সুনামগঞ্জ নগরের পত্তনের পর প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাসে এ-রকম ভয়াবহ বন্যার কোনো রেকর্ড সম্ভবত আর নেই।
দুকূল ছাপিয়ে প্রমত্তা সুরমা পুরো শহরে জেঁকে বসেছে। প্রতিটি রাস্তায় গাড়িঘোড়ার বদলে ছোটোবড়ো নৌকা, ইঞ্জিনচালিত নৌকা আর স্পিডবোট চলছে।
চারদিকে অথৈ জল, কিন্তু পানীয় জলের ভয়াবহ সঙ্কটে আছি। প্রথম দু-দিন ছাদে রেইন ওয়াটার হার্বেস্টিং কৌশল কাজে লাগিয়েছি। গতকাল কেটেছে বৃষ্টিবিহীন।
প্রচণ্ড স্রোত ঠেলে বরফ-শীতল পানি ভেঙে খুঁজতে খুঁজতে একটি ডুবে-যাওয়া দোকান পেলাম। সেখানে প্রচণ্ড ধাক্কাধাক্কির মুখোমুখি হতে হলো। অবশেষে পাঁচ লিটারের চারটি পানির ক্যান সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। কিন্তু এই পানি দিয়ে আর কতক্ষণ চলবে!
মোমবাতি উধাও। পরের দিন খবর পেলাম জগন্নাথবাড়ির কাছে মোমবাতি পাওয়া যাচ্ছে। তিন-চার গুণ দামে চার প্যাকেট মোমবাতি সংগ্রহ করি। অবস্থা এমন যে, ১ টাকার জিনিস ১০০ টাকায়ও পাওয়া যায় না।
বিদ্যুৎ কবে আসবে তার ঠিক নেই। নেটওয়ার্ক চলে যাওয়ার পর ফোন সুইচড অফ করে রাখায় এখনও কিছু চার্জ আছে। চার্জলাইট, টর্চ আর ফোনের চার্জ কোনোমতে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।
নির্ঘুম রাত কাটছে। চুরি-ডাকাতির হিড়িক পড়েছে। দু-দিন আগে রাত তিনটার দিকে একটা চোরের নৌকাকে আমরা কয়েকজন প্রতিবেশী মিলে ছাদ থেকে ঢিল দিয়ে দিয়ে তাড়িয়েছি।
আমার কেন যেন প্রথম থেকেই এবারের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক মনে হচ্ছিল। তাই কিছু কিছু প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। আমাদের বাসায় ২০০৪ সালের বন্যায়ও পানি ওঠেনি। তখন আমরা একতলা বাসায় থাকতাম। মেজদা বাসাটিকে দোতলা করেছে। আমাদের পুরনো বাসাটি আমি পুনর্নির্মাণ করেছি, তখন ২০০৪ সালের ফ্লাডলেভেল মাথায় রেখেই ভিট উঁচু করেছিলাম। কিন্তু এবার সব হিসেবনিকেশ ব্যর্থ হয়ে গেল।
বৃহস্পতিবার রাতে বিরামহীন বজ্রবৃষ্টি চলছে, আর আমি পানির গতিবিধি লক্ষ রাখছি। শেষরাতে বাসায় হু হু করে পানি ঢুকতে শুরু করল। নিমিষেই ঘরের ভিতর প্রায় একহাঁটু জল। জিনিসপত্র নষ্ট হয় হোক, তখন আমার মাথায় কেবল আমার দুই মামণির চিন্তা। বর্ণালীও সাঁতার জানে না।
ভোর হওয়ার প্রতীক্ষা করতে থাকি। ঘড়ির কাঁটাগুলো যেন অলস হয়ে গেছে।
একপর্যায়ে ঘড়ি দেখে বোঝা গেল ভোর হয়েছে, কিন্তু তখনও অন্ধকারে ঢেকে আছে চারপাশ। আকাশে মেঘের ভীতিকর তর্জনগর্জন আর মুষলধারে বৃষ্টি। প্রকৃতির এমন রুদ্রমূর্তি আগে দেখিনি।
একটু ফাঁক পেতেই ছোটো মেয়েকে পিঠে চড়ালাম, আর বড়োজনের হাত ধরে নেমে পড়লাম। পাশেই দোতলা। সবাই ভাড়াটিয়া। একটা ফ্ল্যাট খালি আছে। বড়োজোর ত্রিশ কদম, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এই পথ অন্তহীন। বড়োমেয়ে ভিতরে ভিতরে ভয় পেলেও সে যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছে। ছোটোজন ভয়ে আমার পিঠে যেন মিশে যেতে চাইছে।
মামণিদের পার করার পর কী যে শান্তি পেলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এরপর নিয়ে এলাম তাদের মাকে।
আমাদের সীমাহীন অত্যাচারের কিঞ্চিৎ জবাব দিল আদি-অকৃত্রিম প্রকৃতি। প্রকৃতির শক্তির কাছে আমরা কতটা তুচ্ছ আর অসহায়!
ফোনের চার্জ প্রায় খতম। তাড়াহুড়ো করায় লেখাটি এলোমেলো হয়ে গেছে। আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন অনেকেই আমাদের খবরাখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অনেকেই আমাদের জন্য উদ্বিগ্ন। সবাইকে ধন্যবাদ। এখন আমরা অনেকটাই নিরাপদে আছি।
- ছত্তার পাগলার সন্ধানে আহমেদ স্বপন মাহমুদ ও সরোজ মোস্তফা - January 28, 2025
- সপ্তপদীর দুপুরবেলায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় || ইলিয়াস কমল - January 27, 2025
- স্বরচিত কবিতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণা || হাসান শাহরিয়ার - January 24, 2025
COMMENTS