জয়ধরখালী ২১ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ২১ || শেখ লুৎফর

টকটকে ফর্সা মেয়েটার নাম মজিদা। গরিবের মেয়ে বলে পাড়ার মানুষ তাকে মজি ডাকে। সে লকলক করে লম্বা হচ্ছে। তাই ছেঁড়া, নোংরা আর ছোট হয়ে যাওয়া ফ্রকটা তার দশ-বারো বছরের লম্বা গতরটার সবটুকু ঢেকে রাখতে পারে না। মাথা ভরতি কালো কিচকিচে চুলগুলা তেল-পানির অভাবে কাউয়ার বাসা। টানা টানা গভীর কালো চোখ দুইটাতে পেটের ক্ষিধা সবসময় ধিকধিক করে জ্বলে।

বাপটা দিনমজুর। তাই খুব ভোরে উঠে কামের খোঁজে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে দিন গড়িয়ে রাত হলে। নাবালেগ বড়ভাইটা একপেট ভাতের বদলে গিরস্তের বাড়ির রাখাল। এক-দুই মাস পরপর একরাতের জন্য বাড়ি আসে। ছোটগুলা অবুঝ, উলঙ্গ; সারাদিন উঠানে ধুলা নিয়ে খেলা করে। সুরুজ উঠার আগে মা তাদেরকে একমুঠো লবণ-পান্তা খেতে দিয়ে মানুষের বাড়িতে ধান ভানতে চলে যায়। ফিরে আসে বৈকাল হলে। সারাদিন আর কোনো খাওয়া নাই। সুরুজটা মাথার উপরে উঠার আগেই বাড়ন্ত গড়নের মজির পেটটা ক্ষিধায় কড়মড় করে ডাকে, জ্বলে। তাই বারবার ছুটে গিয়ে গেলাস গেলাস পানি খায়। যখন অসহ্য লাগে, ঝিমঝিম করে মাথা ঘোরায় তখন উঠানে খেলতে-থাকা ভাইবোনদেরকে ফেলে বড় বড় গিরস্তের বাড়িগুলার দিকে প্রায়ই সে একা একা চলে যায়। ওদের হাড়িতে সবসময় ভাত থাকে। বাড়িতে ঢোকার আগেই সে জানতে পারে কার ঘরে পাকা কাঁঠাল-কলা আছে; কোন পাকঘরে গরম গরম ভাত-ছালুন আছে অথচ বাড়ির সব মহিলারা উঠানে কিংবা খলায় ধান-পাট নিয়ে মহাব্যস্ত। জন্মের পর থেকেই বিধাতার দেওয়া পেটের আদিম আগুন তাকে দিয়েছে কুকুরের ঘ্রাণশক্তি ও নিঃশব্দ পায়ে চলার তড়িৎ গতি।

না-চিবিয়ে চুরি করে গপগপ খাওয়ার সময় একবার মজির গলায় গরুর গোস্ত আটকে যায়। এই মস্ত মস্ত টুকরাগুলা কিছুতেই গলা দিয়ে নিচে নামছে না! উপরেও উঠছে না! তাই সে দমও নিতে পারছে না। একফোঁটা বাতাসের অভাবে অন্ধকার দুনিয়াটা কাঁপতে কাঁপতে তার ছোট্ট বুকটায় ভেঙে পড়লে সে দড়াম করে গোস্তের ডেকচির উপরেই লুটিয়ে পড়ে। হাড়ি-পাতিলের চুরমার শব্দে বাড়ির সবাই ছুটে এসে দেখে ঘর জুড়ে ছড়িয়ে-পড়া ঝোলগোস্তের উপর মজির দেহটা খিঁচতেছে; ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে বড় বড় কালো চোখদুইটা!

