জয়ধরখালী ১৫ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ১৫ || শেখ লুৎফর

খেলা করার সময় মুখে মুখে ছড়া কাটা জয়ধরখালীর শিশুদের একটা অভ্যাস। এইসব ছড়ার কোনোটাই বইয়ে পাওয়া না গেলেও বড়দের মুখে শুনে শুনে তারা মুখস্থ করে ফেলেছে। ঐ-যে গ্রামের মানুষ বলে-না, —

দ্যাখ দ্যাখ কর্ম
শিখ শিখ ধর্ম।

তিতা-মিঠা, টক-ঝালে ভরা এইসব ছড়াগুলোর একটা হলো :

মুনশি-মোল্লা, নোয়াখালী-কুমিল্লা
আঁতুড়-ল্যাঙড়া ফরিদপুর।
রাজা-বাদশা জয়দেবপুর
টাকাওয়ালা ঢাকা
ষণ্ডাগুণ্ডা বিদ্যাহীন
এইসব লোক মইমনসিং।

ধনে-জনে, আতিথেয়তায় অনন্য এক গ্রামের নাম জয়ধরখালী। অধিকাংশ বাড়ির সামনে যার যার তৌফিকমতো ছোট-বড় পুকুর আছে। গ্রামের মানুষ পুকুরকে বলে দিঘি। এই দিঘিগুলো তাদের উৎসব-আমোদের জন্য বড় বড় রুই-কাতলার ভাণ্ডার আর খাওয়ার জন্য রোগজীবাণুমুক্ত পানির নিরাপদ উৎস। কারণ তখনও টিউবওয়েল কী জিনিস গ্রামের মানুষ জানে না। বন্যামুক্ত জয়ধরখালীর ফসলের জমিগুলো দোআঁশ, বেলে-দোআঁশ মাটির। তাই সারাবছর মস্ত মস্ত মাঠগুলো কোনো না-কোনো ফসলের সম্ভারে যেন মায়ের হাসিমাখা উজ্জ্বল মুখ।

কোনো কোনো বাড়িতে লজিং থাকে নোয়াখালী, কুমিল্লা থেকে আসা গয়েশপুর মাদরাসার ছাত্ররা। জয়ধরখালী থেকে পাঁচমাইল দূরে গয়েশপুর মাদরাসা। দশমাইল চৌহদ্দির মধ্যে ওই একটিমাত্র মাদরাসা। ছাত্রদের বেশিরভাগই কুমিল্লা-নোয়াখালীর। লেখাপড়া শেষে তাদের অনেকেই মসজিদ-মক্তবের হুজুর হিসাবে থেকে যায়। তাদেরকে জয়ধরখালীর মানুষ বলে — ‘তিরিপুইর‌্যা (ব্রিটিশ আমলে কুমিল্লা ছিল ভারতের ত্রিপুরার অংশ।) হুজুর।’

দুনিয়ার যত মানুষ আজগুবি-উদ্ভট পেশায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে, তাদের পিঠের থলেটা যত বড় তারচে অনেক বেশি বড় অভিজ্ঞতার ঝুলি; পেটের ধান্দায় ঘুরতে ঘুরতে যারা এসে এখানে উদয় হয়, তাদের কেউ কেউ  ল্যাঙড়া-লোলা, কেউ কেউ লতাইরা (দুর্বল) বুড়ো। ভিক্ষা তাদের একমাত্র পেশা। জয়ধরখালীর অধিকাংশ বাড়ির সামনেই ফসল মাড়াইয়ের জন্য বিরাট বড় খলা আছে। খলার একপাশ ঘিরে পাহাড়ের মতো বড় আর উঁচু উঁচু খড়ের পুঞ্জি। যে-বাড়িতে খড়ের পুঞ্জি যত বেশি এবং বড়, দেশগেরামের মানুষের কাছে সেই বাড়ি তত বেশি ইজ্জতদার।

সেদিন এশার নামাজের সময় বড়বাড়ির মসজিদে একজন মুসাফিরের সাক্ষাৎ মেলে। পরনে ময়লা পাঞ্জাবি-পাজামা। মাথার টুপিটায় জগতের ময়লা জমতে জমতে শুকনা তামাক পাতার রঙ ধরে গেছে। ছোট ছোট চোখদুইটা কোটরের ভেতর ঠিক যেন নতুন মার্বেল। বুক-সমান লম্বা দাড়িটায় ঢেউ তুলে মুসাফির ছাবেদালী মেম্বারকে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় জানায়, আঁর নাম মালানা আব্দুর রহমান। আঁই রফিকুলের মামা। ইসলামের আবাদ করবার লাই আঁই নোয়াখালীত্তুন আইছি।

রফিকুল নামে নোয়াখালীর এক তালেবে এলেম মেম্বারের বাড়িতে পাঁচবছর লজিং থেকে, টাইটেল পাশ মাওলানা হয়ে, কিছুদিন আগে দেশে চলে গেছে। মুসাফির মাথার নোংরা টুপিটা একহাতে নিয়ে কামানো মাথাটা আরেক হাতে চুলকাতে চুলকাতে পেরেশান গলায় মিনতি জানায়, — আঁরে এট্টু সুযোগ করি দ্যান।

