গানপার থেকে বেশ কিছুদিন ধরে একটা ট্রাই করতেসিলাম রিসেন্ট স্পোর্টস্ ট্রেন্ড নিয়া, আরও স্পষ্ট করে বললে অনলাইন/অফলাইন মোবাইল/ভিডিয়ো গেইম নিয়া, আলাপ সঞ্চালন করা যায় কি না। আমাদের জিজ্ঞাসাটা ‘পাবজি’ নিয়া আবর্তিত হলেও অন্যান্য গেইমপ্রোডাক্ট নিয়া সেই আলাপে একটা দাঁড়াদিশা পাওয়া যাবে এমনটা আন্দাজ করে নিসলাম। অবদায়ক খুঁজতে যেয়ে দেখা গেল অনলাইন গেইমে একেবারে অ্যাডিক্টেড অ্যাডাল্ট যারা, তাদের কেউই লিখতে অ্যাগ্রি করতেসেন না। কারণ হিশেবে তারা তথ্য-উপাত্তকেন্দ্রী রিসোর্সের অভাবটাকে হাইলাইট করতেসিলেন। এদিকে গানপারের নিয়মিত অবদায়ক ও সঞ্চালকদের কেউই বিন্দুবিসর্গও জানেন না ‘পাবজি’ কিংবা আরও সমস্ত গেইম-ম্যাটেরিয়্যাল বা গেইমিং প্যাটার্ন সম্বন্ধে। এই জিনিশটা, মানে গেইম ইত্যাদি নিয়া, কারে দিয়া লেখানো যায় ভাবতে যায়া আমাদের অবস্থা প্রায় গলদঘর্ম। অনলাইন-অফলাইন কোনো গেইম নিয়াই ইন্ট্রেস্ট নাই এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার, সেইটা পার্ফর্ম করার দিক থেকে সত্য; তবে খেলা নিয়া আর্টিকল লিখবার অভ্যাস আমাদের লেখালেখিলিপ্ত কবিসাহিত্যিকদের মধ্যে নাই-ই বলতে গেলে। খেলাধুলার মতো ‘খেলো’ জিনিশ নিয়া লিখলে, গণবিনোদনের বিচিত্র নোক্তা ধরে লেখায় লিপ্ত হলে, লেখকদের সাহিত্যদার্শনিক অহং হার্ট হয় বোধহয়। অ্যানিওয়ে। খেলা নিয়া জানাজানির আগ্রহ সবার মধ্যেই কমবেশ লভ্য। বলা ভালো, পড়বার আগ্রহ। গেইমিং এবং গেইমার নিয়া আমরা জানতে চাই। প্রিন্টমিডিয়ায় বাজারে-আসা নয়ানতুন ভিডিয়ো/মোবাইল গেইম অপারেইট করবার ট্রিক্স/টেকটিক্স নিয়া ফিচার ছাপা হতে দেখি, কিন্তু এর কন্সিক্যুয়েন্স ও কুফল-সুফল নিয়া আলাপ হতে সেভাবে দেখি না। যা বা যেটুকু মুদ্রিত খবরকাগজে দেখি নিউজ ট্রিটমেন্টে, সেসব কতটা খাস খবর আর কতটা গুজব/রিউমার তা নির্ণয় করা মুশকিল হয়া যায়। অ্যাডিকশন/আসক্তি ও অবসেশন/ঘোরগ্রস্ততা নিয়া গার্জেনদের পোহানো মুসিবত ও আশঙ্কার খবরাখবর নানাভাবে আমাদের নজরে আসে। এর বাইরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলটপকা পাণ্ডিত্য যদি ইগ্নোরও করি, রিমেইনিং থাকে দেদার পথচলতি কথাবার্তা। সেদিন একজন ইউনিগ্র্যাজুয়েট বলতেসিলেন পাবজিপ্লেয়ার নাকি লাখ টাকায় হায়ার খেলতে যায়! ইন্টার্ন্যাশনাল টুর্নামেন্ট হয় পাবজির, এইটা নাকি অনেকেরই ইনকাম-জেনারেইটিং ক্যারিয়ার হয়ে উঠতেসে আজকাল ইত্যাদি। ফিসফিস শুনতে পাই যে এই/এসব খেলায় সাইকোলজিক্যালি ইনভল্ভ হয়া যায় প্লেয়াররা, যার ফলে নাকি বিবিধ পীড়ন এবং এমনকি কেউ কেউ স্যুইসাইড পর্যন্ত করে ফেলে! বেশ কিছুদিন আগে ‘ব্লু হোয়েল’ নিয়া ম্যালা হাল্লাগোল্লা হয় দেশে এবং দুনিয়া জুড়ে। এরপরে এটা-ওটা পার হয়া পাবজিক্রীড়া নিয়া হাউকাউ হয় একই কায়দায়। জেনারালি গেইম নিয়া গালগল্পগাছা আমরা কানে জায়গা দিই না। মাঝেমাঝে দেখি অমুক-তমুক গেইম নিষিদ্ধ হয়, কেন ও কী কারণে সেসব ফলো করার আর ধৈর্য থাকে না আমাদের। এই রিউমার/অকারেন্সগুলা আদৌ সত্যি কি না তা জানতে চেষ্টা চালানোর একটা টাইমে আমরা কানেক্ট করি কথাসাহিত্যিক আহমদ মিনহাজকে, যিনি আর্লি লাইফে টেক্নোলোজি নিয়া ব্যবসায় নিযুক্ত ছিলেন, জনসংস্কৃতির বিভিন্ন মোটিফ নিয়া তাঁর ফিকশন ও ননফিকশনগুলায় আহমদ মিনহাজ যেভাবে ডিল করেন পাঠক হিশেবে আমরা তা মার্ক করি এবং তার হামেশা তারিফ করি। রিকোয়েস্ট করার পরে অবিশ্বাস্য অল্প সময়ের মধ্যে এই লেখাটা আমরা আহমদ মিনহাজের কাছ থেকে পেয়েছি। কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদের সৌজন্য বাদ দিয়া আমরা যদি লেখাটা পড়ি এবং পড়ে এর ইন্সাইটগুলার লগে এনগেইজ করি নিজেরে, সংযোজন/বিয়োজন নিয়া আগায়া আসি, সেইটা কাজের কাজ হবে। সেক্ষেত্রে একটাই জিনিশ ইয়াদ রাখব যে এই রচনার লেখক সোশ্যাল মিডিয়ায়, স্ট্রেইট বাংলায় ফেসবুকে, অ্যাবসেন্ট; অতএব, কেউ যদি দ্বিমত/ভিনমত জানাইতে চান লেখাটির কোনো বক্তব্যাংশে, লেখককে মেইল করতে পারেন ডিরেক্ট, মেইলঠিকানা পাঠশেষে পেয়ে যাবেন; আর ফেসবুকে কেউ যদি অপিনিয়ন রাখেন তাইলে লেখকের কাছে সে-সমস্ত কম্পাইল করে সেন্ডের ব্যবস্থা আমরা করব। অথবা এমনও হতে পারে যে এই লেখা পড়ে বা না-পড়ে যে-কেউ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়া গানপারে গেইম সংক্রান্ত স্বতন্ত্র্য রচনা লিখে পাঠাতে পারেন। শুধু মনে রাখব যে গেইম কন্টেন্ট নিয়া আমরা অপিনিয়ন-পিস্ পড়তে চাই, অপারেশন্যাল ম্যানুয়্যাল না। আর তেমন কেউ যদি ভলান্টারিলি লিখতে আগায়া আসেন তাইলে আমাদের আগ্রহ ও অভিপ্রায় বুঝবার ক্ষেত্রে সহায় হবে এই রচনাটা। ‘তাৎক্ষণিকা’ নামে একটা ধারাবাহিকীর আওতায় লেখাটা গানপারে ছাপা হতেসে। এখানে নোট থাকুক যে ‘তাৎক্ষণিকা’ ধারাবাহিকায় আহমদ মিনহাজ গানপারে রেগ্যুলার লিখে থাকেন, অন্যান্য স্বতন্ত্র্য রচনাও, বর্তমান রচনা একত্রিশ সংখ্যাসূচক ‘তাৎক্ষণিকা’। আর, আরেকটা কথা, রচনায় ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় ছবিগুলা আমরা গ্যুগল-ইমেইজ থেকে নিসি, ক্রেডিট ডিসক্লোজারের জন্যে নেসেসারি রিসার্চ আর করি নাই, বিশেষ দরকারও বোধ করি নাই ইন-ফ্যাক্ট। শুধু ব্যানার ডিজাইন করসেন যিনি, গ্র্যাফিকশিল্পী উসমান গনি, এই সুযোগে উনারে জানাই শুকরিয়া। আসুন, এই বিটকেলে দাবদাহভরা শ্রাবণের অভূতপূর্ব আগুনঝরা বাংলায়, পাঠ করি প্রসঙ্গ পাবজি ও অন্যান্য গেইম এবং আমাদের ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্যারেন্টিং নিয়া আবর্তিত গানপারের এই বিশেষ রচনা। — গানপার
প্রসঙ্গ পাবজি ও অন্যান্য গেইম || আহমদ মিনহাজ
ই-মেইলে পাবজির ব্যাপারে আপনি জানতে চেয়েছিলেন। সমস্যা হলো পাবজি বা হাজারো অনলাইন-অফলাইন গেম সম্পর্কে আমার জানাশোনা নিবিড় নয়। গেমদুনিয়ার কাজকারবারে কালেভদ্রে কৌতূহল জাগলেও সেখানে মাথা ঢোকানোর উৎসাহ মনে প্রবল হয়নি কখনো। যে-বয়সে লোকে এইসব খেলেটেলে রোমাঞ্চিত হয় সেই বয়সটা কোন ফাঁকে মোমের মতো গলে গেল ভেবে বিস্মিত হই! পাবজির মতো খেলায় যেসব ধামাকা থাকে সেগুলো ঘাঁটার দম ও সময় অনেক আগে পেছনে ফেলে এসেছি বলতে পারেন। তবে হ্যাঁ, বয়স বিচারে গার্জেনতুল্য পরিচিতজনকে ভিডিও/কম্পিউটার গেমস নিয়ে কথার তুবড়ি ছোটাতে দেখেছি এক সময়। আলাপের বেশ-অর্ধেকটা পাবজি মোবাইল, ব্লু হোয়েল, ফ্রি ফায়ার, ফ্রন্টনাইট এবং আপাতদৃষ্টে গঠনমূলক মাইনক্রাফ্ট-র মতো গেমগুলোর নিন্দামন্দে ভরাট থাকত মনে পড়ছে। মেকি উত্তেজনায় ভরপুর এইসব খেলায় মজে বাচ্চারা কীভাবে নিজের দেহমন ও ভবিষ্যতের বারোটা বাজাচ্ছে সেই আফসোস সবকিছু ছাপিয়ে প্রধান হতো সেখানে।
গার্জেনের ঘরে পা ঢুকিয়ে বসা পরিচিতজনদের এইসব কথাবার্তা আর ওদিকে খবরের কাগজে পাবজি, ব্লু হোয়েল, ফ্রি ফায়ার নিয়ে নেতিবাচক সংবাদের ঝড়ে নিজের অবুঝ পুত্রকে একটা সময় এইসব থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছি। মাইনক্রাফ্ট খেলার অনুমতি সে অবশ্য আদায় করে নিয়েছিল। যা-ই হোক, কম্পিউটার প্রযুক্তির কল্যাণে সৃষ্ট খেলার জগৎ সম্পর্কে যৎসামান্য যেটুকু জানি সেই কথাগুলো তাৎক্ষণিকায় তুলে ধরার চেষ্টা করতে পারি বড়োজোর। ভুলচুক হলে বিশেষজ্ঞরা তো রইলেন। উনারা শুধরে দেবেন আশা করি। আপাতত এই ভরসায় আগে বাড়া যাক।
…
প্রারম্ভিকায় (*নিজে বোঝার খাতিরেও বলতে পারেন) গেমিং প্রযুক্তির কারিগরি দিকটায় সামান্য আলো ফেলা যেতে পারে। কম্পিউটার ও মোবাইল যন্ত্রের উপযোগী ভিডিও গেম তৈরির ক্ষেত্রে গেম ইঞ্জিন (Game Engine) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গেম পরিকল্পক ও নির্মাতাদের জন্য সৃষ্ট সফটওয়ার প্যাকেজ কম্পিউটারের কাছে বোধগম্য ভাষা যেমন সি প্লাস প্লাস (C++), সি শার্প (C#), জাভাস্ক্রিপ্ট (Javascript) এবং প্রচুর পরিমাণ তথ্য আদান-প্রদানের সঙ্গে সেগুলোকে বিশ্লেষ এবং বিশ্লেষণ দুটোই করতে সক্ষম পাইথন-র (Python) মতো প্রোগ্রাম ব্যবহৃত হয় বলে জানি। এখানে পাইথন নিয়ে একটু ধান ভানতে চাই। মানববিশ্বে যোগাযোগের শত হাজার সড়ক ধরে প্রচুর তথ্য ওরফে Data-র আদান-প্রদান ঘটে চলেছে। পাইথনের মতো প্রোগ্রামকে হাজারো এইসব উৎস থেকে ধেয়ে আসা তথ্যস্রোতকে বিশ্লেষণের কাজে ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রতি সেকেন্ডে উৎপাদিত তথ্য (*যেমন ধরা যাক ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-হোয়াটসঅ্যাপ-ইউটিউব কিংবা মুঠোফোনে লোকের সবিরাম বিনিময় ইত্যাদি) নিছক আবর্জনা, যদি বিক্রয়যোগ্য পণ্য রূপে তাকে ব্যবহার করা না যায়। বিপরীতে এইসব তথ্যকে অঢেল টাকা, ক্ষমতা ও মুনাফা কামানোর খনি করে তুলতে পারলে দৃশ্যপট পাল্টে যেতে বাধ্য।
