বনজুঁই ঘুমিও না ৬ || নিবেদিতা আইচ

বনজুঁই ঘুমিও না ৬ || নিবেদিতা আইচ

স্বপ্ন স্বপ্ন ঘ্রাণমাখা একটা বাড়ি। বাড়িতে একটি মাত্র ঘর। ঘরের চার দেয়ালে চারটি জানালা। জানালাগুলোর কপাট মেলতেই এক একটা দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। এক জানালায় বসন্তের বাউরি হাওয়া, আরেকটিতে বৃষ্টির ছাট। বাকি দুটোর একটিতে শারদ মেঘ ভেসে আসে, অন্যটির শার্সি মেললেই তুষারপাতের ছবি। যখন ক্ষুদে ছিলাম তখন এই গল্পটা খুব প্রিয় ছিল। জীবন যদি শৈশবের গল্পগুলোর মতো হতো তবে ইচ্ছের জানালাগুলো খোলা যেত যখন তখন।

এই গল্পগুলো ফুরিয়ে গেছে কবেই৷ আমি তবু ঘরের জানালা খুলি। ঘর তেমন আগের মতন ঝকঝকে, নিকানো নয়। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে তার। তবু জানালা খুলে দেখি বউটুবানির পাপড়িরা হাওয়ায় ভাসছে। তার সাথে দুয়েকটা ফিঙে পাখিও এদিক ওদিকে উড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে কোনো এক কালে ফিঙেরা এসে বসতো কাপড় শুকানোর তারে।

ঐ বৃষ্টি নামলো, শিগগির কাপড় তুলে আন্।

মায়ের ডাক শুনতে পেলেই আমি পুতুলের বাক্স রান্নাবাটি ফেলে দিতাম একছুট! কাপড় তোলার নাম করে খানিকটা ভিজে নিতাম।

তখন ছিল ঘরের সাথেই ছাদ।

দুই ঘরের বাসা, মাঝে একটা বাথরুম। মায়ের ঘরের দরজা বরাবর আরেকটা আলাদা ঘর, তার ছাউনিটা টিনের। সেটাই মায়ের রান্নাঘর। দুপুরে সেখানকার কাজ শেষ হলে ডাক পড়ত আমার। বসার ঘর যেটা আবার আমার আর মেঝো বোনের শোবার ঘরও ছিল, সেখানে খাবার টেবিলে ভাত তরকারি সব রেখে আসতে হতো। বেড়ালের উৎপাতে রান্নাঘরে কিছু রাখবার জো ছিল না বলে এই ব্যবস্থা।

তখন আমরা বাগিচাগাঁও এলাকায় থাকি। ডায়াবেটিস হাসপাতালের ঠিক উল্টোদিকে৷ চারতলার ছাদের সাথে লাগোয়া দুইরুমের বাসাটা অন্যরকম সুন্দর ছিল। ছাদের রেলিঙ বাবার গলা অব্দি উঁচু। বাইরে কী হচ্ছে দেখতে হলে ইটের খোপে পা দিয়ে আমাকে বেয়ে উঠতে হয়। রাস্তায় পরিচিত মুখ দেখতে পেলেই চেঁচিয়ে ডাক দিই নাম ধরে। এটা খুব মজার কাজ মনে হতো তখন। ছাদের আরেক প্রান্তের রেলিঙে চেপে বসলে দেখা যেত আমার স্কুল। এই স্কুলে ভর্তি হবার আগ পর্যন্ত আমার নাম ছিল মৃত্তিকা। বন্ধুরা নামের অর্থ জানতে পেরে অযথাই খ্যাপাতো। বাসায় ফিরে মনখারাপ করতাম। আমাকে খুশি করতে নামটা বদলে দেয়া হলো। তখন ভাবতাম মাটি বোধহয় খুব তুচ্ছ কিছু। এখন বুঝি মাটির মতো নির্লিপ্ত আর কিছু হয় না। কত অতল যাতনা সে বুক পেতে নিজের ভেতরে নিয়ে নিতে পারে, নির্জন ফসিল করে রাখতে পারে দীর্ঘকাল।

