জয়ধরখালী ৪ || শেখ লুৎফর

জয়ধরখালী ৪ || শেখ লুৎফর

বেদেবহরের রাবি-রুকি যেন জয়ধরখালীরই রাবি-রুকি। তাদেরকে গ্রামের সকলে আপনজনের মতো চিনে, জানে এবং যার যার মনমাফিক পছন্দ করে। বাঙড়ির ঝাঁপি মাথায় বেসাতে যাওয়া-আসার সময় সামনে পড়লে সকলেই তাদের সাথে দু-চার কথা আলাপ করতে ভালোবাসে। ফাঁকমতো বুড়ারাও একটু-আধটু রঙ্গতামশা করে বদ্ধ কুয়ার মতো মনটাতে আলোবাতাস লাগায়। রাবি আর রুকি শুধু বেদেবহরের নয় গোটা গ্রামটারই চান্দের আলো। রূপ-রঙ্গ, ডৌল-গড়নে সমান সমান হলেও স্বভাবে তারা দুইজন ছিল দুই ভুবনের মানুষ। তাই তাদের কথা আলাদা আলাদা করে শুনতে বেশি ভালো লাগবে।

তাবাদে রাবি ছিল কালো। লকলকা লম্বা, ছুরির মতো ধারালো সব অঙ্গসমূহের সৈষ্ঠব। পিঠভর্তি কেশ। কোমরে ঢেউ দিয়ে ভেঙে ভেঙে হেঁটে যাওয়া রাবির অভ্যাস। পদ্মিনীকন্যার নাকের বিন্দু বিন্দু ঘাম আর থুঁতনির তিলটাও যেন সবসময় ঠারেঠুরে কথা কয়। লোকে বলে, রাবির নাকের শ্বাস ভালা না। সে তরতাজা একেকটা জোয়ান মরদরে জোঁকের মতন শুইস্যা, এক-দেড় বছরেই চুচা কৈরা ফালায়। তাবাদে অল্পে কাতর হয়ে পড়া পুরুষটাকে একদিন হাইঞ্জায় রাবি নাও থেকে নামিয়ে দেয়। রাতেও ছৈয়ার ভিতরে ঢুকতে দেয় না। পাঁজরের হাড় ঠেলে বেরিয়ে আসা লোকটা দুই-তিনদিন বহরের চারপাশে ধানাইপানাই করে। বহরের নাওয়ে নাওয়ে ঘুরে জনে জনে বিচার চায়। বেদেবহরের বিধিতে অনধিকার চর্চা কবিরা গুনার মতো; তাই বহরের সর্দার কালু ঠাকুরও লোকটার অনাহক কাউমাউয়ে কান দেয় না। এক-সময় মানুষটা চিরদিনের মতো নাই হয়ে যায়।

এখন রাবি একা। গোসলের সময় গুনগুন করে গান গায়। অনেক সময় নিয়ে কেশে কদুর তেল মাঞ্জন করে, চুল আঁচড়ায়, লম্বা লম্বা বেনি বাঁধে। ঝাঁপি মাথায় হাঁটার সময় বেনিদুইটা কোমরের নিচে কালিদাঁড়াশ সাপের মতো ফণা তুলে দোল দেয়। লালপাড়ের ময়ূরকণ্ঠী শাড়িটা পরেছে ইলা-ঢিলা করে। তাই হাঁটার তালে তালে অঙ্গসমূহের নানান সৈষ্ঠব উছলায়া পড়তে চায়। বিকাল হলে গ্রামের প্রেমকুমারেরা বেদেবহরের উত্তরপাশের চাতালে তাসের আড্ডা জমায়। চারজনে খেললেও পিছনে বসে চৌদ্দজনে সেই খেলার ওম লয়। মাঝে মাঝে বহরের দিকেও ঠার রাখে।

এক-দেড় মাস পরে দেখা যায়, রাবি নতুন স্বামীর সাথে এক-ছৈয়ার নিচে খিলখিল করে হাসছে। রাবির পাঁচ নম্বর পতি হয়ে যে এসেছে সে এই বহরের কেউ না। দুই-তিনগ্রাম দূরের কোনো কৃষক পরিবারের ফুর্তিবাজ তরুণ রাবির আঙ্খিবাণে আমূল বিদ্ধ হয়েছে।

রুকির শরীর দিয়ে যেন ঘি বেয়ে পড়ে এমনি তার রূপের জলুশ। লমলমা চিকন আর ঘি-বর্ণ গতরের পুরুষ্ট পুরুষ্ট সব আজনাপাতির বাজনা বাজাতে বাজাতে সে গেরামে গেরামে বেসাত নিয়ে হাঁটে। বেহায়া পুরুষেরা যতক্ষণ দেখায়া তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাবাদে রুকির জেল্লাদার শরীরটা আরেক বাড়ির দেউড়ির আড়ালে মিলিয়ে গেলে মানুষটার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস আসে। রুকিকে দেখে অনেকদিন পর আজ তার আবার মালুমে আসছে, জীবন এক আজব জিনিস।

রুকির হাসি-হাসি মুখটার পাতলা ঠোঁটে সবসময় লেগে থাকে একটুকরো বিষণ্ণতা। একঘেয়ে জীবনের বোঝা বইতে বইতে মাঝে মাঝে মনটা তার ত্যাবুদা হয়ে যায়। গেরাম ঘুরতে ঘুরতে ডুবে যায় বেলা। তবু বিষণ্ণ রুকির ইচ্ছা হয় না বহরে ফিরতে। পিরিতি করে সে বিয়ে করেছে। বদরের সাথে তার দুধভাত। তবু পড়শিরা সাদা ভাতের সেই থালায় ঢিল মারে। রুকির সুখ এইসব ছ্যাদাভ্যাদা বজ্জাতদের সইবে কেন?