তো এই জায়গা থেকে আরব্য রজনীর আজদাহার চেয়ে অতিকায় তথ্যভাণ্ডারকে প্রযুক্তিবিদরা Big Data নামে ডাকেন। পাইথন বাবাজির মতো প্রোগ্রামের উপযোগিতা সেখানটায়। Big Data-কে সে বিশ্লেষ ও বিশ্লেষণ দুটোই করতে পারে। এর ফলে তথ্য আর নিছক তথ্য থাকে না, ওটা এখন আবর্জনা থেকে পণ্যে রূপান্তরিত ও অন্যের কাছে বিক্রয়যোগ্য সামগ্রীতে পরিণত হয়। জাকারবার্গের মেটা, ল্যারি পেজ-র গুগল, জেফ বেজোস-র আমাজন, জ্যাক মা-র আলিবাবা থেকে শুরু করে মোদের গ্রামীণফোন বা এরকম শত-হাজার কোম্পানি এইসব তথ্য ব্যবহার করে আমার-আপনার মতো আদার ব্যাপারীর কাছে অনায়াস পৌঁছে যায়।
মাগনা ব্যবহার করতে পারার সুবাদে ফেসবুক-এ নিজের হাবিগুষ্ঠির ঠিকুজি তো আমি-আপনি প্রতি সেকেন্ডে দিয়েই যাচ্ছি। জাকারবার্গের পক্ষে মোদের রিড করাটা চুটকি বাজানোর চেয়েও সহজ। এক লহমায় আমাদের চেহারাসুরত, আমরা কী ভালোবাসি অথবা বাসি না, মনের পারদ কখন কোনদিকে উঠানাম করে, তার সবটা অনায়াস বলে দিতে পারবে সে। শুধু কি তাই, প্রচারেই প্রসার প্রবচনে বিশ্বাসী বিচিত্র পণ্যসামগ্রী উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের কাছে আমাদের রেখে যাওয়া হাবিগুষ্ঠির ঠিকুজিকে পণ্য রূপে সে এইবেলা বিক্রয় করে দেদার টাকাও কামায়। ভিডিও গেমের জগতে পাইথনের অনুপ্রবেশ তাই ভাবার বিষয়।
ভিডিও গেমে পাইথন ঢুকে পড়ার মানে হচ্ছে খেলোয়াড় যতক্ষণ একটা খেলা খেলবে তার প্রতিটা Move-কে সনি, মাইক্রোসফট, নিনতেনদো, এপিক গেমস-র মতো বড়োসড়ো কোম্পানি ওই অজগরের সাহায্যে অনুসরণ, বিশ্লেষ, ব্যবচ্ছেদ ও বিশ্লেষণ করে যাবে। গেমের ব্যাপারে খেলোয়াড়ের মনোভাব বুঝতে এটা ভীষণ সহায়তা করে। অন্যদিকে খেলোয়াড়ের পছন্দ-অপছন্দ, স্বস্তি-অস্বস্তিও তারা যাচাই করে নিতে পারছে। তার রেখে যাওয়া তথ্যকে কাজে লাগিয়ে খেলায় নিত্যনতুন উপাদান যোগ করার প্রয়োজন তো মিটছেই, সেইসঙ্গে তথ্যগুলোকে পণ্য রূপে অন্যের কাছে বিক্রয়ের রাস্তা আরো চওড়া হচ্ছে। অদ্য যে-যুগে আমরা বাস করি সেখানে একখানা মানুষ নিছক আল্লা প্রেরিত বনিআদম নহে, সে এখন বাজার-অর্থনীতি। তাকে মানুষ না ডেকে Asset, Capital বা সোজা বাংলায় মাল নামেও ডাকা যেতে পারে।
মালের দুনিয়ায় প্রতি সেকেন্ডে উৎপাদিত লাখো কোটি তথ্যকে ওরাকল (Oracle), এসকিউএল (SQL)-র মতো তথ্যব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত গুদামঘরে জমা রেখে কি লাভ, যদি ওইসব তথ্য থেকে নতুন উপযোগ সৃজন করা না যায়? — হালজামানায় এই প্রশ্নের দাম লাখ টাকা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে পা রাখা মানববিশ্বকে গতিময় মুদ্রা রূপে ব্যবহার করতে তারা কাজের নয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মেশিন ডাটা, বিগ ডাটা-র যুগে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন আগের দিনকালে পড়ে নেই। প্রযুক্তির ওইসব তুলকালাম কাণ্ডের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাদের মনের গতিক সবিরাম নতুন মোড় নিচ্ছে। মোড়বদলের জের থেকে সৃষ্ট ক্যাওস বা বিশৃঙ্খলার গল্পটাই ভিডিও-গেম ভোক্তার কাছে তুলে ধরে।
বনিআদমের দেহমনে Chaotic Anarchy-টা বেশ জাঁকিয়ে রাজত্ব করে এখন। ওটা তাকে দিনরাত দৌড়ের উপ্রে রাখছে। তার এই দৌড়কে গড় করে গেমগুলো তৈরি হয় ও বাজারে আসে। এর বিপরীতে বসে গেম বানানো সম্ভব নয়। যদি কেউ বানায় তাহলে মানুষ সেটা ব্যবহার করবে না। দৌড়ের উপ্রে থাকা জীবন থেকে জন্ম নেওয়া গল্পগুলোকে ওই গেমে আঁটানো যাবে বলে মনে হয় না। যারপরনাই একটা পাবজি বা ব্লু হোয়েলে সচল Chaotic Anarchy মাটির পৃথিবীতে বিদ্যমান বাস্তবতা থেকেই চয়ন করা হয়ে থাকে। ওইসব গেমে দৃষ্ট গতি, মারপিট, খুনাখুনি, যুদ্ধ ও সহিংসতার কিছুই বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন কল্পনা বা ফ্যান্টাসি নয়। কথাটি স্মরণে রেখে পাবজির গভীরতলে প্রবেশ যাওয়া উচিত বলেই ভাবি।
বাস্তবে দুই মাত্রার জগতে মানুষ বিচরণ করে। সেখানে বসে বিচিত্র উপায়ে গতিশীল বিশৃঙ্খলায় যাপন করে দিনরজনী। ভিডিও গেমের ভুবনে বিশৃঙ্খলাটা 3D বা ত্রিমাত্রিক প্রযুক্তির সাহায্যে সৃজন করা হয়। এই মাত্রাবিন্যাসের কারণে তার স্থানকালপাত্রপাত্রীকে কল্পনাপ্রসূত বা ফ্যান্টাসিতুল্য বলে মনে ভ্রম জাগে, যদিও আদতে ওটা 2D-র জগতে ঘাপটি মেরে থাকা কাণ্ডকারখানাকে আত্মসাৎ করে মোবাইল ও মনিটরের পর্দায় হাজিরা দেয়। বাস্তবের দেহে বিভ্রমের আবেশ জাগানো 3D-র কাজ। বিভ্রমটা বাদ দিলে ভিডিও গেম কেউ খেলতে চাইবে না। পাবজির মতো গেমগুলো বিভ্রমাবেশের রঙিন ভুবন তৈরিতে পটু হওয়ার কারণে এতটা বাজার পেয়েছে।
Chaotic Anarchy-কে সাদাকালোয় মর্মঘাতী করে তোলা যাবে না এমন নয়। সিনেমাশিল্পে কাজটা হরহামেশা ঘটছে। প্রয়াত রুশ সিনেমাকার আলেক্সি জার্মান-র (Aleksei German) কল্পবিজ্ঞান ঘরানায় বানানো ছবি হার্ড টু বি এ গড-র (Hard to Be a God) নাম চটজলদি স্মরণ করা যেতে পারে। আলেক্সি যে-কাজটা সিনেমার ক্যানভাসে করেছেন ভিডিও গেমে সেটা অচল দুআনি। বাস্তবের নকল হলেও কম্পিউটারে বানানো খেলাটি বায়বীয় ও মজাদার; — নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা যা-ই বলি না কেন, এগুলোকে এরকম অনুভূতির নমুনা স্বরূপ তুলে ধরতে না পারলে লোকে ভিডিও গেমে সময় খর্চায় অনীহা দেখাবে নির্ঘাত।
একটা ভিডিও গেম চরিত্রের দিক দিয়ে সহিংস হতে পারে কিন্তু গেমটা লোকে খেলছে বাস্তব জীবনের শত হাজার চাপ লাঘব করার জন্য। খেলায় ঢোকার পর থেকে তার মধ্যে ভর করা উত্তেজনা, উদ্বেগ, অস্থিরতার পুরোটা মেকি হলেও মেকিত্বটা শ্বাসরোধী সব চাপ উগড়ে দিয়ে তাকে সাময়িক ভারমুক্ত হতে সাহায্যও করে। এ-উপলক্ষে আলেক্সির হার্ড টু বি এ গড-র সারকথা স্মরণ যাই এবার। ছবির কাহিনিছকে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মানুষ চাইলেও ঈশ্বর হতে পারবে না। ঈশ্বরের সমতুল সদিচ্ছা অথবা তাঁর মতো নির্বিকার থাকার কোনোটাই তাকে দিয়ে হওয়ার নয়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও সহিংস বা যুদ্ধংদেহী রূপ ধারণ করাটা তার নিয়তি! ভিডিও গেমটা লোকে আলেক্সির বার্তায় একীভূত হয়ে খেলে বোধ করি! তফাত এটুকু যে, বায়বীয় হওয়ার কারণে ওটা হার্ড টু বি এ গড-র সিনেভাষায় সচল গা ঘিনঘিনে কদর্যতার ন্যায় অতোটা মর্মান্তিক নয়। কদর্যতাটা সেখানে ত্রিমাত্রিক প্রযুক্তির মায়াবী স্বপ্নজালে বোনার কারণে আর সিরিয়াস থাকে না। সহিংসতাগুলো ফান বা মজায় পরিণত হয়। হার্ড টু বি এ গড-র সঙ্গে এখানেই একখানা স্পোর (Spre), ওয়ার্ল্ড-বক্স (WorldBox) বা পাবজির মতো গেমের তফাত। সুতরাং এগুলো নিয়ে গার্জেনমহলের শঙ্কাতুর ফিসফাস ও বিরক্তিকে হাস্যকর বলে দাগানো যেতে পারে।
…
বোদলেয়ার বা আলেক্সি জার্মানের মনোবিশ্ব থেকে উঠে আসা কদর্য সুন্দর-র উপমায় ত্রিমাত্রিক প্রযুক্তির আবেশে বোনা ভিডিও গেমের সুস্থির থাকা বারণ। মোবাইল ও মনিটরের পর্দায় গতিশীল গেমের জগৎকে মায়াবী, নান্দনিক ও প্রাণবন্ত রূপে হাজির করার ভাবনায় এর কর্তাব্যক্তিরা মাথার চুল ছিঁড়েন। কাজটি ভালোভাবে সারতে গ্রাফিক্স আর অ্যানিমেশন প্যাকেজে ভরপুর সফটওয়্যারকে তারা কাজে লাগান শুনেছি। শব্দ ও আবহসংগীত সংযোজনের জটিল কাজকারবার সামলে নিতে নামকরা সংগীতকারগণ বিশেষ ভূমিকা রাখেন শুনতে পাই। মাইনক্রাফ্টকে উক্ত বিবেচনায় ব্যতিক্রম মনে হয়েছিল। খেলাটি সৃজনের সময় স্বত্বাধিকারমুক্ত (Copyleft) সফটওয়্যার ও মোবাইল অ্যাপস তৈরিতে হরদম ব্যবহৃত জাভা প্রোগামকে এর প্রণেতারা বেছে নিয়েছিলেন!
