জয়ধরখালী ৫ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ৫ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালীতে হিন্দু-মুসলমান মিলে কলেজের ছাত্র ছিল মোটমাট পনেরো-বিশ জন। তাদের বেশিরভাগই রোজ রোজ কাওরাইদ স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে দশ মাইল দূরে গফরগাঁও কলেজে পড়তে যায়। প্রতিদিন খুব ভোরে চার মাইল হেঁটে গিয়ে তারা আপ-লোকাল ট্রেন ধরে। ক্লাস শেষে ফিরে আসে বিকালের ডাউন-লোকালে। একটা মৌচাকের মতো দলবেঁধে কথা বলতে বলতে চালাচল করে। আলোচনার বেশিরভাগই বঙ্গবন্ধু আর পূর্বপাকিস্তানকে ঘিরে। দুর্গাপূজার আগে আগে নাটকের আলাপও হয়। মঞ্চায়নের জন্য সেবার বই সিলেকশন হয় ‘হাসির হাটে কান্না’। একজন একটা সমিতির কথা প্রস্তাব করে। একটা সমিতি হলে তারা গ্রামের মানুষকে আরো সংগঠিত করতে পারবে। এই কথায় হাঁটার মাঝেই সকলে সায় দেয়। অনেক আলোচনা ও অসংখ্য সিগারেট পুড়িয়ে সমিতির নাম রাখা হয় ‘সবুজ সংঘ’।

আঘুন মাসে সমিতির জন্য চান্দা ওঠে। গাঙপাড়ের বাঁশঝাড়ে বাঁশঝাড়ে ইন্টার-ডিগ্রি ক্লাসের ছেলেরা বাঁশ কাটে। চৈত্রের শেষে প্রাইমারি স্কুলের দক্ষিণে গাঙপাড়ের উঁচা টেকে মাটির দেওয়ালের উপর তালাপাতার ছানি নিয়ে সবুজ সংঘ গৌরবে মাথা তোলে। ডিগ্রি ক্লাসের সেই ছেলাটা, যে সবসময় পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে মিছিলের আগে থাকে, গ্রামের বাজারে বাজারে মিটিঙে টুলে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবের কথা, দেশের কথা চিৎকার করে করে কয় সে লেনিনের একটা ছবি উত্তরের দেওয়ালে টাঙিয়ে দেয়। নিচে, কোনার দিকে বাঁশের সেলফে গল্প-কবিতা আর নাটকের কয়টা বই রাখে আরেকজন। সে কবিতা লেখে। মাঝেমাঝে স্বৈরাচার ইয়াহিয়া বিরোধী মিটিঙের আগে নির্মলেন্দু গুণের ‘হুলিয়া’ কবিতাটা মুখস্থ আবৃত্তি করে।

ইদানীং বিকালে বেদেবহরের উত্তর পাশের চাতালটা একটু পতিত পতিত লাগে। তার বদলে সবুজ সংঘ অনেক গর্জিয়াস! সন্ধ্যা হতেই হারিকেন জ্বালিয়ে নাটকের রিহার্সাল চলছে। এবার দুর্গাপূজায় জয়ধরখালীর আখড়া রঙ্গমঞ্চে  ‘একতা’ নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চায়ন করবে ‘হাসির হাটে কান্না।’ সন্ধ্যাকালে পাড়ার তরুণ ও আধাবুড়া কৃষককরা সমিতির সামনের চাতালে গপসপ করে আর নাটকের রিহার্সাল দেখে। গাঙপাড়ের জংলাঘেরা অন্ধকারে দর্শকশ্রোতাদের পাতাকাগজের বিড়ির লাল আগুনগুলাকে দূর থেকে জোনাক পোকার বাতির মতো লাগে।