হুজুরের হাড়গিলা শরীরটা থেকে একটা চিমসে গন্ধ বেরোচ্ছে। কথা বলার সাথে সাথে ক্ষুধার্ত আঁত-নাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে বদ গন্ধ। উপস্থিত মরুব্বিরা এর মাঝেই বুঝে গেছে, পেটের ক্ষিধায় হুজুর ধুঁকছে। তাই এহুদালী শেখ তার সাদা দবদবা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, — আগে নামাজ শেষ হউক। হুজুর আফনে গ্যায়া ইমামতি করুইন।

এহুদালী শেখ পাড়ার সবচে প্রবীণদের একজন। তিনি লেখাপড়া করেছেন ক্লাস ফোর পর্যন্ত। পাড়ার বিচারসালিশেও তার মতামত সকলে অবাধে মেনে নেয়। জমিনের দাগ-খতিয়ান আর মাটির হিসাব খুব ভালো বোঝেন বলে গ্রামের মানুষ তাকে ইজ্জত দিয়ে এহুদালী সরকার বলে ডাকে।

শুক্কুরবারে জুম্মার নামাজের পর মোনাজাতের জন্য দু-হাত তুলে হুজুর কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি গত একসপ্তাহে অঞ্চলটার সব আউবাউ জেনে নিয়েছেন। গ্রামের অর্ধেকের বেশি বাসিন্দা হিন্দু। সরকারি চাকরিবাকরি, ব্যবসাবাণিজ্য, ধনে-মানে তারা প্রবল। তাদের চলন-বলন, করম-ধরম মুসলমানপাড়ার মানুষগুলোর মাঝেও কিছু কিছু দেখা যায়। হাতেগনা কয়জন মরুব্বি ছাড়া দাড়ি নাই কারো মুখে। কেউ কেউ জল্লাদ-সাইজ গোঁফে তা দিয়ে দিনমান ঘোরে। চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বয়েসী মানুষগুলো মসজিদ তো দূরে থাক ভুলেও একটা উশ্টা খেয়ে পশ্চিমমুখো পড়ে না। সন্ধ্যা হলে বেশিরভাগ মানুষ পূজাপার্বণে, ঘাটুগান আর কীর্তনে ছুটে যায়। তাই এই গুমরাহি থেকে পানাহর জন্য খোদার কাছে তিনি জারেজারে কাঁদতে থাকেন। এত লম্বা মোনাজাতের জন্য মরুব্বিদের কেউ কেউ হুজুরের উপর বিরক্ত হয়। এখানে উপস্থিত অনেকেরই বয়স সত্তর-আশি পেরিয়ে গেছে কবে! তাই যখন-তখন পেশাবে ভোগায়। তাদের অনেকেরই ঘরে নাতিপুতিথুতি আছে। চল্লিশ-পঞ্চাশ একটা বয়স নাকি? ছেলেরা একটু আমুদ-সামুদে থাকুক, নাতিটাতির মুখ দেখুক। তারপর তো দাড়ি রাখবেই। মসজিদে আসবেই। কাফের নাকি যে কোরআন-মসজিদ ভুলে গেছে! আর এইজন্য অত বেহুদা বিলাপের দরকারটাই কী?

একবছর পর হুজুরকে চেনাই যায় না। পরনে পরিষ্কার টুপি-পাঞ্জাবি। কমদামা আতরের কড়া সুবাসে সেই চিমসে গন্ধটা শরীর থেকে উধাও। মার্বেল-মার্বেল চোখদুইটা চর্বিঠাসা পাতির আবরণে সবসময় চকচক করে। পিঠের-সাথে-লেগে-থাকা পেটটা এখন সামনের দিকে বেশ আগুয়ান। রোজ সকালে মসজিদের বারান্দায় মক্তব বসে। পঁচিশ-তিরিশজন শিশু সুর করে কায়দা-আমপারা পড়ে। মাগরেবের নামাজের পর আধবুড়া কৃষকদেরকে নামাজকালাম শিখায়। তাদের কারো কারো মুখের দাড়ি এখন একমুঠি পেরিয়ে গেছে। নাটকে-ঘাটুগানে-কীর্তনে যাওয়ার জন্য বেচারারা এখন সবার আগে গামছা দিয়ে দাড়িটা বেঁধে নেয়।

এইসময় হুজুরের দেশ থেকে একটা বিয়ারিং চিঠি আসে। দুইআনা পয়সা পোস্টমাস্টারকে নিজের পকেট থেকে নগদ দিয়ে চিঠিটা মেম্বার নিজেই নিয়ে আসে। ঠিকানা :

মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুর রহমান
প্রযত্নে : ছাবেদ আলী মেম্বার
সাং-পোস্ট : জয়ধরখালী
থানা : গফরগাঁও
জিলা : ময়মনসিংহ
পূর্ব-পাকিস্তান।

এশার নামাজের পর এহুদালী সরকার তার মুরুব্বিয়ানা গাম্ভীর্যের সাথে হুজুরকে জিগায়, — হুনলাম দেশ থাইক্যা চিঠি আইছে?