পুত্রের কল্যাণে খেলাটির Graphical User Interface (GUI) বা সোজা কথায় চেহারাসুরত আন্দাজ করতে গিয়ে সুবিধের ঠেকেনি। ভিডিও গেম সৃজনের আদি যুগে যেসব খেলার প্রচলন ঘটেছিল মাইনক্রাফ্ট-র দৃশ্যচিত্রের জগৎকে সেরকম মনে হচ্ছিল। ত্রিমাত্রিক ব্লক (3D Block) আকৃতির ক্যারেক্টার ও বিবিধ উপকরণে ঠাসা খেলাটির প্রতি পুত্রধনের দুর্বার আগ্রহের কারণ তাৎক্ষণিক দিমাগে ঢোকেনি। জাভা প্রোগ্রাম দিয়ে ভিডিও গেমের উপযোগী নান্দনিক দৃশ্যচিত্র সৃজন বেশ দুরূহ বলে জানি। অবাক করা ব্যাপার বটে, ব্লক আকৃতির বিদঘুটে স্থানকাল আর পাত্রপাত্রীদের নিয়েই মাইনক্রাফ্ট তার সূচনালগ্ন থেকে আজোবধি সমান জনপ্রিয় ও সর্বকালের সেরা ভিডিও গেমের একটি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। গেমটিকে ঘিরে পোলাপানদের আগ্রহ ও উন্মাদনা অনলাইনে ঢু মারলে বা আশপাশে যেসব বাচ্চারা ওটা খেলে তাদেরকে নিরিখ করলে মিলে বৈকি।
যে-ভাবনার ওপর দাঁড়িয়ে মাইনক্রাফ্টকে সৃজন করা হয়েছিল তাকে দিমাগে নিতে পারলে জনপ্রিয়তার কারণ কিছুটা বুঝে আসে। অন্য খেলা থেকে এর স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। কম্পিউটারে সৃষ্ট বাস্তব জগতের বায়বীয় প্রতিরূপতায় ভরা বিশ্বে (Virtual/Computer Generated Simulated World) খেলোয়াড়কে প্রবিষ্ট হতে হয়। এমন এক বিশ্ব যার প্রতি পরতে অজানা চরিত্র আর উপকরণ লুকিয়ে রয়েছে। খেলোয়াড় সেখানে Explorer বা অনুসন্ধানীর সমতুল ভূমিকায় অংশ নিয়ে থাকে। খেলার প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন করতে প্রয়োজনীয় উপকরণ তার জন্য সাজানোই থাকে। অজানা অসীম বিশ্বের প্রতি পরতে লুকিয়ে থাকা বিস্ময়কে খনন করতে এগুলোকে সে ব্যবহার যায়।
পুত্রধন অনলাইন-অফলাইনে মাইনক্রাফ্ট নিয়ে ব্যস্ত হলেন দেখে তার ওপর গোয়েন্দাগিরি ফলানোর সংকল্পে খেলাটির ব্যাপারে খোঁজ নেওয়ার তাগিদ বোধ করেছিলাম। যৎসামান্য ঘাঁটাঘাঁটির পর মনে হলো চেনা বিশ্বকে অপরিচিত ও রহস্যময় উপায়ে খেলাটিতে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। খেলোয়াড় সেখানে Miner বা খনিশ্রমিকের ভূমিকায় নিজেকে অবতীর্ণ হতে দেখে। উপনিবেশযুগে (Colonial Era) কলম্বাস, ভাস্কো দা গামা বা ক্যাপ্টেন কুকরা উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর অজানা সব প্রান্তরে জাহাজ নোঙর করতেন। অপরিচিতকে জয় করার সাহস ও বুদ্ধি খাটানোর পাশাপাশি অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারের লোভ আর নৃশংসতায় নির্মম হতে উনারা তখন বিন্দুমাত্র সংকোচ বোধ করেননি!
ইতিহাসের প্রায় ধূসর অধ্যায়টি অত্র অপ্রাসঙ্গিক বলে আপাতত সেদিকে না যাই। তারচেয়ে মাইনক্রাফ্ট-এ স্থির থাকাটা সমীচীন হয়তো। অন্যরা কী বলবেন জানি না তবে খেলাটির বিচিত্র ধাপে নিজের এবং জাতির ভাগ্য ফেরাতে মরিয়া উপনিবেশযুগের ডাকাবুকো লোকগুলোর খনিশ্রমিক টাইপের অন্বেষণ ও ভাগ্যজয়ের ঘটনা চমক দিচ্ছে, এরকম এক অনুভব আমায় তখন পেয়ে বসেছিল! মাইনক্রাফ্ট-র মানচিত্রে সন্নিবেশিত Territory বলাবাহুল্য অগোছালো। অজানা রোমাঞ্চ ও বিশৃঙ্খল উপকরণে বোঝাই থাকে সারাক্ষণ। সভ্যতা এখানে সুগঠিত নিয়ম-কানুনের তাঁবেদার নয়। তাকে গড়েপিটে নেওয়ার বুদ্ধি ও প্রকৌশল স্বয়ং খেলোয়াড়কে মাথা খাটিয়ে বের করতে হয়। আত্মরক্ষা থেকে শুরু করে আধিপত্য বিস্তারের কলাকৌশল নিয়ে বিস্তর কাঠখড় পোহায় সে। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত মোবাইলসদৃশ অজানা প্রতিপক্ষকে (*মাইনক্রাফ্ট-র ভাষায় তারা Mobs) ঘায়েল করার বুদ্ধি ও সাহস থাকাটা এই খেলার পক্ষে জরুরি, সেইসঙ্গে তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের ইঞ্জিনিয়ারিং ওরফে প্রকৌশলবিদ্যার ভূমিকা বেশ প্রবল মনে হয়েছিল।
অজানা বিশ্বকে মুঠোবন্দি করতে প্রোগ্রামিংয়ের ভাষা যদি খেলোয়াড়ের জানা থাকে তবে খেলাটিকে বিনির্মাণ করা তার জন্য কঠিন নয়। মাইনক্রাফ্ট-র কোডগুলো সেক্ষেত্রে আম পাবলিকের জন্য উন্মুক্ত না হলেও C++-র পরিবর্তে জাভা ব্যবহার করায় দক্ষ প্রোগ্রামারের পক্ষে এর সোর্স কোডের পাত্তা লাগানো ও নতুন আঙ্গিকে তাকে সৃজনের সুযোগকে বোতলবন্দি দৈত্য মনে হয়নি। খেলায় গতি ও নান্দনিকতা যোগ করার প্রয়োজনে মাইনক্রাফ্ট-র নির্মাতারা সম্প্রতি C++ এস্তেমাল করলেও জাভাই এখনাবধি তার মূল ভিত্তি। ওটাকে ইচ্ছাকৃতভাবে জাভা দিয়ে নকশা করা হয়েছে। এর ফলে প্রোগ্রামিংয়ের ভাষায় দক্ষ খেলোয়াড়কে সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ খানিক হলেও সে করে দিতে পেরেছে। অন্য গেমগুলো এহেন সৃজনশীলতাকে জায়গা দেওয়ার ব্যাপারে ভীষণ কৃপণ।
মাইনক্রাফ্ট-এ নতুন ফিচার সংযোজন বা সোজা কথায় এর উন্নতি ও পরিবর্ধনে পাকা মাথার খেলোয়াড় (*ধারণা করি) স্বয়ং অংশ নিয়ে থাকে। সুতরাং এ-কথা বলা যায়, খেলোয়াড়ের নিজেকে দক্ষ পরিকল্পক বা Game Designer রূপে পরখ করার সুযোগ অন্য ডিভিও গেমের তুলনায় এই খেলায় বেশ অবারিত। এদিক থেকে ভাবলে তার উপযোগ-উপকারিতা স্বীকার করা উচিত, যদিও খেলার প্রতিটি ধাপে বিস্তর সময় খর্চা করতে হয়। বাচ্চাদের দেহমনের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করলে জিনিসটা ক্ষতিকর। আমার পুত্রধন বেশ লম্বা সময় এর পেছনে লেগে থাকার পর অদ্য উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন মনে হচ্ছে। পাড়াতুতো ছেলেদের সঙ্গে ফুটবলে লাথালাথি আর ইউটিউবে কৃষ্ণগহ্বরের খবর করা এবং সেইসঙ্গে শ্রীলংকার দুর্গতি বিষয়ে তাকে আজকাল অধিক তৎপর দেখতে পাই! বালকমনের মতিগতি বোঝা, হা ঈশ্বর, সত্যি দুষ্কর বটে!
ফুটবল, কৃষ্ণগহ্বর ও রাবণের শ্রীলংকা পরস্পরবিরোধী হলেও এটা সত্য সকল এন্টিটি দিনের শেষে কৃষ্ণগহ্বরতুল্য মহাবিশ্বে লোপাট হয়। মোর অবুঝ পুত্রের নাতিক্ষুদ্র জীবনে মাইনক্রাফ্ট কাজে লাগেনি বললে মিছে বলা হবে। খেলাটি কোনো এক জাদুবলে তার কুতূহলকে বিচিত্র বিষয়ে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল। চারপাশের জগতের সঙ্গে বোঝাপড়ায় নিজেকে কী করে দক্ষ Miner করে তুলতে হয় সেই টিপস অ্যান্ড ট্রিক্স ধরিয়ে দিতে বিদ্যালয়ের চেয়ে বরং জাভার ভাষাপৃথিবী দিয়ে বোনা গেমটাকে অধিক কামিয়াব বলে আমায় মেনে নিতে হয়েছিল। পুত্রধনকে এখন বয়স-উপযোগী গ্রাফিক্স ও অ্যানিমেশন-এডিটর নিয়ে নড়াচড়া করতে দেখি, আমার সবজান্তা পরামর্শের তোয়াক্কা না করে ফুটবল থেকে মহাবিশ্ব নিয়ে দুমদাম ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি ও আপলোড করছেন দেখতে পাই, ওদিকে চামেচুমে মায়ের মোবাইল সাপটে গেমবাজিও করেন খানিক। বুঝি, এসবই ওই হতচ্ছাড়া খেলাটির অবদান। যারপরনাই মাইনক্রাফ্ট-র ব্যাপারে শুরুর বিরক্তি পরে আর বজায় থাকেনি।
নিজের ঘরের উদাহরণ দিলাম এটা বোঝানোর জন্য, — ভয়-শঙ্কার তড়াসে বখে যাচ্ছে ভেবে বাচ্চাকে আপনি যতই মুঠোবন্দি করবেন তার বাইরে গিয়ে নিজের একখানা পৃথিবী সে ঠিক সৃজন করে নেবে। যাকগে, ভিডিও গেমে বাচ্চা পোলাপানদের সময় খর্চার প্রসঙ্গে পুনরায় ফেরত যাই। পাবজি যতদূর শুনেছি মাইনক্রাফ্ট থেকে এই ব্যাপারে এক কাঠি সরেস। খেলার প্রতিটি ধাপ পার হতে নাকি তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় লেগে যায়। চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রে সময়টা কম লাগতে পারে কিন্তু পাবজিভোক্তার বড়ো অংশ অপেশাদার বাচ্চা পোলাপান দিয়ে ভরাট থাকায় একটা খেলার পেছনে তাদের ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা লেগে থাকা গার্জেনদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে। মোবাইলের ছোট্ট পর্দায় খেলতে বসা বাচ্চার নিকট নিরঙ্কুশ একাগ্রতা ও মনঃসংযোগ সে দাবি করে। টিভি দেখার মতো করে খেলবে সেই উপায় খেলার নকশায় রাখা হয়নি। পরিচিত যেসব ছেলেমেয়েকে সরকার ও অভিভাবকের রক্তচক্ষু এড়িয়ে ওটা খেলতে দেখেছি তাদের উত্তেজনা, শিহরন আর একাগ্রতাকে এইবেলা নমস্য মানতে হয়। অধ্যবসায়টি তারা অন্য কাজে লাগালে কোন উচ্চতায় পৌঁছাত সে-কথা মাঝেমধ্যে মনে উঁকি দিয়েছে বৈকি।
স্কুল-কলেজের গৎবাঁধা কারিকুলাম, সিলেবাস আর নিরস শিখনপদ্ধতির বাইরে মুক্ত এক দুনিয়ার আস্বাদ পাবজির প্রতি অঙ্গে উপচায়। খেলার শেষ ধাপে পৌঁছানোর নেশাটা এমন যে কারো দিকে তাকানোর অবসর জোটে না! রাষ্ট্র ও সমাজে সংঘাত-সহিংসতার যত ফন্দিফকির রয়েছে তার সবকটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কাঁচা বয়সের ছেলেমেয়ের মগজে পাবজি নিজের বিজয়নিশান উড়ায়। সমাজস্বীকৃত Intelligentsia বা বিশেষ বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার খেলাগুলোকে সামান্য এই ভিডিও গেম অনায়াসে প্রতিহত করে যায়।