এত গভীর করে ভাবতে না জানলেও সে-বয়সে মাটির একটা তাৎপর্য আবিষ্কার করেছিলাম আমি। হাতে কিছু পেলে তা নিয়ে খুব পরীক্ষানিরীক্ষা করবার স্বভাব ছিল আমার। তাই পড়ার টেবিলে বইখাতার পাশে ছুরি কাঁচি আইকা এসবও থাকত। মনে আছে রংপেন্সিলের খোসা দিয়ে ফুল বানিয়ে কাগজে বসাতাম। দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে তৈরি করতাম ডালপালা। তখন ঈদ, জন্মদিন এসব উপলক্ষে বন্ধুদের কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর চল ছিল। আর্টপেপারে নানারকম হরফে ঈদ মোরাবক, শুভ জন্মদিন লিখে কার্ড বানানোর বাতিক ছিল আমার। নখ আর আঙুলে আইকা, রং এসব লেগেই থাকত। সত্যি বলতে ক্রাফটিং-এর নেশা যাদের তারা জানে যখন যে আইডিয়াটি মাথায় আসে তা তক্ষুণি করে না ফেলা অব্দি এর থেকে নিস্তার নেই।

আমার মনে আছে তখন আমি মোম দিয়েও খেলতাম। মোম গলিয়ে তা দিয়ে ফুলদানি, পুতুল সহ যেমন-ইচ্ছে-তেমন মিনিয়েচার তৈরি করতাম। মাঝেমাঝে বাটিতে জল নিয়ে তার উপর জ্বলন্ত মোমবাতি কাত করে ধরে রাখতাম। ফোঁটায় ফোঁটায় গলন্ত মোম জলে পড়তেই চুমকির মতো শেইপ তৈরি হতো। এই মোমের চুমকিগুলি সুতায় ভরে মালা বানাতাম। পুতুলবিয়ের আয়োজনে এমন খাটনি হতো আমাদের।

তখন খুব পুতুল খেলার নেশা ছিল। দুইতলায় মায়ের এক বন্ধু ছিলেন যিনি সেলাই করতেন। তার কাছ থেকে টুকরো কাপড় এনে পুতুলের শাড়ি বানাতাম আমি। মনে আছে একবার পুতুল বিয়ের নাম করে যত্নে তুলে রাখা মায়ের শাড়িতেই চুপিচুপি কাঁচি চালিয়েছিলাম। এত সুন্দর নীল জরিপাড় ছিল শাড়িটা। সেই কীর্তি মা টের পেয়েছে বেশ কিছুদিন পর। আর আমার পিঠে কী কী ভেঙেছে সেসব আর না-ইবা বলি।

মাটির গল্পে ফিরি। আমি কাদামাটি দিয়ে খেলতাম। মায়ের বরাবরই গাছপালার শখ। তাই ছাদজুড়ে ফুলের টব ছিল অনেকগুলো। সেখান থেকে মাটি পেতাম। তাছাড়া বাসার ঠিক পাশে ছিল একটা পরিত্যক্ত মাঠ। সেখান থেকেও যখন-ইচ্ছা মাটি আনা যেত। মাঠ থেকে মাটি আনতে গিয়ে জলভরা বাটিতে ব্যাঙাচিও নিয়ে আসতাম কখনো। এসবই করতে হতো মায়ের নজর এড়িয়ে। কারণ ধরা পড়লে তক্ষুণি ফেলে দিয়ে আসতে হতো সব ছাঁইপাশ। মায়ের চোখে সবই ছাইপাঁশ ছিল।

হাতের তালুতে মাটি নিয়ে নানারকম মুখের আদল তৈরি করতে ভালো লাগত আমার। রাজা, রাণী, রাজকন্যার মুখ তৈরি করতাম। কখনো নিজের আদল চেষ্টা করতাম। থালাবাসন, হাড়িকুড়ি এসবও বানাতাম। খেলার জন্য একটা মাটির চুলা এনে দিয়েছিল মায়ের সাহায্যকারী মহিলাটি। দুপুরে মা ঘুমালে মাঝেমাঝে সেই চুলায় আগুন ধরিয়ে রান্নার চেষ্টা করতাম আমরা। মা আসছে টের পেলে ত্রস্ত হাতে সব লুকিয়ে ফেলতে হতো।

মেঝো বোনের খুব হাসির বাতিক ছিল৷ এমন সঙ্গিন অবস্থায় সে কখনো আমাকে সাহায্য তো করতই না বরং হাসতে হাসতে অদ্ভুত ভঙ্গিতে মাটিতে গড়াগড়ি খেতো। তাতে যে ওর কাপড়ে ময়লা লাগছে তার জন্যও কিন্তু জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতাম আমি। এসব কারণে ওকে খেলায় নেবার অনেক হ্যাপা ছিল। বরাবরই নানাভাবে জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে সে আমাকে বেকায়দায় ফেলত। কানামাছি বা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে গিয়ে ব্যথা শুধু ওরই পেতে হতো। তাতেও দোষটা হতো আমার। স্কুলের অনুষ্ঠানে বেড়াতে গিয়ে আমার গানের পর তারও একটা গান গাওয়া চাই। এই যে জোর করে স্টেজে ওঠা তাতে বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্র তো আমাকেই হতে হতো। তবে খালিগলায় গান শুনিয়ে সে সবাইকে মাতিয়েই আসতো।

