নি। কীভাবে সেই হাওয়াবাতাস খেলা করেছে, একটা নজির যদি আমরা দেখতে চাই তবে সঞ্জীবের গানকথার ভিতরে একটু মনোনিবিষ্ট হব।
ধরা যাক, ‘চাঁদ’ একটা অনুষঙ্গ। বলা হয়ে থাকে যে, আধুনিক বাংলা গানে চাঁদ-তারা-সূর্য আর ফুল-নদী-পাখি-মেঘের তুড়বুড়ি এতই যে এর থেকে রেহাই পাওয়া আজকের বাংলা গানের জন্য মস্ত একটা চ্যালেঞ্জ। সঞ্জীব এই চ্যালেঞ্জ ফেস্ করেছেন দারুণভাবে। বেশিরভাগ সমকালিক কবি ও সংগীতকার এক্ষেত্রে চাঁদ-ফুল বাদ দিয়াই ভাবেন যে আনিয়াছেন ধরণীতে চিরনূতনের নাম। যদিও হয় প্রায়শ কচুটাই। চিরপরিচিতরে অপরিচিত করার ব্যাপারটা ডিল্ করা গানের কাজ নয় যতটা কবিতার। আধুনিক গীতিকারেরা তা পারেন না সামলাতে। অ্যাজ অ্যা রেজাল্ট তাদের কাজ না হয় ঘরের না ঘাটের। সঞ্জীব ব্যাপারটা ঘটাতে যেয়ে সেই চিরপুরাতনেরেই নির্ভর করেছেন। নবায়ন করে নিয়েছেন চাঁদ-পাখি-নিসর্গ সমুদয়। এক এই চাঁদের অনুষঙ্গ/প্রসঙ্গ সঞ্জীবের গানে ফিরে ফিরে এসেছে বারবার। তদ্রুপ এসেছে যেমন সমুদ্রও। ধরা যাক শুরুর দিককার বহুল জনপ্রিয় ওই লিরিকটা : “আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ / আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল চাঁদ / আমার চোখ গেল, ধরেছে সুন্দর” … কিংবা আরও সমস্ত গানেই দেখব সঞ্জীব ঘুরেফিরে চেনা চিহ্নগুলোকেই নিজের ভাবপ্রকাশের বাহন করে তুলছেন। এই মুহূর্তে শেষ অ্যালবাম ‘জোছনাবিহার’ থেকে একটা : “তাই তো অবুঝ মেঘের কোলাহলে / ফাঁদ পেতেছি চাঁদ ধরব বলে # ফের যদি তুমি দিগন্তে করো দেখা / দেখবে বন্ধু ষড়যন্ত্র আঁকা # তাই তো জোয়ার আনতে পাঁজর খুলে / ফাঁদ পেতেছি চাঁদ ধরব বলে” … এইটা বাপ্পা-সঞ্জীব যুগলে গেয়েছেন, কথাকার সঞ্জীবই কি না তা আপাতত বলতে পারছি না, উইকিপৃষ্ঠায় রেকি করে এলেই জানা যাবে কে এর গীতিকার।
`
প্রত্যেকটা অ্যালবামেই ফিরে ফিরে এসেছে মেঘ, চাঁদ, ফুল, পাখি, জোছনা ইত্যাদি। কিন্তু এসেছে এমনভাবে যে একবারও মনে হয় না এগুলো চর্বিতচর্বণ। যদিও শঙ্কা ছিল চর্বিত হবার চর্বণচূর্ণচিহ্নগুলো, হয় নাই যে এইখানেই নিহিত সঞ্জীবম্যাজিক। অথচ অবাক হয়ে খেয়াল করব, ওই টাইমেই ব্যান্ডগানে চাঁদ-জোছনার ক্লিশে জোয়ার। সঞ্জীব সেসব ক্লিশে থেকে মুক্ত। সঞ্জীবের জোয়ার প্রয়োগগুণে ক্লিশে মনে হয় নাই। শিল্পের একটা বড় কাজ পুনর্বিন্যাসের। পুরনোকে নতুন করে দেখানোতে। নয়া হাজিরায়।
শেষের অ্যালবাম নিয়া আলাপ করছিলাম। গোটা অ্যালবামেরই নাম খেয়াল করব ‘জোছনাবিহার’, এবং কী নিশ্চুপ বিস্ময়ের, ওই-যে বেরোলেন বাবু সঞ্জীব বিহারে, বেরোলেন সঞ্জীব চৌধুরী বিহারে জোছনায়, ফেরা আর হয় নাই গৃহে! যেন গৌতম, সিদ্ধার্থ যেন, বুদ্ধের মতো অগস্ত্য সঞ্জীবের সেই চিরযাত্রা। অ্যালবামটা বার হবার মাসখানেকের মধ্যেই আমরা বিস্ময়ার্ত বিমূঢ় হয়ে দেখতে পাই চিরপ্রস্থানাঙ্ক সঞ্জীব চৌধুরীর। মরে যাওয়া ভালো, মরে যাওয়া আদৌ মন্দ নয়কো, মরে যাওয়ার আগে এক-দুইটা গান গেয়ে যেয়ো শুধু। মরে যাওয়ার আগে গেয়ে গেছে গান যেমন সঞ্জীব চৌধুরী।
ঠিক এইখানেই কথাটা আসতে পারে এভাবে যে, সৃজনের দুনিয়ায় নয়া-পুরানা বলতে তেমন কোনো দ্বন্দ্ব নাই। সৃজনযজ্ঞে সমস্তই বিরাজিছে চিরসময়ের তরে। দরকার শুধু কুড়িয়ে নেয়া। আর দরকার ধরবার জন্য ফাঁদ পাতিয়া বসিয়া থাকা। ফাঁদটা যদি হয় এফিশিয়েন্ট, যদি হয় এফেক্টিভ ফাঁদ, চাঁদ তাতে ধরা পড়বেই; তাতে যে-চাঁদ ধরা পড়বে, যে-জ্যোৎস্নাস্নিগ্ধ মুখাবয়ব, সেই চাঁদের সঙ্গে পূর্ববর্তী সমস্ত চাঁদের একটা ফারাক থাকবেই দৃষ্টিগ্রাহ্যরূপে।