পাবজির বায়বীয় ভুবনে খেলোয়াড় অবিরত নিজের শক্তি ও বুদ্ধিমত্তাকে বাজিয়ে দেখার চ্যালেঞ্জ কাঁধে বহনে বাধ্য হয়। পাবজিভুবনে ঢুকে পড়া খেলোয়াড় সমাজের পেটের ভিতরে সক্রিয় নিয়মতান্ত্রিক লড়াইয়ের সকল পথ্য ব্যবহার করলেও সবিরাম মারো নয় মরোর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ পায় না। সমাজস্বীকৃত Intelligentsia-র সঙ্গে পাবজির তফাত এই জায়গায় অকাট্য। বাস্তবের পৃথিবীতে প্রতিপক্ষকে পরাভূত করতে গায়ের জোর খাটানো থেকে শুরু করে চিকনবুদ্ধি ফলানোর অসংখ্য কৌশল রয়েছে, পাবজিখেলায় সেগুলো সুলভ রাখা হলেও সমঝোতা বা মিটমাটে যাওয়ার রাস্তা তালাবন্ধ থাকে। শর্ত একটাই সেখানে, — লড়াইয়ে নেমে পিছু হটা যাবে না। একে-একে সবাই মারা পড়লেও একজনকে থাকতে হবে যে কি-না বিজয়ী অথবা বিজয়ী না হলেও আত্মরক্ষায় সফলকাম। অলিখিত এই শর্ত পাবজিকে Outlaw অর্থাৎ সামাজিক বিধিনিষেধের পরোয়া করছে না এরকম খেলায় মোড় নিতে বাধ্য রাখে। খেলাটিতে একবার প্রবেশ করলে শেষ না দেখা পর্যন্ত মনের কুতুহল তাই মিটে না।
ভার্চুয়াল কপ নামক খেলার প্রায় সমসাময়িক রেসিডেন্ট ইভিল বা এরকম আদ্যিকালের ভিডিও গেমের (*নয়ের দশকে বাজারে আসা রেসিডেন্ট ইভিল গেমটি মাদারবোর্ডে আলগা গ্রাফিক্স কার্ড জুড়ে আমরাও খেলেছি এক সময়) সঙ্গে পাবজির মিলমহব্বত থাকলেও মাইনক্রাফ্ট-র সহিত তার মিলন অধিক চোখ টানে। Graphical User Interface-টা ওদিকে আবার ওটার চেয়ে অনেক বেশি নান্দনিক ও মনকাড়া। খেলাটির গোড়াপত্তনে জাপানের বরেণ্য সিনেমাকার কিঞ্জি ফুকাসাকুর (Kinji Fukasaku) দুই পর্বে নির্মিত চলচ্চিত্র ব্যাটল রয়্যাল-র (Battle Royale) যুগান্তকারী ভূমিকা ছিল বলে জানি। কাওশান তাকামির (Koushun Takami) থ্রিলার থেকে ধার করা কাহিনি দিয়ে সাজানো ছবির প্রথম পর্ব অনেক আগে দেখেছিলাম মনে পড়ে। ভৌতিক আবহে নির্মিত ছবিটি দেখার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা বেশ ভয়াবহ ছিল। সিনেমার কাহিনি থেকে ভিডিও গেম বানানো নতুন কিছু নয়, তথাপি ব্যাটল রয়্যাল-র মতো ছবির প্রতি পরতে বহমান রক্তহিম সহিংসতাকে খেলায় রূপদানের যৌক্তিকতা নিয়ে কথা উঠেছিল। সহিংসতায় ভরা সিনেভাষাকে ভিডিও গেমের মোড়কে কোমলমতি ছেলেমেয়ের পাতে তুলে দেওয়াটা সর্বনাশ ডেকে আনবে; — এরকম শঙ্কায় অনেকে সেই সময় কাতর ছিলেন। ফুকাসাকুর ছবিতে মূর্ত পর্দাসহিংসতার (Graphical Violence) পক্ষে-বিপক্ষে চলা বিতণ্ডার মধ্যে পাবজির আত্মপ্রকাশ যারপরনাই ব্যতিক্রম ও সাহসী ঘটনায় মোড় নিয়েছিল।
মাঙ্গা (Manga) অর্থাৎ কমিক্স বা চিত্রআখ্যান অবলম্বনে হাড়হিম হরর, গ্যাংস্টা ধাঁচের ছবি বানাতে জাপানিরা ওস্তাদ বলে সিনেবিশ্বে স্বীকৃত। ব্যাটল রয়্যাল-র গল্পটি এখানে মাঙ্গার পরিবর্তে তাকামির আখ্যানকে আপন করে নিয়েছিল। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার দিন থেকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে। সেন্সরের কাঁচি থেকে পরিচালক কী করে বেঁচে গেলেন সে-কথা ভেবে অবাক হয়েছি সেই সময়। ফাঁকতালে ছবিখানার কাহিনিসংক্ষেপ স্মরণ করা প্রয়োজন। সর্বাত্মকবাদী সরকার (Totalitarian Government) কর্তৃক শাসিত জাপানকে ছবিতে কল্পনা করা হয়েছে। সরকারটি দেশের স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর সহনক্ষমতা বা রেজিস্টেন্সের পরীক্ষা নিতে ব্যাটল রয়্যাল নামের খেলায় তাদেরকে অংশ নিতে বাধ্য করে। খেলার প্রতিটি ধাপকে ঝুঁকি ও নিশ্চিত মৃত্যুর হাতছানি দিয়ে সাজানো হয়েছিল। সুনিশ্চিত মরণের খেলায় নিজের জান বাঁচতে মরিয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যে-প্রতিযোগিতাটা চলে সেখানে বিশ্বাস, অবিশ্বাস থেকে শুরু করে সহানুভূতি, ভালোবাসা, মানবিকতা ও পরার্থপরতা আদৌ অবশিষ্ট থাকে কি-না অর্থাৎ নৈতিক উভয়সঙ্কটকে পরিচালক ফিরে-ফিরে ছবির প্রতি পরতে বাজিয়ে দেখেছেন। সহিংসতার সঙ্গে ভৌতিক রোমাঞ্চ জুড়তেও কঞ্জুসি করেননি।
ছবির কাহিনি ছকবাঁধা গতিতে অগ্রসর হলেও পরিশেষে পৌঁছে শুয়া নানাহারা ( Shuya Nanahara) ও নোরিকো (Noriko) ছাড়া বাকিরা একে-একে মারা পড়ে। খেলার মূল নটে স্কুলশিক্ষক কিতানোর (Takeshi Kitano) কন্যাটিও আত্মরক্ষার খেলায় অংশ নিয়ে বেঘোরে মারা যায়। শুয়া ও নোরিকোকে পলাতক ঘোষণা করে খেলার সমাপ্তি টানেন পরিচালক। তিনি ঝেড়ে না কাশলেও ছবির উপসংহার থেকে বোঝা যায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া শুয়া ও নোরিকো ভবিষ্যতের সর্বাত্মকবাদী জাপানের হাল ধরার যোগ্যতায় আপাতত পাশ গিয়েছে। তবে হ্যাঁ, বাঁচনমরণের খেলা শেষ হলে সর্বাত্মকবাদী সুশৃঙ্খল সমাজের ক্রীতদাস হয়ে দিন কাটানোর ওপর তাদের মনে একরাশ ঘৃণা ও বিতরাগ জন্ম নিয়েছিল; — এরকম এক ইশারা পরিচালক ছবিতে আলগোছে রেখে যেতে ত্রুটি করেননি।
কাহিনির প্রতি পরতে যেসব টেনশন ফুকাসাকু পর্দায় অমোঘ করেছিলেন সেগুলোর অভিঘাত দর্শকস্নায়ুকে বিকল করে তোলে। ছবিটি দেখতে বসে সহ্যশক্তির পরীক্ষায় অংশ নিতে তাকে বাধ্য করা হয়। পর্দাসহিংসতার নটরাজ বলে নন্দিত জাপানি পরিচালক তাকেশি মাইক-র (Takashi Miike) সিনেভাষায় সহিংসতার বাড়াবাড়ি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও দর্শক অনেক সময় একে কমিক বলেই দাগায়। বিগত শতকের নয়ের দশকে মুক্তি পাওয়া সাইকো থ্রিলার অডিশন দর্শকমনে তিক্ত চাপ তৈরি করলেও শূন্য দশকে বানানো ইচি দ্য কিলার (Ichi the Killer) ছবির পর্দাসহিংসতায় সে মোটেও আঁতকে ওঠে না। ইচির মানুষ খুন করার অতিকায় ক্ষমতাকে পরিচালক পরিহাসমুখর বিদ্রুপে মুড়িয়ে পর্দায় ভাষা দিয়েছিলেন। ফুকাসাকুকে এখানে মায়াদয়াহীন মনে হবে। সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে নিষ্ঠুর আনুগত্যের বিকল্প নেই; — এমতো বার্তার চাপ ছবিখানার প্রতি পরতে রাজ করে।
মুক্তির দিন থেকে দেশের-পর-দেশে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া ছবিটির কাল্ট ক্লাসিক হতে আটকায়নি। সুস্থির, নিয়মতান্ত্রিক ও অবিশ্বাস্য সুশৃঙ্খল সমাজে বসবাসে অভ্যস্ত জাপানিরা সর্বাত্মকবাদী শিকল পায়েই দিন কাটায়; — এহেন ইঙ্গিত ছবিটি দেখতে বসে দর্শকমনে আপনা থেকে চেপে বসে। মনে রাখতেই হচ্ছে, জাপানের সুবিখ্যাত সামুরাই ঐতিহ্যটা স্বয়ং সর্বাত্মকবাদী শৃঙ্খলায় বাঁধা। এর দাপট সেকালে যেমনটা ছিল একালেও ব্যতিক্রম নেই। শত রূপান্তর সহ্য করে ওটা এখনো আদি জাপানের প্রতিধ্বনি করে। আকিরা কুরোসাওয়ার সিনেভাষায় এর ধ্রুপদি স্বরূপ দর্শক লম্বা সময় ধরে দেখেছে। ফুকাসাকু বা তাকেশি কিতানোর যুগবিশ্বে পা রাখার দিন থেকে খোলনলচে পাল্টে গেলেও সর্বাত্মকবাদী শৃঙ্খলায় নিজেকে সুনিয়ন্ত্রিত ভাবার চাপ থেকে জাপানিরা আজো মুক্ত নয়।
জাপানিদের এই সুনিয়ন্ত্রিত সর্বাত্মকবাদ Disciplined Nation-র মহিমায় দুনিয়া জুড়ে লোকের প্রশংসা কুড়ালেও একাকীত্ব, সমাজবিচ্ছিন্নতা, স্বেচ্ছামরণ ও সহিংসতা দেশটির পরিপাটি জীবনধারায় অহর্নিশ উঁকি দিয়ে যায়। যে-কারণে হয়তো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে সাংঘাতিক কড়াকড়ি থাকা সত্ত্বেও শিনজো আবেকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলিবিদ্ধ হতে হলো! আততায়ীর স্বীকারোক্তি একালের জাপানকে বুঝে উঠতে সাহায্য করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার অভিপ্রায় তার ছিল না; — কথাটি পুলিশকে সাফসাফ জানিয়ে দিতে ইতস্তত করেনি সে। শিনজো আবে নয় বরং রাষ্ট্রযন্ত্রকে গুলি ছুড়তে চাওয়ার সংকল্পের কথা জানাতেও মুখে আটকায়নি। নির্বাচনী সভা লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণের ঘটনা যে-বার্তাটি সকলের কাছে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল তার সারার্থ এটুকুই, — সুশৃঙ্খল নিয়মের ছন্দে বাঁধা জাপানে কিছুই আসলে ঠিকঠাক কাজ করছে না।
আদ্যিকালের জাপানে ক্ষমতাসীনরা হিটম্যান বা ভাড়াটে খুনি হিসেবে সামুরাইকলায় দক্ষ লোককে ভাড়া করত। সাম্প্রতিক জাপানে শিনজো আবের আততায়ী কারো অপেক্ষায় বসে না থেকে স্বয়ং ওই ভূমিকাটা নিয়ে নিয়েছে। জাপানের সর্বাত্মকবাদী সমাজে মার্কিন ধাঁচে বন্দুকবাজের আবির্ভাব অগত্যা সামুরাই ঐতিহ্যে মোড়বদলের ইশারা দিয়ে যায়। ব্যাটল রয়্যাল-র কল্পবিশ্বে সঙ্কটের নিদান আগাম ফেটে বেরিয়েছিল। সেলুলয়েডের ফিতায় যে-জাপানের দেখা মিলে সেখানে সামুরাই ঐতিহ্যের অবক্ষয় খেলার প্রতিটা ধাপে ফুটিয়ে তুলতে ফুকাসাকু চেষ্টার চূড়ান্ত করেছিলেন।
আপাত সুস্থির সমাজের অন্তরালে যেসব ফাঁকি ও নৈরাজ্য পরগাছার মতো বাড়ে তার প্রতিফলন জাপানের ছবিতে বেশ ব্যাপক। কুরোসাওয়া, ওজো, সুজুকি, ইমামুরা, কোবায়াশির মতো নির্মাতারা যেমন একে পর্দায় ধারণ করেছেন, অনতি সাম্প্রতিক তাকেশি মাইক, সায়ন সোনো, তাকেশি কিতানোর সিনেবয়ান অনুরূপ কাজে শান দিতে ব্যস্ত অবিরাম। রাইসুকে হামাগুচি ও হিরোকাজু কোরেদার মতো সুস্থির কাব্যিক ভাষায় সিনেকাহিনি বুনতে অভ্যস্ত নির্মাতাদের ছবিতেও নৈরাজ্যকবলিত জাপান বারবার অমোঘ হয়। হামাগুচির ড্রাইভ মাই কার আর ওদিকে কোরেদার কানজয়ী শপলিফ্টার, নোবডি নোজ কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার পটভূমিতে নির্মিত ব্রোকার-এ নিয়মতান্ত্রিক সমাজদেহে গজিয়ে ওঠা পুঁজ ও পচনের কাহিনি উঠে আসে। ফুকাসাকুর ছবিটি এইসব ক্ষতকে এক্সট্রিম সিনেমার সঙ্গে মিল করে ব্যবহার করেছিল মাত্র। বাকিদের সঙ্গে তাঁর তফাত বলতে এটুকুই। পাবজি ধাঁচের গেমগুলোর পথপ্রদর্শক ব্যাটল রয়্যাল ইউটিউবে সুলভ, কাজেই কথা আর না বাড়াই।