নামাজ শেষে হুজুর ইমামের আসনেই বসেছিলেন। একহাতে সাদা দবদবা কিস্তি টুপি। অন্য হাত দিয়ে তিনি কামানো মাথাটায় হাত বুলাচ্ছেন। শকুনের পায়ের চঙ্গলের মতো সরু সরু রুক্ষ আঙুলগুলো আজ অনেক পুরুষ্ট। সরকার সাবের জিজ্ঞাসায় হুজুর গোলগোল চোখ দুইটা বিনয়ের সাথে তুলেন :
জি।
— বালবাচ্চারা ভালা আছে?
জি।
— চিঠির মানে কী?
আঁর বউয়ের এক হোলা অইছে। হাতগা (সাতটা) মাইয়ার হরে এই ওগ্গ্যা আঁর হোলা।

আলাপ এই পর্যন্তই শেষ। পরেরদিন দেখা যায় একপাল ছেলেদেরকে সাথে নিয়ে, নতুন নতুন দাড়িরাখা সেই তাগড়া আর ফুর্তিবাজ চাষারা পিঠে বস্তা ফেলে, বাড়ি বাড়ি ধান-চাল তুলছে। ইমাম সাবের বার্ষিক বেতনের জন্য কেউ কেউ নগদ টাকাও দিচ্ছে। বস্তাভরা ধান-চাল দেখে কেউ কেউ জিগায় :
খবর কী?
— খবর অইল ইমাম সাবের বিবির ছেইলে হইছে। তিনি শীঘ্র বাড়ি যাইবেন।

পরেরদিন সন্ধ্যায় নূরুর বাপের রান্নাঘরে এই নিয়ে আলাপ ওঠে। হ্যাংলা-পাতলা গতরের মোবারক তার মিঠা মিঠা আলাপ আর শয়তানি বুদ্ধির জন্য গ্রামের মানুষের কাছে নেউল বলে বিখ্যাত। সে পাতাকাগজের বিড়িতে দম দিয়ে নূরুর বাপের কাছে জানতে চায়, — অ চাচা…তিরিপুইর‌্যা হুজুর আইছে কয় মাস হইছে?

নূরুর বাপের খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর বসন্তের দাগে ভরা মুখটা ফাজিলি-হাসিতে ভরে ওঠে, — কত আর অইব? তেরো-চৈদ্দ মাস।

নূরুর বাপের পিঁড়িতে, ঢেঁকিতে যারা বসে ছিল এই কথায় তারা সকলেই ফ্যাকফ্যাক করে হেসে ওঠে। মোবারক কিন্তু জোরে হাসে না। সে তার চিরচেনা পিরপিরাইন্যা হাসির সাথে বিড়িতে দম দিয়ে আবার জিগায়, — অ চাচা…এর মাঝে হুজুর কয়বার বাড়িৎ গ্যাছে?
একবারও না।

আবার সবাই হো হো করে হাসে এবং হাসতেই থাকে। নানান রকম প্যাঁচগোচ আর জটিলতায় ভরা মোবারকের মুখে বিড়ির স্বাদটা এখন অমৃতের সমান। সে বিড়িতে আরেকটা দম দিয়ে বলে, তিরিপুইর‍্যা হুজুররে আমি কতাডা গ্যাছেকাইল জিগাইছলাম, — তেরো-চৈদ্দ মাস ধইরা বাড়িতে যাওয়া-আসা নাই ত্যা ক্যামনে হুজুরাইন ছেইলার মা অয়?

মোবারকের এই কথায় নূরুর বাপের পাকঘরে টানটান উত্তেজনা ও হাশরের ময়দানের নীরবতা একই লপ্তে নেমে আসে। সবাই একটা নোংরা ও আদিরসাত্মক আমুদে মোবারকের ছুঁচোটাইপ ঠোঁটের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। বিড়ির স্বাদে মোবারকের মুখের ভেতরটা লালায় ভরে উঠেছিল; অন্য দিকে তিরিপুইর‌্যা হুজুরের গপ্পোটাও সে একটামাত্র বাক্যে গুটিয়ে এনেছে, তাই সে ওটা কুঁৎ করে গিলে ফেলে বলে, হুজুর কৈল, ছেইলাডা তার নিজেরই; গামছায় বীজ বাইন্দ্যা, সময়মতো নাকি সুরা-কালাম পইড়া চালান দ্যায়া দিছিন।

তখনও জয়ধরখালীর আকাশে চাঁদ ওঠেনি। পালপাড়ার দিক থেকেও আসছে না কীর্তনের সুরেলা আলাপ। তবু আকাশের অসংখ্য তারা ও ছায়াপথের উজ্জ্বল আভার সাথে পাকা আম-কাঁঠালের গন্ধের দাপটে, নূরুর বাপের ঢেঁকির আসরে উচ্চ হাসির গমকে, রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারটা জয়ধরখালীতে তেমন বল করে উঠতে পারছে না।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you