বব ডিলান কুড়িটা গান :: পর্ব ২ || জাহেদ আহমদ

বব ডিলান কুড়িটা গান :: পর্ব ২ || জাহেদ আহমদ

অনুবাদে যেটুকু হারায়ে যায়, ট্র্যান্সল্যাশনে যা লস্ট হয়, তা-ই কবিতা, সেটুকুই কবিতা, সেইখানেই বিরাজে কবিতা। আমরা জানি, কিংবা জানানো হয়েছে আমাদিগেরে শ্রেণিকক্ষে, এবং বলা যায় মেনেও নিই এই কথাটা। তাহলে গান? গানের বেলায় একই কথা খাটানো যাবে? ট্র্যান্সল্যাশন হয় গানের? কিংবা ট্র্যান্সফর্মেশন বা ট্র্যান্সক্রিয়েশন? খুবই ডিফিকাল্ট এর উত্তরে এককথায় কিছু প্রকাশ করা। ডন-কো পাকাড়না মুশকিল নেহি, না-মুমকিন হ্যায় — ডন মিয়াকে ধরা আদৌ কঠিন কিছু না, ধরা তো যায়ই, কিন্তু অসম্ভব — গানের বেলাতেও কথাটা টানা যায়। গানের অনুবাদ কঠিন কিছু না, করা তো যায়ই, থোড়া-সা বর্ণান্তর-শব্দান্তর-বাক্যান্তর করে নিয়েই আপনি দাবি করতে পারেন যে আপনি গানানুবাদ করেছেন। কিন্তু জনাব, মনে হয় ফেলনা নয় আশঙ্কাটা, গানানুবাদ আদতে অসম্ভব। অন্তত টেক্সটুয়্যালি তা-ই। টিউন হয়তো অ্যাডপ্ট করা যায়, সেইটা আপনি যখন সুর করবেন তখনকার মামলা, কিন্তু বর্ণধৃত টেক্সট ট্র্যান্সল্যাইট করা তো অলমোস্ট ইম্পোসিবলের কাছাকাছি। গানের ছায়া অবলম্বন করে সুরান্তরণ হতে পারে, হয়, কিন্তু কথান্তর খুবই ডিফিকাল্ট। কবিতা বরং অনুবাদ করা যায়, গিয়েছে অনেক কবিতার সফল ও সমর্থ অনুবাদ পাওয়া আমাদের পাঠাভিজ্ঞতায়। কিন্তু গানের বাণীগত অনুবাদ সহজসাধ্য/সহজলভ্য নয়।

একটা সাধারণগণ্য উদাহরণ মনে করে দেখা যাক ঝটপট। কবীর সুমন কয়েকটা গান গেয়েছেন এমন যেগুলো বব ডিলান বা পিট সিগ্যারের গানানুসৃত সৃজন বলে সুমনের বরাতেই জেনেছি আমরা। হাতে নিয়ে উৎসগানের টেক্সট এবং অনূদিত গানের টেক্সট পাশাপাশি মিলিয়ে পড়লে বোঝা যাবে অনুবাদে ফেলতে হয় কতটা আর রাখতে হয় কতটা বা কতটাই-বা হয় নতুন করে জুড়তে। ‘হেই মিস্টার ট্যাম্বুরিনম্যান প্লে অ্যা স্যং ফর মি’ গানটার সঙ্গে ‘ও গানওলা, আর-একটা গান গাও’ কিংবা ‘হাও ম্যানি রোডস মাস্ট অ্যা ম্যান ওয়াক ডাউন’ গানের সঙ্গে ‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়’ মিলিয়ে পড়লেই ধরা যাবে ব্যাপারটা। আসলে এক-দুই নয়, ‘ফেয়ারোয়েল্ অ্যাঞ্জেলিনা’ গানের সুমনকৃত অনুসরণ ‘বিদায় পরিচিতা’ গানটার কথা চট করে মনে পড়ে গেল, কবীর সুমনের ডিলানভাঙা গানের সংখ্যা ক্যাল্কুলেইট করতে গেলে আঙুলে কুলিয়ে ওঠা যাবে না আমরা জানি। কিন্তু সুমনপ্রসঙ্গ মুলতুবি থাক এইখানে। সেসব অন্য আলোচনা।

আমাদের দেশে বেশ-কয়েকটা ব্যান্ডে এমনকি ঢালিউডি সিনেমায় ইংরেজি প্যপ্ মিউজিকের প্লেট-টু-প্লেট অনুসরণ হয়েছে। সেসব অনুসরণও লক্ষণীয় অভিনিবেশ সহকারে। এক/দুইটা উদাহরণ ইয়াদ করা যেতে পারে। লেভ স্যেয়ার নামে একজনের একটা খুবই জনপ্রিয় গান ‘আই ল্যভ য়্যু মৌর দ্যান্ আই ক্যান্ স্যে’ কিংবা স্টিভি ওয়ান্ডারের ‘নো নিউ ইয়ার্স ডে টু সেলেব্রেইট … আই জাস্ট কল্ড টু স্যে আই ল্যভ য়্যু’ প্রভৃতি যখন অনুসৃজিত হয়, বাংলাদেশের ব্যান্ডমিউজিক অ্যারেনায়, কিংবা ‘কপিয়ার’ নামে একটা প্রোজেক্ট মনে পড়বে অনেকেরই, হিন্দি ফিল্মি গান অনুবাদের একটা ট্রেন্ড গড়ে উঠেছিল মনে পড়বে একসময়, টেক্সট মিলিয়ে দুই ভাষার দুই ভার্শন নজর করে গেলে দেখা যাবে ব্যাপারটা আদৌ টেক্সটুয়্যাল ট্র্যান্সল্যাশন নয়, ওয়ার্ড-টু-ওয়ার্ড অনুবাদ নয়, একদমই নয়, এমনকি ভাবানুবাদও নয়। আদ্যোপান্ত না-হলেও অনেক গানই ভিন্নতর ব্যঞ্জনায় উৎরেছে বলতে হবে। তেমনি ফিডব্যাকের, মাকসুদ থাকাকালীন ফিডব্যাকের, বা সঞ্জীবকৃত দলছুটের কয়েকটা খুবই দীপ্তবুদ্ধির গানানুসৃজন রয়েছে, ব্যাপারটা তারিফ করার মতো। সোলস্, মাইলস, এবং এলআরবি তো অবশ্যই, বেশকিছু অনুসৃজিত কম্পোজিশন উপহার দিয়েছে। বিলি জোয়েলের গান, লেড জেপ্লিনের গান, স্যান্টানা বা সাইমন অ্যান্ড গার্ফাঙ্কলের গান ইত্যাদি বাংলাদেশের ব্যান্ডে মেধাদীপ্তভাবে অনুসৃত হয়েছে সুরকাঠামোর দিক থেকে; এইগুলোই শুধু নয়, বলা বাহুল্য, এক্সাম্পল্ হিশেবে এগুলো বলা হলো। অবশ্য বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতে ইংরিজি গানের, বিশেষ করেই ইংরিজি বাজনার, বদখত নকলনবিশিই হয়েছে বেশি। কিন্তু সেইটা আলগ প্রসঙ্গ।

অনুসৃজন হতে পারে গানের, অনুসরণে সৃজন, অবিকল অনুকরণ পরিত্যাজ্য যদিও, তবে এইটাই এক্সপার্ট হাতে পড়ে এমন ঘটনা ঘটে যে এমনকি কখনো-কখনো মনে হয় যেন মূল গানকেও ছাড়িয়ে যেতে লেগেছে অনুসৃজিত গানটা। আবারও কবীর সুমনের নাম নিতে হবে এর সহজ উদাহরণ চয়নের গরজে। এবং, কেন নয়, ফের একবার সর্বত্র-স্মরণযোগ্য রবীন্দ্রনাথের নাম নিতেই তো হবে। ট্যাগোরের সেই গানগুলো, যেগুলোকে আমরা ‘ভাঙা গান’ হিশেবে পৃথক মর্যাদায় আজন্ম এসেছি ডেকে। একটু আগে যে-একটা গানের কথা উঠেছিল, স্টিভি ওয়ান্ডারের গানটা, বহু ভার্শনের বাংলা শোনার পর কবীর সুমনের ভার্শন শুনে দেখলে বোঝা যায় ঠিক কোথায় যেয়ে একটা গানের লিরিক্সের রিটেন্ টেক্সট অনুবাদে বাধাটা আসে। যে-তিনটা বা চারটা গানের কথা বলা হলো কবীর সুমনের, এছাড়াও রয়েছে বেশ-কয়েকটা তারই হাতে ছায়ানুসৃতিমূলক গান, কম নয় সেসব বরং রয়েছে সুমনসংগীতের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে, এগুলো মূল গানের টেক্সটের সঙ্গে রেখে দেখলে শেখা যায় কিছু জিনিশ। শেখা যায় কেমন করে একটা ল্যান্ডস্কেপের গান আরেকটা ল্যান্ডস্কেপে এনে মেশামেশি করাতে হয় সেই দ্বিতীয় ল্যান্ডস্কেপের জলমাটিহাওয়ায়। এইটা করা সম্ভবই নয় যদি-না আপনি অনুবাদ ব্যাপারটা ভুলতে পারেন। সুমনের এমনকি ‘চাইছি তোমার বন্ধুতা’ গানটাও বব ডিলানের অবলম্বী, কিন্তু বোঝার কোনো কুদরত নাই ইংরেজির সঙ্গে এর কোনো সাদৃশ্য রয়েছে, এমনকি সুরের সাদৃশ্যও মুছে দিতে পেরেছেন সুমন তার এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা কাজে। কেবল স্টিভি ওয়ান্ডারেরটার ক্ষেত্রে সুরটা ডিফিউজ্ করেন নাই। স্টিভির সুমনকৃত বাংলাটা কবীর সুমনের ওয়েবক্ষেত্রে রেকর্ডেড পাওয়া যায়।

কিন্তু সুমনের ন্যায় এই-রকম উৎসগানের সুরচিহ্নটাও লোপাট করে দেয়া চাট্টেখানি কথা তো নয় কিংবা নয় যার-তার পক্ষে সম্ভব। তবে এইখানে যেইটা আলোচ্য তা এ-ই যে সুমন কিংবা অন্য কেউই লিরিক্স হুবহু অনুবাদের চেষ্টাও করেননি। ভাগ্যিস! করলে এই গানগুলো তো পেতামই না, উপরন্তু পণ্ডশ্রম হতো গোটা কারবারটা। কাজেই আপনি যদি গান অনুবাদের চেষ্টা করেন, আপনাকে অবশ্যই সুরবোধসম্পন্ন হতে হবে, সুরসাক্ষর হতে হবে, ইনস্ট্রুমেন্টগুলো আপনি চালাতে পারুন বা না-পারুন সেগুলোর চলন ও ধরনধারণ সম্পর্কে একটা আইডিয়া থাকতে হবে আপনার। গাইতে পারুন না-পারুন আপনার জনপদের সুরমানচিত্র সম্পর্কে একটা জানাশোনা থাকতে হবে আপনার। না-হয় তো উদ্ভট উটের পিঠে চড়াবেন কয়েকটা দারুণ সুন্দর ঈশ্বরী-সৃজিত প্রতিমাকে। এরচেয়ে টেক্সট না-শুনে/না-বুঝে কেবল সুর ফলো করে গেলেই ইনসাফ হয়।

এর মানে এ-ও নয় যে বাংলায় ইংরেজি থেকে গানের ট্র্যান্সল্যাশন হয়নি। বিস্তর হয়েছে। বিস্তর হয়ে থাকে হামেশা। একটা ছোটকাগজে একবার লেনার্ড কোহেনের ‘স্যুজ্যান’ ইত্যাদি খুবই দুর্ধর্ষ কতিপয় লিরিক্স ও জনপ্রিয় গানের একগোছা অনুবাদ পড়ে সেই তরুণ অনুবাদকদের অতিসততার কারণে এদেরে একমুখ বকাবকি করবার খুব খায়েশ হয়েছিল। শাকিরার একগোছা গানের অনুবাদ একটা গাট্টামোটা লিটলম্যাগে একবার পড়ে এদের গানবোধ নিয়ে এতই তিতিবিরক্ত হয়ে গেছিলাম যে একনাগাড়ে একহপ্তা পর্যন্ত বোবা থাকতে হয়েছিল। বব ডিলানের গানের অনুবাদ তো পশ্চিমবঙ্গীয় কতিপয় লিটলম্যাগে এ-পর্যন্ত চাক্ষুষ করেছি। বিদঘুটে অভিজ্ঞতা। এমনকি আমাদের সৈয়দ হকের ‘বিম্বিত কবিতাগুলো’ নামে একটা কিতাব আছে ট্র্যান্সল্যাটেড/ট্র্যান্সক্রিয়েটেড কবিতার, সেখানে ডিলানের কোনো-একটা গানের বঙ্গজন্ম পড়ে সৈয়দের সততানিষ্ঠার জন্য করুণা জাগিয়াছিল। বইটা হাতের নাগালে নাই, থাকলে এক্সাম্পল্ টোকা যাইত। সর্বশেষ নোবেল অর্জনোত্তর ববির গান নিয়া বাংলাদেশী দৈনিকীগুলোতে একটা আমোদে হুজ্জোৎ হয়ে গেল। দরকার নাই। নিখাদ নিভাঁজ সততা গানানুবাদনে তেমন কাজের কথা নয়। দীপক মজুমদার অনূদিত বব ডিলানের কিছু গানের গদ্যস্পন্দে প্যারাফ্রেজেস্ পাওয়া গিয়েছিল অনেক আগে, এখন পর্যন্ত ববির গানের সবচেয়ে ভালো বাংলা ওইগুলোই। কিন্তু কাজটা সারতে হয়েছে প্রোজেয়িক প্যারাফ্রেজিং প্রোসেসে। ব্যাপারটা লক্ষ করতে হবে। এজরা পাউন্ড বলেছিলেন বোধহয় যে একবার যা উৎকৃষ্ট গদ্যে লেখা হয়ে গেছে তা কাব্যে রূপান্তর করতে যেও না বাপু খবর্দার! কিন্তু উল্টোটা করা যাবে না তা তো বলেন নাই। নিশ্চয়। বৃথা কাব্যাবয়বে কেটে কেটে পঙক্তি না-বসিয়ে দীপক মজুমদারের ন্যায় প্যারাফ্রেজিং ববির গান ভাষান্তরের ক্ষেত্রে একটা ভালো অনুসরণীয় ঘটনা। সামলাতে পারলে অবশ্য কবিতাকাঠাম হোক অথবা গদ্যগড়ন কোনো সমস্যা না।

গানের অনুবাদের কোনো দরকার নাই। নিতান্ত অনুবাদের দরকার হলে সেখানে সততা-মূলানুগততা প্রভৃতি ট্র্যাশ জিনিশের দরকার বিলকুল নাই বলে এক্সট্রিম মনে না-হলেও যতটা ভাবা হয় তত নেসেসারি না মনে হয়। যেইটা দরকার তা হলো উৎসভাষার গানের বিটগুলো বুঝে বুঝে, মেপে মেপে, ওজন করে করে, গন্তব্যভাষার ভেতর সবচেয়ে কাছাকাছি যেই বিটগুলো/ছন্দগুলো/অনুছন্দগুলো আছে তার দ্বারস্থ হওয়া এবং কন্টেক্সট্যুয়্যালাইজ করে নেয়া।