…
ব্যাটল রয়্যাল-র পর্দাসহিংসতা হলিউডে নির্মিত ভৌতিক ও মারপিট ধাঁচের বহু ছবির প্রেরণা হিসেবে পরে ভূমিকা রেখেছিল। PUBG: Battlegrounds নামে ভিডিও গেমের উৎপত্তি সম্ভবত সেখান থেকেই ঘটে। পাবজি ভিডিও ও মোবাইল গেম রূপে ছবিখানার আত্মপ্রকাশের নেপথ্যে জাপানি গেমবাজদের ভূমিকা নগণ্য ছিল। ব্যাটল রয়্যালকে পাবজিতে রূপান্তরের ভার দক্ষিণ কোরিয়া সেই সময় একলা কাঁধে নিয়েছিল। গেল এক-দেড় দশকে ভিডিও গেমের সঙ্গে হরর ও থ্রিলার ধাঁচের সিনেমা বা টিভি সিরিজে কোরিয়ার নবউত্থানের নেপথ্যে ফুকাসাকুর ছবিখানার অবদানকে তাই যুগান্তকারী মানতে হয়।
করোনার দিনকালে নেটফ্লিক্স-এ ঝড় তোলা ড্রামা সিরিজ স্কুইড গেম (Squid Game) দিয়ে ব্যাটল রয়্যাল আবারো আলোচনায় ফেরত আসে। স্কুইডের প্রতি পরতে বিগত শতকের শূন্য দশকের গোড়ায় বানানো ছবিটির ছাপ দর্শকের বুঝে নিতে আটকায়নি। ওদিকে পাবজি ঘরানার গেমের ভুবনে ব্যাটল রয়্যাল বহুদিন ধরে পৃথক জনরা রূপে স্বীকৃত। পাবজি থেকে মাইনক্রাফ্টকে ওই গোত্রে গড় করে গেম বিশেষজ্ঞরা সচরাচর বিচার করে থাকেন। ব্যাটল রয়্যাল-র প্রেরণায় জারি থেকে পাবজিটা নিত্যনতুন আঙ্গিকে তার ভক্তদের কাছে হাজিরা অব্যাহত রেখেছে। নিজে যেহেতু খেলিনি এর অন্ধিসন্ধি সম্পর্কে গুছিয়ে বলা কঠিন। পরিচিত কিছু বাচ্চাকে খেলতে দেখেছি মাত্র। পর্যবেক্ষণ বা তাদের সঙ্গে বাতচিত থেকে খেলাটির ব্যাপারে খানিক ধারণা গড়ে উঠেছিল। আপাতত এটুকু অধমের সম্বল।
পাবজিকে অনেক দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বাচ্চাদের এর প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তির কারণে। বাংলাদেশেও পাবজি এবং ফ্রি ফায়ার-র মতো খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছেন সরকার। খেলাগুলো থেকে আয়রোজগার সম্ভব হলেও চ্যাম্পিয়নের মতো খেলতে না পারলে সেই আশায় গুড়েবালি। পাবজি খেলতে গিয়ে আত্মহননের ঘটনা সম্পর্কে অধম নিশ্চিত হতে পারিনি। খেলাটিকে যে-ছকে সাজানো হয়েছে সেটা খেলার অবধারিত নিয়মে প্রতিকূলতা জয় করার চ্যালেঞ্জে ভরপুর থাকে। এখন এই চাপ সইতে না পেরে কোনো-কোনো খেলোয়াড় আত্মহত্যা করে থাকতেও পারে। গণমাধ্যমে ওটাই হয়তো অতিকায় ডালপালা মেলে আতঙ্ক ছড়িয়েছে বারবার।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বিশ্বাসযোগ্যতায় আস্থা রাখা কঠিন। একটা লোক কী কারণে আত্মহত্যা করেছে তার ময়নাতদন্তে নামার দম ও সময়ের কোনোটাই সাংবাদিক ভাইয়াদের নেই। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা অনেক দিন হয় মরহুম হয়েছেন। বাংলাদেশে আসমানজমিন একাকার করে চারণ সাংবাদিক খ্যাত একজন মোনাজাতউদ্দিনকে আপনি খুঁজে পাবেন না। ফাঁকি ঢাকা দিতে অগত্যা হ্যাপি জার্নালিজমকে গণমাধ্যমের কত্তাবাবুরা বেছে নিয়েছেন। পাবজি খেলতে গিয়ে কেউ যদি গলায় দড়ি দিয়ে থাকে সেটা খেলার দোষে নাকি খেলোয়াড়ের স্নায়বিক দুর্বলতার কারণে ঘটেছিল এইসব ব্যাপারে সঠিক ধারণা পেতে কত্তাবাবুদের হ্যাপি জার্নালিজম অগত্যা কাজের নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটা আবার সত্যের চেয়ে হাবিজাবি গুজব ছড়ানোর প্রবণতায় সরেস। শৌখিন এই তথ্যভাণ্ডারকে যাচাই করা বিরাট ঝামেলার কাজ! ফেসবুক বা ইউটিউবে সব্বাই একযোগে ছাংবাদিক ও ছম্পাদক। একখানা খবরের লেজ ধরে দশটা বানোয়াট, স্ববিরোধী ও আরোপিত মিথ্যার চাষাবাদ চলে সেখানে। হাউকাউ ছাড়া সারবত্তা কিছু কপালে জোটে না। ওই দেশের হালত দেখে রবি ঠাকুরের চরণ সর্বাগ্রে মাথায় ভর করে। মনে-মনে আওরাই তখন :
কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস / ওরে আমার গান, / কোন্খানে তোর স্থান? / পন্ডিতেরা থাকেন যেথায় / বিদ্যেরত্ন-পাড়ায়— / নস্য উড়ে আকাশ জুড়ে / কাহার সাধ্য দাঁড়ায়, / চলছে সেথায় সূক্ষ্ণ তর্ক / সদাই দিবারাত্র / পাত্রাধার কি তৈল কিম্বা / তৈলাধার কি পাত্র।’ (দ্রষ্টব্য : যথাস্থান]
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জায়গা থেকে নৈরাজ্যটা সুখকর হতে পারে কিন্তু এরকম সংবাদবাহকে বোঝাই মাধ্যমকে রেফারেন্স ঠাউরে পাবজিখেলায় বাচ্চার মরণ সম্পর্কিত খবরে আস্থা রাখা কঠিন। ফুকাসাকুর ছবির মতো পরিস্থিতি পাবজি-প্রণেতারা কভু সৃজন করেছেন সেটা খেলার ধাপগুলো নজর করলে আমলে নেওয়ার ইচ্ছেটা মারা যায়। পরিচিত যারা ওটা খেলেছে তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়নি এই দোষে একজন খেলোয়াড়ের জান চলে যেতে পারে।
সমাজের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আকুল মনোবিদ, মোল্লা-পুরুত আর সুশীল মুরব্বিদের কথা অবশ্য আলাদা। কমিক্স, কার্টুন, মারপিট বা যৌনসুড়সুড়ি জাগানো সিনেমা, পপ-রক-পাঙ্ক-র্যাপ গানবাজনা থেকে শুরু করে ভিডিও গেম…সোজা কথায় সাব-কালচারে বহতা হেন জিনিস নেই যার মধ্যে উনারা ব্যাধি, বিকার ও অসুস্থতা খুঁজে না পান! সমাজের এইসব অতন্দ্র রক্ষকদের শুচিবাইকে পাত্তা দিলে মুশকিল। সবকিছুতে দোষ ধরা ও সেগুলোকে বদঅভ্যাস বলে দাগিয়ে তারা তৃপ্তি পান। তাদের এই খাসলতটা ইদানিং বাতিকে মোড় নিয়েছে দেখতে পাই। বদঅভ্যাস থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখার যেসব দাওয়াই তারা সমাজকে হরহামেশা উপহার দিয়ে থাকেন সেখানে ফাঁক ও ফাঁকিটা যে-কারণে বিকট দাঁত ভ্যাংচায়। উনাদের দাওয়াই আমলে নিয়ে বহু অভিভাবক যদিও বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ওপর নিজের হম্বিতম্বি মার্কা খাসলতে শান দিতেই থাকেন! অধম স্বয়ং এর বাইরে নই। পুত্রসন্তানকে সুরক্ষিত রাখার বিগারে মাঝেসাঝে তাকে যে-ভঙ্গিতে বকাঝকা করি অথবা তার সহজাত কৌতূহলকে নিয়ন্ত্রণ করতে মরিয়া হই, এমনধারা প্যারেন্টিং কতটা ফলদায়ক সে-কথা ভেবে মাঝেসাঝে হয়রান বোধ করি।
কোমলমতি পোলাপানদের কুতুহলে একরাশ নিষেধাজ্ঞা বা টাবু চাপিয়ে লাইনে আনা গেল ভেবে আত্মতৃপ্ত প্রাণীগণ আসলেই বিপজ্জনক। নিষেধাজ্ঞার বিকল্প হাজিরের নাম করে উল্টো সর্বাত্মকবাদী আচরণে শিশুদেরকে তারা অতিষ্ঠ করে মারেন। একটা বাচ্চাকে বিদ্যালয়ের পাঠে অধিক মনযোগী হওয়ার চাপ ও উপদেশ খয়রাত করা ছাড়া দ্বিতীয় কিছু তাদের ঘট থেকে বের হয় না। একখানা খেলার মাঠ, সবুজে নিকানো প্রকৃতির বাহার, সুস্বাদু বিবরণে মোড়ানো সাহিত্য, চমকপ্রদ কার্টুন-কমিক্স-ছায়াছবির সঙ্গে শিশুমনের চিনপরিচয় নিবিড় করার পন্থায় সমাজের এইসব গার্জেন গতানুগতিক পথে হাঁটাচলা করতে স্বস্তি বোধ করেন। না ইধার না উধার এরকম এক উভয়সঙ্কটের পাল্লায় পড়ে কচিকাঁচারা অগত্যা জবরজং প্রাণী রূপে বালেগ হয়। দূর ভবিষ্যতে নিজের বাচ্চাকাচ্চাদের ওপর গার্জেনদের শেখানো কায়দায় শত টাবুর পাহাড় তারা চাপিয়ে দেবে সেটা আর না বললেও চলে!
একটা পাবজিতে ঠাসা বিনোদনের চেয়ে গার্জেনদের নিষেধাজ্ঞা আরোপের এই প্রবণতা বরং আপদ ডেকে আনে। সমাজের ভালোমন্দ, সত্যমিথ্যা, আলোঅন্ধকারকে চিনতে পারার ঘটনায় বাচ্চামনে ফাঁকির পরিমাণ দিন-দিন হয়তো এ-কারণে অতিকায় আকার ধারণ করছে। বাচ্চাদের মধ্যে যারা এটা সইতে পারে না তারা বখাটে হয় ও উচ্ছন্নে যায়। ওদিকে যারা সহ্য করে তারা সর্বাত্মকবাদের দাস হয়ে দিন কাটায়। এই বাচ্চাদের দিয়ে আর যাই হোক সমাজকে নতুন চিন্তা ও সৃজনশীলতায় গড়াপেটা করা কভু সম্ভব নয়।
বাস্তব দুনিয়ায় যদি অনাচার, অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বিরাজ করে তবে মানুষের সংস্কৃতিচর্চায় এর প্রভাব-প্রতিপত্তি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সংস্কৃতির ওপর নৈরাজ্যটা কীভাবে পতিত হচ্ছে, কোন ভাষাকে সঙ্গী করে সে কথা বলতে চাইছে অথবা কী-কারণে এভাবে কথা বলছে ইত্যাদি লক্ষণকে সমাজের সত্যিকার চেহারা তুলে ধরার খাতিরে আলোচনায় টানা প্রয়োজন। এতে করে অন্তত এর লাভক্ষতি সম্পর্কে অভিভাবকরা পরিষ্কার ধারণা পাবেন। ফ্রি ফায়ার বা পাবজির ওপর দুম করে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে কী লাভ হচ্ছে সেটা অধম এইবেলা বুঝতে নাচার।
…
অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগবিশ্বে সেন্সরশিপের সুফল সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। আমাদের বাচ্চা বয়সের অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে উল্টো খাতে বইতে দেখেছি। গুরুজনদের টাবুতুল্য বিধান বালকমনের বিচিত্র কুতূহলকে শেষতক দমিয়ে রাখতে পারেনি। উনাদের চোখের আবডালে নীলছবি থেকে শুরু করে বিড়িভাং, হস্তমৈথুন ও নারীদেহের রসালো অলোচনার সবটাই বিদ্যালয়ে সুবোধ বালক আর মসজিদে সালাত আদায়ের সঙ্গে মোরা সমানে এস্তেমাল করেছি। এতে অনেকের ক্ষতি হয়েছে আবার অনেকে সবকিছু সামলেসুমলে নিয়মতান্ত্রিক সুস্থির জীবনধারায় ফেরত গিয়েছিল। একালে ব্যতিক্রম ঘটার কারণ দেখছি না!
