স্মৃতিগন্ধা রুমাল || সানজিদা শহীদ

স্মৃতিগন্ধা রুমাল || সানজিদা শহীদ

কড়াইতে গরম তেলে পিয়াজ, আদা, রসুন ছেড়ে দেই — ফসফস শব্দ হতে থাকে, ছড়িয়ে পড়ে মসলার সুঘ্রাণ চারদিকে আর আমি চলে যাই আমার অতীতে।

খুব ছোটবেলায় বাবার পোস্টিং হলো যশোরে। আমরা রাজশাহী থেকে রেলগাড়ি চেপে এসে নামলাম সম্পূর্ণ নতুন একটা শহর, — যশোরে। আমরা একটা ছোটখাটো মোটামুটি মানের বাসায় উঠলাম, ভালো বাসা পাইনি আর যশোরে সবকিছুর অনেক দাম।

আমাদের বাসার পিছনে বিশাল জায়গা জুড়ে ছিল বনজঙ্গল, বাঁশঝাড়; মাঝখানে কিছুটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে বউচি খেলার জন্য দাগ কেটে রাখা ঘর, আর ছিল কয়েকটা বড় বড় পাথর — বসার জন্য। আমি পথের পাঁচালীর নায়িকা দুর্গার মতো একা একা ঘুরে বেড়াতাম এই জঙ্গলে। বর্ষায় জঙ্গলের বিশাল জামগাছ থেকে টসটসে জাম পড়ে জঙ্গল ভরে থাকত, আরো ফুটত নাম-না-জানা কত জংলী ফুল।

মার শরীরে তখন অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে আমার ছোটবোন। উনার কাজ করতে কষ্ট হতো। উনাকে সাহায্য করত আমাদের বাসার সহকারী রোকেয়া খালা।অসম্ভব আদর করতেন আমাকে, বকাও দিতেন আমি জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাম দেখে। একদিন সন্ধ্যায় দেখলাম, মা ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছেন, শুয়ে আছেন। আমি যেয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাবা মসজিদে গিয়েছিলেন নামাজে, ফিরতে দেরি করছিলেন। পাশের বাসার কাকা-কাকী মার অবস্থা দেখে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করে ফেললেন। কি হচ্ছে সেই সময় আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। শুধু সকালে হাসপাতালে যেয়ে দেখলাম, কাপড়ে মোড়ানো একটা ছোটবাচ্চা। সবাই বলল — এটা তোমার বোন, ফুলের বাগান থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে তোমার বাবা-মা। আমার ছোটবোন যে-ক’দিন যশোরে ছিলাম, রোকেয়া খালার কাছেই বড় হয়েছে।

আমাকে বাসার কাছেই একটা স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করানো হলো। স্কুলের বয়স্ক হেডস্যার চোখে সুর্মা দিতেন আর কাবুলি ড্রেস পরতেন। স্কুল ছুটির পরেও উনি আমাকে আলাদা ইংরেজি পড়াতেন ক্লাসের বাইরের কঠিন কঠিন বই থেকে। উনি আমাকে খুব আদর করতেন।

আমাকে প্রাইভেট পড়াতে আসতেন আবুবকর স্যার। স্যার দেখতে মোটেই সুন্দর ছিলেন না, হাসলে উপরের পাটির উঁচু দাঁত বের হতো, কিন্তু উনি অসম্ভব বিনয়ী এবং লাজুক ছিলেন। মাথা নিচু করে থাকতেন। আমাকে আদর করে ‘মুনী’ ডাকতেন।

আমার মনে পড়ে বাড়িওয়ালার ছোট প্রতিবন্ধী ছেলেটার নাম ছিল নীলু। আমি নীলুমামা ডাকতাম, বয়স ২৫-৩০ হবে। সারাদিন উনার মুখের লালা বেয়ে জামাকাপড়, শরীর মাখা থাকত, উনি কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু আমি যেবার ফার্স্ট হয়ে ওয়ান থেকে টুতে উঠি উনি আমাকে ঘাড়ে চড়িয়ে পুরো পাড়া চক্কর দিয়ে এসেছিলেন খুশিতে, কোনো-এক বিচিত্র কারণে উনিও আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন।

মাঝেমধ্যে ওখানকার গুন্ডাবাহিনীর প্রধান বাবু তার দলবল নিয়ে পালিয়ে, পুলিশের তাড়া খেয়ে আমাদের বাসার পিছনের জঙ্গলটায় পাথরগুলোর উপর এসে বসে থাকত, তার সাথের লোকজনের হাতে সূর্যের আলোয় চকচক করত নানা অস্ত্র। আমি পিছনের খিড়কির দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতাম। মাঝেমধ্যে গুন্ডা বাবু বাসার ভিতর এসে পানি চাইত, আমার গাল টিপে আদর করে দিত।

রাস্তার ওপারে অনেক দূর থেকে খেলতে আসত তারা-কটেজের মুক্তা, আর কয়েক বাসা পরের লিখন। মুক্তা এখন দুই বাচ্চার মা, পুরোদস্তুর গিন্নী। আর লিখন বুয়েট থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্টের উপরে ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করে বউ নিয়ে আমেরিকায়, পোস্টগ্রাজুয়েশন করছে।

আজকাল বড্ড সেই মানুষগুলোকে দেখতে ইচ্ছে করে। হেডস্যার হয়তো বেঁচে নেই। আবুবকরস্যার, নীলুমামা, গুন্ডাবাবু, মুক্তা, লিখন…সবাইকে। কেমন আছে মানুষগুলো? ফিরে যেতে ইচ্ছা করে আমার শৈশবের সেই যশোরে, সেই বনজঙ্গলে …

কেন বারবার এত স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি আজকাল? কেন স্মৃতির ঝাঁপি খুললেই সব দৈত্যদানবগুলো বের হয়ে এসে আমাকে নস্টালজিক করে দেয়?

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you