নানাবিধ সংগীতানুবাদের পরম্পরা আছে অবশ্য। অঞ্জন দত্ত জন ডেনভারের কয়েকটা গান অবলম্বনে টিউন করেছেন, সেগুলো সুরের আখর ধরে চেনা যায় ডেনভার বলে, কিন্তু লিরিক্স একদম অনুরূপ ডেনভার নয়। ‘এই বুড়ো পুরনো গিটার’ গানটার পাশাপাশি ‘দিস্ ওল্ড গিটার’ শুনে/পড়ে দেখার প্রস্তাব করা যেতে পারে, কিংবা ‘টিভি দেখো না’ গানটার পাশে রেখে ‘ব্লো আপ য়্যুর টিভি’ শুনে দেখুন বা পড়ে, একদম সরাসরি কোনো মিল নাই থিম্যাটিক। বাংলাদেশের একটা ব্যান্ড ‘অর্থহীন’ নামে, সেই ব্যান্ডের ভোক্যাল্-কাম্-ব্যান্ডলিডার সুমন, বেসগিটার ভালো বাজাতে পারেন বলে বেশ বিখ্যাত যিনি, একটা অ্যালবামই করেছিলেন ডেনভারগান নিয়ে, সেইখানে ‘অ্যানির গান’ ইত্যাদি ছিল, টেক্সট্যুয়্যাল দিক থেকেও যথেষ্ট মূলানুগ ছিল অবশ্য, মন্দ হয় নাই। কিন্তু সব-মিলিয়ে এইটা একটা ব্যাপার ধর্তব্য যে, গানের ধ্বনিগত অনুবাদ হলেও কথাগত অনুবাদ সত্যিই ডিফিকাল্ট। অসম্ভব হয়তো নয়, ভালো হাতে পড়ে বেশ উৎরে যেতেও পারে নিশ্চয়, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাণীমঞ্জরির অনুবাদ সুখশ্রাব্য/সুখপাঠ্য হয় না। বাংলাদেশের বেসবাবা ‘অর্থহীন’ সুমন এড়াতে পারেন নাই ‘মেঘের দেশে’ অ্যালবাম করতে যেয়ে এই বিপদটা। আবার ভুয়া বাংলায়নও মায়েস্ত্রো মিউজিশিয়ানের হাতে পড়ে মহাজাগতিক সুরের অভিজ্ঞতা হয়ে-ওঠাও বিচিত্র কিছু নয়।

ট্র্যান্সল্যাশন্ প্রসঙ্গে এই এক্সপেরিয়েন্সটা আরেকটুখানি বিনিময় করা যাক এখানে। হ্যাঁ, ডেনভারের ৯টা গান বাংলায় গেয়েছেন সুমন। বাংলাদেশে ‘সুমন ও অর্থহীন’ ব্যান্ডের ব্যাসবাবাখ্যাত সুমন বেশকিছু সুন্দর-সুষ্ঠু সংগীত উপহার দিয়েছেন বাদ্যযন্ত্র বাজানোর বাইরে নিজের লিরিক্সে স্বকণ্ঠে গাইতে যেয়ে। এমনিতে সেগুলো উচ্ছ্বসিত হবার মতো সুর-উদ্ভাবনা বা গীতিকবিতা না-হলেও ওই সময়ের কন্টেক্সটে উল্লেখযোগ্য ছিল। সুমন যখন ‘সুমন ও অর্থহীন’ ব্যানারে অ্যালবাম রিলিজ্ শুরু করেন, তখন বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতে মিক্সড্ অ্যালবাম ইত্যাদির অপপ্রভাবে হোক কিংবা আর-কোনো কারণে চলছিল ধুমধাড়াক্কা খিচুড়ি লিরিক্স ও মিউজিকের মোচ্ছব। অন্যদিকে কলকাতাকেন্দ্রী মিউজিকে বেশ ভালো সুর ও কথাখচিত সংগীতের সুসময় এসেছিল সমনামী আরেকজনের কল্যাণে। এহেন সময়ে বাংলাদেশের সুমন মোটামুটি নিরিবিলি লিরিক্যাল্ কথাভাগে সুর বসিয়ে গিটারে টেনে টেনে যখন গাইতে শুরু করেন, অঞ্জনাচ্ছন্নতা বা কান্ট্রিমিউজিকের সরাসরি ছাপ সত্ত্বেও শুনতে মন্দ লাগত না। শান্ত-সমাহিত স্বরে এবং পরিমিত বাদ্যযোজনায় নিচু স্কেলে রেখে সুমনের গায়ন তখন অনেককে আশান্বিতও করেছিল নতুন মোড়ের মুখে দাঁড়াতে, উঠতি গাইয়েদের অনেকেই গিটার আর ড্রামস্ খানিকটা ভাবনাচিন্তা করে একটু রয়েসয়ে সামলেসুমলে আরও সৃজনী বিস্তার দিয়ে বাজাবার পথ ঢুঁড়তে শুরু করেছিলেন। পরের দশকে এর বিচিত্রবিস্তৃত ফলও ফলেছে এর, সো-ফার আমার দেখাদেখি দিয়া অনুমিত, থরে-বিথরে বাংলাদেশের গানে বুদ্ধিদীপ্ত বৈচিত্র্যের হাওয়া লেগেছে ক্রমে।

এরপরও উল্লিখিত সুমনের সেই ডেনভারপ্রোজেক্টে অস্বস্তির জায়গাটা ভারী ভুগিয়েছিল শ্রোতা হিশেবে আমাদেরে এবং আজও অভিজ্ঞতাটা ইয়াদ আছে। গানগুলো ছিল জনি ডেনভারের সর্বজনপ্রিয় নাম্বারগুলোর কয়েকটার মধ্যে উল্লেখস্থানীয়; জন ডেনভারের শ্রোতা মাত্রেই লিরিকগুলো ওষ্ঠস্থ রাখেন। যথা — অ্যানি’স্ স্যং, লিভিং অন অ্যা জেটপ্লেন, টেইক মি হোম কান্ট্রিরোড, ড্রিমল্যান্ড এক্সপ্রেস, পোয়েমস প্রেয়ার্স অ্যান্ড প্রোমিজেস্, গার্ডেন স্যং, দিস্ ওল্ড গিটার, ফ্লাই অ্যাওয়ে, এবং পারহ্যাপ্স ল্যভ। সুমনের বঙ্গানুবাদে ডেনভার-মিউজিক শুনতে শুনতে একসময় খেয়াল হয়, আরে! একটা গানই যেন শুনছি ফিরে ফিরে! এইটা কেন হবে? ডেনভারের গানগুলো সিগ্নেচারমার্ক সত্ত্বেও তো মনে হয় না যে একঘেয়ে বা একটা গানই শুনছি, তাহলে এখানে এমন হচ্ছে কেন? ঘটনাটা মনে হয় সুমনের গায়কী-সীমাবদ্ধতার কারণে যতটা-না তারচেয়ে বেশি গানানুবাদের কারণেই। মিউজিকের অনুবাদ হয় না, ‘মেঘের দেশে’ অ্যালবামের সুমন-কম্পোজিত সুর-কথানুবাদগুলো শুনে এই অভিজ্ঞতাটা আমাদের হয়েছিল তখন। যদিও কথার অনুবাদ হতে পারে, হয় আকছার, যেমন কবিতার বিশ্বস্ত টেক্সট্যুয়্যাল ট্র্যান্সফর্ম/ট্র্যান্সল্যাশন্ হয়। বিশ্বস্ত যতই হোক, তবু অনুবাদে যা হারায় তা-ই কবিতা — আমরা জানি এবং মানি। কিন্তু গানের ক্ষেত্রে বোধহয় ট্র্যান্সল্যাশনে কিছুই প্রায় থাকে না। আস্ত লোপাট হয়ে যায় ভাবের বা অনুভবের। ব্যাপারটা হয় তখন না-ঘরকা না-ঘাটকা।

গানের ছায়ানুসারে গান হতে পারে। গান ভেঙে গান হতে পারে। এই দুই প্রক্রিয়াই আসলে গানের বিশ্বস্ত সঞ্চারপ্রক্রিয়া। গান-টু-গান অনুবাদ আসলে হয় না। কাব্যানুবাদ বা গদ্যানুবাদ যদিও সম্ভব লিরিক্সের, কিন্তু সুরের-সংগীতের অনুবাদ! মনুষ্য অসাধ্য। অসুন্দরও। কপি-পেইস্ট হতে পারে অবশ্য। হয়ও। সচরাচর কপি-পেইস্ট হতেই আমরা হামেশা দেখে থাকব। সুমনের ডেনভারগানের অনুবাদচেষ্টা ডেনভারের প্রতি ট্রিবিউট হিশেবে বেশ, সংগীতাভিজ্ঞতার বিচারে এইটা যাচ্ছেতাই।

কিন্তু অন্যদিকে এই কথাটাও তো সৌরজাগতিকতায় সূর্যালোকের মতো ট্রু যে দেশে দেশে গানের অনুবাদই হয় আসলে। দেশে দেশে, যুগে যুগে, কালে ও কালান্তরে। সেই প্রক্রিয়াটা লক্ষণীয়। অর্থহীন শীর্ষক ব্যান্ডের সুমনের প্রক্রিয়ায় সেইটা সম্ভব না। ঠাকুরের প্রক্রিয়ায় সেইটা সম্ভব, কাজীর প্রক্রিয়ায় সেইটা সম্ভব, এবং সম্ভব কবীরের প্রক্রিয়ায়। এইখানে কবীর বলতে আমরা বলছি কবীর সুমন। বাংলা গানে একটা হাওয়া এনেছিলেন সুমন কোন প্রক্রিয়ায়, এইটা আমরা আজ পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করতে পারি বোধহয়। এই জিনিশটা কবীর সুমনের কাছ থেকে আমরা শিখে রাখতে পারি।

এখন বলবার কথাটা এ-ই যে গানে কি আদৌ বক্তব্য থাকে? হ্যাঁ, গানের সংজ্ঞাতালাশে না-লেগে জীবনানন্দের বহুলোদ্ধৃত কবিতাকথার সেই নিরুক্তিসদৃশ সুভাষণ মনে রেখে বলা যেতে পারে যে গান অনেকরকম; হতে পারে বক্তব্যমূলক গান, প্রচারণাগান, তর্ক ও তর্জামূলক গানও হতে পারে, যেমন মরমি বা আরও সহস্র ধরনধারণের গানও রয়েছে দুনিয়ায়। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একটা ভালো গানে আমরা সুরের এক্কাগাড়িতে চড়ে ছবি দেখে বেড়াই, দেখি চলচ্চিত্র, রৌদ্রছায়াছবি; এই ছবি কোনো অন্তরীক্ষছবি কিংবা ভূমিচিত্র নয়, এইটে অনুভূতিচিত্র, মনশ্ছবি। গানের সত্যিমিথ্যা এবং গানের যুক্তিবিদ্যা, যেমন কবিতারও, দুনিয়াবি সত্যিমিথ্যা-যুক্তিবিদ্যা থেকে আলাদা; গানের ব্যাপারস্যাপার এমনকি কবিতার ব্যাপারস্যাপার থেকেও অনেকটা আলাদা। না, মালার্মে বা আরও-আরও প্রতীকবাদী কবির কথা না-জানলেও চোখ বুঁজে এই কথাটা মানতে বেশি বেগ পেতে হয় না। কাজেই অনুভবছবি তর্জমা/ভাষান্তর করবেন কী করে! গান বঙ্গানুবাদিত হতে যেয়ে হামেশা বাংলান্তরিত হতেই দেখব আমরা, বাংলায় যোগ করতে যেয়ে বাংলা থেকে বিয়োগ করে দেয়া, গানের পাঠকৃতিগত অনুবাদনের এই এক বিপদ ও বিপত্তির দিক, বাংলায় মেহমানগানকে নেমন্তন্ন জানায়ে আনতে যেয়ে যেন আমরা বাংলাছাড়া না-করি বেচারিকে।

এত কথা পাড়বার পেছনে একটা কারণ হচ্ছে এ-ই যে, এইখানকার গানগুলো তর্জমা করতে যেয়ে যে-অভিজ্ঞতা এবং যে-প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে এই তর্জমাকার গিয়েছে সেসবের একটা আলতো ডক্যুমেন্টেশন্ রাখা যায় কি না ট্রাই করা; খানিকটা অভিজ্ঞতার বিবরণ পূর্বপ্রকাশিত ববগানসংকলনে রয়েছে (লিঙ্ক https://gaanpaar.com/20-songs-by-bob-dylan-in-bangla/?fbclid=IwAR100AZvE9MgaS5zsRDVGIGMKKdt1EuAVgc4XfzbfZs1IzwxuvCiv1cDvSo), এইখানে আরেকটু রইল, পরে ফের আরও হবে হয়তো অভিপ্রেত পরবর্তী কিস্তিটিতে। এই জিনিশগুলো, পূর্ববর্তী কিস্তিতেও বলা আছে, ববি ডি-র নোবেল ডিক্লেয়ারের বছর-দেড় আগে থেকে এই নিবন্ধকারের ফেসবুকে অলরেডি আপ্লোডেড রয়েছে; সেখান থেকে বেছে, মেজেঘষে একটু, একেকটা খাড়াবড়িথোড় ভূমিকাভাষ্য জুতে দেয়া শুধু।

তবে এইটুকু কনফেস্ করা যাক যে, এখানকার তর্জমাগুলো কোনোভাবেই মূলের অনুবর্তী রাখার চেষ্টা ছিল না; কারণ, মূল/অরিজিন্যাল্ প্রভৃতির ধারণা … ব্যাপারটা গানের ক্ষেত্রে অনেক কথা আনে টেনে টেনে। যেমন, কোন মূল? কীসের মূল? কথার? সুরের? এক্সপ্রেশনের? ইম্প্রেশনের? নাকি ভাষাবিনিময়ের অন্তর্বর্তী হারানো খরগোশের? যেমন, যে-অভিব্যক্তিটা বাংলায় নাই বা থাকলেও ব্যুকিশ সেইটা আংরেজির মূলভাব বজায় রাখিবার গরজে বাংলাকালে রাখতেই হবে? কে কয়ে দিচ্ছে এই মূলভাব? রচয়িতা যদি নিজমুখে কিছু কাহিনি/ন্যারেটিভ বলে রাখেন কোথাও, মূলভাব ওইটাই ধর্তব্য? হলেও, রচয়িতানির্দেশিত গল্প মূলভাব যদি হয়ও, অন্যানুভবে/অন্যভাবে যেতে কেন বাধা থাকবে ভাষাবদলকারীর? আর গানের বেলায় উৎসভাষার এক্সপ্রেশন হুবহু অনুসরণ করে গেলে পরে যে-ভ্যাবলা ব্যাপার দাঁড়ায়, সেই অভিজ্ঞতার বিবরণও পরবর্তী কিস্তির কোনো ভূমিকাফোকরে একবার বলার উদ্যোগ নেয়া যাবে হয়তো।

মোদ্দা কথা, বাংলা টু ইংরেজি কি ইংরেজি টু বাংলা শব্দার্থের অনুবাদন নয়, এখানে এক্সপ্রেশনের একেকটা প্যারালাল্ বাংলা ভার্শন প্রেজেন্টের চেষ্টাটা আগাগোড়া চালায়ে যাওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাঁকানোচুরানো যথেচ্ছ করা হয়েছে। কেবল বাংলা কবিতার কিছু কয়েনেইজ্, বাংলা গানের কিছু কমন্ এক্সপ্রেশন্, বাংলা বাগধারারই কিছু ইডিয়মস্ এবং ফ্রেইজেস্, চলে এসেছে ঘুরেফিরে। একদিক থেকে, কাজেই, এগুলো ভাষান্তর নয় বরঞ্চ বলা যায় এক্সপ্রেশনান্তর। বহমান বাংলা গানের বা কাব্যের কড়ি ও কোমল এখানে বেলেল্লায় ব্যবহৃত হয়েছে। এই ব্যবহারাভিজ্ঞতা নিয়া আরেকদিন কথাকীর্তন হোক।