বাচ্চাদের বিচিত্র কৌতূহল ও সংগোপন বাঁদরামির খোঁজ পেতে হলে হম্বিতম্বির পরিবর্তে তাদের সঙ্গে বাতচিতের জানালাটা খোলা রাখা জরুরি। গার্জেনরা খানিক সুবিবেচনার পরিচয় যদি দেন তাহলে কোন অভিজ্ঞতাটা কোন বয়সে বাচ্চার জন্য লাগসই তার পরিষ্কার ধারণা মনোবিদের সাহায্য ছাড়াই নিতে পারবেন। সেইসঙ্গে বাচ্চা পোলাপানরা কী করছে না করছে সেদিকে নেত্রপাত কঠিন ঠেকবে না। সমুচিত বয়সে পাবজির মতো খেলায় মেতে ওঠা মন্দ নয় কিন্তু অতিরিক্ত আসক্তি খারাপ; — ছোট্ট এই কথাটি বাচ্চাদের বুঝিয়ে বলা গার্জেনের দায়িত্ব। হাবজি গাবজির মতো ছবি বানিয়ে একালের শিশু সমাজের মোবাইল ও ভিডিও গেম আসক্তিকে ভয়ানক বিকার রূপে তুলে ধরা ও তাদের মনে ভয়সঞ্চারের ঘটনা বোধ করি ভুল বার্তাই পৌঁছায় সমাজে।
স্বনির্মিত ছবিটির ব্যাপারে পরিচালক রাজ চক্রবর্তীর কথাবার্তা বাঙালি দর্শককুলের প্রশংসা কুড়ালেও অধমের কাছে ক্লিশে মনে হয়েছে। ছবিতে মোবাইল ও ভিডিও গেমের কুফল ধরিয়ে দিতে সকলের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার চিরাচরিত অস্ত্রকেই পরিচালক হাতিয়ার করেছেন। সদ্য উন্মুক্ত ছবিখানার খবর করতে যেয়ে মনে হলো বাচ্চাদের মনে একরাশ ভয় কীভাবে পয়দা করা যায় এই ভাবনা পরিচালককে জ্বালাতন করেছে। জ্বলুনিটা পর্দায় ভালোভাবে তুলে ধরতে পারায় বিস্তর প্রশংসা জুটেছে কপালে। রাজের বরাত থেকে দর্শক জানতে পাচ্ছে, — বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে যেসব বাচ্চা ছবিটি দেখেছিল তারা এখন ভিডিও গেম দূরে থাক, মোবাইল হাতে নিতেও ভয় পাচ্ছে! গার্জেনরা এই ঘটনায় যৎপরোনাস্তি দিলখোশ! ভয় দেখানোর কাজে রাতদিন চেষ্টা করে তারা সফল হতে পারেননি। তাদের হয়ে রাজ কাজটি করায় সকলে খানিক হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন মনে হলো।
পরিচালকের এমনধারা কথাবার্তা বুঝিয়ে দেয় উদ্দেশ্য মহৎ বা যৌক্তিক হলেও বাচ্চাদের মনে ভয়, আতঙ্ক ইত্যাদি ঢোকানো ছাড়া মোবাইল এবং গেমআসক্তিকে নিরোধ করা সম্ভব নয় বলে তিনি ধরেই নিয়েছেন। বাবা-মায়ের দিক থেকে বাচ্চাকে বেশি করে সময় দেওয়ার জরুরি প্রসঙ্গটা ছুঁয়ে গেলেও ছবির আগাপাশতলা জুড়ে ভয় দেখানোর সপক্ষে তাঁর ওকালতি সব নষ্ট করে দিচ্ছে মনে হলো। ভাবছিলাম, রাজ চক্রবর্তীকে দোষ দিয়ে কি লাভ! বাঙালি জাতি শত হাজার ভয়ের গোলাম খেটে এদ্দুর বালেগ হয়েছে। রাষ্ট্র তাকে যখন-তখন ভয় দেখায়। ক্ষমতা ও টাকাওয়ালারা মওকা বুঝে ভয়ের ট্যাবলেট হাতে ধরিয়ে দিতে দেরি করে না। মোল্লা-পুরুতদের তো ভয়টাই আদি সম্বল। আর্মি-পুলিশ-গুণ্ডা-এমপি থেকে শুরু করে বুদ্ধি বিক্রেতা বিদ্যালয়ের মাস্টার, পাতি অথবা বোয়াল সাইজের নেতা কিংবা ত্যানা…সব্বাই এখানে এক বরাবর! এরকম হাজারবিজার ভয়ের খাঁচায় বন্দি বাংলার গার্জেনকুল নিজের অপোগণ্ড কাচ্চাবাচ্চাদের মোবাইল ও ভিডিও গেম থেকে বিরত রাখতে ভয়কে টোটকা ঠাউরাবেন সে আর বিচিত্র কি? রাজ চক্রবর্তী কাজটি সহজ করে দিলেন এই যা!
ঝরঝরে সিনেভাষায় বোনা ছবিটির ব্যাপারে বাঙালি গার্জেনকুলের গদগদ ভাব দেখে শিশুমনোবিদ্যায় (Child Psychology) একপাক ঘুরে আসার খায়েশ চেপেছিল। মনোবিদরা অধমের পছন্দের পাত্র না হলেও তাদের মানবমন বীক্ষণের আলাদা মূল্য রয়েছে সমাজে। সেই জায়গা থেকে নজর করলে হাবজি গাবজির সিনেভাষা একটা বাচ্চার ওপর দুভাবে ক্রিয়াশীল বলে ধারণা করি। মনে ভয় ঢুকে যাওয়াটা কোনো কারণে স্থায়ী মোড় নিলে দুর্বল স্নায়ুর বাচ্চা বাকি জীবন সেই ভীতি থেকে বেরিয়ে আসতে আপত্তি ও অপারগতা জানাতে পারে। তার মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ঘটনাটি মোটেও সুখকর কিছু নয়। অন্যদিকে সিংহভাগ বাচ্চা ভয়ের সাময়িক ধাক্কা দ্রুত সামলে নেবে আর মজাটা সেখানেই; — বাঁদরগুলো তখন মোবাইল ও ভিডিও গেম ব্যবহারের ঘটনায় খুল্লামখুল্লা হওয়ার পরিবর্তে ছুপা রুস্তমের ভূমিকায় নাম লেখাবে। লুকিয়েচুরিয়ে যত কাম তারা সারবে সেগুলো ভয়ভক্ত গার্জেনকুলের কাছে লাগাতার গোপন করতে থাকবে। হাবজি গাবজির সুবাদে এটা তাদের বেশ বোঝা হয়ে গিয়েছে বাপ-মায়ের কাছে মন খুলে কথা কইতে গেলে বিড়ম্বনা বাড়ে ছাড়া কমে না একটুও! ছুপা রুস্তমের পাঠশালায় নাম লেখানোটা এদিক থেকে বেশ সহজ ও নিরাপদ। রাজ তাঁর ছবিতে প্রাসঙ্গিক ভালো জিনিস তুলে ধরলেও বাচ্চা ও বাপ-মা দুজনেই খুশি হবেন এরকম বোঝাপড়া বা ভারসাম্যে গমনের সড়ক মনে হলো খোঁজার চেষ্টা করেননি।
মোদ্দা কথা, একটা বাচ্চা ফুটবলে লাথি মারবে, নিজেকে কর্মজীবনের যোগ্য করতে বিদ্যালয়ের সিলেবাস মন দিয়ে রপ্ত করার চেষ্টাও করবে, আবার তাকে সেই স্পেসটা সকলের দিতে হবে যাতে করে ভিডিও গেমের জগতে বানানো কল্পবিশ্ব সম্পর্কে অন্ধকারে পড়ে না থাকে। মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া বা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে বেশিদূর যাওয়া যাবে না। এগুলোর ওপর অত্যধিক আসক্ত হয়ে পড়ছে কি-না সেদিকে খেয়াল রাখা ও প্রয়োজনে খোলামনে তাকে বোঝানোটা বরং কাজ দিতেও পারে। স্মরণ রাখা উচিত মনে হয়, পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার জন্য রাতদিন একাকার করে বাচ্চার ওপর অকথ্য চাপ প্রয়োগ যেমন নৈরাজ্যের শামিল, লাগামছুট বকনা বাছুরের মতো ভিডিও গেম আর মোবাইল যন্ত্রের পিছনে পড়ে থাকাটাও সর্বনাশা। দুটোই সামাজিক উপযোগ থেকে জন্ম নিয়েছে বিধায় তাদের মধ্যে ভারসাম্য কীভাবে স্থাপন করা যায় তার সূত্রটা গার্জেনকেই খুঁজে নিতে হবে।
বাচ্চা বয়সী ছেলেমেয়েদের মেলামেশায় Bad Touch-র ঘটনা নিয়ে দুটো কথা বলে এই পর্বের আলাপে ইতি টানতে চাই। Bad Touch নামক ব্যাপারখানা গার্জেন ও বিদ্যালয়ের শিক্ষককুল কীভাবে সামলাবেন তার ওপর একটা বাচ্চার জীবনবোধের বনেদ ও বিকাশ নির্ভর করছে। ওটা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাবেন নাকি অন্য পথে ফয়সালা করবেন ইত্যাদি নিয়ে ভাবনার সময় নজদিক হচ্ছে দিন-দিন। তুলকালাম বাঁধানোর পরিণাম কেমন হয়ে থাকে তার ধারণা পেতে পাঠক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় নির্মিত হামি ছবিখানা ফাঁকতালে দেখে নিতে পারেন। হামি-র সিনেভাষা Bad Touch-র সমস্যাকে আমাদের দেশকালসমাজের সঙ্গে মিল করে বা সেখানে সক্রিয় মনোজগৎ মাথায় রেখেই পর্দায় তুলে ধরেছিল। বাচ্চাদের জগতে বড়োদের অনুপ্রবেশ (*আমরা অহরহ যেমনটা করে থাকি আর কী!) অতো সস্তা নয়, বহুত খাটনি ও বিচক্ষণতার প্রয়োজন রয়েছে সেখানে; — হামি ছবির সারকথাটি বড়োদের উপলব্ধি করা জরুরি মনে হচ্ছে।
…
যা-ই হোক, এইবার আরেক ধাপ আগে বাড়ি। ব্যাটল রয়্যাল ঘরানার Death Game রূপে পাবজিকে দাগানোটা আমার কাছে যৌক্তিক ঠেকেনি। বাচ্চারা আসক্ত হয়ে পড়ছে এরকম এক ভীতি থেকে এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় বহন করে না। জাপানি কার্টুন সিরিজ ডোরেমনকে দেশের সরকার বাহাদুর একদা ক্ষতিকর জ্ঞান করে সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা ঠুকেছিলেন। ডোরেমন দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি কার্টুনটি আদৌ বিষাক্ত ছিল না। টম এন্ড জেরি, পিনাকিও, মিস্টার বিন বা নিনজা হাতুড়ির মতো ধ্রুপদি কার্টুনের আবেদন সকল বয়সী দর্শকমনে আজো অমলিন। বুড়ো হতে চলেছি অথচ এখনো টম এন্ড জেরি বা মিস্টার বিন দেখতে বসে সহজে উঠতে মন চায় না!
