‘অভাবে স্বভাব নষ্ট।’ —
চিরন্তন এই বাণী জয়ধরখালীর কারো কারো বেলায় খাটে না। তাদের ক্ষেত-কৃষি আছে; পেটভরা ভাতও আছে। তবু তারা চুরি করে। চুরি তাদের পেশা না; নেশা। কৃষকের চ্যাংড়া পোলা; চোখভরা জমিনের স্বপ্ন। সারাদিন বাপের সাথে উপুড় হয়ে জমিনে কাম করে। সন্ধ্যা হলে মনটা বিলের বকপাখির মতন দুই পাখা মেলে উড়াল দিতে চায়।
কৈ আর যাবে? নূরুর বাপের ঢেঁকি তো বাপ-চাচাদের দখলে। ইস্কুলের ঘাটের বেদেরা সন্ধ্যা হলেই ভাত খেয়ে নাওয়ের বাতি নিভিয়ে ফেলে। আখড়ার তাসের আসরটাও একচেটিয়া মরুব্বিদের। বাকি থাকল হিন্দুপাড়ার কীর্তন আর নদীর ওপারের ল্যাঙ্গি। ভিনগাঁ থেকে ল্যাঙ্গির কাছে গেলে সে পাক্কা আটআনার একটা আধুলি দাবি করে! তাই জয়ধরখালীর অবিবাহিত চ্যাংড়া চাষারা খোয়াড়ে আটক ষাঁড়বাছুরের মতন একই বৃত্তে ঘুরে ঘুরে খালি পাক খায়।
সেই সুবাদে তাদের মাথায় টাকাপয়সার চিন্তাটাই প্রধান হয়। বাপ-ভাইয়ের সাথে একহাড়িতে ভাত খেলেও সকলেরই গোপন একটা তহবিল আছে। এইরকম ব্যক্তিগত সঞ্চয়কে জয়ধরখালীর মানুষ বলে ‘যোলা।’ চাষার ঘরের মেয়ে-বউ হাঁস-মুরগি-কবুতর পালে। আন্ডা-মুরগি বেচে টাকা জমায়। মাঝেমধ্যে শখ করে নিজের টাকায় দুই-একটা শৌখিন জিনিসও কিনে। চ্যাংড়া ছেলেরা ছাগল-বকরি পালে। এইভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে কয়েক বছরে যোলাটা একটু বড় হয়ে গেলে গরু-বাছুর কিনে। কেউ কেউ সুদে খাটায়। মসজিদের ইমাম হুজুর বলে, ‘সুদ হারাম। সুদ খাওয়া আর মায়ের সাথে জিনা করা সমান কথা।’
হুজুরের এইসব কথায় কেউ কেউ ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে বলে, মাইনশ্যের খায় জুম্মাঘরে ঘুমায়; হুজুরের কি?
তিরিপুইর্যা হুজুরের কথায় যোলার টাকা যারা সুদে খাটায় না তারা সিজনে সিজনে ধান-পাট, আখের গুড়, মরিচ, সরিষা কিনে মজুদ রাখে। মনমতো দর পেলে বেচে দেয়। তাদের মাঝে কেউ কেউ আছে যোলার টাকায় দশমণ ধান কিনলে চুরি করে তার সাথে আরো দুইমণ মিশিয়ে ফেলে। জয়ধরখালীর মানুষ বলে, —
আগের হাল যেদিকে যায়,
পরেরটাও সেই দিকে ধায়।’
এককালে বাপের যোলা ছিল। বর্তমানে বড়ভাইয়ের আছে, তার থাকবে না কেন?