শুধু কথাটা আরেকবার স্পষ্ট বলা যাক যে গানের অনুবাদ হতে পারে কেবল বাগগেয়কারের হাতে। বাগগেয়কার, যিনি নিজে একাধারে স্যংরাইটার-কম্পোজার-মিউজিকঅ্যারেঞ্জার-সিঙ্গার এবং সর্বোপরি মিউজিশিয়্যান। বর্তমান তর্জমাকারের মতো শৌখিন শ্রোতা, স্নানঘর ছাড়া সাউন্ডস্টুডিয়ো নাই যার, তার হাতে গানের ফ্লেভ্যর আশা করা বাতুলতা। সাহিত্য তো ঐশ্বরিক শৌর্যসম্পন্ন ভূতের কাণ্ড। তবে কবি এবং দৈনিক খবরপত্র সম্পাদকদের ব্যাপারে প্রেডিক্ট করা আদৌ সম্ভব নয়। এই দুই সম্প্রদায় গানবাজনার ঘাড় ধরে সততাবাহিত অনুবাদসাহিত্য করে তুলতে সদা উদগ্রীব। টি-ব্রেইকের ফাঁকে সেসব নিয়া আমরা আলাপ জুড়ব। বর্তমানে বব ডিলানের গানের ভবিষ্যতে চেষ্টা করে দেখি দৃষ্টি দিতে পারি কি না। আদৌ অসাধ্য নয় কিছু। মনে হয় পারব।

পরবর্তী অধিবেশনের আগে নিম্নলিখিত কথান্তরগুলো চক্ষুকর্ণ বুলিয়ে গেলে মনে হয় মন্দ হবে না।

বব ডিলান কুড়িটা গান :: পর্ব ২ || জাহেদ আহমদ

আই অ্যাম্ অ্যা ল্যোনস্যম্ হোবো
নিঃসঙ্গ ও ভবঘুরে আমি এক
তিনকুলে কেউ নাই বিলকুল বন্ধু-ও-গৃহহারা
আর-সকলের যেখানে জীবন শুরু
সেখানেই ঠিক জীবন আমার সারা

চালায়ে গিয়েছি ইতিউতি নানা ধান্দা
ঠকায়েছি বহুজনেরে খোদা-না-খাস্তা
রুজিরোজগার হোক যেনতেন করেছি
কখনো ধরিনি ভিক্ষার সোজা রাস্তা

আমারও একদা ছিল উজ্জ্বল দিন
কোনোকিছুতেই ছিল না আদৌ কমতি
সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছি
জুতো ও জামায় ঠিকরে বেরোত জ্যোতি

কিন্তু করিনি বিনে-সন্দেহ ভাইকেও বিশ্বাস
দাঁড় করায়েছি তারে শেষমেশ দোষীর কাঠগড়ায়
সেহেতু এমতি নিয়তির পরিহাস
আউলা লেবাসে বাউলা বান্দা লুটাইনু ধুলাবালুকায়

সমবেত সুধী দর্শক-ও-শ্রোতাবৃন্দ
শিগগিরই আমি যাব ছেড়ে এই চৌরাস্তার মোড়
যাইবার আগে এইটুকু বলি বিনীত ও করজোড় :

পরিহার করো ঈর্ষা এবং পরশ্রীকাতরতা
অন্য কারোর কথায় কদাপি নিজেরে কোরো না চালিত
নিজের ভালো ও মন্দটুকুর নিজেই বিহীত করো
নয়তো নতিজা আমারই মতন পথেঘাটে প্রবাহিত

 

ট্রু ল্যভ টেন্ডস্ টু ফোর্গেট
আমার প্রেমিকা আমার ব্যাপারে বিলকুল বেরহম
দেখলেই এমন ভাব ধরে যেন চেনেই না একদম
ওর কাছে বৃথা আশা করি আমি অনুরাগঝরা গান
প্রকৃত প্রেমের ধর্মই হলো ভুলিয়া থাকার ভান

জাপ্টিয়া রাখো ধরিয়া আমারে লেপ্টিয়া থাকো ধরে
বলেছিলে তুমি বেসে যাবে ভালো অক্ষরে অক্ষরে
দ্যাখো আমি আজ লাটিমের ন্যায় দিনরাত লবেজান
প্রকৃত প্রেমের ধর্ম তবে কি বিস্মরণের ভান?

আছিলাম আমি শরশয্যায় শ্বাসবায়ুহীন শুয়ে
দেখি লোকভিড়ে আচানক তুমি নীরবতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে
আসিয়াছ যেন ক্রমে ভেসে ভেসে দূর গ্রহগৃহ থেকে
যেন আমারেই কামনা করিছ প্রতীক্ষামায়া মেখে

কাঁদানে কামান হলেও তুমিই রেখেছ মোহিত আমারে
সুভদ্রা আমি চিনেছি তোমারে এই নিধুয়ার পাথারে
ঘেমো হপ্তার ভুয়া ডামাডোলে বেজায় তেতো ও হয়রান
প্রকৃত প্রণয়চিহ্ন কি তবে পেরেশানিভরা গান!

জাপ্টিয়া রাখো ধরিয়া আমারে লেপ্টিয়া থাকো ধরে
বলেছিলে তুমি বেসে যাবে ভালো অক্ষরে অক্ষরে
দ্যাখো আমি আজ লাটিমের ন্যায় দিনরাত লবেজান
প্রকৃত প্রেমের ধর্ম সত্যি বিস্মরণের ভান

কারো নও তুমি নিঠুরা আমার তোমারে আমিই পেয়েছি
দিও না আমারে ঠেলিয়া তফাতে তোমাতেই বশ মেনেছি
যেতে ঠেলিও না আমারে একাকী তীর্থসুদূর স্থান
প্রকৃত প্রেমেতে গ্রেফতার আমি গাইছি তোমারই গান

প্রকৃত প্রেমটা বাস্তবে এই ভুলিয়া থাকার ভান
প্রকৃত প্রেমের ধর্মই হলো ভুলিয়া থাকার ধ্যান
প্রকৃত প্রেম তো ধর্মত এই বিস্মরণের টান

 

ডিয়ার ল্যান্ডলর্ড
প্রিয় অগতিরও গতি অনাথেরও নাথ শরণাগতার পতি
এই পতিত্ পামর আত্মারামেরে মেপো না বাজারদরে
এমনিতে দ্যাখো স্কন্ধে আমার বোঁচকা বেজায় ভারী
জিরোতে দ্যায় না খোয়াবগুলোই আমারে দণ্ড-তরে
এবং যখন বাজিয়া উঠিবে নিখিলদণ্ড স্বৈরপ্রভুর বাঁশি
চুকাইয়া দিব যা-কিছু ধার্য কড়ায় এবং গণ্ডায়
আশা করি তুমি হৃষ্ট হৃদয়ে বুঝিয়া পাইবা পাওনা
জানি না আনাজে মুগ্ধ তুমি না নাবাল জমির পর্চায়।

প্রিয় অকূলেরও কূল অজাতেরও জাত্ অনধিকারীর বিভূতি
অনুগ্রহ করে কান পেতে শোনো অবোলার এই ফরিয়াদ
আমি জানি তুমি নিজেও অনেক সয়েছ কাঁটার যাতনা
আর এক্ষেত্রে জেনো অগাধ আমার ব্যথাবেদনার বুনিয়াদ
সবাই আমরা বল্গা পরাতে ব্যস্ত অলীক হরিণ
জীবনের নুন-মরিচ লুটিতে কতই-না কায়দায়
অথচ ভাণ্ড উপচায়ে নেয়া আদৌ তো নয় কঠিন
যা-কিছু দৃশ্য অধরা মাধুরী জীবনেরে ডেকে যায়

প্রিয় অসারেরও সার অফলারও ফল মূক-বধিরেরও মুরতি
খারিজ করিয়া না-দিও হে নাথ অনাথেরও এই মামলা
বাদী-বিবাদীর শুনানিতে গেলে মাঠে মারা যাব জানি
কিচ্ছু করার নাই আমার আর নাই ভিটাবাড়ি আগলা
নাইবা হলাম সর্বময়ের সমতুল আমি তবু তো শৌর্যশালী
তুমি তো জানো ভবসখা আমি মিছে নহি একরত্তি
পরস্পরে এসো তবে এই স্বার্থচুক্তি করি
না-যদি আমারে হেলা করো তবে বাধিত রহিব সত্যি।

 

অল্ দ্য টায়ার্ড হর্সেস্
দিনদুপুরেই হাঁপায় দ্যাখো হদ্দ ঘোড়ার দল
ছুটতে আমায় হবেই হবে বাহনে বা পয়্দল

 

টুনাইট আই’ল্ বি স্টেয়িং হিয়ার উইথ য়্যু
ট্রেনের টিকেট ছুঁড়ে ফ্যালো খোলা-জানলায়
স্যুটকেসটাও ঢুকুক চকির তলে
দুশ্চিন্তারে ফ্যালো দূরে এক-ঝটকায়
ব্যবসাপাতিটা ভাসুক গাঙের জলে
থাকছি আজকে তোমার সঙ্গে সুরম্য কম্বলে

শহর ত্যাজিয়া যাব কথা ছিল সকালেই
নই আমি অত সময়নিষ্ঠ গর্দভ
দুনিয়া বাতিল শুধু তো তোমার কাছেই
অয়ি হৃদিশ্রীনন্দী তিলোত্তমাসম্ভব
রইছি আজকে তোমার সঙ্গে ঝালে-ঝুলে-অম্বলে

হতবুদ্ধির হতে যাবে কেন বলো
অচিনা মানুষে এইধারা ভালোবাসা
তোমারে দেখেই হৃদিখানি থিতু হলো
চোখাচোখিতেই চরিতার্থতা দুরাশা

ওই শোনা যায় রেলের ভেঁপুটা বাজে
ওই দেখা যায় স্টেশনবাবুর মুখ
পাই যদি কোনো গরিবেরে পথিমাঝে
বলে আসি ব্যাটা মাগনা আসনে বসুক
আজিকে আমরা কাটাব মগ্ন রজনীর জঙ্গলে

ট্রেনের টিকেট ছুঁড়ে ফ্যালো খোলা-জানলায়
স্যুটকেসটাও ঢুকুক চকির তলে
দুশ্চিন্তারে ফ্যালো দূরে এক-ঝটকায়
ব্যবসাপাতিটা ভাসুক গাঙের জলে
থাকছি আজকে তোমার সঙ্গে সুরম্য কম্বলে

 

নেভার স্যে গুডবাই
সন্ধের আলো বরফশোভিত হ্রদে
উত্তুরা হাওয়া নামিতেছে লঘু পদে
বরফের গায়ে আবছা পায়ের ছাপ
ঘনঘোরতর হিমাঙ্ক চুপচাপ

তুমি সুন্দর সুচরিতা ভাষাতীত
তোমার ওমেই যেতে পারে এই শীত
ক্ষণবিরহেও প্রাণ করে হায় হায়
বোলো না বোলো না, কখনো বোলো না বিদায়

কেননা আমার স্বপ্নস্থাপত্যটি
বানায়েছি প্রিয় লোহা আর ইস্পাতে
সেখানে তুমিই শীর্ষ ময়ূরঝুঁটি
ঝাঁকাভরা ফুল ছড়ায়ে রেখেছি তাতে

হিমধারা হাওয়া ধাক্কা দিচ্ছে এসে
বরফবালিতে রয়েছি প্রতীক্ষায়
একটুকু ছোঁয়া সবটুকু দেহ ঘেঁষে
প্রেমের পরশে প্রাণ ফিরে পাবো গায়

শিহরণোৎস সুন্দরীতমা আমার
যেমতি-ইচ্ছা পাল্টায়ে নাও পদবী
নিতে পারো চুলে ভিন্ন রঙের বাহার
আমি খুশি হই রেখে দিলে এই কিশোরীকেশের ছবি

 

আই ওয়ান্ট য়্যু
দুঃখশ্বাস ফেলছে দেখো মুদ্দোফরাশ লোকটা
হাপুস নয়নে কেঁদে ভাসাইছে পথবাঁশিছিদ্রটা
রূপালি গিটার কানে কানে কয় ছেড়ে দিতে প্রাণসখারে
পাগলা ঘণ্টি চিৎকারি যায় সঙ্গে বেজায় শিঙ্গার শোরগোল
তারা বলে আমি তোমারই কারণে হেন ভয়াবহ উন্মুল।
সত্যি-মিথ্যা যা-হোক কিন্তু কেমনে ত্যাজিব তোমারে!
কেমনে এমন চিরপৃথকতা মানিয়া বাঁচিব আমি!
তোমারে ছাড়ার রায়ে সায় নাই জানেন অন্তর্যামী।
তোমাকেই চাই যতকিছু হোক বিচারসালিশ শেষে
একটি জীবন করে যাই পার তোমাকেই ভালোবেসে।
তোমাকেই চাই তোমাকেই চাই ছাড়া নাই কিছু গাইবার
প্রিয়তমা আমার আখেরে এরচে বেশি কিছু নাই চাইবার।

লাফাইছে দেখো রাজনীতিকেরা রাস্তার উপরে ধেই ধেই
মিথ্যে বেসাতি নিয়া আসে তারা আমাদের দুয়ারেই
নিমজ্জমান নিদ্রায় হেলে পড়ে আছে যত ত্রাতা
তারা সকলেই ঘ্রাণ নিতে চায় তোমারই অনাঘ্রাতা!
আমিও রয়েছি নিশানের ন্যায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায়
বেত্তমিজেরা রাত্তিরে এসে আমারে শাসায়ে যায়
ফরমাশ করে শালারা আমারে তোরণ খুলিয়া রাখিতে
পাছে তুমি এসে ঢুকে যাও কোনো খোলাদ্বার আনবাড়িতে।
যে-যাহা চাইছে যাক চেয়ে যাক আমিও তো চাই তোমাকে
ধান্দার মহাবান্দা খোয়াবে তোমারই তো মুখ আঁকে।
তোমাকেই চাই তোমাকেই চাই ছাড়া নাই কিছু গাইবার
প্রিয়তমা আমার আখেরে এরচে বেশি কিছু নাই চাইবার।

আমার সকল শ্বশুরআব্বারা আগেভাগে গেছে ভেগে
প্রেমের নজরনিশানা না-পেয়ে মরিয়াছে উদ্বেগে।
সেই আক্রোশে তাদের মেয়েরা আমারে ঈর্ষা করে
ব্যাপক যাতনা দিয়া যায় দ্যাখো অনন্ত অম্বরে।

শেষে ফিরে আসি ইশকাপনের বিবির সরাইখানায়
হৃদয়কাহন খুলিয়া দেখাই পরিচারিকার কাছে
জানে সে যে আমি গররাজি নই পুড়িতে তাহার আঁচে
ভেতরে আমার যেটুকু দেখার ঠিকই সে দেখিতে পায়।
আমার ব্যাপারে পরিচারিকার হৃদয় বেজায় সদয়
হেন কিছু নাই তার দৃষ্টিতে ধরা পড়িবার নয়।
সে জানে আমার যাত্রা কোথায় কতদূর চাই যেতে
ফারাক করিতে ভুলিনাকো আমি অনাহূতে-অভিপ্রেতে।
দ্যাখো দরদিয়া জানে সকলেই তোমার নিষ্ঠুরতা
চাই চাই বলে কেঁদে ফিরি পেয়ে তোমার অপারগতা।
তোমাকেই চাই তোমাকেই চাই ছাড়া নাই কিছু গাইবার
প্রিয়তমা আমার আখেরে এরচে বেশি কিছু নাই চাইবার।

দেখছি বিদেশি নৃত্যগীতের যুবক তোমায় পায়
একফাঁকে তারে পাকড়াও করি ঠোঁট চাপি বাঁশিটায়।
স্বীকার করছি তার সঙ্গে তো সদাচার করি নাই
কীভাবে করব ভণ্ডামি বলো আমি কি নিভানো ছাই?
কিন্তু মন্দ কিছু তো করি নাই ওই মিথ্যুকটার সনে
সে কেন তোমারে নিয়া যাবে বলো রজনীগন্ধাবনে?
দ্যাখো সময় আমার বিপক্ষে আর তোমার আশকারায়
সে-ই জিতে যায় বলে মনে হয় হেন ভণ্ডের জমানায়।
আমার জেতার দরকার নাই আমি তোমারেই চাই
জিৎ-পরাজিৎ ভাবনায় আবার তোমায় না হারাই!
তোমাকেই চাই তোমাকেই চাই ছাড়া নাই কিছু গাইবার
প্রিয়তমা আমার আখেরে এরচে বেশি কিছু নাই চাইবার।

 

ব্লু মুন
দাঁড়িয়ে ছিলাম চাঁদের নিচে একলাটি অগাধ
নিঃসঙ্গ নিঃস্বপ্ন নিষ্প্রেম নিরপরাধ

তুমি জানো চাঁদ ওইখানে যেয়ে একলাটি কেন শূন্য
করেছি বিধুর বেদনার গান মায়ামানুষের জন্য

সহসা সেখানে আগমন সেই তীর্থসৌম্য সরলার
শুনি গলা তার ফিসফিসাইছে আমারই নিকটে ব্যাকুলা আদর মেগে
চেয়ে দেখি নীল ব্যথাতুরা চাঁদ স্বতঃস্ফূর্ত সোনার!