মোদের বাল্যকালে হার্জের টিনটিন আর নারায়ণ দেবনাথের অমর সৃষ্টি নন্টে ফন্টে, হাঁদা ভোঁদা, বাটুল দ্য গ্রেট কমিক্সের বাইরে ভারতীয় কার্টুনের বালাই ছিল না। মার্কিন, ব্রিটিশ কিংবা জাপানিদের বাড়বাড়ন্ত ছিল তখন। অদ্য ভারতীয় কার্টুনটা বাচ্চাদের ওপর বেশ জাঁকিয়ে রাজত্ব করছে দেখতে পাই। মোটু পাতলু যেমন তাদের ভীষণ প্রিয় এখন। বয়ঃসন্ধিতে পা রাখার ক্ষণ ঘনালে বহু বাচ্চাকে এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখেছি। মোটু পাতলুকে নির্মাতারা একটা বিশেষ বয়সের উপযোগী করে সৃজন করায় এর আবেদনকে ওই বয়েসকালের সঙ্গে গড় করে ভাবা যুক্তিসংগত মনে হয়। শিক্ষাধর্মী হলেও মিনা কার্টুন আমরা স্বয়ং এক সময় প্রবল আগ্রহ নিয়ে দেখেছি। বাচ্চারা এখন যেমন সিসিমপুর-এ মজা পায় মোদের বয়সে মিনা কার্টুনের আবেদন সেরকম ছিল। সমাজকে সচেতন করে তুলতে সুচিন্তিত বার্তা জুড়ে বানানো মিনা কার্টুনের দ্বিমাত্রিক জগৎটা (2D Animation) আজো মন কাড়ে। বার্তাগুলোও কমবেশি অমলিন বটে! এগুলোর পাশে ডোরেমন-র মতো কার্টুনের প্রাসঙ্গিকতা ফেলনা ছিল না। খানিক ইঁচড়েপাকা উপাদান থাকলেও ডোরেমন রোবটের কীর্তিকলাপ একটা বাচ্চার মনে কল্পবিজ্ঞানের সৃজনশীল বনেদ ও মানবিক হয়ে ওঠার বার্তা ঠিকই রেখে যায়। পাবজির বেলায় কথাটি খানিক প্রযোজ্য মনে করি।
ফুকাসাকুর ছবির আদলে নির্মিত হলেও সিনেপর্দায় উপচে ওঠা এক্সট্রিম ভায়োলেন্স পাবজিতে প্রকট নয়। আত্মরক্ষার নানান ফন্দিফিকিরের বাড়াবাড়ি অধিক দৃষ্টে সেখানে। ষোল থেকে আটারোর কাছাকাছি বয়স্করা খেলাটি খেলতেই পারে এবং খেলছে দেখে গেল-গেল রব তোলার কারণ আছে বলে মনে হয়নি। আমার এক নিকট আত্মীয়ের কথা বলতে পারি। তার নওল কিশোর ছেলেটি পাবজিতে বুঁদ হলো দেখে তিনি চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। পাবজি খেলতে-খেলতে ছেলের মাথায় ওদিকে কী করে ভিডিও গেম বানানো যায় সেই খেয়াল চাপে। ওটা ছিল কেবল শুরু। ছেলে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (Artificial intelligence) ভাষা ও গণিত ব্যবস্থাপনা রপ্ত করার পথে অনেকদূর এগিয়েছে। গেম খেলাটা তার কাছে নিছক বিনোদন কিন্তু একে যেভাবে সৃজন করা হয় সেই রহস্যটা তার কাছে বিনোদনের অতিরিক্ত হয়ে ক্রমশ ধরা দিয়েছিল। সুতরাং ঘরপোড়া গরুর মতো আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখে আগুন লাগার শঙ্কায় দিশেহারা বোধ করা উচিত নয়।
ভিডিও গেমের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কিছুটাই হচ্ছে সৃজনশীলতা। এর পেছনে শত-শত লোক অমানুষিক খাটনি দিয়ে থাকেন। একজন লেখক গেমের কাহিনিটা ফাঁদেন সেখানে। কাহিনিকে কীভাবে জীবন্ত করা যায় নকশাকার তার ছক আঁকেন মনে-মনে। প্রোগ্রামার আবার নকশাকে কম্পিউটারের কাছে বোধগম্য করতে খেটে মরেন। সংগীতকার তার মধ্যে চমৎকার সংগীত ও আবহসংগীত কীভাবে জোড়া যায় সেটা নিয়ে ভাবনা করতে বসে যান। সমবায়ী এক সৃজনপ্রণালীর ভিতর দিয়ে অবশেষে গেমটা মোবাইল কিংবা মনিটরের পর্দায় জীবন্ত হয়। নিষেধাজ্ঞা আর নিন্দামন্দের রামদা হাতে কচুকাটা করার চেয়ে গেম তৈরির সৃজনশীল দিকগুলোকে বাচ্চাদের সামনে হাজির করা যেতে পারে।
হাজির-নাজিরের কাজটি বিদ্যালয় থেকে শুরু করে গার্জেনরাও অনায়াসে করতে পারেন। ফলাফল খুব একটা খারাপ হওয়ার কথা নয়। বাচ্চা তখন কেবল গেম খেলায় মত্ত না হয়ে এর রচিয়তা বা লেখক হতে চাইবে। গেমের নকশা আঁকার শখ চাপবে তার মনে। কম্পিউটারের কাছে যে-ভাষা দিয়ে নকশাটাকে বোধগম্য করা হয় সেদিকপানে গমন করার ইচ্ছা জাগতেও পারে মনে। সংগীত যদি ভালোবাসে তবে সুর সৃষ্টির ভাবনা তাকে উতলা করবে তখন। ওহে বাপধন, কম্পিউটার ভীষণ সৃজনশীল এক যন্ত্র; ওটাকে দিয়ে নান্দনিক ও নারকীয় সকল অভিজ্ঞতা সৃজন করানো যায়; — জরুরি এই বার্তাটি বাচ্চাদের কাছে চেপে যাওয়ার বদলে খোলাখুলি ব্যাখ্যা করাটাই অধিক ফলদায়ক হবে মনে হয়।
…
গেম খেলে মারা যাওয়ার প্রসঙ্গে আরো দু-চার কথা এইবেলা যোগ করি। Death Game-র বিভীষিকা ছড়ানোর বদনাম পাবজির চেয়ে রাশিয়ান ব্লু হোয়েল-র ওপর সম্ভবত অধিক বর্তায়। আত্মহত্যা করবে কি করবে না এরকম নাটকীয় পরিস্থিতি নাকি এর স্রষ্টা ফিলিপ বুদেইকিন (Philipp Budeikin) খেলাটির মধ্যে জুড়ে দিয়েছিল। আমাদের দেশে বাচ্চা বয়সী এক মেয়ের ব্লু হোয়েল খেলায় মজে আত্মহত্যার খবর বেরিয়েছিল কাগজে। ঘটনাটি নিয়ে যথেষ্ট তোলপাড় হয় তখন। মেয়েটির আত্মহননের সত্যমিথ্যা সম্পর্কে পরে বিশেষ জানার সুযোগ হয়নি।
গেম খেলে মরণ ডেকে আনার ঘটনা নিয়ে মুন্নী সাহা টকশোয় অঅলাপ জুড়েছিলেন। ব্লু হোয়েলের পঞ্চাশটি ধাপ একে-একে পার করেছে কিন্তু আত্মহত্যার ফাঁদে পা দেয়নি এরকম এক সদ্য যুবাকে তিনি টিভিস্ক্রিনের সামনে হাজির করেছিলেন। তার বিবরণটি বেশ নাটকীয় ছিল মনে পড়ে। খেলার শুরু থেকে অন্তে পৌঁছানোর প্রতিটি ধাপে মারা যাওয়া কিংবা গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ার আতঙ্ক নাকি তাকে তাড়া করে ফিরেছিল। সকল বাধা টপটে জয়ী হওয়ার জন্য মনের সঙ্গে দুর্মর লড়াই করতে হয়েছিল তাকে। একবার জিতে আসার পর ডরভয় কেটে যায়, যদিও দ্বিতীয়বার এই খেলায় ঢোকার ইচ্ছা নেই বলেই জানিয়েছিল। ব্লু হোয়েল খেলতে বসে মানসিক উদ্বেগ ও ক্লান্তি এতটাই অতিকায় হয় যে একে সামলে রাখা দুর্বল স্নায়ুর খেলোয়াড়ের পক্ষে কঠিন ইত্যাদি।
ব্লু হোয়েলের মতো ভিডিও গেমকে যে-তরিকা মেনে সৃজন করা হয় সেখানে জমাট রোমাঞ্চ সৃষ্টির বাহানায় নৈরাজ্যকে লাই দিয়ে মাথায় তোলার ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটে না এমন নয়। সকলের চোখের সামনে ঘটতে থাকা যেসব নৈরাজ্যকে নেতিবাচক ঠাউরে সমাজ ঢেকেঢুকে রাখতে তৎপর হয় সেগুলোকে গ্রাহ্য করার প্রবণতা ব্লু হোয়েল ধাঁচের খেলাকে অনেক সময় গ্রাস করে ফেলে। বাস্তবের পৃথিবীতে সংঘটিত হানাহানিকে থ্রিডি প্রযুক্তির মোড়কে সৃষ্ট বায়বীয় বিশ্বে তারা পুনর্জীবিত করে। পাবজি, ব্লু হোয়েল থেকে মাইনক্রাফ্ট অবধি সকল জনপ্রিয় ভিডিও গেমে সর্বাত্মকবাদী শৃঙ্খলাকে অস্বীকার যাওয়ার প্রবণতা কমবেশি চোখে পড়ে। এরকম সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রত্যাখ্যান করতে তারা মরিয়া থাকে নতুবা এর বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার নেশায় নিজেকে সহিংস করে খানিক। পাবজি বা ব্লু হোয়েলে ছলকে ওঠা নৈরাজ্য তা-বলে ফুকাসাকুর ব্যাটল রয়্যাল বা সায়ন সোনোর সুইসাইড ক্লাব-এ উঠে আসা সহিংসতার সমতুল শক্তিধর নয়। কথাটি খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
দেশবিদেশ সর্বত্র তরুণ প্রজন্মের ওপর রাষ্ট্র ও সমাজ মিলে অতিকায় যেসব চাপ আরোপ করেন তার পরিহাসমুখর দিকটা ব্যাটল রয়্যাল বা সুইসাইড ক্লাব-র গল্পে একঝাঁক বাচ্চাবয়সী মেয়ের ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহননের দৃশ্যে অমোঘ করা হয়েছিল। এমনধারা এক্সট্রিম ভায়োলেন্স-র তুলনায় পাবজি বা ব্লু হোয়েলকে নিরীহ মেষশাবক বলা যায়। অতদূর যাওয়ার ক্ষমতা সংগতকারণে ওইসব ভিডিও গেমের থাকবার কথা নয়, যেহেতু সমাজকে বিনোদনের অতিরিক্ত বার্তা পৌঁছানোর পরিসর সেখানে শেষতক বজায় থাকে না। দৃশ্যচিত্র নির্মাণের ধারা সহিংসতাকে ফান ভাবার মধ্যে নিজেকে নিঃস্ব করে। কারণটা রচনার প্রারম্ভিকায় আলোচনা করেছি, সুতরাং পুনারাবৃত্তি অনাবশ্যক।
রেসিডেন্ট ইভিল-র যুগ থেকে পাবজিযুগে পৌঁছে যাওয়া গেমশিল্পের জগৎকে প্রকৃত শিল্পকলার মিম (Mim) ভাবা যেতে পারে। সমাজকে নাড়িয়ে যাওয়া তার কাজ নয় বরং সমাজে যেসব অনাচার ও লুকোছাপার ঘটনা ঘটছে তার ওপর নিজের বায়বীয় বিশ্বকে সে স্থাপন করে ও আপাত বিনয়ভাব ধারণ করে সেখানে খানিক ভাঙচুর ঘটায়। গার্জেনদের হয়তো স্মরণ রাখা সমুচিত, গেম যে-খেলে সে কিন্তু জানে মারপিট, সহিংসতা ও ছলচাতুরিতে বোঝাই বায়বীয় বিশ্বটা মোবাইল বা মনিটরের পর্দায় ততক্ষণ সম্মোহন ছড়াবে যতক্ষণ সে ওটা খেলছে। খেলা সাঙ্গ হলে তাকে ফের ঢুকে পড়তে হবে চিরাচরিত গার্জেনদের জগতে, যেখানে তারা একটা পাবজি বা ব্লু হোয়েল খেলার অপরাধে রক্তচক্ষু ঘুরিয়ে তাকে বকাঝকায় সরব হবেন। তার এই সচেতন দ্রোহকে অগত্যা রক্তচক্ষু ঘুরিয়ে বেশিখন দমানো যাবে না। ফাঁকফোকর গলে গেমটা সে খেলবেই। আমার পুত্রধনকে এটা করতে দেখেছি তাই কথাটি বলা। বাচ্চারা বোকা নয়; — কথাটি আমরা সম্ভবত প্রায়শ ভুলে যাই। জাহাবাজ বাপ-মায়ের সঙ্গে ফাইটিংয়ে না গিয়ে লুকিয়েচুরিয়ে নিজের কুতূহল তারা পুরা করেই ছাড়ে।
