চলে যাও সব সুরের সারথী

চলে যাও সব সুরের সারথী

সিলেটের পুরানা মাধ্যমিক স্কুলগুলার মধ্যে একটি দি এইডেড হাইস্কুল। গত বছর, ২০১৮ খ্রিস্টাব্দ, স্কুলের শতবর্ষ অতিক্রান্ত হলো। শতবার্ষিক অনুষ্ঠান উদযাপনের কোনো আওয়াজ পাওয়া যায় নাই যদিও। তোড়জোড় চলছে কি না তা আপাতত বোঝা যাচ্ছে না। খালি ইয়াদ হয় এলাহি ইভেন্ট হয়েছিল পঁচাত্তর পারানোর সময়। এক্স্যাক্ট বছরটা আজ কনফার্ম বলতে পারছি না, আইডিয়া করছি নিরানব্বই বা দুইহাজার সনের দিককার ঘটনা হবে। সেই পঁচাত্তর পূর্তির তিনব্যাপী ইভেন্টমালার লাস্ট দিনে এসেছিলেন সুবীর নন্দী। বিশেষ কারণে এই স্মৃতিটা আজও অনেকের সঙ্গে শেয়ার করি বিভিন্ন আড্ডায়। শিল্পীর প্রয়াণ হবার পরে সেই স্মৃতিটা আরও জ্বলজ্বল করছে যেন।

কয়েক হাজারের লোকসমাবেশ হয়েছিল সুবীর নন্দীর গান শোনার জন্য। ওই দিন আরেকজন গ্রেইট ছিলেন একই মঞ্চে, গেয়েছিলেন লোকপ্রশংসিত কয়েকটা গান তিনিও সুবীর নন্দী স্টেজে আরোহণের আগে, সেই শিল্পীও সকলের প্রিয় এবং সৈয়দ আব্দুল হাদী নামেই তিনি বাংলার প্রত্যন্ত সর্বত্র পরিচিত। লোকসমাবেশ কত হয়েছিল যদি জিগ্যেশ করা হয়, তাইলে বলব দশ থেকে বারো হাজার তো অবশ্যই। তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না বলতে যা বোঝায়, সেদিন স্কুলকম্পাউন্ডে সমবেত জনতা দেখে ফ্রেইজটা মাথায় এসেছিল। সন্ধ্যার পর থেকে এত লোক জড়ো হয়েছিল যে স্টেজের কাছাকাছি কিছুতেই যাওয়া যাচ্ছিল না পাহাড়প্রতিম অনড় ভিড় ঠেলে।

ম্যাজিক দেখেছিলাম সুবীর নন্দী মঞ্চে ওঠার পরে। ম্যাজিক অবশ্য দেখেছি হাদীর গাইবার সময়ও। তবে হাদীর গানগুলা যেহেতু লোকের মুখস্থ গঞ্জেগাঁয়ে, প্লেব্যাকে ফোকলতায়িত সৈয়দ হাদীর গান ও গলা আর তার গায়নভঙ্গির তারিফ দেহাতি লোকেরাও করে দেখেছি সবসময়, ম্যাজিক এমনিতেই ক্রিয়েট হয় হাদীর গানগুলা সাধা গলায় যে-কেউ ধরলেই। কিন্তু সুবীর নন্দীর ক্ষেত্রে এমন কথা বলা যাবে না যে যে-কেউ গাইলেই ক্ল্যাপ্স মিলবে। যেইটারে লোকে ক্ল্যাসিক্যাল বেইস্ বলে, প্লেব্যাকে বা বাংলার বুলিতে যেইটাকে বলে লঘুসংগীত বা আধুনিক গানও বলেন অনেকে, সেইখানে এই জিনিশের রেফ্রেন্সেস ব্যাপকভাবেই ছিল সুবীর নন্দীর গানে। এবং আশ্চর্য শোনালেও সত্যি যে একদম গ্রামজনপদের লোকেও সুবীর নন্দীর টা রেন্ডিশন পছন্দ করত। সেদিনের সেই সন্ধ্যায় মাঠভরতি লোকের ভিড়ে নন্দীর ক্ল্যাসিক্যালের ছোঁয়া লাগানো গলার দাপট ও শ্রোতামধ্যে এর প্রভাব দেখেছিলাম।