শোনো চাঁদ দ্যাখো একলাটি নই আর
ঘুচেছে দণ্ড স্বপ্নশূন্য সঙ্গবিরলতার
নিকটে এসেছে এ-ই তো প্রকৃত সারস ভালোবাসার।

 

আই’ল্ বি য়্যুর বেইবি টুনাইট
ছিটকিনি দাও, বুঁজে ফ্যালো চোখদুটো
ভয়ডর ফেলে ফুলের নিয়মে ফোটো
অদ্য রজনী আমিই তোমার প্রেমিক

আলোটা নেভাও, সঙ্গে অন্ধকারটাও
দুর্ভাবনাটা আমারে ভাবতে দাও
অদ্য রজনী আমিই তোমার প্রেমিক

গাঙশালিখটা পাল তুলে উড়ে যায়
যেতে দাও, যেতে দাও
হুৎকো মোটকা চাঁদটা যেন-বা চামচ চকমকায়
দেখি না চাঁদের চটকটাও
পস্তাবে শেষে, রাতটুকু বুঝে নাও

ছুঁড়ে ফ্যালো চটিজামা, ফালতু ভাবনা রাখো
মদের বোতল ছিপি খুলে এসো ঘনঘোর বসে থাকো
অদ্য রজনী নির্ভাবনায় আমিই তোমার প্রেমিক

 

বেইবি, স্টপ ক্রাইয়িং
রসাতলে যেতে লেগেছিলে একটা খারাপ লোকের সঙ্গে
আসিয়াছ ফিরে যেখানে তোমার কথা ছিল থাকবার
এইবার যাও লক্ষ্মীসোনাটি নিয়া আসো বন্দুকটা
আমি নিকুচি করি অপরাধ সয়ে এইধারা সাফসুতরার

লক্ষ্মীসোনা, কাঁদে না, কাঁদে না, কান্না থামাও দোহাই
লক্ষ্মীসোনা, কাঁদে না, কাঁদে না, কান্না থামানো চাই
সোনাজাদু, ওগো রূপোখুকু, অবিলম্বে তোমার রোদন থামাও ভাই
দ্যাখো, সূর্য শুধুই কিরণ ছড়াবে — এছাড়া আমার কিচ্ছুটি জানা নাই
মিজাজ আমার খিঁচড়ে যাচ্ছে, ফাটিয়া যাইছে অন্তরাত্মা, কান্না থামাও রাই!

তিরিতিরি হাওয়া বইছে যেখানে নদীটির তীরে প্রেমপরিস্রুত অনাবিল
ওইখানে যেয়ে দাঁড়াও চুপটি নিরালা রাইটি শিগগিরই ফিরে আসছি
তিরিতিরি হাওয়া বইছে যেখানে নদীটির তীরে প্রেমপরিস্রুত অনাবিল
এক্ষুণি ফিরে এসেই তোমার বেদনার ভার নদীর নিয়ড়ে পদপাতাতলে রাখছি

লক্ষ্মীসোনা, কাঁদে না, কাঁদে না, কান্না থামাও দোহাই
লক্ষ্মীসোনা, কাঁদে না, কাঁদে না, কান্না থামানো চাই
সোনাজাদু, ওগো রূপোখুকু, অবিলম্বে তোমার রোদন থামাও ভাই
দ্যাখো, সূর্য শুধুই কিরণ ছড়াবে — এছাড়া আমার কিচ্ছুটি জানা নাই
মিজাজ আমার খিঁচড়ে যাচ্ছে, ফাটিয়া যাইছে অন্তরাত্মা, কান্না থামাও রাই!

কখনো তোমার লাগে যদি ধরো যোগালি খাটার লোক
অথবা ধরো দরকার হলো দূরযাত্রার বোঁচকাবাহক অনুচর
মনে করো শুধু শুনে যাবে কথা চাইছ অমন বন্ধুপ্রতিম উজবুক
সোনামণি, প্রিয়তমা, আমারেই তুমি দ্বিধাহীনচিতে ডেকে নিও সত্বর

লক্ষ্মীসোনা, কাঁদে না, কাঁদে না, কান্না থামাও দোহাই
লক্ষ্মীসোনা, কাঁদে না, কাঁদে না, কান্না থামানো চাই
সোনাজাদু, ওগো রূপোখুকু, অবিলম্বে তোমার রোদন থামাও ভাই
দ্যাখো, সূর্য শুধুই কিরণ ছড়াবে — এছাড়া আমার কিচ্ছুটি জানা নাই
মিজাজ আমার খিঁচড়ে যাচ্ছে, ফাটিয়া যাইছে অন্তরাত্মা, কান্না থামাও রাই!

বহু বেদনার বহিতেছ ভার বহু বছরের অবহ প্রহার
জানি ঠিকই তুমি এই মুহূর্তে এলেবেলে কত ভাবতেছ ছাইপাঁশ
বেদনা বুঝতে হওয়া লাগেনাকো বদ্যি বা ডাক্তার
জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা মানেই ফিরিয়া চাইছ জীবনেই অধিবাস

লক্ষ্মীসোনা, কাঁদে না, কাঁদে না, কান্না থামাও দোহাই
লক্ষ্মীসোনা, কাঁদে না, কাঁদে না, কান্না থামানো চাই
সোনাজাদু, ওগো রূপোখুকু, অবিলম্বে তোমার রোদন থামাও ভাই
দ্যাখো, সূর্য শুধুই কিরণ ছড়াবে — এছাড়া আমার কিচ্ছুটি জানা নাই
মিজাজ আমার খিঁচড়ে যাচ্ছে, ফাটিয়া যাইছে অন্তরাত্মা, কান্না থামাও রাই!

 

ইজ্ য়্যুর ল্যভ ইন্ ভ্যাইন্?
জিগাই তোমারে, — এইটা আসলে ভালোবাসা, নাকি নিছকই শুভকামনার করুণা?
আধেকটাও কি চাও অধমেরে যে-মতো বলিছ, অথবা আসলে এর সবটাই অংবংচংপনা?
আগেও পুড়েছি একাধিকবার, আমি জানি তাই কারে বলে প্রেম-ভালোবাসাবাসি বিদগ্ধ যন্ত্রণা
কাজেই আমি কিছুতেই শোনো টুঁ-শব্দ করব না
তাহলে এবারে দেখতে পারি তো খোয়াব তোমায় নিয়া —
নাকি স্মৃতিবিরূপা আগেরই ন্যায় আশার ছলনে ছ্যাকা খাব শুধু উল্টিয়াপাল্টিয়া?

তুমি কি এতই উরাধুরা নাকি যে দেখতে পাও না আমার ভিতরে সন্তের সমাহিতি?
ঠিক যেইক্ষণে আমি নিরালা আঁধারে ধ্যানাবনত, তুমি কেন এসে বেধুরা জাগালে গীতি?
দেখেছ আমার ভিতর-বারামখানা? সাঁই নাকি আমি নিছকই শিষ্য শয়তানী টালবাহানা?
চাও যদি কিছু সবিস্তার তো বিশদে বুঝায়ে বলি?
তার আগে বলো তুমি কি আমারে যেমন-আছি-ঠিক তেমনই থাকতে দেবে?
এত ভনিতার দরকারই নাই না-পোষায় যদি কী হবে বেঘোরে ভেবে?

দ্যাখো শরীরে আমার পাহাড়ারোহণচিহ্ন, ঝড়বাতাসের সঙ্গজনিত দাগ
সুখের লাগিয়া আগে বেঁধেছিনু বহুবার ঘর সুখেরে দেখেছি শুরু থেকে শেষতক
রাজার থালায় খেয়েছি খানা, ডানায় আছিল উড়ানের সংরাগ
কিছুতেই আমি তিষ্ঠ হইনি জিরোইনি পাখা সাজতে পারিনি ভানপটু তঞ্চক

ঠিকাছে, এসো সুবর্ণ বিষ একঢোঁকে ফের গলায় না-হয় ফেলি আরেকটাবার, প্রেমে পড়ি মেয়ে তোমার
এইবার যদি ঠিকঠাকমতো বোকা হতে পারি নিশ্চয় জেনো সহিসালামতে সামলাইব প্রণয়সিদ্ধ সংসার
তুমি নিখুঁত নুনে রাঁধতে পারো তো? সেলাইফোঁড়াই, চারু ও কারু? ছাঁটতে কি পারো টবের পাতাবাহার?
হতে পারো তুমি আমার জন্য সর্বংসহা অঙ্কশায়িনী, সেবিকা এবং চাহিবামাত্র সরবরাহের ভাণ্ডার?
আমার চাহিদা জানালাম তবে, ভেবে দেখো ঝুঁকি নেবে কি না বাদ দেবে
এত সোজাসাপ্টা ভালোবাসা চাও, স্বর্গ হতে এসে ফের স্বর্গে যাবে চলে, সমঝিয়া তো নেবে?

তুমি নিখুঁত নুনে রাঁধতে পারবে? সেলাইফোঁড়াই, চারু-কারু? ফোটাতে পারবে বসন্তে ফুলবাহার?
পারবে হতে আমার জন্য সর্বংসহা অঙ্কশায়িনী, সেবিকা এবং চাহিবামাত্র সরবরাহের সর্বস্ব ভাণ্ডার?
আমার চাহিদা জানালাম তবে, ভেবে দেখো ঝুঁকি নেবে কি না বাদ দেবে
এত সোজাসাপ্টা ভালোবাসা চাও, অয়ি প্রিয়তমঃ, সমঝিয়া তো নেবে!

 

ইট্ টেইকস্ অ্যা লট্ টু ল্যফ ইট্ টেইকস্ অ্যা ট্রেইন্ টু ক্রাই
ট্রেনে চেপে আমি ছুটছি দূরের পানে
একটুও নাই রোমাঞ্চকর মজা
সারাটা রাত্রি উজাগর থেকে এখন
রেলজানালায় রেখেছি কাঁধটা কুঁজা

দ্যাখো যদি যাই সফরকালীন মরে
পাহাড়শীর্ষে পেয়ে যদি যাই সমাধি
তাতেও যদি শিহরণ হয়নাকো
মজা পাবে তুমি প্রিয়তমে শেহজাদি

চাঁদের কেমন রূপখোলতাই দ্যাখো
জ্যোস্না ঢালিছে পাইনবনের চুলে
বনবাবুকেও লাগছে বেজায় ভালো
মলিনতা তার মুছে গেছে সমূলে

সূর্যটা আজ দ্যাখো কত খুবসুরত
ডুবিয়া যাইছে সাগরশরীর ছুঁয়ে
প্রেমিকা আমার অনিন্দ্য সুন্দরী
পিছু ফিরে একা তাকাই তীব্র প্রণয়ে

এখন সন্ধ্যা আসন্ন শীতকাল
ট্রেনবাতায়ন বরফকুচিতে ভরা
আমার দুঃখ জনে জনে গেছি বলতে
কেউ শোনে নাই ক্বাসিদা হৃদয়ক্ষরা

দ্যাখো জান্ আমি বেফানা তোমার প্রেমে
প্রেমিক হয় না মালিকের মতো লুম্পেন
পরে যেন তুমি দিও না আমারে দোষ
যখন তোমারে ফেলে চলে যাবে ট্রেন।

 

য়্যু’য়ার গ্যনা মেইক মি ল্যোনস্যম হোয়েন য়্যু গ্য
দেখেছি আমার প্রেম চলে যায় আমারই আঙিনা দিয়া
যাওয়া তার এত কাছ ঘেঁষে যেন স্পর্শিতে পারি হিয়া
আগে এত তারে ধীরগতি আর সহজিয়া দেখি নাই
প্রহর জুড়িয়া যামিনীর চুলে তারাঝরা দেখি চুপচাপ
ভিতরে আমার মাতমের রোল রহি রহি জাগে সন্তাপ
তোমার চলিয়া যাওয়ার দৃশ্যে ভ্যাবাচ্যাকা খায়া যাই।

ওই উঁচু দেশে মেঘের জাহাজ হাতির মতন চরে
বেপরোয়া আমি গলা ছেড়ে ডাকি প্রণয়ের গাঢ় স্বরে
তোমারেই প্রিয় অনুনয় করি ফিরায়ে দিও না প্রেমিকে
এতটা আঘাত প্রহারের পীড়া প্রাণে নাহি সহে আর
হয়েছ এবারে নিষ্ঠুর অধিক নজিরবিহীন নির্ভুল নিশানার
পরিত্যক্ত করিয়া যাইছ প্রেমে-ও-প্রণয়ে পর্যুদস্ত চির-অপরাধীটিকে।

রক্তবর্ণ গাত্র তোমার স্বচ্ছ এবং মুকুটবিহীনা রানী
মেহেদি-রঙিন কেশের আড়ে মুখের গড়ন ভোলায় ভুবনখানি
তুমি তা জানো না সখা হে নিঠুরা কান্নার নোনা দাহ
তোমারে ঘেরিয়া আকাশকুসুম গড়িয়াছি কত স্বর্গেরও কল্পনা
ভাবি নাই এত সয়ে যেতে হবে প্রেমের কারণে লাঞ্ছনাগঞ্জনা
যাবার বেলায় একটাবারের জন্যও যদি সকরুণ চোখে চাহ!