বাচ্চাকাচ্চাদের জন্য এইসব খেলা কিছুটা হলেও রিলিফের যোগান দিয়ে থাকে। এর উপযোগ অমোঘ, কেননা গার্জেনরা তাদের হাতে মোবাইল বা কম্পিউটার যন্ত্রের বিকল্প ধরিয়ে দিতে ডাহা ফেল মেরে বসে আছেন অনেক আগে থেকেই। প্রচুর বাচ্চা বিশ্বে গিজগিজ করছে যাদের কপালে ফুটবলে লাথি মারা বা ক্রিকেট বলে সপাটে ছক্কা হাঁকানোর সুযোগ জোটে না। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে প্যাখপানি ছেনেছুনে মাঠে দুদ্দাড় দৌড়ানোর কপাল করে আসেনি অনেকে। তাদের জীবন বিদ্যালয় ও মোবাইল যন্ত্রের পর্দায় আটকা পড়েছে হয়ে গেল বহু বছর। চাপটা অন্যভাবে বাচ্চাদের কিছুটা হলেও দ্রোহী ও জেদি করে যায় মনে হয়। সংবেদনহীন করে কি? আতঙ্কে দিশেহারা হওয়ার পরিবর্তে প্রশ্নটি নিয়ে ভাবনা করা সত্যিই প্রয়োজন।
এইসব চক্করে পড়ে বোধহয় জাপান, কোরিয়া বা সুইডেনের মতো উন্নত দেশ বহুদিন ধরে উচ্চ-আত্মহত্যাপ্রবণ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও আত্মহত্যা নানাকারণে ব্যাপক। চট্টগ্রামের বাঁশখালি বা যশোরের কিছু এলাকা এক সময় উচ্চ-আত্মহত্যাপ্রবণ এলাকা হিসেবে সুবিদিত ছিল। দারিদ্র্য থেকে শুরু করে শত হাজার সামাজিক উপযোগ এলাকার লোকজনকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করত বলে শুনেছি। বিনোদনের উপকরণ ভিডিও গেমে এই দিকটা যদি কেউ তুলে আনে তাহলে সেটা উদ্বেগজনক হলেও নৈরাজ্যটা কী কারণে দাঁত বের করে হাসছে তার উত্তর খোঁজা ও সমাধানের রাস্তায় গমন করা অনিবার্য বৈকি। দুঃখজনক হলেও সত্য, রাষ্ট্র এইসব ব্যাপারে নপুংসক আর তার শিকলে বন্দি জনগণও তথৈবচ। তাদের এই নপুংসকতা এক্ষেত্রে বিপজ্জনক। একজন ফিলিপ বুদেইকিনকে ওটা কম্পিউটারে নৈরাজ্য ঘটাতে উসকানি দিয়ে যায়। রকমারি গার্জেন পরিবেষ্টিত সর্বাত্মকবাদী সমাজে একঘেয়েমিতে আক্রান্ত ও নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে থাকা বাচ্চা আত্মহত্যায় নিজেকে শেষ করার কথা হয়তো ভাবতে শুরু করেছে। বুদেইকিনের ব্লু হোয়েলকে এই সুযোগে সে লুফে নেয়। আত্মহননের ঝুঁকি থাকলেও ভিডিও গেমটা তাকে বোরডেম থেকে মুক্তি দিচ্ছে এই আশায় অতশত না ভেবে এর মায়াবী ভুবনে সে ঝাঁপ দিয়ে বসে।
লোকজনকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অপরাধে ব্লু হোয়েলের স্রষ্টা বুদেইকিনকে মাত্র একুশ বছর বয়সে জেলে পোরা হয়েছিল। পুতিনের দেশে জন্ম নেওয়া ছোকরা স্বয়ং মনোবিজ্ঞানের ছাত্র ছিল সেই সময়। যদিও তাঁর আউটলসুলভ কাজকারবারে অতিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয় তখন। ব্লু হোয়েলকে কী-কারণে এতটা ধ্বংসাত্মক করে সৃজন করেছে তার উত্তর সে এভাবে দিয়েছিল :
দুনিয়ায় মানুষ যেমন রয়েছে, মানুষ নামের জৈববর্জ্যও কম নেই। যে-আদমিরা সমাজে গোনায় আসে না, সমাজের ক্ষতি ছাড়া কিছু ঘটানোর এলেম তাদের নেই, ওইসব লোকের খপ্পর থেকে সমাজকে সাফাই করার কাজে নেমেছিলাম আমি।
প্রচণ্ড নিরাশায় আক্রান্ত বুদেইকিনের জবাব এইবেলা দ্বান্দ্বিক পরিহাসে ভরাট বলে মেনে নিতেই হচ্ছে।
…
সর্বাত্মকবাদী নিয়ন্ত্রণে সুস্থির দেশকালে এমন সমাজ খুঁজে পাওয়া ভার যেখানে মানুষ নামক সত্তা সত্যিই বিরাজ করছে! এর পরিবর্তে সমাজবদ্ধ একদল জীবের দেখা মিলবে যারা নিজের অজান্তে কমবেশি জৈববর্জ্যে রূপান্তরিত হয়েছে বা মহামান্য রাষ্ট্র তাদেরকে সেরকম ছাঁচে গড়াপেটার কামিলিয়াত হাসিল করেছেন। এই অপরাধের জায়গা থেকে দেখলে বুদেইকিনের মনোবিকারের কার্যকারণ বেশ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সমাজে তার জায়গা খুঁজে না পেয়ে সে হয়তো Death Game সৃজনের খেলায় মেতে উঠেছিল। তার এই নৈরাজ্য ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত হলেও বুদেইকিনের মতো তরুণরা দেশবিদেশে সকল যুগে এন্তার ছিল এবং এখনো রয়েছে। অগুন্তি সামাজিক অনাচারে আবিল দেশকালে ব্লু হোয়েল বা পাবজি এক ধরনের প্রতিরোধকামী বিকারকে নিজঅঙ্গে ধারণ করে; — পছন্দ না হলেও এর সত্যতা অস্বীকার করার জো নেই।
আদালতের নির্দেশে আপাত নিরোধ করা গেলেও ব্লু হোয়েল ঘরানার খেলার প্রতি বাচ্চাবয়সী ছেলেমেয়ের আকর্ষণে লাগাম টানা কঠিন। মাদক জীবননাশক জেনেও সমাজ কখনো ওটাকে পুরোপুরি নিরোধ করতে সফল হয়নি। দূর ভবিষ্যতে মাদকাসক্তি নিমূর্লের সম্ভাবনা শূন্য বলা যায়। গেল শতকের ষাট থেকে শূন্য দশক অবধি বিস্তৃত রক-পাঙ্ক-র্যাপ ধাঁচের গান গাইতে অভ্যস্ত এবং গানে মূর্ত জীবনধারায় লটকে থাকা যুবসমাজ সব জেনেবুঝেই মাদককে দেহে শোষণ করেছিল। মরণ নিশ্চিত জেনেও এমনধারা কাণ্ডে দলে-দলে ঝাঁপ দিতে তারা দ্বিধা করেনি। ঝাঁপ দেওয়ার কার্যকারণ তালাশ করতে নামলে মাদকসাক্তি নির্মূল না হওয়ার হেতু আপনাআপনি ন্যাংটো হয় সেখানে। ব্লু হোয়েলটাও সেরকম। অতিকায় অবিচারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা রাষ্ট্র ও সমাজে তার নৈরাজ্য যে-কারণে কভু নিঃশেষ হওয়ার নয়।
রাষ্ট্র যদি বাপ-মা হয় তবে তার প্যারেন্টিংয়ে গুরুতর সমস্যা রয়েছে; — সত্যটি স্বীকার করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রের ছায়ায় আকারে-প্রকারে যত প্যারেন্টিং সমাজে চালু রয়েছে তার কোনোটাই বাচ্চার নিজেকে ঠিকঠাক মানুষ ভাবার উপযোগ ধরে না। সুতরাং সিনেমায় যে-নৈরাজ্যটা ব্যাটল রয়্যাল বা এরকম শত-হাজার ছবি অহরহ সৃজন করে যায়, ওই অন্ধকার-প্রতিরূপতা অনলাইন ভিডিও গেমে ম্লান প্রতিবিম্ব রূপে আভাসিত হয়। এর জন্য গেমার্সদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগে বিচারকের উচিত রবি ঠাকুরের পঙক্তি স্মরণ করা। ঠাকুর বলেছিলেন, “দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।“ সর্বাত্মকবাদী যুগবিশ্বে গান্ধারীর আবেদন কবিতায় উচ্চকিত ঠাকুরবচন দুর্লভ জিনিসে পরিণত হতে চলেছে, সত্যটা এইবেলা অস্বীকার যাই কী করে!
পাবজি বা এরকম খেলার প্রতি বাচ্চা পোলাপানদের নেশাতুর আগ্রহকে প্রশমিত করতে সমাজের বরং এভাবে ভাবা প্রয়োজন, — খেলতে যখন চাইছে তবে খেলুক কিন্তু নেশাটা যেন একমাত্র ঘটনা হয়ে না দাঁড়ায় তার জীবনে। অতিরিক্ত আসক্তি স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর। এতে সময়ের অপচয় ঘটে। মাথাটা ক্রমশ ফাঁকা ও শূন্য হয়। বাচ্চাদের মোবাইল ও পাবজি আসক্তির মধ্যে ফারাক যৎসামান্য। দুটোই তাকে সঙ্গবিচ্ছিন্ন করার পাঁয়তারা কষে। পাবজিখেলায় নেশাতুর বালকের আর পাখি দেখা হয় না। গাছগাছালি দেখার শখ মরে যায়। সে এমনকি চারপাশের মানুষের দিকে তাকিযে দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অপার অজস্র মহাকাশে তাকানোর ক্ষুধা ও রুচি থাকে না আর! বায়বীয় বিশ্বে বসে অবিরাম শত্রুহননের খেলায় মেতে থাকার কারণে সমাজে বাস করেও সমাজবিচ্ছিন্ন সঙ্গীবিহীন নিদারুণ আবর্জনায় মোড় নেয় বালক। ভিডিও গেম খেলতে গিয়ে একটা-দুটো সুইসাইডের চেয়ে এই ক্ষতিটা বোধ করি অধিক মর্মন্তুদ!
ক্ষতি কীভাবে আটকানো যায় সেটা নিয়ে ভাবনার দায় সকলের কমবেশি রয়েছে। কথায়-কথায় নিষেধাজ্ঞার বোঝা চাপানো বালকমনে চাঙ্গা কুতূহলের পারদকে আরো চড়ায় তোলে। বাচ্চাদের সাথে সমাজের চাপা দূরত্ব তাই কমিয়ে আনতেই হবে। তাদেরকে নিছক বাচ্চা ভেবে অনবরত ধমকানো ও উপেক্ষা করা নতুবা আশকারা দিয়ে মাথায় তোলা…এইসব বদ খাসলত থেকে মহামান্য গার্জেনকুলের বেরিয়ে আসার জিহাদ মনে হচ্ছে নতুন ভাবনায় গমনের স্বার্থে অন্তিম হতে যাচ্ছে। পাবজি বা ব্লু হোয়েলটা তা-বলে তখনো নিকেশ হবে না। তারা থাকবে কিন্তু সমগ্রের অভিজ্ঞতায় বাড়ন্ত বাচ্চাকে বেশিখন আটকে রাখতে বিফল হবে। কম্পিউটারের বায়বীয় ভুবনে নতুন করে পাওয়া বিশ্বের প্রতিরূপতা সৃজনের খেলা বরং তাকে অধিক টানবে সেদিন।
বর্তমানে দাঁড়িয়ে এই আশাবাদ অবান্তর হলেও অযৌক্তিক নয়। গার্জেনরা নিজের সর্বাত্মকবাদী আচরণকে কতটা বদলে ফেলবেন বলে ঠিক করছেন তার ওপর অদ্য এবং আগামীর বাচ্চাদের ভূতভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এছাড়া ভারসাম্যে ভর দিয়ে মাটি-আকাশ-নদনদী আর তারকাখচিত ওই মহাবিশ্বের সঙ্গে তার যোগ-সাধন হবে না। ঘরের কোণে লতানো ছোট্ট লতিকা ও পিঁপড়েসারি দেখে নিজেকে সবকিছুর অংশ ভাবতে পারার পুলক জুটবে না কপালে। গার্জেনরা যদি নিজেকে পাল্টাতে ব্যর্থ হন তাহলে বাচ্চাদের গেমের জগতে বিষপুষ্প ফুটলেও হরিৎবরণ চিরপুষ্পের দেখা মিলবে না কোনোদিন।
লেখকের মেইলঠিকানা : qminhaj@gmail.com
আহমদ মিনহাজ রচনারাশি
তাৎক্ষণিকামালা
- ভোটবুথ, ভূতভোট, বজরঙবলি ও বেবুন - November 26, 2024
- ক্বারী আমীর উদ্দিন সান্নিধ্যে সেদিন || তারেক আমিন - November 20, 2024
- পোয়েট ও তার পার্টনার - October 19, 2024
COMMENTS