মাঝে মাঝে গেরাম থেকে রুকির হাওয়া হয়ে যাওয়ার কথাটা বদর জানে খাপ্শ্যা জিনের আছর বলে। রুকি বের হয় বাঙড়ি-বাসনের ঝাঁপি মাথায়। বদর ছৈয়ার খিড়কিতে তালা দিয়ে কোষা ডিঙিতে ছিপ-বড়শি কিংবা ট্যাঁটা নিয়ে শিকারে যায়। বিকালে ফিরে সে রান্নাবান্না করে, গোসল করে, ছোট্ট আয়নায় দেখে বাবরিতে বাহার তোলে। তাবাদে খিদার-পেটে বদর নাওয়ের আগা গলুইয়ে বসে বসে রুকির অপেক্ষা করে। কোনো কোনোদিন সন্ধ্যা ঘোর হয়ে আসে। বহরের সব মেয়েরা বেসাত থেকে যার যার নাওয়ে ফিরেছে। শুধু বদরের নাওয়ে কোনো রাও-রব নাই। ছৈয়ার ভিতর বাতি নাই। সে গলুইয়ে বসে বসে বেজার মনে বিড়ি টানছে। আজ সে রুকির প্রিয় বাইন মাছ ঝাল-ভোনা করেছে। আর সেই বিকাল থেকে সে রুকির চিন্তা আর সন্দেহের আগুনে ভোনা ভোনা হচ্ছে।

রুকি আসে দেড়দিন পরে। তাকে সেই খবিশ জিনে নিয়ে গিয়ে সারারাত নাকি আমিন বাড়ির বাঁশঝাড়ের মাথায় বসিয়ে রেখেছিল। সকালে বাড়ির লোকজন তাকে বাঁশঝাড় থেকে ধরাধরি করে নামিয়েছে। বহরের সকলেই রুকির কথা বিশ্বাস করে আবার আড়ালে আড়ালে মুখ টিপে হাসে। হাসে না শুধু বদর। সে রুকির কথা বিশ্বাস করে। তার বিচারে রুকি পথ দ্যায়া হাঁটলে মানুষ ত মানুষ পাগলেও নাকি পাগলামি ভুলে যায়। তাবাদে রুকি দিনমান গেরামে গেরামে হাঁটে। কত বটতলা, শেওড়াতলা দিয়ে তাকে যেতে হয়। রুকির রূপে অন্ধ বদরের বিশ্বাস পাথরসমান মজবুত।

তাবাদে আরেকদিনও রুকি নাই। পরেরদিন খুব ভোরে উজানপাড়ার কাছু মুনশির চিৎকারে বহরের সবাই সেদিকে ছুটে যায়। গ্রাম থেকেও অনেকে ছুটে আসে। বহরের উত্তরপাশের বাঁশতলায় রুকি পড়ে আছে। পরনের শাড়িটায় চাপ চাপ রক্ত। সিথানের দিকে দলা-মচা সায়া-ব্লাউজ। রুকির হুঁশ নাই। গ্রামে রব পড়ে যায়, রুকি অইজ্ঞান হইয়া বাঁশঝাড়ের নিচে পইড়া রইছে রে…।  নিচ দ্যায়া রক্তগঙ্গা বাইয়া যাইতাছে।

বদর আসে সবার পরে। সে সারারাত ঘুমায়নি। চোখ দুইটা লাল কুক্কা। মাথার চমৎকার বাবরিটা উসকুখুসকু। কালো টানটান পেশীর পেটানো শরীরটা একরাতের চিন্তায় নুয়ে পড়েছে। অজ্ঞান রুকিকে দেখেই সে একদৌড়ে এসে সিথানে বসে। কারো দিকে না তাকিয়ে, সায়া দিয়ে রুকির বিদ্রোহী বুক দুইটা ঢেকে দেয়। উপস্থিত সকলকে অবাক করে দিয়ে সে রুকির মাথাটা কোলে নিয়ে বসে। তাবাদে রুকির শরীরে বারবার ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে, একবার ক, খালি একবার তার নামডা ক, ক্যাডা তরে এইরহম করছে?

রুকি চোখ মেলে। ঠোঁটে জাদুমাখা সেই বিষণ্ণ হাসি। কে তাকে এমন করবে? ঘোর চোখে সুঠাম তরুণদের ছায়া-ছায়া আলো। ওদের দেহের ঘামের গন্ধ এখনো রুকির নাকে লেগে আছে। সে কি জানত যে একজনকে নিয়ে গাঙপারের নির্জন ক্লাবঘরে ঢুকলে পেছন পেছন আরো সাতজন আসবে?

বদরের গর্জনে রুকির চেতনা পরিষ্কার হয়। তার ঠোঁটের বিষণ্ণ হাসিটা শারীরিক কষ্টে আরো গভীর হয়, আমারে তুমি বহরে লইয়া যাও। আমি ভালা অইয়া যাইয়াম। খাপ্শ্যা পেরতে হুদাহুদি আমারে খালি কষ্ট দ্যায়।

… …

COMMENTS

error: You are not allowed to copy text, Thank you