পাহাড়ের গায়ে টিলার মাথায় মাতাল-করা বাহারী ফুলের ঝাঁক
ঝিঁঝিদের সনে বনপোকাদের ঝগড়াফ্যাসাদে মিলনের সংরাগ
ঝিলিমিলি নীল ঝিলমের স্রোত অলস বাতাসে ঘুরে ঘুরে কথা কয়
চেয়েছি আমিও তোমার সঙ্গ অনন্তকাল বিপুলা সৌরজগতে
তোমারই সঙ্গে চেয়েছি বাঁধিতে পরান আমার সুখে-দুখে-সহবতে
বেয়াড়া সময় এসে যেত বাগে আমাদের প্রেমে হতো যদি পরিণয়।

ভাবি নাই হবে এমন করুণ বিষাদের পরিণতি
শুরু হতে-না-হতেই ঘনাবে সম্পর্কের যতি
যেমতি বিষাদজীবন যেপেছে কবি র‍্যাবোঁ আর সন্ত ভ্যালেন্টাইন
কিন্তু উনারা মহতি মহান আর আমি নিতান্ত নস্যি
নিতান্ত হই সাধারণ আর নহি দেবতা বা দস্যি
তুমি চলে যাও বলেই জীবন পথে ও বিপথে এতটাই পরাধীন।

তুমি চলে গেলে এমনিভাবেই দিন যাবে বয়ে এতলবেতল হাওয়ায়
কেটে যাবে দিন বছর গড়াবে তুমিহীনা আমৃত্যু
তুমি চলে গেলে এমনিভাবেই দিন যাবে এই ব্যর্থ কথকতায়
কেটে যাবে দিন আয়ুর সীমানা এসে যাবে শেষকৃত্য।

চলে যাও তুমি দৃষ্টির আড়াল যতদূর পারো যেতে
খুঁজিয়া ফিরিব তোমারেই আমি দিকে-ও-দিগন্তরে
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয় স্মৃতিপৃথিবীর ক্ষেতে
দেখিব তোমারে চকিত নয়নে অনন্ত অম্বরে
নেত্র প্রসারি তাকাব যখনই তৃণের তেপান্তরে
যতই আমারে ফেলে ফেলে যাও রহি তোমাতেই মেতে।

 

শি বিলোংস্ টু মি
তার যা-কিছু দরকার সব অপরিমেয়ই আছে
সে তো কলাকার কাজ নাই তার পিছু ফিরে দেখবার
আঁধার মুছায়ে ফেরায় সে দিন রাত্রির গাছে গাছে
দিনকে বানায় রাত্রিরঙিন কালো ও অন্ধকার।

তুমি হয়তো-বা দাঁড়িয়ে ভাবছ বোকা
যা-কিছু সে চায় এনে দেবে তার সামনে
যেই-না তাহার দুয়ারে দিয়াছ টোকা
হাঁটু ঠকঠক ভঙ্গ দিয়াছ রণে।

সে তো কখনোই হোঁচট খায় না কোথাও
উষ্টা খাওয়ার জায়গা তাহার নাই
নহে মাতা কারো কন্যা বা শ্যালিকাও
নাই তার কোনো সংবিধানেরও ধর্তাই।

কানে দোল তার মিশরীয় কানপাশা
জবান খোলার আগেই সে ঝলমল
সে এক মোহিনী চিরকুহকিনী আশা
তুমি বড়জোর প্রত্নসময় বৃথা মাকালের ফল।

সপ্তাহান্তে শুক্কুরবারে কোরো তারে কুর্নিশ
যথাকালে প্রতিবছর জানিও জন্মদিনের দোয়া
পূজাপার্বণে কিনে দিও তারে একটি পাখির শিস
ঈদে-বড়দিনে দিও হাতে তার সেতার এবং সিন্ধুর বারোয়াঁ।

 

মিস্টার ট্যাম্বুরিন্ ম্যান্
সাঁইজি তোমার খঞ্জনিটায় আনচান-করা আরেকটা গান গাও
ঘুম আসে না চক্ষে আমার কোথায় গিয়া কার কাছে পাই শান্তি
সাঁইজি তোমার খঞ্জনিটায় হৃদি-আনচান গানটা আবার গাও
সকালবেলায় আমিও তোমার সঙ্গ লইব ভুলে অনিদ্রাক্লান্তি

সন্ধেবেলার বালুচরে যেন বাঁধিয়াছি খেলাঘর
বিলীন হয়েছে বালুজলে মিশে, হাত থেকে ছুটে গিয়েছে তেপান্তর
পড়ে আছি একা আন্ধার মতো পরিত্যক্ত ঘুমহীন গোবেচারা
উদ্বেগরাশি ঘিরেছে আমারে দেবে-গেছে দ্যাখো দুই-পা মাটির সঙ্গে
কেউ নাই যার লগে দু-দণ্ড কথা ক’ব এই বঙ্গে
প্রাচীন প্রত্ন পথঘাটগুলো খোয়াব দেখিতে নাহি দ্যায় আশকারা

সাঁইজি তোমার খঞ্জনিটায় আনচান-করা আরেকটা গান গাও
ঘুম আসে না চক্ষে আমার কোথায় গিয়া কার কাছে পাই শান্তি
সাঁইজি তোমার খঞ্জনিটায় হৃদি-আনচান গানটা আবার গাও
সকালবেলায় আমিও তোমার সঙ্গ লইব ভুলে অনিদ্রাক্লান্তি

তুলে নাও সাঁই তোমার মায়ার জাদুনৌকায় আমারে ভুবনভ্রমণে
স্নায়ুতন্ত্রী বিবশ আমার, নাই ঠিকঠাক হাতের আঙুল সুস্থ সংবেদনে
গোঁসাই আমার পদাঙ্গুলি বিকট ফাটা মাটিবিদীর্ণ-চৈত্রের-মাঠ অক্ষম হণ্টনে
কেবল জুতোর গোড়ালি ভীষণ চাইছে বেরোবে দেশান্তরে
যেতে প্রস্তুত জাহান্নামেও, অথবা হারাব ব্যোমভোলাগিরি নীলে
মিশিয়া যাইব মুছিয়া যাইব নিজেরই পায়ের চিহ্নের মিছিলে
দরবেশনাচে ঘেরিয়া আমারে নেও গুরু তব বক্ষের পাঞ্জরে

সাঁইজি তোমার খঞ্জনিটায় আনচান-করা আরেকটা গান গাও
ঘুম আসে না চক্ষে আমার কোথায় গিয়া কার কাছে পাই শান্তি
সাঁইজি তোমার খঞ্জনিটায় হৃদি-আনচান গানটা আবার গাও
সকালবেলায় আমিও তোমার সঙ্গ লইব ভুলে অনিদ্রাক্লান্তি

দেখিছ দয়াল হাসিতে গাহিতে নাচিতে আমারে ফুলডোরে-বাঁধা ঝোলনায়
বেদিশে বেতাল ঘূর্ণিমুখর সূর্যের সংসারে
এমনও তো নয় শিল্পধন্য ললিতকলার লেবেল্ লাগানো তায়
একে বলা যায় দৌড়ের উপ্রে ফিরিয়া তাকানো ভবপগারের পারে
আকাশের ওপারে কেবলই আকাশ, নাই বেড়া কোনো সীমানার
নিচে থেকে ভেসে আসিছে কত-না তা-না-না-না লারেলাপ্পার
হেনকালে সাঁই মোহনীয় তব ধ্বনি, চিত্রিত আলখাল্লায় যেন সুরের সঞ্জীবনী
নিচে-থেকে-ভেসে-আসা তামাশায় বিলকুল নাই কান
তোমার গানেই পরিত্রাণ সাঁই তোমার গানেই প্রাণ

সাঁইজি তোমার খঞ্জনিটায় আনচান-করা আরেকটা গান গাও
ঘুম আসে না চক্ষে আমার কোথায় গিয়া কার কাছে পাই শান্তি
সাঁইজি তোমার খঞ্জনিটায় হৃদি-আনচান গানটা আবার গাও
সকালবেলায় আমিও তোমার সঙ্গ লইব ভুলে অনিদ্রাক্লান্তি

তারপর আমারে লুকাইয়া ফ্যালো ধোঁয়ায় আঁধার আমারই ভিতরদেশে
ফ্যালো লুকাইয়া কালের কুয়াশাবিবরে, যেন রই চিরকাল হিম পাতাটার বেশে
দ্যাখো ঝঞ্ঝাক্লিষ্ট ত্রস্ত গাছের দল, সৈকতে তারা কুঁজো ও ঝড়ো সংবিগ্ন চঞ্চল
দুঃখের উন্মত্ত দহনে একজনও নাই হৃদয়ের পাশে সমব্যথী সম্বল।
হ্যাঁ, আমি হীরার গগনতলে একপাক নেচে নিতে চাই হাওয়ায় হাতটা নেড়ে
বালিঝিল্কানো সমুদ্র সমুখে রেখে এইবার দেবো সবটুকু শরীরের ভার ছেড়ে
ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে যাবে যত স্মৃতির কচুরিপানার সঙ্গে নিয়তির নুড়িগুলো
দয়াল তোমার বাজনায় বেজে যেন ভুলে যাই দিবসের শত শৌর্যের খেলাধুলো।

সাঁইজি তোমার খঞ্জনিটায় আনচান-করা আরেকটা গান গাও
ঘুম আসে না চক্ষে আমার কোথায় গিয়া কার কাছে পাই শান্তি
সাঁইজি তোমার খঞ্জনিটায় হৃদি-আনচান গানটা আবার গাও
সকালবেলায় আমিও তোমার সঙ্গ লইব ভুলে অনিদ্রাক্লান্তি

 

ইফ নট ফর য়্যু
তুমি না থাকলে, সোনা, হাতড়ে যেতাম পাগলাদাশু দরোজা পেতাম না —
পায়ের তলায় মেঝেটা থাকত অন্ধবুদ্ধু চোখে দেখিতাম না
হইতাম আমি তোমার অভাবে আস্ত একটা রামগরুড়ের ছানা

তুমি না থাকলে, সোনা, সারারাত যেত উজাগর অপচয়ে
সকালবেলার আলোর জন্য অপেক্ষিতাম তীর্থবায়স হয়ে
আলোকের ওই বৃষ্টিধারায় নিতাম সারিয়া দিনসূচনার স্নান
তুমি না থাকলে সেকেলে জইফ বুঢঢার মতো রহিতাম বহমান

মাথায় ভেঙে পড়ত গোটা আকাশরাজ্য, গুচ্ছগাদায় মেঘেরা বাঁধাত হুজ্জোৎ
তোমার ভালোবাসাটা না পেলে রহিতাম আমি নিরস্তিত্ব কিম্ভুত
তুমি না থাকলে কবেই যেতাম হারায়ে আমি বিন্দুবৎ একরত্তি
কেউ না-জানুক তুমি ঠিক জানো কথাটা খাঁটি স্বর্ণের মতো সত্যি

তুমি না থাকলে সয়ে যেতে হতো উপর্যুপরি আকাশভাঙন মেঘেদের মাস্তানি
তোমার প্রেমের গরহাজিরায় এই লীলাধামে কেউ খুঁজত না আমার এহেন বেহুদা আননখানি
কোন গগনের তারা ফালাইতাম তুমি না থাকলে কার কাননে দিতাম গোবর-পানি?

তুমি না থাকলে শ্রেষ্ঠী শীতের শেষে থাকত না বাসন্তী নিশান
গাছপাখিরা গাইত না গান একাকার করে শিথান ও পৈথান
কোনো রহস্যেরই কিনারা আদৌ শত কুস্তিতেও সম্ভব হইত না
তুমি না থাকলে, তুমি না থাকলে, তুমি না থাকলে, সোনা!

 

ল্যভ মাইনাস্ জিরো / নো লিমিট
অবিকল তার বাচনভঙ্গি নীরবতারই মতো
নয় এতটুকু উঁচামার্গী বা হাল্কা অসংযত
পুনঃপুনঃ হতে হয় না তাহারে ঘোষণায় বিশ্বস্ত
অগ্নির মতো জলের মতো সত্যের-অধিক-সত্য-সত্তা সে আমার প্রেমিকা
মানুষেরা আনে গোলাপের তোড়া বয়ে
একের-পর-এক করে আর ভাঙে প্রতিজ্ঞা শয়ে শয়ে
আমার প্রেমিকা হাসে একমুঠো বসন্তপ্রত্যয়ে
ভ্যালেন্টাইন্-ডে বেনিয়ারা তার তৃণবিভাময় হৃদয়েতে কভু পায়নাকো প্রবেশিকা

মুদিখানায় আর মোড়ের মাথায় গাড়ির ইশটিশনে
হাল-জমানার হকিকত নিয়া কথা কয় লোকজনে
কেউ বই পড়ে কেউ চুটকি বা ডাহা উদ্ধৃতি ঝাড়ে
কেউ-বা আবার বিভেদ ভাঙার সম্প্রীতিশ্লোক আওড়ায়
কেউ কথা বলে যেন ভবিষ্যৎ এক্ষুণি ডিম পাড়ে
প্রেমিকা আমার চলনে যেমন বলনেও অতি স্নিগ্ধ
সফলতা নিয়া ভাবিতে সে সদা ত্যাক্ত ও সন্দিগ্ধ
কেননা জানে সে সফলেরা যায় কবরে ব্যর্থতায়

আলখাল্লার ফাঁক দিয়া দ্যাখো ছুরি-চাকু ঝলসায়
শ্রীমতীর হাতে একে-একে কত মোমবাতি আলো পায়
ঘোড়সওয়ারের স্নাতক অনুষ্ঠানে
কলের পুতুলও বক্তিমা দ্যায় তীব্র সসম্মানে
দিকে দিকে দ্যাখো শলাকার উঁচু চূড়
ভেঙে পড়ে একে অন্যের গায়ে হুড়মুড়
আমার প্রেমিকা হাসে এইসবে থোড়াই পরোয়া করে
সে জানে এগুলো সময়ের ধুলো সময়েই যাবে ঝরে

এদিকে সাঁকোটা গাঙের উপরে থরহরি কাঁপে রাত্রে
জুড়িগাড়ি হেঁকে বেরোলেন বাবু নদীকৃপা নিতে গাত্রে
ব্যাঙ্কক্যাশিয়ার পোলাডারে তার বানাবে বাপের ব্যাডা
কায়মনে চায় যেন পোলা পায় বেস্ট ব্যাঙ্কের ল্যাডার
বাতাস বহিছে চিৎকারি যেন রুদ্রচণ্ড রোষ
ঘনরাত্তিরে মেঘে-বিজলিতে ঘনাইছে প্রত্যুষ
একলা একটা শালিক যেনবা আমি যারে ভালোবাসি
জানালার পারে বসে থাকে ঠায় নিশ্চুপা বানভাসি।

 

ফ্রম অ্যা ব্যুয়িক সিক্স
এক শ্মশানকালীর কব্জায় আছি জীবন্মৃত, যদিও ওরই যত্নে বাড়ছে দ্যাখো সন্তানগুলো আমার
স্বর্গাদপী গরিয়সী মম জননী হে জেনে রেখো, ও-ই কিন্তু লুকায় আমার সমস্ত দোষভার
খণ্ডারনি ওই মহিলা আসলে সস্তা শাড়িতে বেহেশ্তি হুর হাত পুড়িয়ে রান্না করে তিনটেবেলার আহার
মরার কালে এই মহিলাই নিশ্চিত জানি বিছিয়ে দেবে সুবাসভরা সাফসুতরা চাদর বিছানার

বেড়িবাঁধ ভেঙে বানের পানি ঢুকলে ঘরে তলিয়ে যাবার জোগাড় যখন বালবাচ্চা সহ বাপ
বড়রাস্তায় একটাকিছু দুর্ঘটনা ঘটলে পরে যখন আমার অবস্থা হয় বেদিশার শেষ ধাপ
উন্মাদিনী ছুটে এসে ঈগলপাখায় ভরসা বয়ে একহাতে সুঁইসুতা বাগায়ে লাগায় সেলাইঠাপ
নিতান্ত যদি মরতেই বসি নিশ্চিত জানি জমজমজলে সে-ই কিন্তু ধুইয়ে দেবে আমার যত পাপ

সত্যি কথাটা আজকেই বলি, আসলে সে এক সর্বংসহা, আমার হাজার গালগঞ্জনা যায় চুপচাপ সয়ে
একটু এই-যা ল্যাংচিয়ে হাঁটে দেখতেও বদসুরত খুবই কিন্তু মোটেও জড়োসড়ো নয় হীনম্মন্য ভয়ে
এতই ভীষণ জল্লাদিনী অবিকল যেন দস্যুরানী দিবালোকেও সূর্য নেভে তার শীতল চোখের ফুঁয়ে
এবং আমার মরণবেলায় নিশ্চিত জেনো এই মহিলাই মাতম করবে সাচ্চা শোকে লুটিয়ে আঁচল ভূঁয়ে