মজি কী ঘটিয়েছে আর এখন কী ঘটছে সবাই একপলকে বুঝে ফেলে। বাড়ির বড় মেয়েটা শহরে থেকে কলেজে পড়ে। সে একঝটকায় চুলের মুঠি ধরে মজিকে মাটি থেকে তুলে বসায়। মজি বাতাসের অভাবে হা করে কাতলামাছের মতো খাবি খাচ্ছে। শিক্ষিত-চতুর মেয়েটা সেই হা-করা মুখের ভেতর হাত ঢুকিয়ে গলায় আটকে-থাকা গোস্তের টুকরাগুলা নিচের দিকে জোরে ঠেলে দেয়। মুহূর্তে মজি হসহস করে বাতাস টানতে টানতে মাথা ঝাড়া দিয়ে বসে। এইবার তার চর্তুদিক থেকে দুম দুম করে ছুটে আসতে থাকে কিল-থাপ্পড়। বাড়ির কর্ত্রী ঝাড়ু নিয়ে ছুটে আসে, — তর অত সাহস! নতুন জামাইয়ের লাইগ্গ্যা গোস্তু রাইন্দ্যা থইছি?

একটু পরেই মজিকে দেখা যায় তার ভাইবোনদের মাঝে; সে সবার সামনে কলাপাতা বিছিয়ে তার উপর ধুলার ভাত আর ছোট ছোট মাটির ঢেলার গোস্ত দিয়ে, মুখে চবচব শব্দ তুলে ‘খাবার খাওয়া’ খেলাটা খেলছে। ফকিরবাড়ির টানাহিঁচড়ায় ছেঁড়া-নোংরা ফ্রকটা আরো বেশি ছেঁড়া। টকটকে ফর্সা গালদুইটায় পাঁচআঙুলের লাল লাল দাগ।

পাড়ার ছোট-বড় সকলের কাছে মজি একটা ছ্যাঁচড়া-চুরনি। এইসব নিয়ে মাঝে মাঝে মা-ও তাকে মারে। দিনমজুর বাবা মারেও না গালিও দেয় না। সব শুনে-টুনে বড় একটা শ্বাস ছেড়ে গুম হয়ে হুক্কা টানে। দেখতে দেখতে মেয়েটা তার কাঁধ ছুঁয়ে ফেলছে! আর কয়দিন পরেই অন্যের বাড়ি চলে যাবে! শুধু জন্মই দিলো; না পারল ভালো একটা কাপড় দিতে, না একবেলা পেট ভরে ভাত দিতে।

গরিবের মেয়ের ইজ্জত ঢাকবার কাপড় নাই সে রূপ ঢাকে কী দিয়ে! তাই তেরো পেরোবার আগেই মজির বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।

পাত্র দুইতত্যাবর (দোজবর)। আগের বউটা নাকি সাপের কামুড়ে মরছিন। কোলের একটা ছেলেও আছিন, মায়ের পিছে পিছে নিউমুনিয়াতে মরে গেছে। পুরুষ মাইনশ্যের বয়সটয়স কিচ্ছু না রে…। ফসলের জমিন আছে, গরু আছে, বাড়ির সামনে পাহাড়সমান বড় একটা খড়ের পুঞ্জি। বুঝলে, বাকিটা আমার মজিদার ভাইগগ্য।

এইসব বলতে বলতে পাত্রের তত্ত্বতালাশ নিয়ে ফিরে-আসা মজির বাপ গতর ছেড়ে বারান্দায় বসে পড়ে। একটু পরেই দেখা যায় তার মাথার উপর তামাকের ধোঁয়া সাদা সাদা আস্তর বেঁধেছে। চোখের কোনায় একবিন্দু পানি।

বিয়ের দিন মজিকে সাজিয়ে-গুছিয়ে দেওয়ার জন্য কলেজে পড়ুয়া সেই মেয়েটা তার দলবল নিয়ে এল। বর-কনেকে গয়না নাওয়ে উঠিয়ে দেওয়ার আগে পাড়ার বুড়িরাও এল গাঙের ঘাটে। মজির তো দাদি নাই। বিয়ের রাতে পুরুষ মানুষ ঘরের দরজায় খিল দেওয়ার পর কি কি করতে হবে সব তারা নিজ দায়িত্বে তার কানে কানে শিখিয়ে দেয়। আজ দেখলে কেউ ভাবতেও পারবে না, একদিন এই বুড়িগুলা কলাটা, আমটা, দুধের সরটা চুরি করে খাওয়ার জন্য মজির প্রতি কতটা নির্দয় ছিল!