ক্রীতদাসের হাসি, মিষ্টি ইক্ষুরস এবং সঞ্জীবের প্রার্থনা
বাবরের প্রার্থনার গল্পটা আমরা জানি; নিজের সন্তানের সুস্থতাকামনায় মৃত্যুপ্রার্থনা করেছিলেন তিনি নিজেরই, বিনিময়ে চেয়েছিলেন সবল-জোয়ান পুত্র যেন ফিরিয়া পায় আগ্নেয় মধুর ভরভরন্ত যৌবনোজ্জ্বল জীবন। পরে সে তা পেয়েছিল কি না, বাবরপুত্র হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ফিরতে পেরেছিল কি না আগুনজলের জীবনে, আপাতত ওই গল্পটা আমরা এক্সপ্লোর করতে যাচ্ছি না। আপাতত শুধু মনে রাখছি যে, একটা কবিতা আমরা পড়েছি বিহানবেলায় আমাদের জীবনের, ‘বাবরের প্রার্থনা’ সেই কবিতার নাম, কবিতাটি লিখেছেন শঙ্খ ঘোষ, — “এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম / আজ বসন্তের শূন্য হাত — / ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও / আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক। # কোথায় গেল ওর স্বচ্ছ যৌবন / কোথায় কুরে খায় গোপন ক্ষয়! / চোখের কোণে এই সমূহ পরাভব / বিষায় ফুসফুস ধমনী শিরা! # জাগাও শহরের প্রান্তে প্রান্তরে / ধূসর শূন্যের আজান গান; / পাথর করে দাও আমাকে নিশ্চল / আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক। # না কি এ শরীরের পাপের বীজাণুতে / কোনোই ত্রাণ নেই ভবিষ্যের? / আমারই বর্বর জয়ের উল্লাসে / মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে? # না কি এ প্রাসাদের আলোর ঝলসানি / পুড়িয়ে দেয় সব হৃদয় হাড় / এবং শরীরের ভিতরে বাসা গড়ে / লক্ষ নির্বোধ পতঙ্গের? # আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার / জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে? / ধ্বংস করে দাও আমাকে ঈশ্বর / আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।” কবিতা এটুকুই। কিন্তু খুব-যে অভাবিত নতুন, তা তো নয়, তা হয়তো নয়, সেই ঈশ্বরী পাটনি থেকে এই-ই প্রার্থনা বাংলার বাপেদের-মায়েদের।
সঞ্জীবের প্রার্থনাটা আমরা লক্ষ করব। সঞ্জীবের সমস্ত গানেই জিকির লক্ষ করব। সত্যিকার অর্থেই জিকিরের সাউন্ড লক্ষ করব সঞ্জীবের সমস্ত গানে, যেখানে এর আগে বেইস্ সাউন্ড হিশেবে দেখেছি কীর্তনের হুবহু/ভাঙা ব্যবহার বাংলা গানে। সঞ্জীবের সুরগুলো সুফি-ফকিরদের জিকিরের ধুয়া ধারণ করে লতিয়ে ওঠে। এইখানেই সঞ্জীব চৌধুরীর সুরচর্যার অনন্যতা। আর লিরিকস্থিত প্রার্থনা? আসুন, শুনি, অন্তিম অ্যালবাম থেকেই শুনি : “ক্রীতদাসের হাসি শুনি নিজের ভেতর / ভাসছে ছুরি ঘুরছে ছড়ি মাথার ওপর / এই জমানার ক্রীতদাসকে মুক্তি দিও — / প্রভু! আখের রসে আরেকটুকু মিষ্টি দিও # ওই ছেলেটি এমন কেন ঝিমিয়ে কাটায় / আকাশটা কি আগুনপুরী মৃত্যুভাটায় / ওই ছেলেটির মৃত্যুকূপে জীবন দিও — / প্রভু! আখের রসে আরেকটুকু মিষ্টি দিও # ওই শিশুটি দারুণ শীতে কাঁপছে কেমন / রাস্তা জুড়ে ভিড়ের মাঝে জীবন যেমন / ওই শিশুটির ভবিষ্যতে দৃষ্টি দিও — / প্রভু! আখের রসে আরেকটুকু মিষ্টি দিও # প্রভু, আখের রসে আরেকটুকু মিষ্টি দিও!”