অয়ি মাতাজি, তোমায় বলি, মৃত্যু-উপত্যকায় এখন মুদ্দোফরাশ হব আমি তাই বেলচা-কোদাল চাই
ফিরব যখন ঘরে আমার গায়ে গোরের গন্ধ ধুতে স্নানের আগে সম্মুখে চাই শিশু এবং সূর্যের রোশনাই
এই মহিলাই যোগায় সেসব এবং অন্য আর-যা-যা সব একবর্ণও বাড়িয়ে বলিনি ছাই
শেষনিঃশ্বাস ফেলব যখন পরম স্নেহে খাটিয়া সাজাবে বিদায় জানাবে মায়ামন্ত্রে এই শ্যেনচক্ষু পাষণ্ড মহিলাই

 

ইন মাই টাইম অফ ডাইয়িন্
মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে জাদুধন

মুর্দা আমারে ত্বরা করে নিয়া রাখবি গৃহের উঠোন
যথাসাধ্য সহিসালামতে বিদায় দিবি আমায়
এইটুকু শুধু ওসিয়ত আমার প্রিয়তম যত শত্রুমিত্রজন
অন্তিমকালে নির্দায়দাবি জানাবি শেষবিদায়
যিশু সহায় হবেন আমার, যিশু হবেন পথবন্ধু সুদীর্ঘ যাত্রার
সদাপ্রভু তার নিজহাতে দেবেন সাজায়েগুছায়ে কুঞ্জটা এই পাপিষ্ঠা বান্দার

আমায় দিদার দিও প্রভু, দরিশন দিও, শূন্য গগন পেরোনোর পথিমধ্যে
এই ডানাজোড়া যায় যদি ভেঙে বিকল হয়ে যুঝতে না-পেরে ঝড়ের সনে যুদ্ধে
তুমি কি আমারে ত্বরাবে না মালিক মমতাময়ী দূতী পরীর কুদরতি পাখা দিয়া?
এইটুকু শুধু ওসিয়ত আমার প্রিয়তম যত শত্রুমিত্রজন
অন্তিমকালে নির্দায়দাবি জানাবি শেষবিদায়
যিশু সহায় হবেন আমার, যিশু হবেন পথবন্ধু সুদীর্ঘ যাত্রার
সদাপ্রভু তার নিজহাতে দেবেন সাজায়েগুছায়ে কুঞ্জটা এই পাপিষ্ঠা বান্দার

প্রভু আমার, পরমপ্রিয়, মরণকালে কেউ যেন না কান্দে আমার দায়
আমি শুধু চাই সাততাড়াতাড়ি ভবপাড়ি দিয়া যাইতে ত্বরায় নিতাইগঞ্জগাঁয়
এইটুকু শুধু ওসিয়ত আমার প্রিয়তম যত শত্রুমিত্রজন
অন্তিমকালে নির্দায়দাবি জানাবি শেষবিদায়
যিশু সহায় হবেন আমার, যিশু হবেন পথবন্ধু সুদীর্ঘ যাত্রার
সদাপ্রভু তার নিজহাতে দেবেন সাজায়েগুছায়ে কুঞ্জটা এই পাপিষ্ঠা বান্দার

 

গ্যয়িং, গ্যয়িং, গ্যন্
পৌঁছেছি এসে এমন এক জায়গায়
যেখানে নষ্ট হয় না গাছের ঋজুতা
বার্ধক্যের আগেই বিদায় ভালো
অন্তিমে এই শীর্ষক সমঝোতা
আমি নিচ্ছি বিদায়
যাচ্ছি চলে
গেলাম।

রাখছি বইটা বন্ধ করে
যেখানে এবং যেই পৃষ্ঠাতেই ছিলাম
পরোয়া না-করি কী যে হয় এরপরে
ইস্তফা তাই এখানেই দিয়া দিলাম
আমি নিতেছি বিদায়
যাইছি ছেড়ে
গেলাম।

ছিলাম ঝুলন্ত যথা বাদুড়
খেলেছি সার্কাসে দড়িখেলা
খুলে ফেলি এক্ষুণি গিট্টুটা
তামাশায় গিয়েছে অনেক বেলা
তাই বেলাবেলি যাই
ফিরিয়া না চাই
বিদায়।

দাদিমা বলত, “মনের কথাটা মাথা পেতে নিবি ভাই
দৌড়ের শেষে দেখবি তুই কামিয়াব
চকচকি দিয়া হয় না সোনার হিসাব
তোর প্রেম তোরই চিরনির্ভর হারাবার কিছু নাই।”

ইতিউতি হুদা পায়চারি করে রাস্তায়
জীবন কেটেছে কত-না খাজুল খাস্তায়
ওই নিমপাখি দ্যায় শিস
এসে গেছি জানালার কার্নিশ
আমি আসি তাহলে
চলি তাহলে
গেলাম।


পোস্টস্ক্রিপ্ট : দুই কিস্তিতে এই তর্জমাকাজটা প্রকাশের পরে একটা কাণ্ড ঘটেছিল। চুরিকাণ্ড। সংঘবদ্ধ চুরিচামারির খবর আমরা কাগজে পড়ি, কিন্তু বরাতের উপর ভরসা রেখে সংঘবদ্ধ চোরদের খপ্পর এড়িয়ে একটু সুস্থস্বাভাবিক বাঁচতে চায় সবাই। সিন্ডিকেইটেড চোরছ্যাঁচড়ে দেশ ছেয়ে যেতেছে, এমন খবর শোনা যায় হামেশা চারপাশে। এককান দিয়া আমরা শুনি এবং আর-কান দিয়া বাইর করে দেই। কিন্তু অনলাইন লেখালেখির এই জমানায় এত সহজ ও সবার কাছে গ্রাহ্য হয়ে গেছে লেখাচুরি, বিষয়টা আলাপে এনে একটু চোরনিবারণী ম্যাকানিজম গড়ে তোলা যায় কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার।

যা-হোক, ২০১৭ সনের শেষদিকে সেই বাটপারচক্রের খপ্পরে পড়ে এই নিবন্ধকার ও অনুবাদকের কেমন অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা নিয়া আরেকটু নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানে থেকে একটাকিছু রচনা করবার চেষ্টা জারি আছে আমার দিক থেকে। এইখানে কেবল ওই বিরক্তিকর চোরসংঘের টালবাহানাকালে একটা বক্তব্য ফেসবুকে রেখেছিলাম কাউকে ট্যাগ না করে, স্রেফ নিজের দিক থেকে ক্ল্যারিটি বজায় রাখতে, এবং এর বাইরে তামিশকিরদের কারো কোনো কমেন্টে একটা সাউন্ডও করি নাই। জিনিশটা এই লেখার লগে অ্যাটাচড রাখছি। নিশ্চয় এইটা পাঠকের জন্য জরুরি কিছু নয়, কিন্তু অনুবাদকের ব্যক্তিগত নথি হিশেবে এই তর্জমাগোছার সঙ্গে এর সংযুক্তি ইতিহাস হিশেবে সেঁটে থাকুক। এইটা বাংলাদেশের লেখালেখিলিপ্ত লোকগুলার পুঁজিপাট্টার কমজোরিতার ইতিহাস যেমন, তেমনি নির্লজ্জ লুণ্ঠনপ্রবণ সংঘসৌহার্দ্যেরও।

মোট তিনটা সংযোজনী নিচে পরপর রাখছি : পরিশিষ্ট ১, পরিশিষ্ট ২ এবং পরিশিষ্ট ৩ সূচক দিয়ে। পয়লাটায় আছে ফেসবুকে দেয়া আমার বক্তব্যটা, পরেরটায় চোরের চুরিকাণ্ডের নমুনা এবং সবশেষে পরস্পরগোত্রের গাবরগিরির সংক্ষিপ্ততম নমুনা।

পরিশিষ্ট ১ :
লেখাচুরি বিষয়ে এই নোটটুকু আপনার নজরে এলে একবার চেয়ে দেখে নিয়ে চুপটি করে সরে যায়েন। ফ্যাসাদে জড়ায়েন না। আমার মামলা আমারেই চিরদিন চালিয়ে নিতে দেন। কাউকে মেনশন করছি না সেজন্যেই। কিন্তু যদি লেখালেখি করেন আপনি, শুধু সতর্ক থাইকেন। এইটা আমার নাগরিক দায় থেকে জানাচ্ছি, আপনি কমফোর্ট জোনে থাইকেন। আমিও তা-ই থাকি চিরদিন। হে অনলাইনযুগের অসহায় লেখক, এইটা আপনার মামলা না।

আচ্ছা। জানাই যে, আমার কিবোর্ডে (এবং আমারই উর্বর মস্তিষ্ক দিয়া) বাংলা করা বব ডিলানের দুইটা গান বিতস্তা ঘোষাল নামের এক ‘অনুবাদক’ উনার ‘বব ডিলানের কবিতা’ শীর্ষক দুই কিস্তিতে ছাপানো ‘পরস্পর’ অনলাইন পত্রিকায় থাউজ্যান্ড টাইমস্ আপনজ্ঞানে এবং আনমনে (কেন বলছি আনমনে, ব্যাপারটা ভাঙব একটু পরের প্যারায়) গ্রহণ করে ফেলেছেন। ঘটনার পাক্কা মাসখানেকের মাথায় ব্যাপারটা আমার গোচরীভূত হয়েছে। এবং ঘটনাটা আমার নজরে এনেছেন ‘গানপার’ সাইটের অন্যতম চালক ও দ্বিতীয় দশকের কবি আলফ্রেড আমিন। গত ৯ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে এইটা আমি জানতে পারি এবং অকুস্থল পরিদর্শন করে স্রেফ দুইজন মানুষকেই ফোনে জানাই তাদের স্ট্যান্ড স্পষ্ট করার জন্য। ঘটনার সঙ্গে যে-দুইটা সাইট সংশ্লিষ্ট তাদের মধ্যে আমার লেখাজোড়ার প্রকাশক ‘রাশপ্রিন্ট’ সঞ্চালক আহমদ সায়েম; আরেকজনের নাম আগেই বলেছি, তিনি গানপারের চালকদের একজন, যাদের পত্রিকায় ‘পরস্পর’-আশ্রিত বিতস্তা ঘোষালের লেখা ছাপা হওয়ার অনেক আগে সৈয়দ শামসুল হক কর্তৃক ২০০৩ সনে অনূদিত বব ডিলানের একটা গান রিপ্রিন্ট করা হয় এবং যেই জিনিশটা বিতস্তা ঘোষাল তিরানব্বই শতাংশ আপনজ্ঞানে এবং সাত শতাংশ আনমনে গ্রহণ করে ফেলেছেন। খবর এইটুকুই। খবরের সত্যতা যাচাইয়ের স্বার্থে এর প্রথম সংবাদদাতা আলফ্রেড আমিনের ফেসবুকনিউজলিঙ্ক এখানে রেখে যেতেছি : https://www.facebook.com/alfred.amen

কিন্তু আমি ডিটার্মাইন্ড ছিলাম ব্যাপারটায় ইন্টার্ভিন করব না। আমি ভেবেছিলাম আমাকে এমন কান্নাকাটি করে ইন্টার্ভিন করার দরকারই হবে না। কারণ, আমার লেখাগুলো যেখানে ছাপানো, ‘রাশপ্রিন্ট’ সাইটে, সেখানকার সঞ্চালক মহোদয় নিশ্চয় আমার লেখা তার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে ২০১৬ সনের সেপ্টেম্বরে, এই বিবৃতিটা আহমদ সায়েম অন্তত পাব্লিকলি দিবেন এবং সেইসঙ্গে একজন সঞ্চালক হিশেবে তার সাইটের সমস্ত লেখকের কন্টেন্ট সুরক্ষায় একটা আশু পদক্ষেপ নেবেন, উনি সেদিকে যান নাই। ঠিক একইভাবে বিতস্তা ঘোষালের ‘অনুবাদ’-সম্বলিত ‘পরস্পর’-কর্ণধার সোহেল হাসান গালিব মহোদয়ও খুব দ্রুত ব্যাপারটা ব্লান্ডার হয়ে গেছে বুঝতে পারবেন এবং অহেতু ঘোলা না-করে রেহাই দিবেন আমার লেখাজোড়াকে; সেইটা প্রায় হয়ে যেয়েও হলো না। আমিনের দেয়া আমার ফেসবুকনোটদ্বয়ের স্ক্রিনশট ইত্যাদির ভিত্তিতে ‘পরস্পর’ থেকে অভিযুক্ত ‘অনুবাদক’ বিতস্তার কিস্তিদ্বয় সাইলেন্টলি ‘সরিয়ে রাখা’-র পরেও (চুরিটার পক্ষে তাদের দীর্ঘ ও সম্মিলিত সমর্থন বিষয়ে ‘বক্তব্য’ দেয়া হবে ঘোষণা দিয়েও কোনো বক্তব্য না দিয়ে লেখাচোর বিতস্তা ঘোষালের লেখাটা সাইট থেকে চুপিসারে নামিয়ে ফেলা হয়) সোহেল হাসান গালিবের সর্বশেষ বক্তব্য (“লেখাদুটি বাদ দেয়া হয় নাই। সরিয়ে রাখা হয়েছে পাঠকদের কাছ থেকে। বিষয়টা নিয়ে আমাদেরও একটু বিচার করে দেখা দরকার। যেহেতু প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে আপনার অভিযোগ সংগত মনে হয়েছে, সেহেতু লেখাদুটো মুলতুবি করা গেল। পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটাকে ডিলিট করা বা পাবলিক করা যাবে।”) স্পষ্টত বলছে যে ত্যানা প্যাঁচানো হতে পারে আরও। হুমকিই প্রায়, বা অ্যারোগ্যান্স, “বিচার করে … পাবলিক করা যাবে” ইত্যাদি কথাবার্তা আমার লেখাজোড়ারে সসম্মান মুক্তি দিচ্ছে না সহসা তা বুঝতে পারছি, কিন্তু এই অ্যারোগ্যান্স হজম করতে আমি সক্ষম, কারণ আমার কাজ চুরি করা বা চোরের প্রশ্রয়দাতা হওয়া নয়, আমার কাজ অন্য; অতএব বোঝা যাচ্ছে যে বিচারাচার চলছে আমার অবলা লেখাজোড়া নিয়া। তা চলুক। বক্তব্য আসুক বিচারকের বেঞ্চ থেকে। চোর বিতস্তার “তবে যেহেতু অরিজিনালটা এক সেহেতু মিল হতে পারে” জয়যুক্ত হোক। দুই/আড়াই বছর আগপিছের ব্যাবধান নিয়া আলাপ তোলা আমার জন্য পরাজয়ের চেয়েও হতবুদ্ধিকর। দুইবছর বা দুইদিনের ব্যাবধানের মামলা না এইটা। গালিব যদি গিভেন এভিডেন্সেসের ভিত্তিতে এতটা কালক্ষেপণ করেন উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, একদম হাতেনাতে ধৃতকেও যদি গ্রেইস্ দিতে চান, সেক্ষেত্রে এই বিবদমান লেখাদুটো গঙ্গাতেই বিসর্জন দেয়া আমার তরফে জান-বাঁচোয়া। ত্যানার প্যাঁচপয়জার নিয়া টাইম কিল্ করার অ্যাফোর্ডিবিলিটি আমার কোনোকালেই ছিল না, আজও নাই, আগামীকাল হবে বলিয়াও ভরসা অল্প।