রাতারাতি যোলার তহবিল বড় করতে ধান চুরিতে গিয়ে তারেকের ছোটছেলে আর ভাতিজা মগবুলের হাতে ধরা খায়। মগবুল গিয়েছিল পালপাড়ায় কীর্তন শুনতে। ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। হাতে টর্চলাইট থাকলেও ব্যাটারি পুড়ে যাওয়ার ভয়ে মগবুল সহজে সুইচ টিপে না। চুপচাপ একলা একলা সে বাড়িতে ফিরে আসে। ওরা ব্যস্ত ছিল বস্তায় ধান ভরতে তাই মগবুলের পায়ের শব্দ কানে গেল না। বারান্দায় ধানের খসখসানি শুনে মগবুল সোজা ধানের স্তূপটা বরাবর লাইট মারে। তীব্র আলোর ঝলকানিতে হতবাক ছেলেদুইটা হিতাহিত ভুলে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মগবুল ছিল দেউড়ির কাছে; ওরা ইচ্ছা করলে দৌড়ে পালাতে পারত। কিন্তু ওদের পা বুঝি মাটিতে আটকে গেছে! একই বাড়িতে বসত; চাচাতো ভাইদের ছেলে। নতুন ব্যাটারিভরা লাইটটার তীব্র আলো ওদের চোখে-মুখে ধরে রেখেই মগবুল বারান্দায় ওঠে এল, — তরা আমার ধান চুরি করতাছস?
ওরা নির্বাক! নিথর! সে ওদের কাছে এসে একজনের হাতে ঝাঁকি দিয়ে বলল, — যা, বস্তা থুইয়া ঘরে যা।
পরেরদিন বাদ-মাগরিব জুম্মাঘরের সামনে সালিশ বসে। বিচারকদের সামনে সেই বস্তাটা। এহুদালী সরকার তারেককে ডেকে আনে, — এই বস্তা তর?
তারেক আমতা আমতা করে জবাব দেয়, — হ চাচা।
এইবার ডাক পড়ে চোরদের, — তরা মগবুলের ধান চুরিত গ্যাছলে?
নিশ্চুপ! সব নিশ্চুপ! এত নীরবতা যে শ দুইয়েক হাত পশ্চিমে কলকল করে বয়ে চলা সুতিয়া নদীর শব্দ শোনা যায়।
নীরবতা সম্মতির লক্ষণ। বেশি রাগ উঠলে এহুদালী সরকার শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে শুরু করে। তাই এইবার বুড়া গর্জে ওঠে, — এবং তোমরা লেকুর বাড়ির পেঁপেও খাইছ। খাইছ না?
বলতে বলতে এহুদালী সরকার পায়ের খড়ম হাতে নিয়ে চোরদের দিকে এগিয়ে আসে। তারেক পাশেই ছিল। সে বলে, — চাচা আফনের কষ্ট করতে অইব না। আমারে একটু সুযোগ দ্যাইন।
এইকথা বলতে বলতে তারেক তার পায়ের খড়ম দিয়ে নিজের ছেলের পিঠেই দুইটা বসিয়ে দেয়, — ক লেকুচাচার বাড়ির পাবদা ক্যাডা খাইছে?
অল্প বয়সে বিড়ি ধরার জন্য ছেলেটার কাশির দোষ আছে। তাই সে কাঠের খড়মের দুই লাঠি খেয়েই কাশতে কাশতে বলে, — আমরা।
এইবার সালিশে কবকব রব ওঠে, — ইস…লেকুচাচা কী সৎ মানুষ! মাঝরাইত থাইক্যা চাচি কত নামাজ পড়ে, কোরআন পড়ে, কত জাতের দোয়া-কালাম পড়ে। পরশুদিন সহালে দ্যাহে পাবদা গাছের পাকনা পাবদাগুলান নাই। চাচি কেউরে কিচ্ছু নাই কৈয়া নমাজের পাটিত পইড়্যা কাইন্দ্যা কাইন্দ্যা আল্লার কাছে বিচার দিছিন। ইস…, আল্লা জাগাত কবুল কৈরালাইছে। নাইলে এইবা কেউ চুরিৎ ধরা পড়ে!
তিরিপুইর্যা হুজুর সাতেও নাই পাঁচেও নাই। সে মসজিদের ভিতরে জায়নামাজে বসে, একহাতে টুপি নিয়ে আরেক হাতে খতকামানো ছিলা মাথাটা হাতায় আর পিটপিট করে হাসে।
এইবার মগবুল উঠে দাঁড়ায়, — কৈলে আফনেরা বিশ্বাস করবাইন না। দেউড়ির কাছ থাইকক্যা আমি লাইট ধরছি; ঠিকমতন চিনছিও না। এরা ইচ্ছা করলে দৌড়াইয়া পলাইতে পারত। কিন্তুক আল্লার বিচার, এরা বোবা-ল্যাংড়ার মতন জাগাত খাড়ইয়া রইল!