বোঝা গেল, মহোদয়গণ, সঞ্জীবের প্রার্থনার ডেপ্থ ও ডেন্সিটি? জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সঞ্জীবের লেখা-গাওয়া-সুরারোপিত সমস্ত কাজেই এই প্রার্থনা, এই দোয়া, এই মুনাজাত লভ্য। ব্যত্যয় ঘটেনি আখেরি অ্যালবামেও।
গল্পগুচ্ছ সঞ্জীবন্ত
সঞ্জীব চৌধুরী ইন্তেকাল করলেন ২০০৭ নভেম্বরে। এরই মধ্যে একে একে তিনটে অ্যালবাম বেরিয়ে গেছে ব্যান্ড ‘দলছুট’ থেকে — ‘আহ্’, ‘হৃদয়পুর’, ‘আকাশচুরি’ — এবং সম্ভবত ‘স্বপ্নবাজি’ রিলিজ হয়েছিল ২০০৪ সনের দিকে। ‘স্বপ্নবাজি’ ছিল সঞ্জীবের জীবদ্দশায় রিলিজড একমাত্র সোলো সংকলন। তবে জীবনাবসানের বাদে এক-দেড়টা অ্যালবাম আরও বেরিয়েছে বোধহয় একক হিশেবে। সেগুলো অবশ্য পূর্ণাঙ্গ নয়, সেই অর্থে সেগুলো সঞ্জীবের প্রতিনিধিত্বের শীর্ষস্বাক্ষরও বহন করে না কোনোভাবে, এক-দুইটা গান নতুন পাওয়া গেছে অ্যালবামগুলোর সুবাদে। এমনিতে সংগীতশিল্পী হিশেবে সঞ্জীবের ইনফর্ম্যাল পদচারণা আগে থেকেই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ক্যাম্পাস, শিক্ষার্থী-শিক্ষক কেন্দ্র, উদীচী ইত্যাদির অনুষ্ঠানমঞ্চে এবং বেশিরভাগই অনানুষ্ঠানিক উতলা আড্ডায়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সেই নিরুপম সময়ে স্ট্রিটপ্রোটেস্টগুলোতে, প্রতিবাদমঞ্চে, প্রতিরোধপ্রোসেশনে, শহিদবেদির সোপানে একদল তুখোড় তরুণের তৎপরতার সঙ্গী ছিলেন সঞ্জীব। গণসংগীত এসেনশিয়্যাল ছিল সময়েরই নিদানে, গেয়েছেনও সঞ্জীব গণ ও অন্যান্য সংগীতের আদরায় গান তবলা-হার্মোনিয়্যমে। এরচেয়ে বেশি কিছু, বড়সড় অডিয়েন্স টার্গেট করে তেমনকিছু, করেন নাই তখনও।
স্টুডিয়োরেকর্ডেড অ্যালবামের বিবেচনায় তার ফর্ম্যাল সংগীতশিল্পীজীবন সাকুল্যে একদশকের। ১৯৯৭ থেকে ২০০৭। ডেব্যু ‘আহ্’ রিলিজড ইন ১৯৯৭ এবং জীবদ্দশায় ‘জোছনাবিহার’ রিলিজড ইন ২০০৭; জোছনাবিহার সঞ্জীবের লাস্ট অ্যালবাম। জোছনাবিহার বেরোনোর মাসখানেকের মধ্যে অনন্তলোক বিহারে বেরিয়ে পড়েন সঞ্জীব। অগস্ত্য যাত্রার রাতে ব্যাপক ঘূর্ণিবায়ে দেশের পরিস্থিতি ছিল লণ্ডভণ্ড। সঞ্জীবপ্রয়াণের দিনটায় ‘সিডর’ ডাকনামের এক প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত সঙ্গিন। সম্ভবত প্রকৃতিই শিল্পীর অকাল প্রস্থানে গররাজি ছিল।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সঞ্জীব চৌধুরী নিউজপেপারে চাকরির সুবাদে পোস্ট-নাইন্টিজের তারুণ্যভরা বাংলাদেশের সংবাদজীবিতায় ফিচার রাইটিঙের ক্ষেত্রে ব্রেকথ্রু এনেছিলেন। সঞ্জীবের ফিচারধাঁচ ফলো করে সেকালের বিনোদনসাংবাদিকতায় নয়া হাওয়া এসেছিল। সংগীতে দেশজোড়া খ্যাতিলাভের অনেক আগে থেকেই ইয়াং জার্নালিস্টদের কাছে ক্রেইজ ছিলেন সঞ্জীব। দুইটা জায়গায় সঞ্জীবের ইনোভেটিভ আইডিয়া বাংলাদেশের মুদ্রিত-সংবাদপত্রজগতে প্যারাডাইম পাল্টে দিতে হেল্পফ্যুল হয়েছে বলে মেমোয়্যারে লিখেছেন সঞ্জীববান্ধব অনেকেই; — এক, বিনোদনপাতার