নাকফুল আর কানপাশাটা সোনার। গলার হার, হাতের বালা, পায়ের মল সবই রূপার। বিয়ের শাড়িটাও পুরাতন দেখে পাড়ার বুড়িরা সব কানাকানি করে পরস্পর জানাজানি করল, সব আগের বউয়ের পুরান জিনিস।

এইসব দোষ-তিরুটির কথা বলতে বলতে হিংসুটে বুড়িগুলার বুকের আগুন বুঝি কিছুটা থিতিয়ে আসে।

হোক রূপার, হোক পুরাতন তবু মজির ছিপছিপে লম্বা গড়ন, বেলান বেলান হাত-পা, লাল টসটসে গাল আর টানা টানা ঘোর-কালো চোখের দিকে তাকিয়ে ‘পরীর দেশের রাজকন্যা’ বলে রূপকথার অসংখ্য কিচ্ছা জানা বুড়িদের মনে খটকা লাগে, হিংসায় বুক পুড়ে।

চার-পাঁচ মাস জয়ধরখালীতে মজির কোনো খোঁজ নাই। আঘুন মাসের ধানকাটা শেষ হলে তার বাপ গিয়ে জামাইকে বলে-কয়ে তিনদিনের জন্য মেয়েকে নিয়ে আসে। পরেরদিন সকালে তার মা গিরস্তের বাড়ি কাজে যাওয়ার আগে মজিকে সতর্ক করে যায়, কেউর বাড়িত যাইছ না। তরে কেউ দ্যাখবার আইছে?

আগের মজি আর নাই। সে এখন সচ্ছল এক গিরস্তের বউ; কাপড়চোপড়, শরীর-স্বাস্থ্য, চলন-বলনে ব্যক্তিত্বের ধার সবসময় নীরবে দ্যুতি ছড়ায়।

মা বেরিয়ে যেতেই মজিও বাইরে পা বাড়ায়। বড়বাড়ি, ফকিরবাড়ি, উত্তরপাড়া ঘুরে ঘুরে সে সবার বাড়িতে যায়। বুড়িদের পাশে বসে পাকা গিন্নীর মতো জনে জনে খোঁজ লয়। বুড়িরা আদর করে আমটা, কলাটা, মুড়িটা খেতে দেয়। সে মাথা নাড়ে, — না দাদি, আগের মতন আর ক্ষিধা নাই।

বুড়িরা মজির দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে; তার খাড়া নাকের ডগার বিন্দু বিন্দু ঘামে সুখ নামের হীরের দ্যুতি।

আষাঢ় মাসের শেষদিকে মজি আবার জয়ধরখালীতে ফিরে আসে। টানা টানা কালো চোখদুইটার নজর এখন ভোঁতা ভোঁতা, পেটটা সামনের দিকে ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। খাওয়াটাওয়ার রুচি নাই। সারাদিন বিছানায় পড়ে পড়ে হাঁসফাঁস করে। মাঝে মাঝে দুনিয়া ঘোর হয়ে বৃষ্টি নামে। থমথমে কালো আকাশটা ফাৎ ফাৎ করে বিজলি মারে। বিছানা থেকে উঠে এসে মজি দরজার চৌকাঠে বসে অসার চোখে দুনিয়াটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই শরীর নিয়ে সে বাড়ি বাড়ি যেতে পারল না বলে কাউকে দেখা হলো না আর কেউ তাকেও দেখতে এল না, এই অভিমানে বুঝি মজির চোখের কোনাকানায় পানি চিকচিক করে।

