অসম্মতির প্রতিবেদন || সরোজ মোস্তফা

অসম্মতির প্রতিবেদন || সরোজ মোস্তফা

ইতিহাসের দায়িত্ব বহন করে কবি কাজী নাসির মামুন লিখেছেন, ‘রোহিঙ্গা পুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই’। সময়ের উত্তাপ না লিখে কবি কী কলম নামিয়ে রাখবেন! জ্ঞান-বৈদগ্ধ্যের হাতমোজায় কবি কী অনুভূতির সত্য-পঙক্তিকে সরিয়ে রাখবেন! বাস্তবের কালো অক্ষর না লিখে কবি কী শুধু ঘ্রাণমুহূর্তের গন্ধরাজই লিখবেন! সময়ের পরিসরে কবি তাই প্রতিবাদের কবিতা লিখেছেন। কবিতাগুলোর গতিময় ছায়াপথে রিফিউজি ক্যাম্পের বর্ণনা, ক্ষুধা, বালিশ না পাওয়ার অস্থিরতা আর ভূমিতে ফেরার আর্তনাদ।

কবি একজন দুর্বিনীত ফুল। পরমতের সাথে সহাবস্থানের পরেও কবির একটা নিজস্ব চক্ষু থাকে। কবির সে-চক্ষুটাই লেখে। সত্যস্থাপনের নিমগ্নতায় পরিচিত-অপরিচিত সংকটের শেকড়ে কবির সে-চক্ষুটাই প্রবেশ করে। রোহিঙ্গাপুস্তক মূলত সময় ও মানবিক পৃথিবীর ইতিহাস। এখানে “টিয়ার ঠোঁটের মতো লাল কিয়ামত / কাটা হাত; কর্তিত মাথার নিচে / টুকরো পায়ের নীল ভ্যাবাচেকা”। এখানে জীবন মানে পায়ের হিসাব! উদ্বাস্তুশিবিরে জীবন মানে রেশনকার্ডের হিসাবনিকাশ! কবর না পাওয়া স্বজনের হিসাব দিতে দিতে এরা দাতাসংস্থার সাদা মনিবদের গল্প শোনায়। এদের প্রত্যেকের পরিবারে দুইটা ছেলে। সে-ছেলেদের একটার কোমরে লাল ইয়াবা অন্যটার কোমরে থ্রি-নট-থ্রি। কাঠের নৌকায় এরাই একদিন চিনা জাহাজকে গ্রেফতার করবে।

কাব্যগ্রন্থটায় ৩৮ পৃষ্ঠার একটা লম্বা কবিতা লিখেছেন কবি কাজী নাসির মামুন। এর কাব্যভাষায় মিশেছে নাফনদীর কালার। কবিতায় যিনি মিলিটারির বুটের শব্দ লেখেন, তিনি মাছের চোখের পথ-বিপথের গল্প লেখেন না। পুরো কবিতায় রক্তিম শয়তানের দৃশ্যপাত। কালেমা শরিফ গাইতে গাইতে এখানকার মা ও ছেলেরা পিতা ও স্বামীকে সমুদ্রে ভাসায়।

পৃথিবীটা গোল ব্যভিচার
অঝোর বৃষ্টির মতো
গুলির শৃঙ্গারে বেঁচে আছে

ভিএস নাইপল লেখক সম্পর্কে বলেছেন, “লেখক যদি বসে বসে কেবল শোষণ আর নিপীড়নের কথাই বলেন তবে তাদের পক্ষে বেশি কিছু লেখা হয়ে ওঠে না। লেখকদের উচিত অসম্মতিকে প্ররোচিত করা”। রোহিঙ্গাপুস্তকের পুরোটায় সে-অসম্মতিই স্পষ্ট। শাশ্বত কবিতার পঙক্তিতেই কবি সাজিয়েছেন এই অসম্মতি। কবিতা এখানে দেয়াললিখন কিংবা পোস্টারপেপার কিংবা ডিজিটাল ব্যানার হয়ে ঝুলে থাকেনি। একেকটি পঙক্তি পাঠকের মর্মে একটা ঝাঁকুনি দেয়। কবি বলেন, —

সারাদিন ত্রাণের নিয়ম মেনে / কেবল দাঁড়িয়ে থাকে ক্ষুধা … চল্লিশটি গরুর সরল বিনিময়; তবু টাকা নেই। দু’মুঠো ভাতের / নিরাময় কেড়ে নিয়ে / মানুষ ঠকায় / নিজেদের উদরে বাড়ে বিষণ্ন ক্ষুধার ভলিউম / অসংখ্য তারার আলো / আকাশে খাদ্যের / বিরহ ছড়ায়। … জগৎ মোহিত প্রাচুর্যের সাদা দুধ / জীবন এখানে কালো সর।

সান্ত্বনারুমালটা পকেটে রেখে কবি দ্রোহের কলম খুলেছেন। একজন লেখক বরাবরই নিঃসঙ্গ, কিন্তু সক্রিয় কবির চিত্তবোধ। প্রতিটা পঙক্তিতে সঞ্চারিত হয় সময়ের আহ্বান। অক্ষরে অক্ষরে কবি আসলে মর্মরিতদের ডাকাডাকি করেন। মাটির ফাল্গুনে দাঁড়াবার এই আহ্বানটা কবি ছাড়া কেউ রাখতে পারেন না।

কবিতার শিহরণে প্রবেশ করলে কেউ আর মরণবেদিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। মানবনিধনের পৃথিবীতে ৩৮ পৃষ্ঠার এই লম্বা কবিতাটি একটি দীর্ঘ প্রতিবাদ। কবিতা কোনো পোস্টারপেপার নয়; কবিতা অন্তরের আগুন। কবিতা ভূমিপুত্রের রক্তিম-পলাশ। রোহিঙ্গাপুস্তকে তাই আত্মহত্যা লেখা থাকে না । রোহিঙ্গারা আত্মহত্যা করে না। ভূমিপুত্ররা আত্মহত্যা করতে জানে না। ভূমিপুত্ররা অতীত রক্ষা করে। ভূমিপুত্ররা পিতৃপুরুষের চোখ পুনরায় ভূমিতেই বিছিয়ে দেয়। বাস্তবতার পৃথিবী লিখতে লিখতে নাসির মামুন মূলত হাড্ডি-জর্জরিত লড়াইয়ের ইতিহাস লিখেছেন। জ্ঞানে-অজ্ঞানে কবিতায় আমরা যে-ইতিহাস লিখি নাসির মামুন সে-ইতিহাস স্পষ্ট করে লিখেছেন। ক্ষুধার্ত ও ভূমিবিতাড়িত মানুষের ইতিহাস না লিখলে কবির কলমকেও জবাবদিহি করতে হয়। কবি কাজী নাসির মামুন সময়ের সে-জবাবদিহি থেকে বেঁচে গেলেন।

অধিকৃত মাটির আগুন
বসন্ত আনে না কোনোদিন।
কখনো বোতলবন্দী জলের কোটরে
সাঁতারের ইতিহাস নেই।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you