কন্টেন্ট ও বিন্যাস ল্যুক্রেটিভ করে তোলা এবং দুই হচ্ছে রিডার্স পার্টিসিপেশন পেইজের বহুল জনপ্রিয়করণ; দুইটাই পত্রিকার সার্কুলেশন বাড়িয়েছে ব্যাপক পরিমাণে, এবং পত্রিকা হয়েছে আগের তুলনায় বিচিত্রমুখী। কিন্তু পত্রিকার অবনমনের শুরুটাও মুক্তহাওয়া নাইন্টিজের সময় থেকেই স্টার্টেড, কথাটা মানবেন যে-কেউ। অনেকেই বিল্ডিংবাল্ডিং-গাড়িঘোড়া বাগিয়েছেন বার্তাজীবী বৃত্তি থেকে, সঞ্জীবের মতো সাংবাদিকের গ্রাসাচ্ছাদন আর কায়ক্লেশে বোতলজোটানো ব্যতিরেকে বেশিকিছু হয়েছে বলিয়া মনে হয় না আদৌ।
সঞ্জীব চৌধুরী প্রয়াণের একদশক পূর্ণ হয়ে গেল দেখতে দেখতে। কেমন করে একপলকে, যেন ফড়িঙপাখায় চেপে, উড়িয়া যায় দিবারাত্রিজীবনের অতুল্য সময়! পেশাজীবনে সাংবাদিক হিশেবে সঞ্জীব চৌধুরী শিল্পীপরিচয়ের আগে থেকেই ছিলেন স্বনামে খ্যাত। ঝড়ের গতিতে এসে একদশকের স্বল্পসীমায় বাংলা গানে অমোচনীয় একটা ছাপ রেখে যেতে পেরেছেন বলা বাহুল্য। ঝড়েরই এক রাতে এই পৃথিবীর মায়া ছাড়িয়ে গেছেন অফেরা আনভুবনের বাটে। এই নিবন্ধকার এবং তার প্রজন্মের লোকেরা হায়াতে যে-কয়টা আলোআঁধারি দিন পাবে অবশিষ্ট, সঞ্জীব ও সতীর্থ বহু সংগীতকারদেরে এরা হারাম ভুলবে না, সঞ্জীবের জন্মের শুভক্ষণে এবং তার প্রয়াণবার্ষিকীতে স্মরণ করে যাবে এরা তারে শ্রদ্ধায়, সুরে এবং সোল্লাসে। এবং ইয়াদ করবে এইটিজের লিটলম্যাগে কালেভদ্রে সঞ্জীবের কবিতা ছাপার হরফে দেখার স্মৃতি, ইয়াদ করবে তার স্মার্ট গস্পেলিক গদ্যে লেখা গল্পমালা ‘রাশপ্রিন্ট’, ইয়াদ করবে অতুলনীয় কথাকাব্যের গীতিকার সঞ্জীব চৌধুরীকে।
সোজাসাপ্টা ভালোমন্দ ও সঞ্জীবের বিবৃতি
নিছক যুগ্ম-অপোজিশনের ক্যাটেগোরি দিয়া, বাইনারি-বৈপরীত্যের ব্যক্তিক সিদ্ধান্তসঞ্জাত প্রকাশপ্রক্রিয়ায়, ভাবান্দোলিত বুজরুকির দিন সম্ভবত অস্তমিত। তবু মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আজও তো ব্যুকিশ দর্শনের অনুগামী নয়; বরঞ্চ উল্টো, দর্শনই মানুষের আচরণপ্রতিকল্পের মুখাপেক্ষী। কিন্তু কবিতা বা গানে এবং শিল্পসাহিত্যের অন্যান্য ফর্মে এই মর্মেই ঘাপলাটা লাগতে দেখি হামেশা। গাড়ি আগে না ঘোড়া, তা নিয়া মাথাঘাম না-ফেলেও বলা যায় এর একটা সুরাহা সম্ভব। সঞ্জীবের গানে এই সুরাহা পাওয়া যায়। কেমন সুরাহা? কাব্যকলায় বিবিধ অলঙ্কারের মধ্যে, চিত্রকল্প-উপমা-সমাসোক্তি ইত্যাদি সমস্তকিছুর মধ্যে, সবচেয়ে বেশি শক্তি নিরলঙ্কার নিরাভরণ বিবৃতিবাচক বাক্য/পঙক্তিনিচয় ধরে রাখে। এই কথার প্রমাণসাক্ষ্য লভ্য যে-কোনো কবির কাজে, যেমন জীবনানন্দে; “হাজার বছর ধরে পথ হাঁটিতেছি আমি পৃথিবীর পথে” — এই পঙক্তিটা আদতে একটা বিবৃতিবাক্যই। কিংবা তার ‘আট বছর আগের একদিন’ অথবা ‘বোধ’ প্রভৃতি কবিতায় দেখা যাবে লাইনের-পর-লাইন বিবৃতিবাক্যের উপস্থিতি। বিস্ময় কিংবা অন্য সমস্ত প্রকাশাভিব্যক্তির মুকাবিলা করা যায় একভাবে-না-আরভাবে, কিন্তু বিবৃতির সামনে চুপচাপ হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। চিত্রকল্প ইত্যাদি বিশ্লিষ্ট করে দেখা এবং দেখানো যায়, কিন্তু বিবৃতির বিশ্লেষ করা যায় না। আমরা, জাগতিকেরা, হ্যাঁ/না-বাচক বিবৃতির সামনে মূক ও অসহায়। কিংবা মুখর, ও অবধারিত অসহায়। বিবৃতির রয়েছে এক অব্যাখ্যেয় অসীম, রয়েছে আদি-অন্তহীনতা।