মনে পড়ে স্কুলে সপ্তাহে একদিন কি দু-দিন আমাদের গানের ক্লাস হতো। সেই ক্লাস ছিল খুব আনন্দের। গানের দিদি হারমোনিয়ামে গান বাজাতেন। আমরা সবাই গলা মেলাতাম। ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে, মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ’, ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’, ‘ওরে গৃহবাসী’। তবে আমার তখনকার প্রিয় গান ছিল ‘বাবা বলে গেল আর কোনোদিন গান করো না’। বাসায় ফিরে সমস্ত গান হারমোনিয়ামে তুলে ফেলতাম আমি। গান গাইবার চেয়ে সুর তোলার দিকে আগ্রহ ছিল বেশি। মাঝেমাঝে আমাদের বাসার ছাদে জ্যোৎস্নার আলোয় বসে গান গাওয়া হতো। ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’, ‘ও আমার চাঁদের আলো’ এসব ছিল সে-সময়ের সবচেয়ে উপযুক্ত গান।

এই ছাদে বৃষ্টি এলে আমি ছাতা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। তীর্যক ফোঁটা এসে ছিটকে পড়ত মাটিতে। তার ছাট এসে লাগত হাঁটু অব্দি। মাঝেমাঝে মায়ের মন ভালো থাকলে সবাই স্নান করতাম বৃষ্টিতে। মায়ের গান সুরেলা। বৃষ্টি এলে ‘ছায়াবীথি তলে এসো, করো স্নান, নবধারা জলে’ এই গান গুনগুন করত মা।

মায়ের প্রিয় শিল্পী সাগর সেন, চিত্রা সিং, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। প্রায় প্রতিদিন দুপুরে তাদের গানের ক্যাসেট বাজত ঘরে। ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’, ‘রোদন ভরা এ বসন্ত’, ‘মধুর বসন্ত এসেছে’, ‘প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’, ‘দুটি মন আর নেই দু-জনার’, ‘মনে করো যদি সব ছেড়ে হায়’ এসব গানের লাইন আমার মুখস্থ ছিল। ‘তুমি কি এখন দেখিছো স্বপন’, ‘এনেছি আমার শত জনমের প্রেম আঁখিজলে গাঁথা মালা’ সহ আরো কিছু গানও ছেঁড়াছেঁড়াভাবে মনে পড়ে।

নিচতলায় গানের স্যার থাকতেন সপরিবার। স্যারের নামটি আজ আর মনে নেই। তার কন্যা, যাকে আমরা চঞ্চুদিদি বলে ডাকতাম, সে সংগীতে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। সপ্তাহে দু-দিন স্যারের বাসায় গান শিখতে যেতাম। ‘মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে’ — আমার মনে আছে তার কাছে এ-ই ছিল প্রথম রবীন্দ্রসংগীত শেখা।

এখানে খুব অল্প কিছুদিন একটা আর্টস্কুলে ড্রয়িং শেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। মায়ের সাথে যেতাম। আমার মনে আছে কী চমৎকার একটা সবুজ রঙের মাঠে খোলা আকাশের নিচে বসে ক্লাস করতাম। একদিন প্যাটার্ন শিখছিলাম আমরা। স্যার বললেন তোমার খাতাটা নিয়ে এসো তো। খাতা নিয়ে এলাম আমি। সেদিন স্যার বেশ কিছুক্ষণ নানারকম প্যাটার্নের ধারণা দিয়েছিলেন আমাকে। মনে আছে কুমিল্লা ছেড়ে চলে আসবার সময় একটা চমৎকার বই উপহার পেয়েছিলাম তার কাছ থেকে। প্র‍থম পাতায় তারচেয়েও চমৎকার আর নান্দনিক হরফে আমার প্রতি আশিস জানিয়েছিলেন তিনি। স্যারের নামটি আজ মনে করতে পারছি না। বহুদিন যত্ন করে রেখেছিলাম তার দেয়া উপহারটি। শহর বদলাতে বদলাতে কবে কোথায় যে হারিয়ে গেছে সে আর এখন জানি না।

এমন অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে স্থান বদলের সাথে সাথে। তবে সমস্তকিছুর একটা নির্যাস কিন্তু থেকেই যায় দীর্ঘদিন, ছেলেবেলার মেয়েবেলার সেই লাল শালুকের ঘ্রাণ ভাবনায় দুলতে থাকে একটু পরিচিত হাওয়ার সুবাস পেলেই।

প্রচ্ছদচিত্র : অসীম দাস

… …

নিবেদিতা আইচ

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you