পেছন থেকে আরেকজন আবেগরুদ্ধ গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, — লেকুচাচির দোয়ায় আল্লা এগরে মতিভরষ্ট কৈরা দিছিন গ…
উপস্থিত সবাই আবার একসাথে কথা বলতে শুরু করে। এত কথা যে কেউ কারো কথা ঠিকমতো শুনতে পারছে না। সবাই বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে আল্লার কুদরতি ক্ষমতা দেখানোর কাহিনিগুলা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে।
এশার নামাজের পর তিরিপুইর্যা হুজুর আল্লার দরবারে দুইহাত তুলে বিরাট মোনাজাত জোড়ে, — আল্লা আন্নে ঘরে ঘরে লেকু মিয়ার বউর মতন পুন্নবতী বউ দেও, হিগগ্যারর হেডেত্তন এইরকম বাচ্চা অয় জিগগ্যা দীন ইসলামের হচার কইত্তে হাড়ে।
‘বেহায়া বলে রাজ্যটা আমার।’ —
মাঝে মাঝে জয়ধরখালীর মানুষ এই কথা বলে কোনো নির্লজ্জ মানুষের বিষয়ে আলাপ শুরু করে। কারণ গ্রামে যতকিছুরই অভাব থাকুক না কেন, বেহায়া মানুষের অভাব নাই। সন্ধ্যায় চোর সাব্যস্ত হওয়া সেই ছেলে দুইটাও তাই : বাপের খড়মের পিটনি খাইছে; তো কি হইছে? তারা ভাতটাত খেয়ে বেরিয়েছে পালপাড়ায় যাবে। আজ অধীর পালের মেয়ের বিয়ে। সারারাত উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হ্যাজাক বাতির সাদা আলোতে বিয়েবাড়ির মেয়েদেরকে দেখবে, বিয়েও দেখবে। জুম্মাঘরের পিছন দিয়ে যাওয়ার সময় এশার নামাজ শেষে মোনাজাতে তিরিপুইর্যা হুজুরের রোদন আর ভাষা শুনে তারা দুইজনই দাঁড়িয়ে পড়ে। মন দিয়ে সবটা মোনাজাত শুনে। তারপর দুইজনই হাসতে হাসতে দক্ষিণের সড়কে উঠে আসে। মেঘহীন, চাঁদহীন তারাভরা আকাশ এমনভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে যেন মহাকাল চেয়ে আছে একালের দুইটি নতুন মানুষের মুখের দিকে। কিন্তু তারা মানুষের মতো কথা না বলে খাঁটি চোরের মতোই বলছে, — দ্যাখছত তিরিপুইর্যা কি কয়?
হাসতে হাসতে আরেকজন বলে, — ইচ্ছা করলে দৌড় মারতারতাম; মারছি না যে মগবুল চাচা ত দ্যাইকক্যাই ফালাইছে। কিন্তুক তিরিপুইর্যা হুজুরের পকেট আমি সাফ কৈরালাইয়াম।
এই কথায় সাথের জন লোভে, আবেগে ফিসফিস করে ওঠে, — তুই দ্যাখছস?
— হ।
— কত ট্যাহা?
— কত আর অইব লিল্লা-ছদকার সাত-আট ট্যাহা।
— কৈ রাহে?
— পাঞ্জাবির পকেটে।
— ঘুমাইবার সময় পাঞ্জাবি কৈ রাহে?
— জুম্মাঘরের কোনার দড়িত।
— যদি বাড়িত মানিওয়ার্ডার কৈরা দেয়?
— আমি দ্যাখছি, দশ ট্যাহার নিচে মানিওয়ার্ডার করে না।
— অহন না। ঠারে ঠারে রাখ; তিন-চাইরদিন যাওক।
পালপাড়ার সানাইয়ের করুণ সুর আরো পষ্ট হয়। কিন্তু তাদের হৃদয়ে নোংরা, জটিল কিছু চিন্তা ছাড়া আবেগের কোনো আলোড়ন নাই। তারা অন্ধকারে বিড়ি টানতে টানেত সেই দিকে এগিয়ে যায়। তাদের চারপাশে অন্ধকার থিকথিক করে।
COMMENTS