“পাখির কণ্ঠে বেসুরো গান ভালো লাগে না / নরনারীর একমুখী টান ভালো লাগে না / ওই ফুলের বুকে ধুতুরার ঘ্রাণ ভালো লাগে না / ছুরির ভয়ে চমকানো প্রাণ ভালো লাগে না # তোমায় নিয়ে কাড়াকাড়ি ভালো লাগে না / তোমায় নিয়ে বাড়াবাড়ি ভালো লাগে না / আর তোমার-আমার ছাড়াছাড়ি ভালো লাগে না / তোমায় নিয়ে কাড়াকাড়ি ভালো লাগে না # কান্নাকাটি-হল্লাহাটি ভালো লাগে না / সবুজ দ্বীপে মরণঘাঁটি ভালো লাগে না / দুঃস্বপ্ন-ছাওয়া মাটি ভালো লাগে না / অন্ধকারে বসতবাটি ভালো লাগে না # ওই কান্নাভেজা আকাশ আমার ভালো লাগে না / থমকে-থাকা বাতাস আমার ভালো লাগে না / দড়ির তালে নাচতে থাকা ভালো লাগে না / এই মরে মরে বেঁচে থাকা ভালো লাগে না” — আমরা কি বিবৃতিবাক্যের শক্তি লক্ষ না করে পারি? সঞ্জীব চৌধুরীর গানে এই চিরপুরাতনী অথচ চিরনতুন বিবৃতিব্যঞ্জনা আমরা লক্ষ না করে পারি না।
আর ইয়াদ হবে যে, একবার কোনো-একটা সাক্ষাৎকারে/কথিকায় কবীর সুমন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ থেকে একটা গান চয়ন করে বলতে চেয়েছিলেন সমকালীন দুঃখদৈন্যদুর্দশার মাঝখানে ঘোড়াগুলি সম্পাদিত গানের লিরিকে তিনি তীক্ষ্ণ রাজনৈতিকতার বিপরীতপিঠে নির্বুদ্ধিতারই চিহ্ন দেখতে পেয়েছেন। সত্তরের দশকে যেখানে রাস্তায় নর্দমায় ভেসে যেতেছিল তরুণ তাজা লাশ, তখন ঘোড়াগুলি লিখছিল : “ভালোবাসি জোছনায় কাশবনে ছুটতে / ছায়াঘেরা মেঠোপথে ভালোবাসি হাটতে / দূর পাহাড়ের গায়ে গোধুলির আলো মেখে / কাছে ডাকে ধানক্ষেত সবুজ দিগন্তে / তবুও কিছুই যেন ভালো যে লাগে না কেন / উদাসী পথের মাঝে মন পড়ে থাকে যেন / কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও? # ভালোলাগে ডিঙি নৌকায় চড়ে ভাসতে / প্রজাপতি বুনোহাঁস ভালো লাগে দেখতে / জানলার কোণে বসে উদাসী বিকেল দেখে / ভালোবাসি একমনে কবিতা পড়তে / তবুও কিছুই যেন ভালো যে লাগে না কেন / উদাসী পথের মাঝে মন পড়ে থাকে যেন / কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও? # যখন দেখি ওরা কাজ করে গ্রামে বন্দরে / শুধুই ফসল ফলায়, ঘাম ঝরায় মাঠে প্রান্তরে … / তখন ভালো লাগে না, লাগে না কোনোকিছুই / সুদিন কাছে এসো, ভালোবাসি একসাথে সবকিছুই … # ভালোবাসি পিকাসো, বুনুয়েল, দান্তে / বিটলস, ডিলান আর বিথোফেন শুনতে / রবি শঙ্কর আর আলি আকবর শুনে / ভালোবাসি ভোরে কুয়াশায় ঘরে ফিরতে / তবুও কিছুই যেন ভালো যে লাগে না কেন / উদাসী পথের মাঝে মন পড়ে থাকে যেন / কোথায় রয়েছে ভাবি লুকিয়ে বিষাদ তবুও?” — এই লিরিকে কবীর সুমন খুঁজিয়া পান নাই নিত্যদিনের লড়াইরত জনমানুষের আকাঙ্ক্ষা। আমরাও কি পাই না? ট্র্যাডিশন্যাল কবিতার চিত্রকল্পময়তা থেকে একটু চোখ ফেরায়ে দেখতে শিখলেই এই লিরিকের বিবৃতি হৃদয়স্থ করা সম্ভব। সঞ্জীবের এই বিবৃতিপ্রবণতায় আছে তার রাজনৈতিক অবস্থানেরই নিরঙ্কুশ প্যাঁচপয়জারহীন চিরকালের অভীপ্সা প্রকটিত।
বানভাসানি ভীষণ অভিমানের গান
সঞ্জীবের গানগুলো অভিমানের গান, অন্বয়বাসনার গান, রোদনহীন অন্তর্যাতনার গান। প্রথানুবর্তী বিচ্ছেদ-বিরহের বাংলা গান থেকে এই লিরিক ও লিরিক-লতিয়ে-ওঠা সাংগীতিক টেক্সটগুলোর ফারাক কয়েকটা জায়গায় প্রত্যক্ষ। সঞ্জীবের গানগুলো জলীয় ভাবাবেগের গান নয়। এগুলো নয় বিরহে কাৎরানো প্রণয়ার্থীর গান। প্রণয়ব্যর্থ যৌবনবাউলের যৌনঈর্ষার গান নয় এগুলো। নয় প্রেমাস্পদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রতিশোধ তুলবার গান। সঞ্জীবের প্রেমের গানে এমন একটা আবহাওয়া বিরাজিছে যেখানে নেই দ্বিতীয় কাউকে দোষারোপের আবিলতা। বাংলা আধুনিক গানে যে-ব্যাপারটা সাধারণদৃষ্ট, প্রণয়িনীরে পেতে ব্যর্থ হয়ে বেবাক জীবনযন্ত্রণার জন্যে বেচারির কান্ধে দায় চাপিয়ে দেয়া, না, সঞ্জীবের প্রেমের গানে এইসব শস্তা ভাজুংভুজুং নাই। তাই বলে শাস্ত্রীয় প্রণয়বিলাসের বিমূর্ত মুখগোমড়ামিও অনুপস্থিত। সঞ্জীবের গানে ব্যাপক একটা বানভাসানি অভিমানের স্রোত সত্ত্বেও রয়েছে ব্যাপক সহজিয়া দার্ঢ্য, রঙ্গপ্রবণ রসোচ্ছ্বাস, দৈনন্দিন টালবাহানা-টানাপোড়েনের টুংটাং। অভিমানটাকে সঞ্জীব সংহত উপায়ে রেখে দিতে পেরেছেন সংগীতে-সুরে-কথায় মাখোমাখো করে। এই অভিমান মান্না দে প্রমুখের পানিমেশানো অভিমান নয়। এ হচ্ছে এ-যুগের যুগযন্ত্রণা যাপিয়া গানে চোলাই-করা আত্মরক্ষার প্রতিবেদন সঞ্জীবের। গত শতকে জন্মানো সকল প্রণয়বিধ্বস্ত জনমানুষের তরফে একাই নীলকণ্ঠ সঞ্জীব সুরে পুরে রেখেছেন জীবনবটিকা। আরও কয়েকজন রেখেছেন এমন, সঞ্জীবেরই তীর্থসহোদর তারা বাংলাদেশের গানে, মাকসুদ ও জেমস্ তেমনই দুইজন।
উদযাপনই করেছেন সঞ্জীব, সুরে-কথায়-সংগীতে-গায়নে, উদযাপন করেছেন অতিকায় নৈসঙ্গ। উদযাপন করিয়েছেন তার শ্রোতাদিগেরে। এই নিঃসঙ্গতার জন্ম মানুষেরই চিরজন্মলগ্ন। লতাগুল্মময়, আদিম এই নিঃসঙ্গতা। হাজার জনতা থাকুক গ্যালারি ঘিরে, বঁধু শুয়ে থাকুক পাশে, থাকুক শিশুটিও, জন্মলগ্নবলয়িত এই নিঃসঙ্গতাদানবের খপ্পর হইতে রেহাই নাই মানুষের। আর সেই মানুষ যদি হয় সঞ্জীবের মতো অনুভূতিবিপন্ন, বিস্ময়ের কিছু নাই যে এই মানুষের রক্তের অন্তর্গত খেলা করে যাবে এক অতিকায় বিষাদ। অমল ধবল এই বিষাদেরই সুর রৌদ্রময়দানে, অ্যাশফল্টে, অ্যাভিন্যু-মহল্লাগলি ঘিরে বিছিয়ে দিয়ে গেছেন সঞ্জীব চৌধুরী।