ওই সময়টায় ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ নামে হুমায়ূন আহমেদের ম্যুভিটা মাত্র মুক্তি পেয়েছে। প্রেক্ষাগৃহে যেয়ে লোকে দেখছে দলে দলে। ব্যাপক জনপ্রিয় হয় বারী সিদ্দিকী এবং সুবীর নন্দীর প্লেব্যাকে এই সিনেমায় আসা গানগুলা। সেই সন্ধ্যায় মাঠভর্তি হাজার-দশেক লোকের সামনে নন্দী গেয়েছিলেন ‘এক যে ছিল সোনার কইন্যা মেঘবরন কেশ / ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কইন্যার দেশ’, ‘ও আমার উড়াল পঙ্খি রে / যা যা উড়াল দিয়া যা’ ছাড়াও তার অলটাইম হিট ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয় / তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’ ইত্যাদি ছয়-সাতটা। মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল দেখার মতো। মনে এখনও রয়ে গেছে সেই দৃশ্য-শব্দাবলি। কিছুটা আকার দিতে চেষ্টা করছি নিবন্ধের এই পরিসরে সুবীর নন্দীর গানের অভিঘাতে সমবেত শ্রোতার মধ্যে কেমন তৎপরতা আর জেশ্চার লক্ষ করেছিলাম সেইদিন।

সমবেতদের মধ্যে পুরানা ছাত্ররা ছাড়াও শহরের নানান পেশার মানুষজন ছিল। ওয়ার্কশপের মেকানিক, মুদিদোকানি, কাপড়ের গদির কর্মচারি ও মালিক, কম্পিউটার গ্র্যাফিক্সের দোকানদার, প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসায়ী ইত্যাদি বিচিত্র বয়স ও কামকাজের মানুষ তারা। ক্যাসেট কিনে গান শোনাশুনির আমলের গল্প এইটা। আমি এইখানে হাজিরানে-মজলিশের অনেকেরেই চিনতাম। খুব-যে গানমাতোয়ালা ছিলেন সবাই তা তো নয়। রিকশাওয়ালা আর শহরফ্যুটপাথের তরকারিবিক্রেতা ফলবিক্রেতাদের কথা তো বলাই হলো না। তারা ছিলেন উল্লেখযোগ্য অংশের ভিড় দখল করে। হাদীর গানের সঙ্গে তারা আনন্দ করেছেন সশব্দ উল্লাসধ্বনি দিয়া। আর নন্দীর বেলায়? এইবার সেইটাই বলছি।

নন্দী তার স্টুডিয়োরেকর্ডেড গানগুলা লাইভে গাইবার সময় যেই তিলিসমাতি দেখিয়েছেন, এই জিনিশ ভুলবার নয়। চেনা গানগুলার একেকটা লাইন গলার সরগম আর তানকারি দিয়া প্রায় ইনফিনিটি পর্যন্ত খেলা করছিলেন প্রত্যেকটাবার, আর আশ্চর্য যে মানুষ সেইটা লুফে নিচ্ছিল বুক চাপড়ে! এমনকি ভীষণ আবেগে চূড়ায় উঠে যেয়ে শ্রোতাদর্শক তার প্রিয় শিল্পীটিকে আশ্চর্য আদরের আঞ্চলিক গালি দিচ্ছিল যে, একেকবার একেকটা গালি শুনে হচ্ছিল এর চেয়ে বেশি সম্মানের ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রিসিয়েশন আর কিছু হতেই পারে না। উদাহরণ মনে করা যাক। খুবই প্রিয় লিরিকের গানটাকে নন্দী যখন দশমিনিট ধরে টেনে যাচ্ছিলেন শুধুই তার গলাকারুকাজে ভাসিয়ে, শ্রোতার তখন ধৈর্যচ্যুতি ঘটবার কথা। সাধারণ শ্রোতা ক্ল্যাসিক্যালের অত সমুজদারি করবার কথা না। কিন্তু ভুল ভেঙেছিল সেদিন। পাশের গোবেচারা মানুষটাও সুবীর নন্দীর সুরবিহার দেখে বুক চাপড়ে মাথা-মুচড়ে বলছিল, উফ, হালার হালায় এমন ‘টান’ দিসে রে ভাই, মারিলাইবার অবস্থা! ইয়াল্লা! মানুষের গলায় এমন জোর আর দুঃখশান্তি!

সেদিন বুঝেছিলাম যে আমরা খামাখাই জনরুচি অবনমনের ধুয়া তুলি। জনরুচি অবনমিত হয় নাই অন্তত সংগীত সমুজদারিতায়। মানুষ নামাজের সময় এবং পূজা-আহ্নিকের সময় কীর্তন ও কোরানের সুরায়-আয়াতে যেমন লম্বা ক্ল্যাসিক্যালের টান পাইলে উজ্জীবিত হয়, গানেও তেমনি। ঠিকঠাক জায়গায় লাগসই প্রযুক্ত হলে ক্ল্যাসিক্যালের তারিফ সাধারণ মানুষ করতে পারে সবচেয়ে শ্রেয় উপায়ে। এরচেয়ে বড় তারিফ আর হতেই পারে না কিছু। সুবীর নন্দী সেই তারিফ পেয়েছিলেন জীবনে, পেয়ে গেছেন তার ক্যারিয়ারের গোড়া থেকে চূড়া অব্দি।

লেখা : মিল্টন মৃধা

… …  

Latest posts by মিল্টন মৃধা (see all)

COMMENTS

error: