জয়ধরখালী ৮ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ৮ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী গ্রামে তিনটা বকুলফুলের গাছ ছিল। সবচে বুড়ো আর টুন্ডামুন্ডা গাছটা বাজারের একটু আগে চেয়ারম্যানবাড়ির সামনে। সে-বেচারা তার শতবর্ষী জীবনটা নিয়ে তিনমাথা বুড়োদের মতো সামান্য কয়টা ডালপালায় শতাব্দীর ইতিহাস মেলে ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাই তার কাছে কেউ ফুলের আশা করে না। ফুলে-ফলে সারাবছর গ্রামের কিশোরকিশোরীদের মাতিয়ে রাখে যে দুইটা গাছ, তারা এই আসমান-উঁচা; বটবৃক্ষের মতো চারপাশে ছড়িয়ে দিয়েছে নিজেদের যৌবনের বিস্তার। ডালে ডালে কত পাখি ডাকছে। সারাদিনরাত কিশোরীর হাসির মতো টুপটাপ ঝরে পড়ছে; — হয় পাকা ফল নয়তো ফুল।

মসজিদে ফজরের আজান হলেই কিশোরকিশোরীরা ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে; — কে কার আগে বকুলতলায় যাবে — কে কারচে বেশি ফুল কুড়াতে পারবে?

সবার হাতেই বাঁশের শলি দিয়ে বানানো সের। সের মানে কমপক্ষে একসের চাল ধরবে জিনিসটায়। তারা দৌড়াতে দৌড়াতে বকুলতলায় গিয়ে হাজির হয়। শুধু হাপ্পুপরা একপাল বালকবালিকা বকুলতলাটাকে চারপাশ থেকে ঘিরে বসে। তারপর নিঃশব্দে সবার হাত লহমায় নামছে, লহমায়  উঠছে। ফুল কুড়ানো শেষ হলে তারা এইমাত্র পাওয়া ধনদৌলতের আমুদে আটখানা হয়ে কলরব করতে করতে ইশকুলের মাঠে এসে থামে। আশপাশের কলাগাছ থেকে সেটকুলের সুতাও তুলে লয়। সারা গাঙপাড়ের বাঁশঝাড়ে বাঁশঝাড়ে হাজার হাজার পাখি ডাকছে। কেউ কেউ পাখা ঝাপটে সারারাতের জাড্য ভেঙে বেড়িয়ে পড়ছে দূরদূরান্তের বিলগুলোর উদ্দেশ্যে।

একদল কিশোরকিশোরী ঠিক পাখিদের মতোই কলরব করতে করতে নদীর পাড়ের উঁচা কান্দায় গিয়ে পা ছড়িয়ে বসে। সাদা মেঘের মতো পাল তুলে মস্ত বড় একটা মহাজনি নাও নদীর উজানদিক থেকে আসছে। মাঠ থেকে আনা ল্যাঙড়া-ঘাস দিয়ে বানানো সুজনিতে সকলেই সেটকুলের লম্বা লম্বা সুতা লাগায়। তারপর মালা বুনন শুরু, — দ্যাখি কার মালা কত লম্বা হয়?

শিশুর মন, আনন্দে কুড়িয়েছে; আনন্দে মালা গেঁথেছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেই উত্তেজনা পানি হয়ে গেলে কেউ কেউ মালাটা ছিঁড়ে ফেলে দেয়। কেউ কেউ আস্ত মালাটাই উঠানে ছুঁড়ে মারে। ঘরের বড়আপা এই সুযোগের অপেক্ষায় তক্কে তক্কে ছিল। সে এসে মালাটা চুপি চুপি কুড়িয়ে নেয়। কিংবা ছেঁড়া মালার ছড়িয়ে-পড়া ফুলগুলো তুলে আবার নতুন করে মালা গাঁথে।

দুপুরে যে-মালাটা শরিফার হাতে দেখা গেছিল, বিকালে দেখা যায় সেই মালাটাই তমিজ ডানহাতের কব্জিতে জড়িয়ে পুকুরপাড় দিয়ে আকবর বাদশার মতো হেঁটে যাচ্ছে। সে দুনিয়ার কিচ্ছু জানে না, কিচ্ছু দেখে না। শুধু পুকুরঘাটে কলস নিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা শরিফাকে দেখে। শরিফার চোখ তমিজের ডানকব্জিতে জড়ানো ফুলের মালাটার দিকে। তমিজের কব্জিতে যেন তার দেওয়া ফুলের মালা নয়, সে নিজেই জড়িয়ে আছে! শরিফার সারা শরীর শিরশির করে ভেঙে আসে।

গ্রামের অধিকাংশ নরনারী জানে, সুরেশের হাতের বকুল ফুলের মালাটা মহেশের মেয়ে অঞ্জলির। অঞ্জলি কিংবা শরিফারা জানে, তাদের এই লেনাদেনার কথা দুনিয়ার কেউ জানে না। কিন্তু সাহাপাড়ার বুড়ি বৈষ্টমি হররোজ ভিক্ষা করতে বেড়িয়েই গান ধরে,

চন্দ্র দেখিল না,
সূর্য দেখিল না,
না দেখিল সায়রের পানি,
হায় পিরিতি —
তবু তোমার লাগিয়া
চারপাশে কত কানাকানি!

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you