“কী আমাকে দিয়েছিলে বঙ্গোপসাগর / কী আমাকে দিয়েছিলে নোনা জলহাওয়া / কী আমাকে দিয়েছিলে কক্সেসবাজার / আমার সন্তান সে-তো তোমার কাছে পাওয়া” — আনডাউটেডলি, লিরিকটা সঞ্জীব চৌধুরীর। যদিও কণ্ঠে এইটা বাপ্পা মজুমদারের, সম্ভবত সঞ্জীবেরও কণ্ঠধুয়া আছে গানটায় মিশে, সুরে বিদেশি টিউনের অনুসৃতি, কী ভীষণ অতিজাগতিক প্রণয়ের এই লিরিক, এই মিউজিক, এই গান! “আমার সন্তান”, হে মহাকালসমুদ্র, “তোমার কাছে পাওয়া” — আমি স্বীকার যাইছি! আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, “আমি তোমার জন্য কাব্য কুড়াই তোমার জন্য গান / লিখি তোমার-আমার বানভাসানি ভীষণ অভিমান / আমি বুকের মধ্যে জমা রাখি হারানো সন্তান” — তুলনা আছে এই লিরিকের? কবীর সুমনের ‘জাতিস্মর’ গানে সেই “অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবিদাওয়া / এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া” ছাড়া সঞ্জীবের এই লিরিকের তুলনা কোথায় পাবো? “কোন স্বপ্নে গেলাম রেখে সে-স্বপ্ন তোমার / আমরা দুজন ছিলাম কবে পরস্পরের আহার” — উচ্চারিত এই প্রশ্নের উত্তর কি শুনিতে পাও, অয়ি নির্ঘুমন্ত মহাসময়, হে মহাজীবন, কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও, এই লিরিকে, এই একটামাত্র লিরিকের প্রায়-নিঃশব্দ পঙক্তিমালায়?
এই গানে যে-অভিমান, যে-ব্যক্তিক হতচকিত জন্মবিষাদের নৈর্ব্যক্তিকতা, যাপিত সময়ের ঝুঁটি ধরে যে-অনাদিকালিক অনন্তরতা, জাতিস্মর মানুষের অনঙ্গ বিষাদের যে-অসহায়তা, আঁজলায় আসমুদ্র অন্তর্গত বিপন্নতার যে-ম্যাপ আঁকা, সাময়িকতাকে যেভাবে চিরকালিক করে তোলা হয়েছে এই একটা গানে, এজন্য সঞ্জীব স্মরণীয় রইবেন দুঃখিনী বাংলাদেশের শহুরে গানের সমুজদারের গঞ্জনা-সওয়া সাধারণ শ্রোতামানুষের কাছে। এই লিরিকের বিষাদ-বৈদগ্ধ্য সঞ্জীবের অন্যান্য সমস্ত গানেই ক্রিয়াশীল থেকে গেছে আগুপিছু, লক্ষ না-করে পারি না, আরও লক্ষ করি যে সঞ্জীবের আজীবনের গানে ব্যাপ্ত অভিমানের বীজ এই লিরিকেই নিহিত। মোদ্দা কথা, ব্যক্তিক একাকিতা নিয়া হাহুতাশ-ভাববিলাস রচনার বাইরে এক অন্যতর উদ্ভাসনে সঞ্জীবের গান সবসময় সচেষ্ট। অনবদ্য ওইভাবে আজও।
সঞ্জীব ও আমাদের জীবনযাত্রা
আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যে-অ্যালবামের মধ্য দিয়া আমরা, যারা মাকসুদ-জেমস্-সঞ্জীবের গানবাজনায় সাঁতরে বেড়ে উঠেছি, যাপনের মধু ও মজ্জমান গরলের ভেদ নির্ণয় করে নিতে শিখেছি, আমাদের কাছে সেই ‘আহ্’ অ্যালবাম অন্যতম যুগনির্ণায়ক বিবেচিত হবে এতে এমন আশ্চর্যের কিছু নাই। কিন্তু আজও, যখন জীবন গিয়াছে চলে সত্যি সত্যি আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার, যখন আমাদের জিন্দেগি থেকেই রিয়্যালি বিশ বছর অতিক্রান্ত, অদ্যাবধি লিরিক্যাল ইন্টেন্সিটির শহুরে বাংলা গানে সঞ্জীবতুল্য সংগীতের অভিজ্ঞতা আমাদের দ্বিতীয় হয়েছে? জেমস্-ম্যাক প্রমুখের মতো ননলিরিক্যাল গদ্যগানের অভিজ্ঞতার তুল্য অনবদ্যতা আজও হলো কই? ঠিক যেই বিষাদের, যেই নিঃসঙ্গতার, যেই বিপন্ন অল্পায়ুর, জেনদর্শনের ন্যায় একরত্তি হাহাকারের ফোঁটা সঞ্জীব চারিয়ে রেখে গেছেন তার গানে