পুরনো লোক-উৎসবগুলোর ভিতরে একটি হচ্ছে চড়ক। মূলত চড়ক পূজার সময় এই উৎসবটা হয়। এই উপলক্ষে মেলা বসে। ব্যাপক জনসমাগম হয়। শিবের ভক্তরা শারীরিক ক্লেশ তুড়ি মেরে ভক্তিপ্রকাশক হরেক প্রকার খেলা দেখায়। পাব্লিকের মনে ভাবের উদয় হয়, পাব্লিক ভগবানসৃষ্ট ভক্ত-ভাবোন্মত্ত মনুষ্যের মাহাত্ম্য বুঝতে পারে, শিহরিত হয় বেদনার বেদান্ত উল্লাসে।
এই চিত্রটা বাংলাদেশে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কমন দেখা যায় যে চড়কের পূজাটা জাঁকজমকের সঙ্গেই হয়। বিশেষভাবেই কৃষিনিষ্ঠ সুবিশাল বাংলার গ্রামান্তরে এই পূজা আজও বড়সড় সমাবেশ একটা। মাধবেশ্বর লর্ড শিবকে এবং শক্তিকে এই পূজার মধ্য দিয়া সন্তুষ্ট করার চেষ্টা চলে। এর একটা আত্মিক আবেগের দিক যেমন আছে, তেমনি আছে একটা আর্টের দিকও। শরীরকসরতমূলক ক্রীড়া বা অ্যাক্রোব্যাটিক্সের একটি নিদর্শন এই পূজাকালীন মেলায় শারীরিক কসরত দেখানোর খেলা।
আরও লম্বা আছে অবশ্য উপাসনা-আরতিনিবেদনের প্রোসেসটা। ফাস্টিং করেন ভক্তপূজারীরা। মানে, রোজা রাখেন। সকাল-সন্ধ্যা আহারান্ন গ্রহণ থেকে নিজেদেরে বিরত রাখেন। মুসলমানদের রোজার সঙ্গে এই রোজার মিল-বেমিল দুনোটাই আছে। এই রোজাকালে কেবল ফলফ্রুট খাওয়া যায়। এক্সট্রিম ফিজিক্যাল কষ্টটা ধারণ করতে হয় নিজের শরীরে, তবেই শিবের শিবত্ব বোধগম্য করার দিকে একপা আগানো সম্ভব হতে পারে। এইসময় নানান ব্রত গ্রহণ ও পালন করেন পূজারী ধার্মিকেরা।
গাজনও বলা হয় এই উৎসবটাকে। গাজনের মোচ্ছব, গাজনের মেলা। গাজনের বিচিত্র সব গান আছে। সেসবের লিরিকেও বাংলা গানের একটি ঋদ্ধ পরম্পরা ধরা। শিবের প্রতি ভক্তি, শক্তির আরাধনা, শিবচরিত্রের মাহাত্ম্য বর্ণনা আর শিবশক্তি বন্দনাই লিরিকের মূল কন্টেন্ট। চড়কে বা গাজনে যে-একধরনের নাচ হয়, সাহসী শিবসুন্দর পুরুষের দর্পহীন দাপটের যে-প্রদর্শনলীলা আমরা দেখি, এই জিনিশের তুলনা হয় না। আফ্রিকার ঘন-অরণ্যভূমিলগ্ন মানুষের কার্নিভ্যালের সঙ্গে এই শিবশক্তিবিশ্রুত উৎসবের তুলনা টানা যায়। এই চড়কের উৎসবের সঙ্গে মুসলমানদের একটা সেক্ট শিয়া সম্প্রদায়ের মুহররম পালনের ইভেন্টটাকে মিলিয়ে দেখলে একটা আলাদা পাঠকোণ আলাদা অবলোকনের দেখা পাওয়া যায়। সাধারণত চৈত্রসংক্রান্তির দিনে বা বৈশাখের পয়লা দিনে এই চড়ক অনুষ্ঠিত হয়।
এই নিবন্ধের মূল উপজীব্য চড়কের কিছু ফোটোগ্র্যাফ। মোটেও অনুষ্ঠান-কাভার-করা সাংবাদিকী ইমেইজ এগুলো নয়। ফেঞ্চুগঞ্জের একটা গ্রামের চড়কের পূজার মেলায় তোলা আলোচিত্র এগুলো। সিলেট শহর থেকে ফেঞ্চুগঞ্জের এই গ্রামটা মাইল-পঁয়তিরিশের বেশি নয়। এই চড়কের একটি বিশেষ ফিচার হচ্ছে এ-ই যে এখানকার পূজারীরা শারীরিক কসরতক্রীড়া ছাড়াও মুখরঞ্জনী বিদ্যায় দড়। উৎসবের আদিম লতাগুল্মময় রেখায়-রঙে নকশায়-নৈসর্গিকতায় নিজেদেরে রাঙিয়ে ভগবান শিব ও শক্তির সামনে তারা তাদের নৈবেদ্যটা রাখেন।
এই চিত্রাবলোকনভিত্তিক ছবিনিবন্ধে ফেঞ্চুগঞ্জের অটল-প্রত্যন্তা গ্রামের একটি চড়কোৎসবের কয়েকটি ঝলক শুধু দেখা যাবে। এই স্থিরচিত্রগুলো ধারণ করা হয়েছে বেশি আগে নয়, আবার অত সম্প্রতিও নয়, সাত-আট বছর আগে। ২০১৩-র আগে তো অবশ্যই। কিছু মুখাবয়ব দেখেই নির্দিষ্ট ওই গ্রামের চড়কের আলাদাত্ব ও উৎসবমুখরতা আন্দাজ করা যাবে আশা করি।
নিচের গ্যালারিতে দেখে নেয়া যায় একগুচ্ছ বর্ণাঢ্য মুখচ্ছবি। ক্লিক করলেই ইমেইজগুলোরে এনলার্জ করে দেখাবে।
প্রণবেশ দাশ ফোটোগ্র্যাফিগুচ্ছ : চড়কের চোখমুখ
… …
- খোন্দকারের রচনাসংগ্রহ || প্রণবেশ দাশ - June 16, 2024
- ছবিনিবন্ধ : চড়ক || প্রণবেশ দাশ - April 13, 2019
- ছবিনিবন্ধ : পণাতীর্থ || প্রণবেশ দাশ - April 5, 2019
COMMENTS