বনজুঁই ঘুমিও না ৪  || নিবেদিতা আইচ

বনজুঁই ঘুমিও না ৪  || নিবেদিতা আইচ

হোমনায় যখন বাবার পোস্টিং তখন আমরা অফিসার্স কোয়ার্টারে থাকতাম। বোধহয় দোতলা কি তিনতলায়। বারান্দায় গ্রিল ছিল না। আর আমি টপাটপ খেলনা ফেলে দিতাম নিচে। পরে আবার সেগুলো তুলে আনতে হতো। ওটাও একটা খেলা ছিল। খেলনা তুলে আনার নাম করে একবার বের হতে পারলেই মজা। পুরো কলোনি ঘুরেটুরে তারপর বাসায় ফিরতাম। তখন বোধহয় মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছি। স্কুলের নাম হোমনা প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাসা থেকে বেশ দূরে ছিল স্কুল। বাবা দিয়ে এলে মা নিয়ে আসত বা কাউকে পাঠাত। মাটির রাস্তা ছিল। আমি দুয়েকদিন একা-একাও চলে এসেছি বাসায়। মনে আছে মাটির রাস্তায় থপথপ পা ফেলে হাঁটতাম।

বাসায় ফিরলে আর সময় কাটতে চাইত না আমার।আমাদের পরিবারে তখন মাত্র তিনজন। আমি, মা আর বাবা। দুপুরে ঘুমাতে না চাইলে মা চোখে কাঁচামরিচ ঘষে দেবে বলত। ছুটে বিছানায় যেতাম তখুনিই। তারপর মা ঘুমিয়ে পড়লে চুপিচুপি আবার বারান্দায় গিয়ে বসতাম।

একা একা খেলতাম। খুব একঘেয়ে লাগত। মা ঘুমালে বা কোনো কাজে ব্যস্ত থাকলে তার চোখে ধুলা দিয়ে দরজা খুলে পালাতাম। এটা প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা ছিল। আমার বিচরণের জায়গা ছিল অনেক। নিচতলার বাসায় খুব প্রশ্রয় পেতাম। পাশের বিল্ডিঙে ইভা/রিভা নামে একটা বন্ধু ছিল। ওর সাথেও খেলতাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। ফিরেই মাতৃপ্রসাদ হিসেবে পিঠে কিল আর কানমলা জুটত। কারণ আমাকে খুঁজে বাসায় ফিরিয়ে আনা ছিল আরেক হাঙ্গামার কাজ। যেসব বাসায় খুঁজতে পাঠানো হতো আমি তাদেরকে আগেই সুপারিশ করে রাখতাম — বলবে আমি কিন্তু নেই এখানে।

বিশাল মাঠ ছিল কলোনির ভেতর। কী পরিমাণ ছুটোছুটি যে করেছি সেই মাঠ জুড়ে! কানামাছি, রুমালচুরি, বরফপানি, দাঁড়িয়াবান্ধা, সাতচারা, টিলো এক্সপ্রেস, বৌছি এমন অনেক অনেক খেলা খেলতাম। একটা অড়বরইয়ের গাছ ছিল কোথাও। কখনো খেলা ফেলে সেখানে অড়বরই কুড়াতে যেতাম। আর ছিল চুকাইয়ের ঝোপ আর লতানো ঢোলকলমির বেষ্টনী৷ এসবের আশেপাশে ঘুরে বেড়াতাম।

একবার এ-রকম ঘুরে বেড়াতে গিয়ে ড্রেনের মধ্যে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে গেল আমার। আমাকে উদ্ধার করে বাসায় পৌঁছে দিলো বন্ধুরা। ভাগ্যিস ড্রেনটা ছিল পরিস্কার, নতুন একটা বিল্ডিঙের সাথে লাগোয়া। নইলে বাসায় ফিরে প্রসাদ দুয়েকটা বেশি ভোগ করতে হতো।

খুব দুর্যোগের দিন ছিল ওটা। দুপুর থেকে ঝুম বৃষ্টি। বাবা এজলাসের কাজ ফেলে রেখে আমাকে নিয়ে ছুটল হেলথ কমপ্লেক্সে। গিয়ে দেখি এক্সরে মেশিনটা নষ্ট। নিরুপায় হয়ে বাসে করে যেতে হলো মুরাদনগর। বা দেবিদ্বারে। সেখানে এক্সরে করে হাতে প্লাস্টার করে দেয়া হলো। বাবা আঙুর কিনে দিয়েছিল আমাকে। তখন খুব পছন্দ করতাম। একহাতে প্লাস্টার আর আরেক হাতে আঙুর হাতে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে বসে ছিলাম। মাঝেমাঝে আঙুর মুখে দিচ্ছিলাম।

ফেরার পথেও বৃষ্টি। বাসের জানালাগুলো সব বন্ধ। কাচের বাইরে পৃথিবীটা ঘোলাটে। বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাচ্ছে সবকিছু। ঝমাঝম শব্দে কান পাতা যায় না।তারই মধ্যে আমি বাবার কানেকানে বললাম — বাবা, একটা গল্প শোনাবে?

গল্প শোনা আমার অভ্যাস ছিল তখন। পাগল করে দিতাম দু-জনকে। মা বেশ চালাকি করত। প্রথম আর শেষ লাইনটা বদলে দিত আর মাঝে সেই খাঁজকাটা খাঁজকাটা। এত গল্প পাবে কোত্থেকে! আমি শেষ লাইন পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম। গল্প শেষ হলে বলতাম — এটা একটা গল্প হলো?

যদ্দুর মনে পড়ে বাবা এ ব্যাপারে কিছুটা সৎ ছিল। ভেবে ভেবে বলত অনেককিছু। অন্তত চেষ্টা করত নতুন কিছু শোনাতে। সেদিন বাসে বসে আমার আবদারটা শুনে বাবা হেসে ফেলেছিল। মনে আছে হাসিটা কেমন করুণ ছিল। শুধু গল্পটা আর মনে নেই এখন।

প্রচ্ছদচিত্র : অসীম দাস

… …

নিবেদিতা আইচ

COMMENTS

error: