হারিয়ে যাবার ঠিকানা || সাযযাদ কাদির

হারিয়ে যাবার ঠিকানা || সাযযাদ কাদির

[সদ্যপ্রয়াত কবি সাযযাদ কাদির পেশাজীবনে ছিলেন সাংবাদিক। ২০১৭ এপ্রিলে জীবনাবসানের আগ অব্দি তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রে কাজ করেছেন, কখনো একসঙ্গে একাধিক পত্রিকায়, লিখেছেন প্রতিবেদন বিচিত্র সমস্ত বিষয়ে। যেমন এই নিবন্ধটা, তালাত মাহমুদ প্রয়াণের অব্যবহিত পরের হপ্তায় স্মৃতিবিহারী নিবন্ধটায়, সাযযাদ কাদিরের গানপ্যাশন নিয়া পাঠকেরে একটা আন্দাজ দ্যায় নিশ্চয়। এইটা লাস্ট সেঞ্চুরির আটানব্বই খ্রিস্টাব্দের রচনা। মাথায় রাখতে হবে যে তখনও গ্যুগলের সার্চইঞ্জিন দুনিয়ায় (বা, বাংলা মুল্লুকে অন্তত) পয়দা হয় নাই; কিংবা পয়দা হলেও ওইভাবে জাঁকিয়ে বসে নাই। ইনফোর্মেশনভিত্তিক রচনা হলেও নিছক ইনফোর্মেটিভ রচনা এইটা না বোধহয়। ব্যক্তিশ্রোতার প্রেমটুকুও অগোচর নয় হিন্দি-বাংলা মিলিয়ে সেইসময়কার এক অবিসংবাদিত কণ্ঠশিল্পীর প্রতি।

কিন্তু রচনাটা ছাপানোর মধ্য দিয়া আমরা গানপার থেকে স্মরণ করছি বাংলা ভাষার একজন কবিকে, প্রেম স্বীকার করছি মিউজিকের প্রতি, এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি তালাত মাহমুদ ও সাযযাদ কাদির উভয়কেই। বলা বাহুল্য, এই মাসে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ঘটেছিল তালাত মাহমুদের প্রস্থান। এবং এই বছরের এপ্রিলে ঘটে গেল সাযযাদ কাদিরের পরলোকযাত্রা।

বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় দেশভাগের বছরে ১৯৪৭ সনের ১৪ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন সাযযাদ কাদির। কবি হিশেবে ষাটের দশকটি চিহ্নিত হয় (নাকি সত্তরের দশক বলা হবে সেইটা?) তার আবির্ভাবকাল হিশেবে। ক্যারিয়ারের গোড়ার দিকে কিছুকাল শিক্ষকতা ব্যতিরেকে পেশাজীবনে সাযযাদ কাদির সংবাদপত্রজীবীই ছিলেন। যথেচ্ছ ধ্রুপদ কবিতাবই দিয়ে ডেব্যু হয় তার ১৯৭২ সনে। এরপর কবিতা-নাটক-উপন্যাস-প্রবন্ধ সহ সবমিলিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তার অনেক বই। সংখ্যায় ষাটটিরও বেশি বইয়ের তিনি সম্পাদক ও প্রণেতা, তার বইয়ের তথ্যতালিকা থেকে জানা যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০১২ সনে কাদিরের কবিতাবই বৃষ্টিবিলীন প্রকাশিত হয়েছিল।

পত্রস্থ রচনাটা, হারিয়ে যাবার ঠিকানা, পাক্ষিক আনন্দভুবন পত্রিকায় ছাপানো হয়েছিল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে সংখ্যায়। লেখাটার সঙ্গে তালাত মাহমুদ ছাড়াও ও.পি. নায়ার এবং কিশোর কুমারের দু-দুটো ছবি ছাপা হয়েছিল ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইটে।