অতএব, তলব করা না-হলেও বিচার যেহেতু চলছে লেখাজোড়ার এবং মনগড়া সেই লেখাজোড়া আমিই লিখেছিলাম, সেহেতু, ফরিয়াদ করছি না কারো কাছে বা কাউকে আমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনুনয়ও করছি না, আমি শুধু মনে করছি যে একটু বক্তব্য কোথাও থাকুক আমারও যে এই লেখাজোড়া আমি শখের বশে একদিন লিখেছিলাম বছর-আড়াই আগে এবং লিখে-যে-ছিলাম সেই সত্যটা আজকে আমাকেই আবার গলা ফাটিয়ে লোক হাসিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠার মরিয়া চেষ্টা চালাতে হচ্ছে। এখন, করার কিছুই তো নাই, বিচার চলছে। সেজন্য নয়, বিচার আমার দরকার অতটা নাই, কিংবা আব্দার নাই কোনো বক্তব্যের, কেননা আমি বিচারিক প্রক্রিয়াটাকে হা হয়ে দেখছি এবং জিন্দেগিভর আউট-ল্য হয়ে থাকার ধান্দাই করছি, কিন্তু ‘পরস্পর’ সাইটের কোনো অবদায়কেরই যেন ‘রাশপ্রিন্ট’ সাইটের এই নিরস্তিত্ব অনুবাদকের মতো করুণ দশা না-হয়, যেন সাইটের সঞ্চালক তার লেখকের লেখাটা বুক দিয়া আগলায় ‘পরস্পর’ সাইট যেভাবে একটা চুরিসিদ্ধ ‘অনুবাদক’-কে আদাজল খেয়ে সামলাচ্ছে, সেইভাবে, জনসমক্ষে এই দোয়াটা আমি করে যেতে এসেছি। ‘পরস্পর’ যা করছে, লেখকের ফেস-সেইভিং যে-এফোর্ট, এইটা সাইটের সাবালকত্বই প্রমাণ করে; যে-কাজে যে পেশাদার সেই কাজই সে করবে, সেজন্যে আমি তাদেরে ‘সাধুবাদ’ জানায়ে যাব শত ক্ষতি সত্ত্বেও। এই জিনিশটাই রাশপ্রিন্ট করতে পারে নাই। কিন্তু রাশপ্রিন্ট যদি ‘পরস্পর’-ক্যালিবারের হতো, তবে এইসব প্রমাণাদি পরস্পরের সঙ্গে শেয়ার করে দুই সাইট-সঞ্চালকের মধ্যস্থতায় অভিযুক্ত ‘অনুবাদকের’ লেখা নামিয়ে একটা ডিসক্লেইমার জনস্বার্থে দিয়ে দিলেই পারত নমিত পক্ষটি। বিচক্ষণতার পরিচয় এখানে গালিবই দেখায়েছেন প্রাথমিকভাবে, ত্যানার বহর-গতর বাড়ছে যদিও, ‘অবশেষে অরিন্দম’ আহমদ সায়েমের দেয়া ‘সাধুবাদ’ আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে এতই আমোদের হয়েছে যে এই তিনদিনের ট্রমা কাটিয়ে ফের ঝলমলিয়ে উঠেছি। গীতাঞ্জলি লিখতে বসেছি দ্যাখো। নোবেল নির্ঘাৎ।

ধরে নিয়েছিলাম, এইখানে আমার কিছু করার নাই, যা করার তা দুই সাইট মিলেই করবে, যেহেতু মুখে যা দাবি করব আমি তা তো দুইবছর আগে থেকেই বিরাজিছে! শেষমেশ ইন্টার্ভিন করতে হচ্ছে। ব্যক্তিগত-দুনিয়ায় একজোড়া আত্মজন হারানো এবং অনলাইনদুনিয়ায় একজোড়া বালকোচিত অনুবাদ প্রায়-হারাতে-বসার ট্রমা কাটায়ে এইখানে আমি আমার কারো-মুখ-ম্লান-না-করা আওয়াজটুকু চুপিসারে রেখে যাই। কিন্তু ভব্যতা আমাকে বলছে যে এইখানে অ্যাট-লিস্ট বিতস্তা-গালিব-মাজুলচক্রকে মেনশন করা দরকার; কিন্তু আমি নাচার, এদের কারো সঙ্গেই আমার সংশ্রব নাই।

আনমনা ট্র্যান্সল্যাশন কেন বলছিলাম বিতস্তা ঘোষালের কাণ্ডটাকে? আচ্ছা, তার আগে বলি যে আমার ফেসবুকনোটে ডিলান আপ্লোড শুরু করি ১৩ জুলাই ২০১৫ থেকে, ‘ববি ডি ইন বেঙ্গলি’ (পয়লা আপ্লোডের লিঙ্ক : https://www.facebook.com/notes/zahed-ahmed/ববি-ডি-ইন-বেঙ্গলি/1052765454733646/ )  শিরোনামে এবং সেই বছরেরই ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একটানে ৩৩টা আপ্লোড করে সে-যাত্রা থামি (৩৩ সংখ্যক অনুবাদের লিঙ্ক : https://www.facebook.com/notes/zahed-ahmed/ববি-ডি-ইন-বেঙ্গলি-৩৩/1080626095280915/ ) … পরে ফের ২০১৬ সনে এসে মে থেকে (https://www.facebook.com/notes/zahed-ahmed/ববি-ডি-ইন-বেঙ্গলি-৩৪/1220303257979864/ ) একটানা ৩৮টা আপ্লোড করে নোবেলপ্রাপ্তি ইত্যাদি হিড়িকে ববিবঙ্গানুবাদ পাইকারি হারে বেড়ে গেলে পিছু হটি এবং তারপর আহমদ সায়েম ‘রাশপ্রিন্ট’ পত্রিকায় দুই পার্টে ‘বব ডিলান কুড়িটা গান’ শীর্ষক যথাক্রমে ১ এবং ২ আপ করেন। যদিও সায়েম নিজেই সেই লেখাগুলো বেমালুম ভুলে বসে আছেন, ‘পরস্পর’ থেকে এই অভিযুক্ত রচনা তাকে ট্যাগ করা হয়েছে এবং তিনি তাতে লাইক দিয়ে অ্যাক্নোলেজও করেছেন, বুঝতেই পারেন নাই এখানে তার সাইটের কন্টেন্ট হুবহু কপি-পেস্ট করে মেরে দেয়া হয়েছে, এবং দেখা গেল বিতস্তা ঘোষাল দুই সাইট-সঞ্চালকেরই মিউচুয়্যাল মিতা, আহমদ সায়েম তার সাইটের কোন সুড়ঙ্গে এই নাদান ববভক্তের লেখাগুলো গুঁজে রেখেছেন খুঁজিয়া পাচ্ছেন না। আমার কি হবে গো?

অনেক ত্যানা প্যাঁচানোর দরকার নাই। সিম্পল জিনিশ কয়েকটা একটু ধরায়ে দেই। আমার যে-লেখাজোড়া বিতস্তা ঘোষাল আপনজ্ঞানে আনমনে নিজের নামে ‘পরস্পর’-প্রশ্রয়ে গত একমাস ধরে বিশ্বজুড়ে প্রচার করে ফেলেছেন, পরে বিতস্তা বক্তব্য দিচ্ছেন তিনি ‘অরিজিনাল’ দেখে ‘অনুবাদ’ করেছেন কাজেই বিতস্তার দাবি “তবে যেহেতু অরিজিনালটা এক সেহেতু মিল হতে পারে”, এবং ‘পরস্পর’ থেকেও ‘অরিজিনাল’ মিলিয়ে দেখাদেখির হামবড়াই অলরেডি করা হয়েছে (আলফ্রেড আমিনের পোস্টের লিঙ্ক থেকে কমেন্টগুলো দ্রষ্টব্য), এইখানে আমি একবার অরিজিনালটা দেখাই এবং দেখি যে বিতস্তার অরিজিনালজাত অনুবাদের দাবি নিয়া ‘পরস্পর’ কোনো সল্যুশনে যেতে পারে কি না। আর, পরস্পর এতদিন কোন অরিজিনালটা দেখল সেইটাও বোঝা যাবে। আমি কারো ইংরেজিলিটারেসি দিয়া খাটো করতে চাই না কাউরে, এবং ভান ও মিথ্যাচারের কালচার/অধিকার বাংলাদেশে আছে দেখতেই পাই।

প্রথমে ‘ব্লু মুন’ ‘অরিজিনাল’ :

Blue Moon
Blue moon, you saw me standing alone
Without a dream in my heart, without a love of my own.

Blue moon, you knew just what I was there for
You heard me saying a prayet for someone I really could care for.

And suddenly there appeared before me the only one my arms could ever hold
I heard someone whisper, “Please, adore me”
And when I looked my moon had turned to gold.

Blue moon, now I’m no longer alone
Without a dream in my heart, without a love of my own
Without a love of my own.

এখন ‘ব্লু মুন’ অনুসরণে আমার ভার্শন :

ব্লু মুন
দাঁড়িয়ে ছিলাম চাঁদের নিচে একলাটি অগাধ
নিঃসঙ্গ নিঃস্বপ্ন নিষ্প্রেম নিরপরাধ

তুমি জানো চাঁদ ওইখানে যেয়ে একলাটি কেন শূন্য
করেছি বিধুর বেদনার গান মায়ামানুষের জন্য

সহসা সেখানে আগমন সেই তীর্থসৌম্য সরলার
শুনি গলা তার ফিসফিসাইছে আমারই নিকটে ব্যাকুলা আদর মেগে
চেয়ে দেখি নীল ব্যথাতুরা চাঁদ স্বতঃস্ফূর্ত সোনার!

শোনো চাঁদ দ্যাখো একলাটি নই আর
ঘুচেছে দণ্ড স্বপ্নশূন্য সঙ্গবিরলতার
নিকটে এসেছে এ-ই তো প্রকৃত সারস ভালোবাসার

উপরের ইংরেজিটা যদি ‘অরিজিনাল’ হয়, তাহলে আমার বাংলাটা আপনি কীভাবে মেলাবেন? ঝড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটারে মেলানোর কায়দায় আমারে স্রেফ শুইয়ে দেয়া ছাড়া তো উপায় নাই আর। তা, দেন শুইয়ে। কিন্তু ইংরেজিটার মান দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কীভাবে বাড়ানো যায় সেইটা অ্যাট-লিস্ট ভাবেন। দেখেন মিলিয়ে, ‘নিঃসঙ্গ নিঃস্বপ্ন নিষ্প্রেম নিরপরাধ’ বা ‘মায়ামানুষ’ বা ‘প্রকৃত সারস’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ইংরেজিতে কোথায়? আমার বাংলাটা কাজেই ইংরেজি এই টেক্সটের সঙ্গে মেলানোর মুরদটা সাইটওয়ালাদের থাকলে রেহাই পেতাম আমি পারস্পরিকতার খপ্পর থেকে অনেক আগেই। বিতস্তা যদি এই ইংরেজি ‘অরিজিনাল’ ফলো করিয়া থাকেন, তবে এই বাংলাটা কোত্থেকে এল? পরস্পর এইসব ডিটেক্ট করতে পারলে ‘বিচার করে দেখা দরকার’ হতো না, আর হলেও তৎক্ষণাৎ একক্লিকেই হয়ে যেতে পারত।

মনে রাখুন, ‘পরস্পর’ অরিজিনাল মিলিয়ে দেখে ফেলেছেন অলরেডি। কিন্তু অরিজিনাল মিলানোর ব্যাপারটা আসলে যে কী ভাওতা, আরেকটু সহ্য করলে দেখাতে পারি। দ্বিতীয় উদাহরণটা আগে সামনে নিয়া রাখি :

I’ll Be Your Baby Tonight
Close your eyes, close your door
You don’t have to worry any more
I’ll be your baby tonight.

Shut the light, shut the shade
You don’t have to be afraid
I’ll be your baby tonight.

Well, that mockingbird’s gonna sail away
We’re gonna forget it
That big, fat moon is gonna shine like a spoon
But we’re gonna let it
You won’t regret it.

Kick your shoes off, do not fear
Bring that bottle over here
I’ll be your baby tonight.

‘অরিজিনাল’ দেখুন দ্বিতীয়টার। দেখলেন তো, উপরে? এবার আমার-করা বাংলাটা :

আই’ল্ বি য়্যুর বেইবি টুনাইট
ছিটকিনি দাও, বুঁজে ফ্যালো চোখদুটো
ভয়ডর ফেলে ফুলের নিয়মে ফোটো
অদ্য রজনী আমিই তোমার প্রেমিক

আলোটা নেভাও, সঙ্গে অন্ধকারটাও
দুর্ভাবনাটা আমারে ভাবতে দাও
অদ্য রজনী আমিই তোমার প্রেমিক

গাঙশালিখটা পাল তুলে উড়ে যায়
যেতে দাও, যেতে দাও
হুৎকো মোটকা চাঁদটা যেন-বা চামচ চকমকায়
দেখি না চাঁদের চটকটাও
পস্তাবে শেষে, রাতটুকু বুঝে নাও

ছুঁড়ে ফ্যালো চটিজামা, ফালতু ভাবনা রাখো
মদের বোতল ছিপি খুলে এসো ঘনঘোর বসে থাকো
অদ্য রজনী নির্ভাবনায় আমিই তোমার প্রেমিক

দেখেছেন? আচ্ছা, তাহলে নিশ্চয় ‘ছিটকিনি’ বা ‘ফুলের নিয়মে ফোটো’ বা ‘গাঙশালিখ’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি ইংরেজিতে পেয়েছেন? উত্তর যদি না-বোধক হয়, আপনাদের বিতস্তা লইয়া আমরা কি করিব? আমার ইন্টেনশন্যাল বাংলা যদি আরেকজনের ‘অরিজিনাল’-মানা বাংলা হয়ে যায় আড়াই-বছর বাদে এসে, এই নিয়া সালিশিতে আমি নাই। কিংবা এই কথাটাও বলতে আমার ক্লান্ত লাগছে যে একজনের লেখার চাল আরেকজনের লেখায় অবিকল পাবার পরেও শব্দ মিলাইতে বসে যে-পাঠক, তারপর ‘বিচার’ করে, তার বাংলা পড়াটাও চুপচাপ উপেক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকে না। আমি অন্তত প্রমাণ পাই নাই এই বিতণ্ডায় কেউ ‘অরিজিনাল’ পড়েছেন। মিলিয়ে দেখা তো বহু পরের ব্যাপার, বহু স্কিলের ব্যাপার। তবুও মিলনকাণ্ড হজম করতে হলো আমারে।

এইবার একটা কথা বলি, বুঝতে পারবেন আমাদের পড়াশোনার বড়াই কী বিপজ্জনক! আমার ‘ব্লু মুন’ বিতস্তা ‘পরস্পর’ সাইটে ছেপেছেন ‘নীল চাঁদ’ নামে এবং ‘বব ডিলানের কবিতা’ বলেছেন তিনি সেইটাকে। পরস্পর সেইটা রীতিমতো ‘সম্পাদকীয় বিবেচনা’ সাঙ্গ করে ছেপেছে এবং গত ৯ ডিসেম্বর থেকে এই তিনচারদিন সেইটা নিয়া গলদঘর্ম হচ্ছে তবু কমন যে-এররটা তারা ফার্স্ট কমেন্টেই বলে নিতে পারত যদি ইংরেজি গান শোনার সামান্য অভিজ্ঞতাটা তাদের থাকত। ‘ব্লু মুন’ বব ডিলানের কবিতা নয়। এই জিনিশ বিতস্তা জানতেন যদি ‘অরিজিনাল’ দেখার/শোনার কোনো অভিজ্ঞতা থাকত তার। এইটা বব ডিলানের কবিতা নয়। কিন্তু কয়েকজন এসে এই জিনিশের সঙ্গে ‘অরিজিনাল’ দেখার ইঙ্গিতও প্রকাশ্যে দিয়ে ফেলেছেন, অথচ জানেন না যে এইটা লিখেছেন অন্য দুই স্যংরাইটার Richard Rodgers ও Lorenz Hart এবং ববি নিজের জীবনে একটা গোটা অ্যালবামই করেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রার গাওয়া গান নিয়ে এবং এইটা আদতে ববিরও ‘অরিজিনাল’ গান নয়। এইটা ববির গানও নয়, এইটা সিনাত্রার গান; ববি কাভার করেছেন এবং স্টুডিয়োরেকর্ডেড সেইটা। আমি ‘অরিজিনাল’ শুনে লিখি, ‘অরিজিনাল’ দেখার মতো ধৈর্য দিয়া আল্লা আমারে বানান নাই যে এইটুকু ‘অরিজিনাল’ তথ্য বের করতে তিনদিন লাগিয়ে বসে থাকব। তবে আমি কেন বব ডিলানের গান বলেছি আজ থেকে আড়াই বছর আগের এই কুকর্মে? এইটা গান, তাই; কবিতা নয়। আমি হামেশা গানেরই বাংলা বানাই। কিন্তু ‘অনুবাদের’ টাইম আমার নাই। আনমনা বিতস্তা আমারে তারই ন্যায় আলাভোলা জ্ঞান করে একটা ফ্যাঁকড়াতেই ফেলেছেন সবাইরে, এত তলঠাপ খেয়াল করেন নাই।