এবং সুরের বাহনে, এখনও কি লিরিকে-আপোস-করা বাংলার তরুণাস্থি মিউজিশিয়্যানদের দ্রষ্টব্য নয়? জীবনে এবং যাপনের প্রাত্যহিকতায় এই গীতিকার এই সুরকার এই সংগীতকার আজকের নতুন গানকারের কাছেও বরণীয়। প্রত্যেক বছর সঞ্জীব স্মরণে যে-সমস্ত তরুণ গানের অনুষ্ঠান হয়, যে-সঞ্জীবউৎসব হয় বিশেষ সময়ে প্রতি বছর, বাংলাদেশের গানে নয়া দিশা নিয়া আজকের তরুণের তৎপরতা ও তোড়জোড়প্রস্তুতি তাতে ব্যাপকভাবেই স্পষ্ট হয় আমাদের কাছে। আমরা আশায় অন্বিত হই। আর আমরা যারা গাইতে পারি নাই জীবনে একটাও গান, হইল না আদায় যাদের নমাজকালাম-আল্লাবিল্লা, খেদ নাই তাতে একটুও, কেননা আমরা শুনেছি গান সঞ্জীবের, সঞ্জীবের লিরিকে প্রবাহিত হই আমরা আজও। অতএব, খেদ কিসে? বেয়ে-যাওয়া গাঙের ঘোলাপানি-বাঁক নিয়ে খেদোক্তি বৃথা।
স্বাগত সঞ্জীব
বলি নাই যে-নামটা আজও জনসমক্ষে, কেউ জানে না যেই নামের আদ্যাক্ষর, এমনকি আড়ালও না-জানে, সেই নামটার সম্মানে অতএব, স্বাগত সঞ্জীব! কী দীর্ঘ রাতগুলো কাটিয়েছি জীবনে, পেরিয়ে এসেছি একাকী বিষণ্ণ দুপুর ও অসংযত অস্থিরতার সন্ধেবেলাগুলো, মুখরতার মর্মর বিকেলবেলাগুলো, অতএব সেই নিশিদিনগুলোর সম্মানে বলি, স্বাগত সঞ্জীব! বয়স যখন সাতাশ, দুঃসহ সেই সাতাশের মিতা-পাতানো সন্ধিবিচ্ছেদের স্মরণে, অতএব, স্বাগত সঞ্জীব! ঘুরিয়া ঘুরিয়া সন্ধান করিয়া স্বপ্নফেরি দিনগুলোর খাতিরে, অতএব বলতেই হয়, স্বাগত সঞ্জীব! কাঁটার পুলকে উদ্ভাসিত যে-মুহূর্তগুলো, অবচেতনা আর নিশ্চেতনার ভৌতিকতাগুলো, ওঠো ও-গোলাপ, ওঠো, সঞ্জীবকে স্বাগত জানাও! ছবি-হয়ে-থাকা বাগানের সেই চিরপ্রিয় মুখগুলোর সম্মানে আজ, এবং আমরণ, স্বাগত সঞ্জীব! মনের ভেতরে রাঙা নাও-বাওয়া মাঝিটির মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখিবার গরজে আজ এবং অনাগত-সমাগত সমস্তকাল, বলি, স্বাগত সঞ্জীব! হাতের ওপর হাতের পরশ র’বে না, স্বাগত সঞ্জীব, জানিয়ে গেছ তুমিই তো! শিশির ঝরবে সকালবেলা, তারপরও অবহেলা, স্বাগত সঞ্জীব, স্বাগত! যখন যেখানে নোঙর ফেলেছি, বিস্তর নোঙরের গল্পে এ-জীবন বোবা পাথরের ন্যায় আলোকোজ্জ্বল যদিও জেনেছি, কিন্তু দাঁড়ি টেনে কৃতজ্ঞমূর্ত কুর্নিশ জানিয়ে বিদায় নেবার প্রাক্কালে বলি, চিরস্বাগতম, সঞ্জীব! সমস্ত খুঁজে-ফেরা ক্ষ্যাপার পরশপাথর আর নিখোঁজ ঘুড়িমুখ, হৃত জনয়িতাযুগলের নাকে স্বাতীনাক্ষত্রিক নথ আর কাঁধে কালপুরুষ আলোয়ান দেখে, একলা রাত্তিরে, স্বাগত, অতএব, সঞ্জীব! স্বাগত, সঞ্জীব, স্বাগত! স্বাগত … সঞ্জীব … স্বাগত … স্বর্গত নয়, এই মর্ত্যদুনিয়ায়, স্বাগত সঞ্জীব, স্বাগত …
… …
একই বিষয়ে লেখকের পূর্বপ্রকাশিত রচনার লিঙ্ক : সঞ্জীবিত সংগীতাঢ্য
https://laljiperdiary.wordpress.com/2014/09/18/সঞ্জীবিত-সংগীতাঢ্য-জাহে/
- কথাকার, কবিতাকার ও ফিলোসোফার - November 26, 2024
- বর্ষীয়ান কবি ও বাংলা সাবান - November 24, 2024
- লঘুগুরু - November 8, 2024
COMMENTS