সেই পত্রিকায় সাযযাদ কাদির নিয়মিত অবদায়ক হিশেবেই লিখতেন বিবিধ প্রসঙ্গের ফিচারধর্মী নিবন্ধ। অত্র রচনায় কাদিরের সেইসমস্ত অগ্রন্থিত প্রতিবেদনপ্রতিম সুখপাঠ্য লেখাগুলো সম্পর্কে একটা আইডিয়া পাওয়া যাবে। গানপার]

talat1

মুম্বাইয়ের চলচ্চিত্রজগতে ‘মিঞাজি’ নামে খ্যাত প্রযোজক-পরিচালক আবদুল রশিদ [এআর] কারদার [১৯০৪-১৯৮৯] তখন হিন্দি ছবির ইতিহাসে এক মাইলফলক স্থাপনে ব্যস্ত : উর্দু ঘরানার প্রতিভূ তালাত মাহমুদকে তিনি সশরীরে হাজির করছেন ‘দিল-এ-নাদান’ [১৯৫৩] ছবিতে। ট্রাজেডিকিং দিলীপ কুমারের জন্য অপরিহার্য কণ্ঠ তখন গজলকিং তালাত মাহমুদ সর্বত্র নন্দিত-বন্দিত। তিনি ভাবলেন, অভিনয়ে সাফল্য পাওয়া কঠিন হবে না তার পক্ষে। অর্ধেক সাফল্য এনে দেবে তার জাদুকরি কণ্ঠ, আর বাকি অর্ধেক? — তিনি কি দেখতে কম সুদর্শন? না, মোটেও তা নয়। তাকে সুদর্শন বলবে না তারাই, যারা কিছুই দেখতে পায় না দু-চোখে।

গায়ক তালাত মাহমুদকে নায়ক হিশেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি অনুভব করেননি কারদার। তবে সংগীত পরিচালনার জন্য নওশাদ [জন্ম ১৯১৯] রাজি ছিলেন না। কারদারের সঙ্গে তার নিয়মিত সুরকার নওশাদ জড়িয়ে পড়েছিলেন ঝামেলায় — ‘দস্তান’ [১৯৫০] ও ‘জাদু’ [১৯৫১] ছবির সূত্রে। ছবি দুটির কথা সেকালের দর্শকের নিশ্চয়ই মনে আছে; মার্কিন ছবি ‘এনচান্টমেন্ট’ [১৯৪৯] অবলম্বনে ‘দস্তান’ এবং ‘দ্য ল্যভস্ অব কারমেন’ [১৯৪৮] অবলম্বনে ‘জাদু’ নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া নওশাদের সঙ্গে প্রকৃত অর্থে কখনো সুরায়িত হননি তালাত। ‘বাবুল’ [১৯৫০] ছবির প্রথম রেকর্ডিং-এর সময়ে তার সামনে সিগারেট টানার জন্য তালাতকে বের করে দিয়েছিলেন নওশাদ, আর কখনো সামনে আসতে দেননি তাকে। ফলে নওশাদের সহকারী গুলাম মোহাম্মদ দায়িত্ব নিলেন তালাত মাহমুদের জন্য বিশেষভাবে-বাছাই-করা কয়েকটি গজল সৃষ্টি করার। তালাতের জনপ্রিয়তা তখন এমন তুঙ্গে যে তার বিপরীতে নায়িকা নির্বাচনের জন্য আয়োজিত হলো কারদার-কলিন্স কন্টেস্ট। প্রতিযোগিতায় জয়ী হলেন পিস কনওয়াল। আসলে পর্দায় ‘গজল নওয়াজ’-এর মুখোমুখি হওয়ার স্বপ্ন কোন তরুণীর ছিল না?

কিন্তু সকলই বৃথা গেল। মুক্তির পর প্রথম সপ্তাহেই দর্শক প্রত্যাখ্যান করলেন ‘দিল-এ-নাদান’ ছবিটি। অথচ এই ছবিতেই রয়েছে সেই অবিস্মরণীয় গান — ‘জিন্দেগি দেনেওয়ালে সুন’, যে-গান সর্বাঙ্গে তুলনীয় হতে পারে নওশাদের যে-কোনো শ্রেষ্ঠ রচনার সঙ্গে। অধিকন্তু এতে ছিল তালাত মাহমুদের শাশ্বত রোমান্টিক কণ্ঠ। তার সেই কণ্ঠের রেশমি-মলমল বৈশিষ্ট্য আবশ্যিকভাবেই উপস্থিত ছিল ওই গানে, যেমন ছিল ‘জো খুশি স্যে চোট খায়ে’ ও ‘জিগর কহাঁ স্যে লাউ’ এবং ‘ইয়ে রাত সুহানি রাত নাহিঁ’ গান দুটিতেও। এছাড়া তালাতের কণ্ঠ তখন তার স্বর্ণযুগে। সেকালের সকল তরুণীর হৃদয় তখন উন্মুখ — ‘মোহব্বত কি ধুন বেকারারোঁ স্যে পুছোঁ’ সুরটা শুনতে।