বিষুধবার দিন সন্ধ্যায় মজির পানি ভাঙতে শুরু করে। সারা পেট জুড়ে চনচন করে বেদনা ওঠে। তার মা বড় বড় পা ফেলে একপাঞ্জা খড় এনে মাঝঘরে বিছিয়ে দেয়। তার উপর একটা ছেঁড়া-নোংরা খেতা ফেলে মজিকে শোয়ানো হয়। খবর পেয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছুটে আসে দক্ষিণপাড়ার বুড়ি ধাত্রী। সারারাত ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে; মজিকে নিয়ে মেয়েদের টানাটানি চলে কিন্তু পেটের বাচ্চা নামে না। পরের দিন দুপুর পর্যন্তও তা-ই। মজির বাপ তো দূরে থাক টাকাওয়ালা গিরস্তেরাও বউ-ঝির এইরকম টাইমে ডাক্তার-হাসপাতালের কথা কল্পনাও করে না। তারা উপরের স্তব্দ-নীল আসমানটার দিকে আঙুল তুলে বলে, —

নসিবের লিখন,
না যায় খণ্ডন।

বিকালের আগেই মজির পেটটা এই উঁচু হয়ে ফুলে ওঠে। তারপর মেয়েদের সব চেষ্টাফেষ্টা মিথ্যা করে তার টানা টানা ঘোর কালো চোখ দুইটা চিরতরে স্থির হয়ে যায়।

আছরের আযানের পর বিধাতার বুঝি একটু দয়া হয়। দক্ষিণের কোনা বরাবর আকাশে গুড়ুম গুড়ুম কয়টা ডাক দিয়ে বৃষ্টিটা থামে। পশ্চিমে ঢলে-পড়া সূর্যের লাল আলো গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে লিকলিক করে মৌতাবাড়ির উঠানে আছড়ে পড়ে। মজির মায়ের বুকফাটা বিলাপে পড়শি-বুড়িদের কেউ কেউ থকথকে কাদা ভেঙে উঠানে এসে দাঁড়ায়, — আল্লার দয়া হইছে গ; মজিরে কব্বর দেওয়ার লাইগগ্যা দ্যাহ কী সুন্দর রৈদ উডছে!

কবর খুদতে আসা পড়শিদের কেউ কেউ নিচু গলায় বলে, — একমুঠ ভাতের লাইগগ্যা মেয়েডা কী করছে … কষ্টের পরে আল্লায় সুখ দিছিন, নসিবে সইল না।

এখন আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মজির বাপ গাঙপাড় থেকে ফিরে আসে। তারপর ভেজা কাপড় পালটে লোকটা হুক্কা নিয়ে বারান্দায় বসে। মজির বাপকে দেখে মায়ের ইনাই-বিনাই রোদন আরো তীব্র হয়, — থইয়াইছ গ …, আমার সোনার পুতুলরে তুমি গাঙপাড়ে হুতায়া থইয়াইছ?

মজির বাপ হুক্কা টানতে টানতে ধরা গলায় বলে, — এই অইল মানুষের নসিব; এক দরজাত সুখ আইলে আরেক দরজাত আইসা আজরাইল খাড়া অয়।

হুক্কা টানতে টানতে মজির বাপ দেখে, পানিভরা কালো কালো মেঘে আষাঢ়ের সারা আকাশ আবার ছেয়ে গেছে! তারপর সে আর আকাশ দেখে না। খোদার দুনিয়ার কিছুই দেখে না। হুক্কার কুড়ুৎ কুড়ুৎ শব্দে ডুবে গিয়ে ভাবে, এক রাতের ভারী বর্ষণেই বুঝি গুটিকয় বছরের মজির জীবন জয়ধরখালী থেকে চিরতরে ধুয়েমুছে যাবে!

ব্যানারে ব্যবহৃত অলঙ্করণের শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী

প্রিভিয়াসলি অন জয়ধরখালী

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you