গ্রামের তরুণ কৃষকেরা কুটিল মাথার আধাবুড়া কৃষকদের উসকানিতে সমিতির সদস্য হতে চায়, পদ চায়। বাঁশঝাড়ের ছায়াঘেরা গ্রামটায় শুরু হয় কোন্দল। একদিন মাঝরাতে লেনিনের ছবি সহ সবুজ সংঘের তালপাতার চালের আগুনে জয়ধরখালীর অন্ধকার আকাশ লাল হয়ে ওঠে। ছাত্রদের মন খুব খারাপ হয়। মনের দুঃখ ভোলার জন্য তারা পিকনিকের আয়োজন করে। গ্রামের যুবক কৃষকেরাও পিকিনিকে যাবে। তাদেরকেও সাথে নিতে হবে। ডিগ্রি ক্লাসের ছেলেটার মনে পড়ে সবুজ সংঘের চালের আগুনে মাঝরাতের আকাশ লাল হওয়ার কথা। সে সাফ বলে দেয়, এইটা ছাত্রপার্টির পিকনিক। শুধু ছাত্ররাই যেতে পাড়বে।

একদিন সকালে একটা বড়সড় গয়না নাওয়ের সামনের পাটাতানে একটা খাসি বেঁধে মাস্তুলে একটা মাইক টাঙিয়ে পিকনিকে যায় ছাত্ররা। ডিগ্রি ক্লাসের ছেলেটা নৌকার ছৈয়ার উপর বসে সিগারেট ধরায়। নদীর দুইপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ। মাইকের আঙয়াজ পেয়ে তরুণ কৃষকদের কেউ কেউ ঘাটে এসেছে। ছৈয়ার উপরের ছেলেটা নেমে এসে অন্য সকলের সাথে একটু আলোচনা করে। তারপর মাইক্রোফোনের কাছে মুখ নিয়ে সকলেই জোরে জোরে স্লোগান দেয়, জয়ধরখালী ছাত্র সংঘ জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ!

এই স্লোগানে গ্রামের আঁতেলদের মাথা আঁতলামিতে জটিল মোচড় খায়। তরুণ চাষাদের মাথাগুলাও গরম হয়ে ওঠে। বিকালেই ইশকুলের মাঠে পিকনিকের আলোচনা শুরু হয়। পেছন থেকে আওয়াজ ওঠে, আমরা দুতালা লঞ্চ লইয়া পিকনিকে যাইয়াম। খাসি থাকব দুইডা।

একজন হুজুগী আঁতেল ঘাউ ঘাউ করে পয়গাম দেয়, আমগর পিকনিক পাট্টির নাম অইব ‘জয়ধরখালী আইজং পাট্টি’। এই কথার সাথে সাথেই পেছনের অতি উৎসাহীরা স্লোগান দিয়ে বসে, জয়ধরখালী আইজং পাট্টি জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ!

এতকিছুর পরেও সবুজ সংঘের মাটির দেওয়াল গাঙপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে আরো অনেকদিন। দরজা-জানালা, চালটাল কিচ্ছু নাই। গাঙের উঁচু পাড়ে সবুজ সংঘের চারদেওয়াল। দক্ষিণে বড়বাড়ির ঘাট। উত্তরে বেদেবহর। দেওয়ালের পিছনে শরীর লুকিয়ে জানালায় উঁকি দিলে নিচের ঘাট দিব্যি দেখা যায়। গোসলটোসল শেষে মেয়েরা নির্জন সবুজ সংঘের দিকে ফিরে শাড়ি বদলায়। দুপুরের দিকে কেউ কেউ ক্ষুধার্ত বাঘের মতো সবুজ সংঘের দেওয়ালের আড়ালে লুক্কি-মেরে, ঘাটের দিকে দিশ ধরে তাকিয়ে থাকে। মেয়ে-মহিলাদের গোসলটোসল দেখে। গ্রামের অধিকাংশ মহিলারা ব্লাউজটাউজ পড়ে না। যখন তারা সবুজ সংঘের দিকে ফিরে সায়া-শাড়ি বদলায়, তখন লোকটা নারীর বুক, তলপেট, উরুটুরুর একটুআধটু দেখতে দেখতে ইচ্ছামতো হাত মারে। একজন আগুন ঠাণ্ডা করে যায় তো ফাঁকমতো আরেকজন আসে।

জৈষ্ঠ মাসে আম-কাঁঠাল পাকা শুরু হলে দেখা যায়, সবুজ সংঘের দেওয়াল জুড়ে আমের বিচির শাঁস দিয়ে কে-একজন লিখে রেখেছে, ‘সাবধান! এখানে হাতমারা হয়!’

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you