দর্শকের মনে বারবার এ-প্রশ্ন জেগেছিল তালাত মাহমুদের কণ্ঠে ‘জিন্দেগি দেনেওয়ালে সুন’ কেমন শোনাত দিলীপ কুমার [জন্ম ১৯২২]-এর ঠোঁটে! দিল-এ-নাদান এমনভাবে ফ্লপ হলো যেন এই নামে কোনো ছবিই হয়নি! তাহলেও তালাত-অভিনীত ছবি নির্মিত হলো আরো কয়েকটি। সবগুলোর ক্ষেত্রে ঘটল দিল-এ-নাদানের ব্যাপারটি।

এভাবেই মুকুট হারালেন গজলকিং। চলচ্চিত্রজগৎ থেকে যেভাবে চলে গিয়েছে ও.পি. নায়ার [জন্ম ১৯২৬]-এর সুরজোয়ার, সেভাবেই হারিয়ে গেল ‘জিন্দেগি দেনেওয়ালে সুন’-রীতির গায়কী। প্রেম-ভালোবাসার মরমী অনুভূতির কোনো স্থান রইল না হিন্দি ছবিতে। সেই সত্তর দশক থেকে ফিল্মি গানে অনুপস্থিত থাকলেও সর্বকালের তরুণ হৃদয়ে আকাঙ্ক্ষাহীন প্রেমের প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে তালাত মাহমুদের কণ্ঠ। তাঁর কণ্ঠের অমিত ঐশ্বর্য সম্পর্কে কিশোর কুমার [১৯২৯-১৯৮৭]-এর একটি মন্তব্য এখানে তুলে ধরা যায়। সুরকার অনিল বিশ্বাস [জন্ম ১৯১৪]-এর বাড়িতে তার সুরারোপিত ‘আরজু’ [১৯৫০] ছবির জন্য গাওয়া তালাত মাহমুদের ‘অ্যায় দিল মুঝে অ্যায়সি জাগা লে চল’ শুনে কিশোর কুমার বলেছিলেন, “আমার মনে হচ্ছে,আমার গানগাওয়া ছেড়ে দেয়াই উচিত। এ-রকম এক চিরজীবী রোমান্টিক কণ্ঠ থাকতে আমি গান গাওয়ার জন্য মুখ খুলব কোন সাহসে!”

মুম্বাইয়ের সেইসব সুরকার
শঙ্কর-জয়কিষণ । ও.পি. নায়ার । এস.ডি. বর্মন । তালাত মাহমুদ । লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারিলাল । মদনমোহন । কল্যাণজি-আনন্দজি । তিমিরবরণ । নওশাদ । হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়

এক-নজরে তালাত মাহমুদ
পুরো নাম : তালাত মাহমুদ । জন্ম : ২৪ জানুয়ারি ১৯২৪ লক্ষ্মৌ । মৃত্যু     : ৯ মে ১৯৯৮ মুম্বাই । সন্তান : ১ মেয়ে ১ ছেলে । গান   : ছায়াছবিতে দুইশরও অধিক এবং ক্যাসেট-এলপি-সিডিতে আড়াইশ প্রায় । প্রথম প্লেব্যাক   : ১৯৪১ । প্রথম অভিনয় : ১৯৪৫ কলকাতা । উপাধি : শাহেশাহ-ই-গজল।

তালাত মাহমুদের জনপ্রিয় কয়েকটা গান
১. আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায় ।। ২. তোমারে লেগেছে এত যে ভালো ।। ৩. দুটি পাখি দুটি তীরে ।। ৪. এই রিমঝিমঝিম ।। ৫. শোনো গো সোনার মেয়ে ।। ৬. জ্বলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে ।। ৭. মেরি জিবনসাথি ।। ৮.  মেরা-তেরা নজরকা ।। ৯.     অ্যায় দিল মুঝে অ্যায়সি জাগা লে চল ।। ১০. যায় তো যায়ে কাঁহা


18280602_10210485957877807_984780563_n

সাযযাদ কাদির (১৯৪৭-২০১৭) । কবি । সাংবাদিক


COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you