অরিজিনালের ভাওতাবাজিটা আরেকটু বলি। গানপারে সৈয়দ হকের অনুবাদটার চুরি-যাওয়াটাকে পরস্পর মোটামুটি বৈধতা দান করে ফেলেছে। দানের হস্ত বিতস্তার কোলে। এবং “ইংরেজি থেকে আনুবাদ অনেকখানিই মিলেছে বটে”  রায় দিয়া মরহুম হকেরে খেয়ে ফেলা হয়েছে, এবং তার আগে ‘ছন্দ’ পরীক্ষা হয়ে গেছে এবং ‘অন্ত্যমিল’ ‘ইউনিক’ কি না তাও, সোহেল হাসান গালিব এসে এই বিচারকের সরলমনা কারবারটাকে একটা সামাল দিতে চেয়েছেন, সৈয়দ হক নাই হয়ে গেছেন কাজেই। কিন্তু একটাবারও কেউ বলতে পারল না এই লিরিকের আসল নামটা। জানলে কিন্তু ওই নায়্যিভ কবিতাবিচারের উদ্ভট চেষ্টাটা বাচ্চারাও করত না। আপনারা ভাবেন একবার, যে-লিরিকের ‘অরিজিন্যাল’ নাম ‘মোটরসাইকো নাইটমেয়ার’ এবং সৈয়দ হক যেইটাকে ‘অনুবাদ’ করেছেন ‘পথিকের দুঃস্বপ্ন অথবা জাহানারার স্বপ্ন অথবা ফিদেল কাস্ত্রোর স্বপ্ন’, বলুন দেখি, ইংরেজি মিলনের মুরদ মিনিমাম যদি থাকত, তবে এরপর কোনো মানুষ মিলনে আগাতে পারত? ছন্দের চাল ধরতে না জেনে যদি কেউ শব্দ আর অন্ত্যমিল ধরে কবিতা দেখার সবক নিয়ে বেড়ে ওঠে, সে-ই কেবল এমন আহাম্মকিটা করতে পারে। এখন আমি দিচ্ছি ইংরেজিতে এই লিরিকের নামটা, পরস্পরের জন্য নয়, জীবনেও ‘অরিজিনাল’-না-দেখা বিতস্তার জন্য : ‘Motorpsycho Nightmare’ ডিলানের এই লিরিকের নাম। তবুও কি সৈয়দ হকের বাংলাটা বিদিতা চুরি করে নিজের নামে ছেপেছেন বলবেন না আপনি, প্রিয়? কিন্তু পরস্পর ‘রাম দা’, ‘বন্দুক’ ইত্যাদি বের করে “এই যে ফারাক এটা বিরাট ফারাক” (দ্র. আলফ্রেড আমিনের ফেবুলিঙ্কে এসে পরস্পরবেরাদরদের কমেন্ট) রায় দিয়া ফাঁসি দিয়া ফালাইসে বেচারা সৈয়দ বংশের নিঃস্ব পোলাডারে। এ কী পোলাপানের কারবারে ফালাইলায় আমারে তুমি মাবুদ?

বাদ দ্যান এইগুলা। বিচার চলছে। চলুক। হিশশশ!

বিতস্তা নয়, এইখানে আমার বিস্ময় ইংরেজি শিক্ষার ভয়াবহ জাতীয় বিপর্যয় দেখে। এবং একদমই গান না-শুনে এইভাবে গানপণ্ডিতি আমরা যদি চালাইতে থাকি, আমাদের বাচ্চাকাচ্চারা তো গানশোনাও ছেড়ে দেবে, যেমন ছেড়েছে কবিতা।

আমার এই বিবৃতি যদি কারো নজরে পড়ে, ব্যাপারটার অসার বোকাবোকা মাজাকটা নিজজ্ঞানে জেনে নেবেন। নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে। আমার লেখার কোনো পাত্রমিত্রসভাসদ লাগবে না। আমি সারাজীবন ইংরেজি গানের মনগড়া বাংলা করে যেতেই থাকব। পরস্পরও তাদের মিশন অব্যাহত রাখবে এতে আশ্চর্যের কিছু নাই। কিন্তু যদি কেউ কথা বলেন এইসব নিয়া, নিজের সম্মানে বলবেন। নিজের রুহের সম্মানে। আমাকে হিরো বানায়েন না। আমার ঢোল আপনি পিটায়েন না। আমার সময় কমে এসেছে, এদিকে কাম তো মরে নাই।

(দ্র. সিনাত্রার গান শুধু নয়, এমন আরও জনা-পনেরো ঘটনা আমি ঘটিয়েছি যেখানে অরিজিনাল নয় ভার্শনের জয়গাথা প্রচার করেছি। কাজেই, কবিতাওয়ালারা নিজেদের মিলনকাণ্ড চালাইতে থাকেন। আর হ্যাঁ, এইখানে বিতস্তা ঘোষালের অপকর্মগুলো হাজির করি নাই, আমারগুলো পড়তে দিয়েছি, এতে কেউ মুচকি হাসবেন না। আপনার সঙ্গে বিতস্তাদের দেখা হয়েই যাবে অচিরে। এবং যেটুকু চাতুরি বিতস্তা চুরিকালে করেছেন অন্ত্যমিল ইত্যাদিতে, সেগুলোর ভিত্তিতে যারা আতশ কাচ হাতে নিয়া গবেষণায় বসে এবং রায় দ্যায় যে ‘অনেক মিল’ ‘অল্প মিল’, এদের কাজকর্ম মূলত কোন তরিকার, আপনি জানতে চাইলে নিজের দায়িত্বে জেনে নেন। আমি কমনসেন্স নিয়া জন্মেছি বলিয়া আর-বেশি জানোয়ারি জিন্দেগিতে দরকার হয় নাই। এবং পুনশ্চ, যদি মেহেরবনানি করে এই ইংরেজিগানশৌখিন মানুষগুলোকে আলোচ্য গানদুইটার এবং সৈয়দেরটার অনুবাদ করে দেন কেউ, মনে হয় দেশ ও জাতি হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে। আমারে দিয়া যা হয় তা আমি দেখায়ে ফেলেসি, আপনি সেইটা না-দেখলে সেইটা আপনার ব্যাপার; অনুবাদ আমি অরিজিনাল দেখে দেখে করি না, এই কথাটা আমার বাংলা বস্তুগুলো দেখা মাত্রই ইংরেজিগানের বনেদি পিচ্চিরাও বোঝে। ধুর! কারে কি বলি! ভাল্লাগে না। যাই। থ্যাঙ্কয়্যু জানাই।)

পরিশিষ্ট ২ :
‘পরস্পর’ নামের সেই সাইটে প্রকাশিত বিতস্তা ঘোষাল কর্তৃক চুরিকৃত ও পরস্পরমদতপুষ্ট চৌর্যকর্মগুচ্ছ থেকে একজোড়া মাল এইখানে রেখে দিচ্ছি :

নীল চাঁদ
দাঁড়িয়ে ছিলাম চাঁদের নিচে একলাটি অগাধ
নিঃসঙ্গ নিঃস্বপ্ন নিষ্প্রেম নিরপরাধ
তুমি জানো চাঁদ ওইখানে গিয়ে একলাটি কেন শূন্য
করেছি বিধুর বেদনার গান মায়ামানুষের জন্য
সহসা সেখানে আগমন সেই তীর্থসৌম্য সরলার
শুনি তার ফিসফিসানি, আমারই নিকটে ব্যাকুলা আদর মেগে
চেয়ে দেখি নীল ব্যথাতুরা চাঁদ স্বতঃস্ফূর্ত সোনার!
শোনো চাঁদ দেখো একলাটি নই আর
ঘুচেছে দণ্ড স্বপ্নশূন্য সঙ্গ বিরলতার
নিকটে এসেছে এ-ই তো প্রকৃত সারস ভালোবাসার।

আজ রাতে আমি তোমার
ছিটকিনি দাও, বুঁজে ফেলো চোখদুটো
ভয়ডর ফেলে ফুলের নিয়মে ফোটো
আজ রাতে আমিই তোমার প্রেমিক
আলোটা নেভাও, সঙ্গে অন্ধকারও
দুর্ভাবনাটা আমাকেই ভাবতে দাও
আজ রাতে আমিই তোমার প্রেমিক
গাঙশালিখটা পাল তুলে উড়ে যায়
যেতে দাও, যেতে দাও
হুৎকো মোটকা চাঁদটা যেন-বা রুপোর চামচ ঝলসায়
দেখি না চাঁদের চটকটাও
পস্তাবে শেষে, রাতটুকু বুঝে নাও
ছুঁড়ে ফেলো চটিজামা, ফালতু ভাবনা রাখো
মদের বোতল ছিপি খুলে এসো, ঘনঘোর বসে থাকো
আজ নির্ভাবনায় আমিই তোমার প্রেমিক

পরিশিষ্ট ৩ :
চোর বিতস্তার একেক সময় একেক কথা বলার ভজকট থেকে একটামাত্র ধুনফুনের নজির এইখানে রাখা হলো প্রথম উদ্ধৃতি অংশে। এখানে যে ব্লগের কথা চোরের মুখে শোনা যাচ্ছে, যেটি সে চেনে না বলে জানাচ্ছে, এইটা রাশপ্রিন্ট। অনুসন্ধানে দেখা যায় বিতস্তার ফেসবুকটাইমলাইনে রেগ্যুলার রাশপ্রিন্টের পোস্টগুলা ট্যাগ করা আছে।

“আমি নিজেই কনফিউজড। কারন এই ভদ্রলোকের করা অনুবাদ কোথায় বেরিয়েছে আমার জানা নেই। প্রথম যে অনুবাদের অংশ টা সেটা আমি এভাবেই মেলাবার চেষ্টা করেছি। আর এই অনুবাদগুলি 2017-এর অনুবাদ পত্রিকায় জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত। কাজেই কারোর থেকে কপি করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে যেহেতু অরিজিনাল টা এক সেহেতু মিল হতে পারে। … দীর্ঘদিন অনুবাদের সাথে যুক্ত থাকায় এটা বলতে পারি অনুবাদ কপি করার চিন্তা বা সম়য় কোনোটাই আমার নেই। আর এই ব্লগ বিষয়ে আমি কিছু জানিও না।”

দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটা গালিবের, পরস্পরকর্ণধার, ফাইজলামি আর মকারিভরা কমেন্টগুলা থেকে এর সবচেয়ে কম ফাইজলামির নজিরটাই নিচে রেখে দিচ্ছি।

“আলফ্রেড, লেখাদুটি বাদ দেয়া হয় নাই। সরিয়ে রাখা হয়েছে পাঠকদের কাছ থেকে। বিষয়টা নিয়ে আমাদেরও একটু বিচার করে দেখা দরকার। যেহেতু প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে আপনার অভিযোগ সংগত মনে হয়েছে, সেহেতু লেখাদুটো মুলতুবি করা গেল। পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটাকে ডিলিট করা বা পাবলিক করা যাবে।”

এইবার মাজুল হাসান নামে একজনের আশ্চর্য বোকাহাবামি। এ-ও পরস্পরযুক্ত। অন্ত্যমিল নয়, চাল দিয়াই যে একটা কবিতার লগে আরেকটা কবিতার বা ছন্দোবদ্ধ কোনোকিছুর সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য বিচার করতে হয়, এইটা জানার কথা না এর পক্ষে। এর অনেক কমেন্টের ভিড় থেকে একটা রাখছি, হাবাগোবামো বোঝার জন্য।

“সৈয়দ হকের সাথে বিতস্তার করা অনুবাদ হুবহু মেলে না। অন্তত প্রথম যে লিংকটা দিয়েছেন তার সাথে। একটু দেখি দুই অংশের শেষ বাক্যটিতে। ‘হাতে তার রাম দা’ আর ‘হাতে তার বন্দুক ও দা!’ সৈয়দ হকে বন্দুক নাই, বিতস্তায় বন্দুকও আছে। সেটি ডিলানের যে সহজ কথার লিরিক তার কারণেও হতে পারে, আর দুটো্ কাছাকাছি অনুবাদই হওয়ার কথা। নিচে বিতস্তার অনুবাদটুকু দিলাম। হক লিখছেন – ‘চলেই চলেছি’; বিতস্তা : ‘হেঁটেই চলেছি’। তবে এটা স্বীকার করতেই হয় মিলে গেছে অন্তমিলগুলো। আমি : থামি, খামারবাড়ি : নাড়ি। এই মিল কী খুব ইউনিক, এটা তো হতেও পারে।”

অ্যানিওয়ে। এরই মধ্যে সৈয়দ হক প্রয়াত। পরস্পর  কর্তৃক ফাইজলামি চালানোর কালে হক অবশ্য জীবিতই ছিলেন। এইখানে হকের লিরিকটা অ্যাড করা হয় নাই, ইন্ট্রেস্টেড যে-কেউ গানপার ম্যাগাজিনে অনুসন্ধান বাটনে সৈয়দ হকের নাম লিখে খোঁজ চালাইলেই পাবেন। আমার এবং হকের অনূদিত ববের লিরিকগুলা আদৌ মূল লিরিকের সরাসরি শব্দবদল যে নয়, এইটা রাইতকানায়ও বুঝতে পারে। একেকটি লিরিকের প্রত্যেকটা বাক্য/পঙক্তি ধরে ধরে যে-কেউ বুঝবেন যে এইগুলা এতই আইডেন্টিক্যাল, খুবই ইন্টেন্ডেড অব্জেক্টিভ ছাড়া আর-কারো অবিকল এই এক্সপ্রেশন্স আসা না-মুমকিন। শব্দান্তর হলে সেইটা সম্ভব ছিল। ‘প্রকৃত সারস’ ইত্যাদি বিনয়ব্যবহৃত কয়েনগুলা বব ডিলানের গানে আকারে-ইঙ্গিতেও নাই। কিন্তু ধরা হয়েছে এসবের মধ্য দিয়া ভাবসূত্র শুধু। চোর ও চোরের সহচরদের অল্পস্বল্প ইংরেজি গান শোনার অভ্যাস থাকলে এই জিনিশ তারা করতে যেত না। তারপরও আমি ভাবি যে একটা দেশের সার্বিক সারস্বত সমাজের মান কোথায় যেয়ে নেমেছে, এইসব চুরিচামারি আর ছ্যাবলামি দিয়া তা ঠাহর করা যায়।

  • এই লেখার সঙ্গে ব্যবহারের জন্য সংগৃহীত ফোটোগ্রাফ অবলম্বনে ব্যানার বানিয়ে দিয়েছেন গ্র্যাফিক-আর্টিস্ট উসমান গনি

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you